সুবর্ণা একতলায় নেমে আসতেই রামেশ্বর বসাক উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করতে আসতে হল। কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম।
রাজতন্ত্র কবেই শেষ হয়ে গেছে, তবু প্রতাপপুরের সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে প্রশাসন, পুলিশ, সবাই রাজবাড়ির অধিবাসীদের যথেষ্ট সমীহ করে। সুবর্ণা রামেশ্বরকে বসতে বলে তার মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় বসতে বসতে বলে, বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি। টের পেল, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে যে কাঁপুনিটা শুরু হয়েছিল সেটা এখন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
রামেশ্বরের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হাইট প্রায় ছ’ফুট। মোটা মোটা হাড়ের ফ্রেমে দারুণ মজবুত চেহারা। গায়ের রং তামাটে। মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের বেশির ভাগটাই অবশ্য কালো। তবে রগ এবং সিঁথির দু’পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ পাক ধরেছে। পুরু কালচে ঠোঁট তার, ছড়ানো চোয়াল, থ্যাবড়া গোছের থুতনি, ঘন জোড়া ভুরুর তলায় তীব্র, সন্দিগ্ধ চোখ দু’টো সর্বক্ষণ চরকির মতো ঘোরে। আজীবন ঘের..ডাকাত ঘেঁটে ঘেঁটে পৃথিবীর কাউকেই বোধহয় বিশ্বাস করেন না। তার কাছে বেশির ভাগ লোকই ঠক, দাগাবাজ, জোচ্চোর কিংবা খুনী। তার ধারণা দুনিয়া থেকে সব ভালমানুষ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।
রামেশ্বরের চেহারায় এমন একটা ভীতিকর ব্যাপার আছে যাতে যত বড় ক্রিমিনালই হোক না, তার মুখোমুখি পড়লে ভয়ে তাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। একজোড়া পাকানো গোঁফ তার ভয়ঙ্করত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতাপপুর শহরে অ্যান্টি-সোশালদের যম হিসেবে রামেশ্বরের সুনাম এবং দুর্নাম দুইই আছে। একবার একটা রেপিস্ট অর্থাৎ ধর্ষণকারীকে থানায় এনে এমন মার নাকি দেওয়া হয়েছিল যার ফলে মুখে রক্ত উঠে লোকটা মারা যায়। এই নিয়ে হিউম্যান রাইটসের ব্যাপারে যারা আন্দোলন করে তারা তুমুল হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল। সেবার অনেক কষ্টে চাকরিটা বাঁচাতে পেরেছিলেন তিনি। অবশ্য লোকটার মৃত্যুতে তার বিন্দুমাত্র অনুতাপ হয়নি। তাঁর মতে খুনী এবং নারীধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তাদের যেভাবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাবাড় করে ফেলা উচিত। মানবাধিকার ওনারা কেন যে এদের প্রতি এত সহানুভূতিশীল, তিনি সেটা ভেবে উঠতে পারেন না।
ক্রিমিনালদের কাছে রামেশ্বর যত.নির্মমই হন, এমনিতে লোকটা মোটামুটি ভদ্র, হৃদয়বান। সেটা অবশ্য চট করে বোঝা যায় না। তার চরিত্রে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সহৃদয়তার অদ্ভুত একটা মিশ্রণ ঘটেছে।
রামেশ্বর বললেন, একটা মারাত্মক ধরনের টেরোরিস্ট নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে এক উইক আগে আমাদের শহরে এসে ঢুকেছে। ওখানকার পুলিশ আর মিলিটারি থেকে আমাদের অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। কদিন নানা জায়গায় লুকিয়ে থাকার পর খুব সম্ভব খাবার দাবার কিনতে টেরোরিস্টটা আজ সন্ধেবেলায় বেরিয়ে পুলিশের একটা প্যাট্রোল ভ্যানের সামনাসামনি পড়ে যায়। তারপর তাড়া খেয়ে আপনাদের এদিকে চলে আসে। যারা প্যাট্রোল দিচ্ছিল তাদের ধারণা লোকটা আপনাদের প্যালেসে ঢুকে থাকতে পারে। অবশ্য কুয়াশা আর অন্ধকারে ওরা ভাল করে দেখতে পায়নি।
সুবর্ণার চোখের সামনে অদৃশ্য টিভি স্ক্রিনে রাজীবের চেহারাটা ফুটে ওঠে। গাল ভর্তি দাড়ি থাকলেও তার চোখেমুখে মঙ্গোলিয়ান একটা ছাপ রয়েছে যা উত্তর-পূর্ব ভারতেই দেখা যায়। রামেশ্বর যে এর সম্বন্ধেই বলছেন, তা নিয়ে এতটুকু সংশয় নেই সুবর্ণার। প্রথমটা তার মনে হয়েছিল, নোকটা সাধারণ একটা খুনী বা ডাকাত কিংবা জেল-পলাতক কোনও জঘন্য অপরাধের আসামী। এখন দেখা যাচ্ছে সে একজন উগ্রপন্থী।
অনিবার্য কোনও নিয়মে সুবর্ণার চোখদু’টো দোতলার দিকে খানিকটা ঘুরে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, ওপরে তাকালে রামেশ্বরের মতো ধুরন্ধর পুলিশ অফিসারের সন্দেহ হতে পারে। তাই আর মুখ তোলার চেষ্টা করল না; সোজা রামেশ্বরের দিকে চোখ রেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।
রামেশ্বর ফের বললেন, লোকটার আসল নাম জানা যায়নি। আইডেন্টিটি গোপন করার জন্যে সে একেক সময় একেকটা নাম নেয়। সে মিলিটান্টদের একটা বড় আউটফিটের লিডার। তার নামে সত্তর আশি জন পুলিশ, মিলিটারি জওয়ান আর সাধারণ সিভিলিয়ান খুনের অভিযোগ আছে। বিরাট বিরাট কোম্পানির ডিরেক্টর বা একজিকিউটিভদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে, আটকে রেখে কোটি কোটি টাকা ব্যানসম হিসাবে আদায় করেছে। ওর সঙ্গে সব সময় এ কে-৫৬ রাইফেল, পিস্তল থাকে। আর থাকে এমন কিছু অস্ত্র যা দিয়ে আপনাদের এই প্যালেসের মতো পঞ্চাশটা বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া যায়।
শুনতে শুনতে হৃৎপিণ্ডের উত্থান-পতন থমকে গিয়েছিল সুবর্ণার। সে চুপচাপ নিজীবের মতো তাকিয়ে থাকে।
রামেশ্বর থামেননি, লোকটা এই শহরের পক্ষে একেবারেই নিরাপদ নয়। ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখলে কখন কী ধরনের ব্লাস্ট ঘটিয়ে মানুষ, বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলবে, জানি না। যতক্ষণ ও প্রতাপপুর সিটিতে থাকবে, আমাদের কারও শান্তি নেই। একটু থেমে বলেন, আচ্ছা ম্যাডাম–
সুবর্ণা কিছু না বলে তাকিয়েই থাকে।
রামেশ্বর এবার জিজ্ঞেস করেন, আজ সন্ধের পর কোনও আউটসাইডার কি প্যালেসে ঢুকেছে?