.
০৪.
নিজের ঘরে এসে সুবর্ণা দেখল, খাটের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে দেবী। ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায় সে। মুখটা মাত্র এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ঠোঁট দু’টো ভীষণ কাগছে।
মেয়ের গা ঘেঁষে বসে পড়ে সুবর্ণা। এতক্ষণ একটা মারাত্মক আততায়ীর সঙ্গে প্রাণপণে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। এখন মনে হচ্ছে হাত-পায়ের জোড়গুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর এবং মনের যাবতীয় শক্তি আর সাহস লোকটা যেন প্রায় শুষেই নিয়েছে। সুবর্ণা টের পাচ্ছিল, তার রক্ত হঠাৎ অনেক কমে গেছে। মাথার ভেতরটা ভীষণ টলছিল।
দেবী বলল, মা, লোকটার কাছে পিস্তল আছে। আমাদের সবাইকে কি খুন করে ফেলবে?’
দেবীর কাঁধে একটা হাত রেখে সুবর্ণা ম্লান একটু হাসে। বলে, আরে না না, এমনি ভয় দেখাচ্ছিল। আমি তো আছি, ও কিছু করতে পারবে না।
দেবী কতটা ভরসা পায় সে-ই জানে। ভয় তার এক ফোঁটাও কমেছে বলে মনে হয় না। ভীরু চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
সুবর্ণা বলে, স্কুলে গিয়ে ওই লোকটা সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবি না।
দেবী খুবই ভাল মেয়ে। মা যা বলে, অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। কোনওদিন অবাধ্য হয় না। সে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বলে, বলব না। ওই লোকটাও বারণ করে দিয়েছে।
দেখা গেল, রাজীবের হুঁশিয়ারি ভুলে যায়নি দেবী। সুবর্ণা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এ নিয়ে আর একদম ভাববি না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
লোকটা আমাদের বাড়ি ক’দিন থাকবে মা?’ দেবী জিজ্ঞেস করে।
সুবর্ণা বুঝতে পারছিল রাজীব যতদিন তাদের বাড়িতে থাকবে হাজার বললেও দেবীর ভয় বা আতঙ্ক কোনওটাই কাটবে না। ব্যাপারটা হালকা করে দেওয়ার জন্য বলে, ক’দিন আর? পাঁচদিন, সাতদিন, কি দশদিন।’ বলছিল আর ভাবছিল, দশটা দিনও যদি রাজীব এ বাড়িতে থাকে এবং পিস্তলের একটি কার্তুজও খরচ না করে, আতঙ্কে তাদের আয়ু প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।
দেবী এবার বলে, মাস্টারমশাইকে তো আসতে বারণ করে দিলে। আমার। পড়াশোনার কী হবে?
আমি তোকে পড়িয়ে দেবো। বলতে বলতে উঠে পড়ে সুবর্ণা। রাজীবকে খেতে দিতে হবে। রান্নাবান্নার কতদূর কী হয়েছে খোঁজ নেওয়া দরকার। না হলে মায়াকে তাড়া দিতে হবে।
এ বাড়িতে দু’বেলাই রান্না হয়। দুপুরের তৈরি খাবার রাতে কেউ মুখে তোলে না।
কিচেনে আসতেই সুবর্ণার চোখে পড়ল মায়া লুচির জন্য ময়দা মাখছে। সে। জিজ্ঞেস করল, রান্নার কত বাকি?’
মায়া জানায়, ভাত, ছোলার ডাল, মাংস, আলু-কপির তরকারি আর বেগুনভাজা হয়ে গেছে। খাওয়ার সময় গরম গরম লুচি ভেজে দেবে।
সুবর্ণা মনে মনে হিসেব করে নিল, দাদাশ্বশুরের ঘর থেকে সে আধ ঘণ্টা আগে চলে এসেছে। এর ভেতর নিশ্চয়ই রাজীবের স্নান হয়ে গেছে। কিচেনের দরজার কাছে গিয়ে হল-ঘরের ওধারে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেড-রুমের দিকে তাকায় সে। ওই ঘরটার দরজা এখন খোলা। ভেতরে রাজীবকে দেখা যাচ্ছে, সে বৃদ্ধকে বোধহয় কিছু বলছে। তার একটা কথাও এখান থেকে অবশ্য শোনা গেল না।
সুবর্ণা মায়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, লুচি পরে ভেজো। যা রান্না হয়েছে, একটা থালায় করে দাদাভাইয়ের ঘরে নিয়ে এসো। আমি ওখানে যাচ্ছি।’ বলে হল পেরিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে যায় সে।
রাজীব একটা গদি-মোড়া চেয়ারে বসে ছিল। বলল, আপনার গ্র্যান্ডফাদার-ইন-ল কি কথা বলতে পারেন না?
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ আপনার এরকম মনে হল?
এক ঘরে পাশাপাশি থাকব। তাই ওঁর সঙ্গে একটু আলাপ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যাই জিজ্ঞেস করি না কেন, উনি শুধু হাসেন। কোনও উত্তর দেন না।
ওঁর কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে বলতে পারেন।
খুব বেশিদিন বাঁচলে এরকম হয়, তাই না? ওল্ড এজ হাজার্ড।
সুবর্ণা বলে, সবার কি একরকম হয়? নব্বই বছরের বেশ কয়েকজন বৃদ্ধকে। জানি যাঁদের চমৎকার হেলথ, মস্তিষ্কের সেলগুলো পুরোপুরি অ্যাক্টিভ, রোজ দু মাইল মর্নিং ওয়াক করেন, গুছিয়ে সুন্দর কথা বলেন। আমার দাদাশ্বশুর যে কথা বলতে পারেন না, তাঁর স্মৃতিশক্তি যে নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
কী একটু ভেবে রাজীব চোখ কুঁচকে বলে, এই যে হাবা সেজে থাকা, এটা আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল’র কোনও ধান্ধা নয় তো?
সুবর্ণা কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, হাবা সাজা, ধান্ধা–এসব কী বলছেন আপনি!
রাজীব বলে, হয়তো ওভাবে অ্যাক্টিং করে আমার ওপর উনি নজর রাখবেন।
প্রচণ্ড রাগে মাথায় আগুন ধরে যায় যেন। কিন্তু লোকটা যে মারাত্মক খুনে ধরনের সেটা এক মুহূর্তের জন্যও ভোলার উপায় নেই। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে সুবর্ণা বলে, হি ইজ মোস্ট রেসপেক্টেড মেম্বার অফ আওয়ার ফ্যামিলি। ওঁর সম্পর্কে আপনি যা বললেন সেটা কিন্তু একেবারেই সম্মানজনক নয়। তাছাড়া আপনি যখন এ বাড়িতে ঢুকলেন আমি আর দেবী নিচেই ছিলাম। ওঁকে অ্যাক্টিং করতে বলার সুযোগ কিন্তু পাইনি। সে যাক, আপনার খাবার নিয়ে। মায়া আসছে। কোথায় বসে খাবেন? এই ঘরে, না ওখানে?’ বলে হল-ঘরের এক কোণে বিশাল ডাইনিং টেবলটা দেখিয়ে দেয় সে।
কয়েক পলক চুপ করে থাকে রাজীব। পরে বলে, চলুন, ওখানেই যাওয়া যাক। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।