সুবর্ণার কানের কাছে রাজীবের সেই হুঁশিয়ারিটা অদৃশ্য অডিও সিস্টেমে বেজে ওঠে। ধীরে ধীরে মাথাটা ডাইনে এবং বাঁয়ে হেলিয়ে দুর্বল স্বরে সে বলে, না।
দেখুন, আপনাদের এত বড় বাড়ি। অন্ধকারে কেউ কোনও দিক দিয়ে ঢুকে লুকিয়ে থাকলে বোঝা মুশকিল।
ওভাবে ঢোকাটা একেবারেই সম্ভব নয়। অন্তত আজ—
এত জোর দিয়ে বলছেন কী করে?
সুবর্ণা জানায় এ বাড়িতে ঢুকতে হলে একতলার হল-ঘরের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। পেছন দিকেও একটা দরজা অবশ্য আছে, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। দোতলায় যেতে হলেও নিচের তলার হল-ঘরের সিঁড়ি ভেঙেই যেতে হবে। সেখানেও শেষ মাথায় একতলার মতো যে দরজাটা আছে সেটাতেও সারাক্ষণ খিল দেওয়া থাকে। আজ সন্ধেবেলায় সুবর্ণা নিচের তলাতেই ছিল, কেউ ঢুকলে সে নিশ্চয়ই দেখতে পেত।
একটু চিন্তা করে রামেশ্বর বললেন, ঠিক আছে, আমরা এখন যাচ্ছি। খুব সাবধানে থাকবেন। আপনাদের এত বড় প্যালেস বলেই বলছি, এখানে কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকলে সহজে চোখে পড়বে না। কাল দিনের বেলায় কাজের লোকদের দিয়ে ছাদ টাদগুলো দেখিয়ে নেবেন।
আচ্ছা–
সন্দেহজনক, অচেনা কাউকে চোখে পড়লে দয়া করে থানায় ফোন করে দেবেন।
দেবো।
তাহলে এখন চলি–’ সোফা থেকে উঠে পড়তে পড়তে রামেশ্বর বলেন, আপনার অনেকটা সময় নিলাম। নমস্কার।
নমস্কার। সুবর্ণাও উঠে দাঁড়ায়। তার হাত-পায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি। এরই মধ্যে মনে পড়ল, বাড়িতে কেউ এলে তাকে আপ্যায়ন করাটা রাজপরিবারের দীর্ঘকালের রীতি। এখানে এসে কেউ চা, মিষ্টি কি শরবত খেয়ে যায়নি, এমনটা কখনও হয়নি। আজই প্রথম আতিথেয়তায় ত্রুটি ঘটল। সে যে মায়াকে ডেকে কফি, বিস্কুট টিস্কুট আনতে বলবে, তেমন সাহস হয়নি। ওপরে রাজীব রয়েছে। মায়া এসে কী বলতে কী বলে বসবে, তার ফলে গোটা পরিবারটাই শেষ হয়ে যাবে। তবু রামেশ্বরদের যে সামান্য এক কাপ চা-ও দেওয়া গেল না, সে জন্য মনটা খচখচ করতে থাকে সুবর্ণার।
রামেশ্বররা চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে ফিরে আসে হরেন। সুবর্ণা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।
হরেন মানুষটা খুবই ভাল এবং সৎ। দোকান বাজার থেকে শুরু করে বেশির ভাগ খরচপত্র তার হাত দিয়েই হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না, একটা পয়সাও এদিক ওদিক হয়েছে। কাজে একটু আধটু ফাঁকি যে দেয় না তা নয়। কিন্তু সে সব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। দীর্ঘদিন রাজ-পরিবারে থেকে সুখে দুঃখে এদেরই একজন হয়ে গেছে। ঝামেলা ঝঞ্জাট একেবারেই পছন্দ করে না। পুলিশ এবং আদালত টাদালত সম্পর্কে তার অকারণ একটা ভীতি আছে যার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
হরেন চাপা, ভীরু গলায় বলে, বৌদিদি আপনি তো দারোগাকে বললেন, আমাদের বাড়ির সব দরজা বন্ধ ছিল। খুনেটা ঢুকতে পারেনি। কিন্তু যদি বাইরের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে লুকিয়ে থাকে?
বোঝা গেল, রেন ওয়াটার পাইপের কথা বলছে হরেন। সুবর্ণা বলল, এই রাত্রিবেলা কিছু করার নেই। কাল সকালে ছাদে উঠে একবার দেখে আসব।
ব্যস্তভাবে হরেন বলে, আপনি আবার অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠবেন কেন? আমি যাব।
সুবর্ণা সচকিত হয়ে ওঠে। সে চায় না, হরেন কোনও কারণে ওপরে উঠুক। বলে, না না, তোমার যাবার দরকার নেই। ধর, লোকটা ছাদে লুকিয়ে আছে, আর তার সঙ্গে যদি অস্ত্রস্ত্র থাকে–
হরেনকে এবার ম্রিয়মাণ দেখায়। ঢোক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করে, পারে না।
সুবর্ণা বলে, রাত হচ্ছে। এবার রান্না চাপিয়ে দাও। আমি ওপরে যাচ্ছি।
হরেন এ বাড়িতে থাকে ঠিকই, তবে তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আলাদা। নিজের রান্না সে নিজেই করে নেয়।
সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না, সিঁড়ি ভেঙে ক্লান্ত পায়ে ওপরে উঠতে থাকে। কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। পাশ দিয়ে যে বিশাল, গোলাকার পিলারটা একতলার হল-ঘর থেকে সোজা ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে সেটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব। তার ডান হাতটায় ভাত আর মাংসের ঝোল লেগে বেআছে। বাঁ হাতে সেই পিস্তলটা। চোখাচোখি হতেই একটু হাসল সে। বলল, গুড। খুব ইনটেলিজেন্টলি ওসি’র প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন।
সুবর্ণা আন্দাজ করল, সে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে রাজীব ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে এসে পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে, সবটাই শুনেছে। সুবর্ণা তাকে ধরিয়ে দিতে চাইছে কিনা, নিশ্চয়ই সেদিকে লক্ষ্য রাখছিল। ওসি’র কাছে বেস কিছু বলে ফেললে রাজীব কি গুলি করত?
সুবর্ণা তাকিয়েই ছিল, কিছু বলল না।
রাজীব বলে, চলুন, ওপরে যাওয়া যাক।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলার দিকে উঠতে উঠতে রাজীব বলে, দু-ঘণ্টা আগে আমি এ বাড়িতে ঢুকেছি। এর মধ্যেই বুঝতে পেরেছি ইউ আর অ্যান এক্সট্রা-অর্ডিনারি লেডি। আই অ্যাম সিওর, আমি যা বলেছি তার বাইরে আপনি কিছু করবেন না। কারণ এ বাড়ির এতগুলো মানুষের লাইফ অ্যান্ড ডেথ আমার ওপর নির্ভর করছে। তবু হয়তো ভাবতে পারেন, কেন লুকিয়ে আপনাদের কথা শুনছিলাম?
সুবর্ণা উত্তর দেয় না। রাজীব বলে, আসলে কি জানেন, মানুষের সাইকোলজি একটা অদ্ভুত জটিল ব্যাপার। পুলিশ দেখে হঠাৎ যদি ডেসপারেট হয়ে কিছু করে বসেন, তাই
সুবর্ণা রাজীবের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, আপনি কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না, তাই না?