চারপাশের দেওয়াল থেকে দু ফুটের মতো বাদ দিয়ে কার্পেটটা হল-ঘরের মেঝে ঢেকে রেখেছে। নিচের মতোই এখানে তিন সেট ভারী ভারী সোফা, সেগুলোর ওপর দামি কাপড়ের কভার। একধারে রঙিন টিভি, আরেক ধারে লম্বা ধাঁচের অ্যাকোয়ারিয়াম। ডানদিকের গোটা দেওয়াল জুড়ে উঁচু নিচু কাঁচে ঢাকা ক্যাবিনেটের ভেতর অজস্র বই। ক্যাবিনেটের নিচু অংশগুলোতে নানা ধরনের পেতল এবং মার্বেলের সুদৃশ্য সব শিল্পকর্ম। আর আছে বিচিত্র চেহারার অনেকগুলো ক্যাকটাস। আরেক দেওয়ালের উঁচুর দিকটায় পনের কুড়িটা বাঘ, হরিণ এবং শিংওলা বুনো মোষের মাথা সারিবদ্ধভাবে সাজানো। প্রতাপপুর রাজবংশের পূর্বপুরুষদের কেউ হয়তো দুর্ধর্ষ শিকারি টিকারি ছিলেন। বাঘটাঘের মুণ্ডুগুলো সেই স্বর্ণযুগের স্মৃতিচিহ্ন। হল-ঘরের শেষ মাথায় কিচেনের কাছাকাছি বিরাট লম্বাটে ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে বাবোটা করে চব্বিশটা চেয়ার। ঠিক মাঝখানে ঝাড়লণ্ঠনের তলায় মস্ত একটা গ্র্যান্ড-ফাদার ক্লক।
দোতলায় এসে হল-ঘরটা দ্রুত একবার দেখে নিয়ে রাজীব বলে, বেড-রুম, কিচেন টিচেনগুলো এবার দেখিয়ে দিন।
সুবর্ণা সবে রাজীবকে নিয়ে বাঁদিকে পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ কিচেন থেকে মায়া বেরিয়ে এসে অচেনা একটা লোককে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটার পোশাক এবং চেহারা এই রাজপ্রাসাদের পক্ষে এতই বেমানান যে তাকে যতই দেখছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল সে।
মায়ার বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ। মাঝারি মাপের শক্তপোক্ত, চালাক চতুর চেহারা। মুখটা চৌকো ধরনের। গায়ের রং ময়লা। চওড়া কাধ এবং ছড়ানো চোয়াল এবং হাতের মোটা মোটা হাড়ের দিকে তাকালে বোঝা যায় মেয়েমানুষটি অসীম শক্তির অধিকারিণী। পরনে একটু খাটো ধরনের সবুজ সবুজ খোপ-কাটা শাড়ি, আর ডগডগে লাল রঙের ব্লাউজ। দু’হাতে কয়েক গাছা করে রুপোর চুড়ি, গলায় সোনার সরু চেন হার। নাকের পাটায় সাদা পাথর বসানো একটা বেঢপ নাকছাবি।
কিছু বলার জন্য ঠোঁটদু’টো ফাঁক করতে যাচ্ছিল মায়া, চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় সুবর্ণা। বলে, তুমি এখন রান্নাঘরে যাও। দরকার হলে ডাকব।
সন্দিগ্ধ চোখে রাজীবের দিকে তাকাতে তাকাতে কিচেনে চলে যায় মায়া। তার তাকানোর ভঙ্গিটা বুঝিয়ে দেয়, রাজীবকে তার পছন্দ হয়নি।
সুবর্ণা বাঁ ধারের যে বিশাল বেড-রুমটার সামনে রাজীবকে নিয়ে এল সেটার। ভেতর একটা ডিভানে যে বৃদ্ধটি বসে আছেন তাঁর মাথায় মরা ঘাসের মতো সামান্য ক’টি চুল। দু’পাটির একটা দাঁতও আর অবশিষ্ট নেই। গাল তুবড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। হাত দু’টো গাছের শুকনো ডালের মতো কাঁধ থেকে ঝুলছে। চামড়া কুঁচকে কুঁচকে একেবারে জালি জালি। থুতনির হাড় এবং হনু দু’টো অস্বাভাবিক বেরিয়ে এসেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। পরনে সরু পাজামার ওপর ঢলঢলে সোয়েটার। যৌবনে তার চেহারা কেমন ছিল, প্রবল কল্পনাশক্তি দিয়েও এখন আর তা আন্দাজ করার উপায় নেই।
বৃদ্ধটি সুবর্ণাদের দিকে তাকিয়ে হাবলার মতো নিঃশব্দে হাসছিলেন। বার্ধক্য তার শারীরিক সৌষ্ঠব এবং ক্ষমতা, বোধবুদ্ধি, সব কিছু শুষে নিয়ে ছিবড়েটুকু ফেলে রেখেছে।
সুবর্ণা এঁর কথা আগেই জানিয়েছিল। দেখামাত্রই চিনে নিতে পারল রাজীব। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনার গ্র্যান্ড ফাদার ইন-ল?
হ্যাঁ–শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ সিংহ। আস্তে মাথা নাড়ে সুবর্ণা, আসুন–’
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পরের চমৎকার সাজানো ঘরটা সুবর্ণা আর দেবীর। তারপরের বেড-রুমটায় নকশা-করা, প্রকাণ্ড মেহগনির খাটে কাত হয়ে, লেপ গায়ে, শুয়েছিলেন একজন বয়স্ক মানুষ। মাথা, নাক এবং গালের খানিকটা দেখে বোঝা যায় এঁরও বয়স হয়েছে, তবে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের মতো অতটা নয়। বাইরে থেকে রাজীবের মনে হল, তার চোখ দুটি বোজা। বালিশ থেকে মাথা না তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে, বৌমা?
নিচু গলায় সুবর্ণা সাড়া দিল, হা, বাবা। রাজীবের দিকে ফিরে কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে বলে, আমার শ্বশুরমশাই সংগ্রামনারায়ণ সিংহ।
মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে রাজীব জানায়, সে বুঝতে পেরেছে। চাপা গলায় বলে, এবাড়ির সবারই দেখছি মিলিটারি মার্কা নাম। শৌর্যে–সংগ্রাম–
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
সংগ্রামনারায়ণ আগের মতো শুয়ে শুয়ে সুবর্ণাদের দিকে মুখ না ফিরিয়ে এবার বলেন, তিনরকম পায়ের শব্দ কানে আসছে। একজোড়া তোমার, একজোড়া দেবী দিদিভাইয়ের, আরেক জোড়া অচেনা লাগছে। হরেন বা মায়ার তো নয়।
সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। দ্রুত একবার রাজীবকে দেখে নেয়। রাজীবের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে ভীতভাবে সুবর্ণা বলে, না। আমার এক আত্মীয় এসেছেন। তিনি আমার দাদার–
তার কথা শেষ হতে না হতেই সংগ্রামনারায়ণ বলে ওঠেন, অনেক বছর পর, অ্যাবাউট থারটিন ইয়ারস, তোমার দাদাকে বাদ দিলে তোমার বাপের বাড়ির দিকের অন্য কোনও রিলেটিভ এ বাড়িতে এলেন। তাই না?
আবছা গলায় সুবর্ণা বলে, হ্যাঁ বাবা—
আমি তোমার আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম, তবু যখন একজন এসেই পড়েছেন, আদরযত্নের ক্রটি যেন না হয়।’
কথা বলছিল ঠিকই, তবু সুবর্ণা টের পাচ্ছিল তার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস ধীরে ধীরে বের করে সে বলে, আচ্ছা।