- বইয়ের নামঃ ক্রান্তিকাল
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. সবে নভেম্বরের শুরু
ক্রান্তিকাল – প্রফুল্ল রায়
অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ২০০৩
দে’জ পাবলিশিং কলকাতা ৭০০ ০৭৩
KRANTIKAL A Bengali Novel by PRAFULLA ROY Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Dey’s Publishing 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata 700 073
প্রথম প্রকাশ : কলিকাতা পুস্তকমেলা জানুয়ারি ১৯৯৮, মাঘ ১৪০৪
দ্বাদশ সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৭, বৈশাখ ১৪২৪
.
সবে নভেম্বরের শুরু। কিন্তু এরই মধ্যে বিকেলের আয়ু ফুরোতে না ফুরোতে সীমান্তের এই শহরটিতে চিনির মিহি দানার মতো হিম ঝরতে থাকে। দূরে, আকাশ যেখানে ঝুঁকে অনেকখানি নেমে এসেছে ঠিক সেইখানটায় পাহাড়ের উঁচুনিচু, ঢেউখেলানো একটা লাইন স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলা রোদের ঝকমকে আলোয় পাহাড়গুলোকে নীল মেঘপুঞ্জের মতো দেখায়। কিন্তু বেলা পড়ে এলে রোদের রং যত ফিকে হয়, ওগুলোও দ্রুত ঝাপসা হতে থাকে। পাহাড়ের রেঞ্জটাকে তখন আবছা একটা পেনসিল স্কেচের মতো মনে হয়।
সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগে। যদিও হিম ঝরতে শুরু করেছে, তবু দিনের আলো একেবারে নিভে যায়নি। হঠাৎ লজ্জা-পাওয়া কিশোরীর আরক্ত মুখের মতো একটু আধটু লালচে আভা আকাশের গায়ে এখনও লেগে আছে। কিন্তু কতক্ষণ আর? খানিক পরেই ঝপ করে নেমে আসবে সন্ধে। কুয়াশা আর অন্ধকারে ডুবে যাবে সমস্ত চরাচর।
নভেম্বরের গোড়া থেকে সারাদিন সারারাত এখানে উত্তুরে হাওয়া বয়ে যায়। দিনের দিকটায় রোদের তাত থাকায় ততটা গায়ে লাগে না, কিন্তু বিকেলের পর থেকে চামড়া কুঁড়ে যেন হাড়ের ভেতর পর্যন্ত ছুরির ছুঁচলো ফলার মতো বিধে যায়।
সাতচল্লিশের আগে সীমান্তের এই শহরটা ছিল দেশীয় রাজ্য প্রতাপপুর স্টেটের রাজধানী। রাজ্যের নামেই রাজধানীর নাম। অর্থাৎ প্রতাপপুর স্টেটের ক্যাপিটাল প্রতাপপুর সিটি।
স্বাধীনতার আগে, শুধু আগেই বা কেন, তার পরেও বেশ কয়েক বছর প্রতাপপুর সিটিটা ছিল ছবির মতো, পিকচার পোস্টকার্ডে ঠিক যেমনটা দেখা যায়। চওড়া চওড়া অ্যাসফাল্টের মসৃণ রাস্তা, দু’ধারে বাগানওলা বাংলো ধরনের বাড়ি, পার্ক, ফোয়ারা, দুই রাস্তার ক্রসিংয়ে শ্বেতপাথরের পরি। এছাড়া ছোট একটা জু-গার্ডেন, স্টেট লাইব্রেরি, ঝকঝকে হাসপাতাল, নানা ধরনের স্পোর্টসের জন্য একটা স্টেডিয়াম ইত্যাদি। যেদিকেই তাকানো যাক, তখন এখানে প্রচুর গাছপালা, ফুলের বাগান আর নির্জনতা। শহরটা যত বড়, সেই তুলনায় মানুষজন ছিল অনেক কম।
স্বাধীনতার পর অ্যাকসেসন অফ নেটিভ স্টেটস’ অর্থাৎ দেশীয় রাজ্যগুলো যখন ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হল, রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটল, তখন ক্রান্তিকাল থেকেই প্রতাপপুর সিটি তার পুরনো আভিজাত্য, সৌন্দর্য আর মর্যাদা খুইয়ে ফেলেছে।
দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সেকালের পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল সীমান্তের এপারে। তার ধাক্কা এই প্রতাপপুরেও এসে লাগে। স্বাধীনতার পর যে দু-চারটে বছর রাজতন্ত্র চালু ছিল, জনস্রোত ঠেকিয়ে রাখা গেছে। তারপর আর পারা গেল না। প্রতাপপুর সিটি আমূল বদলে যেতে লাগল। যেখানে যত বাগান, পার্ক বা ফাঁকা জায়গা ছিল, পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা সমস্ত কিছু দখল করে তুলতে লাগল ছিরিছাঁদহীন, বেঢপ চেহারার বাড়িঘর। রাজাদের সময় ভিক্টোরিয়ান আমলের ধাঁচে সন্ধের পর রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলত। পরে মিউনিসিপ্যালিটি সেগুলো তুলে ফেলে লম্বা লম্বা ল্যাম্পপোস্ট বসিয়ে তার গায়ে একটা করে বা ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাল্বগুলোর বেশির ভাগই জ্বলে না। রাস্তাগুলো খানাখন্দে বোঝাই। দু’ধারের নর্দমা কত কাল যে সাফাই হয় না। বছরের পর বছর সেগুলোতে থকথকে কালচে রঙের তরল অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এইসব নদৰ্মা হল যাবতীয় রোগের জীবাণু আর মশাদের মেটার্নিটি হোম। রাস্তার মোড়ের শ্বেতপাথরের যে পরীগুলি একদা এই শহরে অলৌকিক স্বপ্ন নামিয়ে আনত, কবেই তারা উধাও হয়ে গেছে। চারিদিকে আবর্জনার পাহাড়। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে প্রতাপপুর সিটি এখন নোংরা, ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধে-ভরা এক শহর।
রাজতন্ত্র নেই, তবু রাজা আর রানীদের নাম এখানকার অনেক কিছুর সঙ্গে এখনও জড়িয়ে আছে। যেমন, ‘রাজা বিক্রম সিংহ রোড’ বা ‘রানী স্বর্ণময়ী গার্লস কলেজ’ কিংবা ‘মহারাজা বীরেন্দ্র সিংহ হাসপাতাল’ ইত্যাদি। গণতন্ত্র পুরোমাত্রায় চালু হয়ে গেলেও প্রতাপপুর অদূর অতীতের রাজমহিমা একেবারে খারিজ করে দেয়নি, তার কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও সযত্নে ধরে রেখেছে।
এই শহরে পা দিলে প্রথমেই যা চোখে পড়বে সেটা রাজবাড়ি, যার নাম ‘প্রতাপপুর প্যালেস’। সিটির দক্ষিণ দিকের শেষ মাথায় পাঁচ একর জমির মাঝখানে গথিক স্থাপত্যের এই বিশাল দোতলা বাড়িটা মধ্যযুগের ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের কোনও রাজপ্রাসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। লর্ড কার্জনের সময়ে তৈরি এই রাজবাড়িকে এখন ভগ্নস্তূপের মতো দেখায়। দেওয়ালে এবং ছাদে কত জায়গায় যে ফাটল ধরেছে, হিসেব নেই। পলেস্তারা খসে খসে দগদগে ঘায়ের মতো ইট বেরিয়ে পড়েছে। ভিতে আর কার্নিসে অশ্বথেরা শিকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ। অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে। সামনের দিকে একধারে ছিল চমৎকার টেনিস লন, আরেক পাশে ফুলের বাগানের মাঝখানে বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ। ফুলবাগান আর টেনিস কোর্টের চিহ্নমাত্র নেই। সেখানে এখন শুধু আগাছার জঙ্গল। পেছন দিকে ছিল বাঁধানো দীঘি, সেটা কবেই মজে গেছে। জল শুকিয়ে যে তলানিটুকু পড়ে আছে তা আর দেখা যায় না, গুঁড়িপানা এবং ঢোলকলমির ঠাসবুনট চাদরের তলায় তা ঢাকা।