ডাইনিং টেবলে এসে রাজীব এমন একটা চেয়ারে বসে যেখান থেকে পুরো দোতলাটা তো বটেই, একতলায় সিঁড়ির ল্যান্ডিং পর্যন্ত দেখা যায়। অর্থাৎ কোনও দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে সে তক্ষুণি সতর্ক হয়ে যাবে।
সুবর্ণা আন্দাজ করল, সেই পিস্তলটা রাজীবের প্যান্টের পকেটেই রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও খুব সম্ভব সে নিরস্ত্র থাকে না।
সুবর্ণা আগে ততটা খেয়াল করেনি। এবার লক্ষ করল, রাজীবের গালে দাড়িটাড়ি তেমনই রয়েছে। স্নান করার পর ভাল করে মাথাটাথা মোছে নি। তাই ভেজা চুলদাড়ি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঝরছে।
রাজীবের চোখও সুবর্ণার দিকেই ছিল। তার তাকানোটা লক্ষ করে নিজের গালে হাত দিল রাজীব। বলল, এত টায়ার্ড লাগছিল যে আজ আর দাড়িটা কামানো হয়ে উঠল না। কাল শেভটেভ করে খানিকটা ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করব। অন্তত আপনার আত্মীয় বলে যাতে মনে হয় সেদিকে আমার লক্ষ্য থাকবে। আপনি। শেলটার দিয়েছেন। যাতে শ্বশুর মশাইয়ের কাছে বিপন্ন হয়ে না পড়েন সেটা আমি দেখব।’ বলে অল্প একটু হাসল।
এই প্রথম রাজীবকে হাসতে দেখল সুবর্ণা, সে কিছু বলল না।
একতলা থেকে হঠাৎ হরেনের গলা ভেসে আসে, বৌদিদি, আমি ফিরে এসেছি। ওপরে আসব কি?’ এ বাড়ির কাজের লোকেরা, অনুমতি না নিয়ে কখনও দোতলায় উঠত না। সেই রেওয়াজ এখনও চালু রয়েছে।
সুবর্ণার নজরে পড়ল, রাজীবের শিরদাঁড়া মুহূর্তে টান টান হয়ে গেছে এবং চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে। সর্বক্ষণ যারা আক্রমণের আশঙ্কা করে, তাদের বোধহয় এমনটাই হয়ে থাকে। সিঁড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে সুবর্ণা বলে, এখন আসার দরকার নেই।
হরেন বলে, কিন্তু বৌদিদি, বড়বাবাকে খাওয়াতে হবে, জামাকাপড় বদলে ঘুম। পাড়াতে হবে। বেশি রাত করলে–
হরেনের ওপর বড়বাবা অর্থাৎ শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খানিকটা দায়িত্ব দেওয়া আছে। সকালে তার মুখ ধোয়ানো, ব্রেকফাস্ট করানো, দুপুরে কলেজে বেরুবার আগে স্নান করিয়ে ভাত খাওয়ানো–এ সবই নিজের হাতে করে সুবর্ণা। কিন্তু টানা চার পাঁচটা বড় ক্লাস এবং দু-তিনটে স্পেশাল ক্লাস নেবার পর শরীর এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে বাড়ি ফিরে আর কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। তাছাড়া পরের দিন ক্লাস নেবার জন্য রাতে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করতে হয়। অন্য ফাঁকিবাজ অধ্যাপকদের মতো প্রস্তুত না হয়ে দায়সারাভাবে সে পড়াতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের ঠকানোটা সে অন্যায় মনে করে। তাই সন্ধের পর হরেন এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু আজকের দিনটা অন্য সব দিনের থেকে আলাদা।
হরেনকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা বলে, আমিই আজ দাদাভাইকে খাওয়াব।
হরেন বলে, ঠিক আছে বৌদিদি–
মায়া কিচেন থেকে স্টেনলেস স্টিলের বিরাট থালায় ভাত এবং বাটিতে বাটিতে ডাল তরকারি মাংস ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে আসে; খাদ্যবস্তুগুলো রাজীবের সামনে রেখে খানিক দূরে গিয়ে আড় হয়ে দাঁড়ায়। তার চোখে তখনকার মতোই ভীত, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি।
সুবর্ণা মায়ার মনোভাব আন্দাজ করতে পারছিল। একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বলল, ইনি কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে থাকবেন। আমি কলেজে বেরিয়ে গেলে ওঁর যখন যা দরকার হয় দিও।
এ বাড়িতে কাজের লোকদের প্রশ্ন করার রীতি নেই। মায়া আস্তে মাথা নাড়ল শুধু।
এদিকে ভাতের থালাটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাজীব। সে যে কতটা ক্ষুধার্ত, তার গোগ্রাসে খাওয়া দেখে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
মায়া বার তিনেক আরও ভাত, আরও তরকারি এবং মাংস টাংস এনে দিল। সেগুলো যখন ফুরিয়ে এসেছে সেই সময় একতলার হল-ঘর থেকে হরেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বৌদিদি, শীগগির নিচে আসুন–
তার গলায় এমন এক আতঙ্ক, ব্যগ্রতা আর উৎকণ্ঠা মেশানো ছিল যাতে ভীষণ চমকে ওঠে সুবর্ণা। বলে, কী হয়েছে হরেনদা?’
থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
নিজের অজান্তেই সুবর্ণার চোখ দু’টো রাজীবের দিকে ঘুরে যায়। রাজীবও একদৃষ্টে তাকেই লক্ষ করছে। খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। ডান হাতটা মুঠো পাকিয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। বাঁ হাতটা নিঃশব্দে পকেটের ভেতর কখন ঢুকে গেছে, টের পাওয়া যায়নি। দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে সে। প্রবল উত্তেজনায় কণ্ঠমণিটা দুরন্ত গতিতে ওঠানামা করছে।
মায়া টেবলের ওধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে খুব চাপা গলায় সুবর্ণা বলে, থানার ওসি’র সঙ্গে দেখা না করে উপায় নেই। আমাকে নিচে যেতে হবে।
গলার স্বর অনেকখানি খাদে নামিয়ে রাজীব বলে, হ্যাঁ যাবেন। নইলে ওসিই ওপরে উঠে আসবে।
সুবর্ণা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে যাবে, রাজীব ফের বলে, ওসি কী জিজ্ঞেস করবে, আমি জানি না। ইউ আর সাফিসিয়েন্টলি ইনটেলিজেন্ট। পুলিশের কথার কী জবাব দেবেন সেটা মনে মনে ঠিক করে নিন। ভুলে যাবেন না, আপনার হোল ফ্যামিলি দোতলায় রয়েছে, সেই সঙ্গে আমিও আছি। আর আমার পকেটে কী আছে, ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।
সুবর্ণা উত্তর না দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার শরীর ভীষণ কাঁপছে।
০৫. প্রতাপপুর থানার ওসি
০৫.
প্রতাপপুর থানার ওসি রামেশ্বর বসাককে নিচের হল-ঘরে একটা সোফায় বসিয়ে সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সুবর্ণার জন্য অপেক্ষা করছিল হরেন। খানিক দূরে বাইরের দরজার কাছে তিনজন আমর্ড কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ওসি’র সঙ্গে এসেছে।