রাজীব বলে, এগজ্যাক্টলি। আপনাকে বোধহয় আগেও বলেছি, বিশ্বাস রেসপেক্ট স্নেহ সিমপ্যাথি, এইসব দারুণ দারুণ সব হিউম্যান কোয়ালিটির কোনওটাই আমার মধ্যে নেই। আমাকে বিপদে ফেলার মতো সামান্য চান্সও কাউকে দেব না।’
সুবর্ণা বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? অবশ্য আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছেন, আপনিই শুধু প্রশ্ন করবেন আর আমি উত্তর দিয়ে যাব। তবু–
তাকে থামিয়ে দিয়ে রাজীব বলে, কী জিজ্ঞেস করতে চাইছেন?
অসীম দুঃসাহসে সুবর্ণা বলে, আপনার হাতে যেমন ওয়েপন আছে, অন্যের হাতেও তা থাকা অসম্ভব নয়। অস্ত্রের ব্যবহার তারাও জানে। কতদিন এভাবে চালাতে পারবেন?
রাজীবকে অসহিষ্ণু দেখায়। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে, যতদিন সম্ভব।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
খাওয়া শেষ না করেই ল্যান্ডিংয়ের কাছে নেমে গিয়েছিল রাজীব। দোতলায় এসে আবার খেতে বসে যায় সে।
সুবর্ণা অবশ্য বসে না, ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
এক টুকরো মাংস মুখে পুরে রাজীব এবার বলে, পুলিশ অফিসারের কাছে আমার পরিচয়টা তো জেনে গেছেন।
সুবর্ণা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন আপনি–আপনি–বলতে বলতে থেমে যায়। বাকিটা শেষ করে না।
মাংস চিবুতে চিবুতে খুব সহজ ভঙ্গিতে রাজীব বলে, একজন ড্রেডেড টেরোরিস্ট। আরও একটা ইনফরমেশন উনি আপনাকে দিতে ভুলে গেছেন কিংবা জানেন না।
ক্ষীণ গলায় সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কী ইনফরমেশন?
রাজীব বলে, আমার মাথার দাম পঞ্চাশ লাখ টাকা–ফাইভ মিলিয়ন। জীবিত বা মৃত, যে অবস্থায় থোক না আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলে এই রিওয়ার্ডটা গভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হবে।
সুবর্ণা চোখ নামিয়ে নেয়, কিছু বলে না।
সামনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে রাজীব বলে, টাকার অঙ্কটা হিউজ। মানুষের লোভকে খুঁচিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। যে কোনও লোককে, এমনকি ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে হদ্দ কাওয়ার্ডও এর জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেটা হবে ভয়ঙ্কর রকমের ঝুঁকি। নতুন আরেকটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে পলকহীন স্থির চোখে সে তাকিয়ে থাকে।
সুবর্ণা বিশাল অঙ্কের পুরস্কার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করে না। নিস্পৃহ গলায় বলে, আমার শ্বশুরমশাইকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, দাদাশ্বশুরের ডিনার খাওয়ার সময় হয়েছে, দেবীর কালকের পড়াগুলো দেখিয়ে দেওয়া দরকার। আমি কি এখন যেতে পারি?
রাজীব সুবর্ণার দিক থেকে চোখ ফেরাল না। ধীরে ধীরে বলল, হ্যাঁ, যান।
.
০৬.
হল-ঘরের মাঝখানে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটায় এখন সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ। সেতারের ঝংকার তুলে সেটা বেজে যাচ্ছিল।
ঘড়িটার পাশ দিয়ে প্রথমে নিজের ঘরে চলে আসে সুবর্ণা।
দেবী বিছানায় বসে বই-টই নাড়াচাড়া করছিল। রাজীবকে দেখার পর যে প্রাথমিক ভয়টা পেয়েছিল তার খানিকটা কেটে গেলেও মেয়েটার চোখেমুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ লেগে আছে। পড়ায় মন বসাতে পারছিল না সে।
দেবীর পাশে বসে তার পিঠে একটা হাত রেখে সুবর্ণা বলে, কাল স্কুলে কী কী পড়া আছে?
দেবী ইংরেজি গ্রামার, ভূগোল, এরিথমেটিক, বাংলা কবিতা, বিজ্ঞান আর ইতিহাসের বই খুলে পাঠ্য বিষয়গুলো দেখিয়ে দেয়।
সুবর্ণা পাঁচটা অঙ্ক কষতে দিয়ে দেবীকে বলে, এগুলো করে ফেল। আমি ক’টা কাজ সেরে আসি। তারপর বাকি পড়াগুলো করিয়ে দেব।
দেবী আস্তে মাথা নাড়ে।
সুবর্ণা এবার শ্বশুরের ঘরে আসে। সংগ্রামনারায়ণ বিকেলে যে নতুন ট্যাবলেটটা খেয়েছিলেন তার মধ্যে কড়া সিডেটিভ ধরনের কিছু রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে যখন রাজীবকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়েছিল, তিনি চোখ মেলতে পারছিলেন না। এখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। অথচ ফুসফুসকে সতেজ রাখার জন্য একটা ক্যাপসিউল রাত আটটার ভেতর খাওয়ানো দরকার। ডাক্তার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, সময়ের এতটুকু এদিক-ওদিক যেন না হয়। সেটা সংগ্রামনারায়ণের পক্ষে ক্ষতিকর হবে।
সুবর্ণা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবা–বাবা–
সংগ্রামনারায়ণের সাড়াশব্দ নেই। শুধু শ্বাস টানা আর শ্বাস ফেলার তালে তালে বুকটা ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর সংগ্রামনারায়ণ অস্ফুটে বললেন, উঁ–
একটু উঠুন। ওষুধ খেতে হবে।
দাও–
খাটের পাশেই একটা নিচু সাইড টেবলে নানা আকারের শিশি আর স্ট্র্যাপের ভেতর বহু রকমের ওষুধ। সারা দিনে ষোলো সতেরোটা ট্যাবলেট এবং ক্যাপসিউল খেতে হয় সংগ্রামনারায়ণকে। গাদা গাদা ওষুধ তার নির্জীব হৃৎযন্ত্রকে খানিকটা সচল রেখেছে।
টেবলটায় ক্যাপসিউল ট্যাপসিউল ছাড়াও রয়েছে বড় ওয়াটার বটলে ফোঁটানো বিশুদ্ধ জল আর কয়েকটা কাঁচের গেলাস, চামচ, প্লেট ইত্যাদি। এক গেলাস জল। আর একটা ক্যাপসিউল নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের কাছে এসে দাঁড়াল সুবর্ণা। তিনি চোখ খুললেন না, ঘুমের আচ্ছন্নতার মধ্যে মাথাটা সামান্য তুলে হাঁ করলেন।
ওষুধ এবং জল খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই সংগ্রামনারায়ণের মাথাটা ফের নরম বালিশের ভেতর ডুবে গেল। সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খাবেন বাবা?
ঘুমন্ত গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, কিছু না। আমাকে ঘুমোতে দাও।
মানুষটা ভয়ানক বদরাগী এবং জেদী। রাজত্ব না থাকলে কী হবে, উগ্র রাজকীয় মেজাজটা এখনও তার মধ্যে থেকে গেছে। দেড়শ বছরের প্রাচীন রাজবংশের দুর্বিনীত রক্ত যে তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে, এক মুহূর্তের জন্য তিনি তা ভুলতে পারেন না এবং চারপাশের মানুষজনকে ভুলতে দেনও না। তার অহংকার, ক্রোধ আর প্রতাপ যে কতটা বিধ্বংসী সেটা সুবর্ণার চেয়ে কে আর ভাল জানে। তিনি যা স্থির করবেন সেটাই চূড়ান্ত, তার ওপর আর কথা নেই।