ডাক্তার এবার যে ওষুধটা দিয়েছে সেটা ভীষণ কড়া। বিকেলের ট্যাবলেটটা খাওয়ার পর থেকে খালি ঘুম পাচ্ছে, চোখ আর মেলতে পারছি না। কাল তোমার আত্মীয়ের সঙ্গে আলাপ করব।
সুবর্ণা আপাতত বেঁচে গেল। ঘাড়ের ওপর চেপে বসা উগ্র চেহারার লোকটাকে সংগ্রামনারায়ণের কাছে হাজির করতে হলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হত, ভাবতে পারে না সে। চোখের ইশারায় রাজীবকে তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলল।
সংগ্রামনারায়ণের পাশের ঘরটা হল প্রতাপপুর রাজপরিবারের পুরনো অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহশালা। সেখানে এসে রাজীব বলে, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কান তো সাঙ্ঘাতিক। পায়ের আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারেন কোনটা কার–
সুবর্ণা বলে, শুধু কানই না, সবগুলো ইন্দ্রিয়ই ওঁর ভয়ানক রকমের প্রখর।
উনি বলেছিলেন আপনার আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে ঢোকা নিষেধ। কারণটা–’বলতে বলতে থেমে যায় রাজীব।
এই প্রথম রাজীব কোনও ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করল। ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলে, আপনি নিজের নিরাপত্তার জন্যে একটা শেলটার খুঁজছেন। সেটা ছাড়া অন্য সব কিছুই কিন্তু অবান্তর।
একটু চমকে ওঠে রাজীব, আর কোনও প্রশ্ন করে না।
অস্ত্রশালার পরের ঘরটা চেয়ার টেবিল এবং নানা রেফরেন্স বই-টই দিয়ে সাজানো। এটা সুবর্ণার নিজস্ব লাইব্রেরি। এখানে বসেই সে পড়াশোনা করে, পরীক্ষার খাতা দেখে।
সুবর্ণার পড়ার ঘরের গায়েই কিচেন। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে তার চোখে পড়ল দরজা সামান্য ফাঁক করে মায়া তাদের লক্ষ করছে। চোখাচোখি হতে চট করে সরে গেল সে।
কিচেনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুবর্ণা বলে, এটা আমাদের রান্নাঘর। রাত্তিরে মায়া এখানেই শোয়।
রাজীব কিছু বলল না।
কিচেনের পাশ দিয়ে একতলার মতোই একটা প্যাসেজ দোতলার শেষ মাথায় চলে গেছে। ওদিককার দরজা খুললে একটা বিরাট ঝোলানো ব্যালকনি।
যেভাবে কোনও প্রদর্শনী বা দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয়, অবিকল তেমনি প্রতাপপুর প্যালেসের একতলা এবং দোতলা দেখানো হলে ফের ওরা হল-ঘরে ফিরে আসে।
সুবর্ণা লক্ষ করল, দেবী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এমনিতে সে খুবই নরম ধরনের মেয়ে। অচেনা, সশস্ত্র লোকটার ভয়ে তার মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে।
সুবর্ণা মনে মনে খানিকটা সাহস এনে বলল, দেবীর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ওর কি এখানে থাকার আর দরকার আছে?
রাজীব তক্ষুণি বলে, না না, ও যেতে পারে।
সুবর্ণা দেবীকে তাদের ঘরে যেতে বলে। সাময়িক মুক্তি পেয়ে দেবী পা বাড়াতে যাচ্ছিল, রাজীব বলে ওঠে, তোমার মাকে যে কথাটা বলেছিলাম সেটা মনে আছে তো? আমার সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না।
আস্তে মাথা হেলিয়ে দেবী জানায়-মনে আছে। তারপর হল-ঘর পেরিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে যায়।
সুবর্ণার হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করে, আমি কি একবার নিচে যেতে পারি?
রাজীবের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। সে বলে, কেন?
সুবর্ণা বলে, হরেন ফিরে আসবে। বাইরের দরজাটা বন্ধ রয়েছে। ওটা খুলে দিয়ে আসি।
ওর তো দু’ঘণ্টা পর ফেরার কথা। গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার দিকে তাকিয়ে সময় হিসেব করে নেয় রাজীব। বলে, মাক্সিমাম চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটেছে।
সুবর্ণা বলে, ফিরে এসে ডাকাডাকি করলে কাউকে না কাউকে তো দরজা খুলতে হবে। মায়াকে পাঠাতে পারি কিন্তু ও যদি ফস করে আপনার সম্পর্কে কিছু বলে বসে। একটু ভেবে বলল, ওর চোখমুখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল আপনাকে আমার রিলেটিভ বলে হয়তো বিশ্বাস করেনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাজীব। তারপর বলে, ঠিক আছে, খুলে দিয়ে আসুন। মায়াকে বলবেন কোনওরকম বজ্জাতি করার চেষ্টা যেন না করে।
পরে আমি বুঝিয়ে দেবো।
সুবর্ণা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। রাজীব তার সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ডিং পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার পকেটে নিঃশব্দে একটা হাত ঢুকে গেছে। তবে অস্ত্রটা এবার। আর বের করেনি সে।
দরজা খোলা হলে সুবর্ণাকে সঙ্গে করে ফের দোতলায় উঠে আসে রাজীব।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, আমাকে এখন কী করতে হবে?
তার প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি রাজীব। জবাব না দিয়ে বলে, আপনাদের গোটা বাড়িটা দেখার পর মনে হয়েছে, দোতলাটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে সেফ।
অর্থাৎ এই লোকটা সর্বক্ষণ দোতলায় একটা দম বন্ধ-করা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে রাখবে। কিন্তু তাকে ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। সুবর্ণা বলে, এখানে লাইব্রেরি আর যে ঘরে পুরনো অস্ত্রশস্ত্র থাকে সে দু’টোয় রাতে কেউ থাকে না। ওর একটায় আপনার জন্যে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
নো, নো ম্যাডাম। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে রাজীব।
রীতিমত অবাক হয়ে সুবর্ণা বলে, কেন, ও দু’টো আপনার পছন্দ নয়? বেশ বড় বড় রুম। শোওয়ার জন্যে ডিভান টিভান পেতে দিলে–
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিতে দিতে রাজীব বলে, আমাকে কি আপনার স্টুপিড মনে হয়?
মানে?
ওই ঘর দু’টোর কোনও একটায় থাকলে আপনাদের খুবই সুবিধে হয়, তাই না? সারা রাত তো জেগে থাকতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলবেন, সেটা কোনওভাবেই হাতে দিচ্ছি না।
এমন একটা চিন্তা ঘুণাক্ষরেও সুবর্ণার মাথায় আসেনি। দেখা যাচ্ছে লোকটা খুবই প্যাচালো। তার মানসিক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নয়, অত্যন্ত জটিল। রাজীব সম্পর্কে সুবর্ণা কিছুই জানে না। হয়তো তার জীবনে এমন কিছু ঘটে গেছে যাতে কাউকে সে বিশ্বাস করে না, পৃথিবীর সবার সম্বন্ধেই সে সন্দেহপরায়ণ। হয়তো তার ধারণা, চেনা-অচেনা প্রতিটি মানুষ তার বিরুদ্ধে গভীর কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।