সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, তা হলে কোথায় থাকতে চান?
ওই যে ওল্ডেস্ট মেম্বার অফ ইয়োর ফ্যামিলি, আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল, আমি ওঁর ঘরে ওঁর সঙ্গে থাকতে চাই। বলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেড-রুমটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় রাজীব।
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সুবর্ণা। একজন জড়ভরত মার্কা নব্বই বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে কেউ থাকতে চাইছে, শুনেও তার বিশ্বাস হয় না।
রাজীব সুবর্ণার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল। বলল, মনে হচ্ছে, বুঝতে পারছেন না।
আস্তে মাথা নাড়ে সুবর্ণা।
রাজীব এবার যা বলে তাতে আতঙ্কে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় সুবর্ণার। একটা অর্থ বুড়ো যার বোধবুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে, ওয়ার্ল্ডে যার কোনও প্রয়োজন নেই, তবু পরিবারের লোকজনের কাছে তার জীবন অবশ্যই মূল্যবান। সেটা সেন্টিমেন্টাল আর ইমোশনাল কারণে। রাজীবের মধ্যে এই সব আবেগ টাবেগের ছিটেফোঁটাও নেই। যদি দেখা যায় তাকে বিপাকে ফেলার চক্রান্ত চলছে, বৃদ্ধটির আয়ু তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যাবে। তার সঙ্গে যে মারণাস্ত্র রয়েছে। সেটার ট্রিগারে আঙুলের একটা চাপই যথেষ্ট।
শ্বাসরুদ্ধের মতো সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, এই জন্যেই বুড়ো লোকটার ঘরে থেকে ওঁকে আপনার হাতের মুঠোয় রাখতে চান?
এগজ্যাক্টলি। আশা করি বুঝতে পারছেন আমার সিকিউরিটির জন্যে এটা খুবই প্রয়োজন। ওল্ড ম্যান আমার জিম্মায় থাকলে আপনারা তেমন কোনও ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন না।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় রাজীব বলে ওঠে, আপনাদের বাড়িতে একটা টেলিফোন আছে বলেছিলেন না?
হ্যাঁ—
সেটা ডিসকানেক্ট করে দিতে হবে।
সুবর্ণা চমকে ওঠে, না না, আমার শ্বশুরমশাই ভীষণ অসুস্থ। প্রায়ই ডাক্তার ডাকতে হয়। টেলিফোন না থাকলে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?
কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজীব বলে, ওটা ছাড়া আর কোনও ফোন নেই তো? যেমন ধরুন কর্ডলেস টেস–’
না। ওই একটাই।
ওটা খুলে আপনার দাদাশ্বশুরের ঘরে এনে লাগিয়ে দেবেন।
অর্থাৎ নিরাপত্তার দিক থেকে কোনওরকম ত্রুটি থাকতে দেবে না রাজীব। টেলিফোনটাও নিজের হেপাজতে রাখতে চাইছে সে। সুবর্ণা বলে, ঠিক আছে।
রাজীব এবার বলে, আমি ভীষণ টায়ার্ড আর হাংগ্রি। দু’টো দিন এক মিনিটের জন্যেও ঘুমোতে পারিনি, ক’টা বিস্কুট আর কয়েক কাপ চা ছাড়া কিছু জোটেনি।
এই প্রথম সুবর্ণা লক্ষ করল, লোকটার চোখে মুখে উগ্রতা থাকলেও সে সত্যিই খুব ক্লান্ত। তার কথা মেনে নিলে ক্ষুধার্তও। সুবর্ণা বলল, আসুন–
কোথায়?
আপনিই তো আমার দাদাশ্বশুরের বেড-রুমটায় থাকার জন্যে ঠিক করে ফেলেছেন। সেখানে যাওয়া যাক।
রাজীব উত্তর দেয় না। হল-ঘর পেরিয়ে দু’জনে চুপচাপ শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে আসে। আগের মতোই তিনি ডিভানে বসে ছিলেন। সুবর্ণা বলল, দাদাভাই, ইনি আমার আত্মীয়। দিনকয়েক আপনার সঙ্গে থাকবেন। বলে রাজীবকে দেখিয়ে দেয়।
কথাগুলো বৃদ্ধের মাথায় ঢুকলো কিনা কে জানে। কোনওরকম প্রতিক্রিয়াই হল না তার। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তিনি। তারপর শব্দহীন বোকাটে হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে।
একধারে একটা চামড়ায়-ঢাকা আর্ম চেয়ার রয়েছে। কাঁধের ব্যাগ দু’টো মেঝেতে নামিয়ে রেখে রাজীব বলে, আমি একটু বসছি। আপনি টেলিফোনটা খুলে এখানে নিয়ে আসুন।
বোঝা যাচ্ছিল অসীম ক্লান্তিতে রাজীব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সে আর্মচেয়ারে শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। নিজের ঘর থেকে টেলিফোন নিয়ে এসে এ ঘরের প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে দেয় সুবর্ণা।
রাজীব বলে, আমি স্নান করব। বাথরুম কোথায়?
ডানপাশের দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা দেখিয়ে সুবর্ণা বলে ওখানে—
ভালই হল, এখানে অ্যাটাচড বাথরুমও রয়েছে। স্নানটানের জন্যে বাইরে বেরুতে হবে না।
এখানকার গিজারটা কিন্তু নষ্ট হয়ে গেছে। গরম জল পাওয়া যাবে না।
নো প্রবলেম।
আমি কি এখন যেতে পারি? আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে—
ঠিক আছে।
সুবর্ণা চলে যাচ্ছিল, রাজীব পেছন থেকে ডাকে, মিসেস সিংহ—
সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
রাজীব বলে, বাড়তি একটা লোক কিছুদিন থাকলে আপনাদের ওপর প্রেসার পড়বে। আমি সেটা চাই না।–
বুঝতে না পেরে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কীসের প্রেসার?
আমি আর্থিক ব্যাপারের কথা বলছি। আমার কাছে কিছু টাকা আছে—
রাজীবকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা বলে, আপনাকে আগেই বলেছি এটা একটা প্যালেস। প্রতাপপুর রাজবংশের লোকেরা একসময় বহু মানুষকে খাইয়েছে। জোর করে এ বাড়িতে ঢুকে পড়লেও আপনি আমাদের গেস্ট। পয়সা নিয়ে অতিথিকে খাওয়ানোর কথা আমরা ভাবতে পারি না।
কয়েক পলক সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর বলে, আপনার। যেমন ইচ্ছে।
তার কথা যেন শুনতে পায়নি, এমনভাবে সুবর্ণা বলে, ইন্ডিয়ান হসপিটালিটি বলে একটা কথা আছে। এই পরিবার তার রীতিনীতিগুলো মেনে চলে। তা। ছাড়া–
কী?
রাজত্ব বা রয়ালটি কোনওটাই আর নেই। মর্যাদা, অর্থ, বংশগৌরব, সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। তবু একটা লোককে কয়েকদিন খাওয়ানোর ক্ষমতা আমাদের এখনও আছে।
রাজীব উত্তর দেয় না।
সুবর্ণা চলে যায়। রাজীব দরজার পাল্লা দু’টো টেনে ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকে দেয়। পুরনো জং-ধরা কজার আওয়াজে নিজের ঘরের দিকে, যেতে যেতে একবার মুখ ফেরায় সুবর্ণা। লোকটা যে নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত হুঁশিয়ার সেটা আগে বহুবার বুঝিয়ে দিয়েছে। পাছে বাথরুমে ঢুকলে সুবর্ণা কিছু করে বসে তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করেছে। রাজীব।