Site icon BnBoi.Com

গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

গহনগোপন - প্রফুল্ল রায়

 ১. সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে

গহনগোপন – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

০১.

প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বা অক্টোবরের গোড়ায় কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়ে দীপেন। এবারও তার হেরফের হয়নি।

সবে অক্টোবর পড়েছে। বাংলা ক্যালেন্ডারে এটা আশ্বিন মাস! কলকাতার বাতাসে এখন পুজো পুজো গন্ধ। শহরের রাস্তায় রাস্তায় আর পার্কে পার্কে প্যান্ডেল বাঁধা চলছে পূর্ণোদ্যমে। আর কয়েক দিনের মধ্যে দশভুজা বাপের বাড়ি আসবেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ বাঙালির সবচেয়ে বড় পার্বণও দীপেনকে কলকাতায় ধরে রাখতে পারেনি।

মাঝখানে তিনটে বছর বাদ দিলে কোনওবার সে গেছে ঈশ্বরের আপন দেশ কেরালায়, কোনওবার রাজস্থানে, কোনওবার অমরকন্টকে বা গোয়র সমুদ্রসৈকতে। দশ পা হাঁটলেই ফুরিয়ে যাবে, ভারত তো এমন একরত্তি দেশ নয়; এ প্রায় এক মহাদেশ। দীপেনের বয়স যখন একুশ কি বাইশ, তখন থেকেই বছরের এই সময়টায় তার ভারতভ্রমণ চলছে।

এ-বছরে সে এসেছে কাশ্মীরে। এই নিয়ে তিনবার। কলকাতা থেকে জেট এয়ারের উড়ানে দিল্লি, সেখান থেকে কানেক্টিং ফ্লাইটে শ্রীনগর। শ্রীনগরে দুরাত কাটিয়ে তিনদিন হল দীপেন এসেছে পহেলগাঁও। উঠেছে লিডার নদীর ধারে ছোটখাটো একটা হোটেলে।

সারা ভারতভূমি জুড়ে যেখানে যত ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে, প্রায় সবই চষে ফেলেছে দীপেন। যেখানে সে একবার যায় সেখানে দুবার তার পা পড়ে না। কিন্তু কাশ্মীর তার কাছে ভেরি ভেরি স্পেশাল। ভূস্বর্গ কি এমনি এমনি বলে? তাই এখানে তিন-তিনবার।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছিল দীপেন। লিডার নদীর পাশ দিয়ে মসৃণ পাহাড়ি রাস্তাটা কোথাও সামান্য উঁচু, কোথাও সামান্য নীচু। স্বচ্ছন্দে হাঁটা যায়; পাহাড়ি-পথ বলে হাঁফ ধরে না।

দীপেনের বয়স পঞ্চাশ পেরোয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই সারা শরীর জুড়ে ভাঙন ধরেছে। চোখের তলায় কালচে ছোপ, গাল বসা, গায়ের চামড়া কুঁচকে-মুচকে গেছে। কপালে ভাঁজ। হাতের শিরাগুলো বড় বেশি প্রকট। অদৃশ্য ঘুণপোকারা রক্তে-মাংসে ঘাঁটি গেড়ে ধ্বংসের কাজ অনেকটাই শেষ করে ফেলেছে। তার পরনে সাত-আট বছরের পুরোনো গরম ট্রাউজার্স, শার্ট, সোয়েটার, কোট, মাথায় উলের টুপি। স্বাস্থ্য যখন টান টান, মজবুত ছিল, শীতের এই পোশাক চমৎকার মানিয়ে যেত। কিন্তু এখন ক্ষয়াটে, শীর্ণ দেহে সেগুলো ঝলঝল করে। শরীর শুকিয়ে গেছে কিন্তু কোট-প্যান্টগুলোর মাপ তো পাল্লা দিয়ে ছোট হয়ে যায়নি। তাই ভীষণ বেখাপ্পা দেখায়।

পা থেকে মাথা অবধি এত যে ভাঙচুর, তবু বোঝা যায় একসময় সে বেশ সপুরুষ ছিল।

পহেলগাঁওয়ের রাস্তাটা ধরে হাঁটছিল দীপেন। তার কোনও গন্তব্য নেই। শুধুই লক্ষ্যহীন হাঁটা। কলকাতায় এবছর আক্টোবরের গোড়াতেও বেশ গরম রয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরে? এর মধ্যেই কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। হিম-ঋতুটা যে এখন থেকে জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।

ভরদুপুরে রোদের উষ্ণতা গায়ে মেখে হাঁটতে ভালোই লাগছে দীপেনের। রাস্তায় প্রচুর মানুষজন। বোঝা যাচ্ছে এরা সব টুরিস্ট। আগের বছর দুই জঙ্গি হামলার জন্য টুরিস্টরা আসছিল না। এবছর পরিবেশ খুব শান্ত, গুলি-গোলা ঝামেলা-ঝঞ্জাট নেই। পর্যটকরা তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চারপাশ থেকে অবিরল কলকলানি কানে আসছে। গুজরাতি, মারাঠি, হিন্দি, ওড়িয়া–এসব তো আছেই, তবে সব ছাপিয়ে বাংলাটাই বেশি শোনা যাচ্ছে।

বাঙালি এক জাত বটে। পায়ের তলায় তাদের সরষে। ছুটি পেলে তো ভালোই, নইলে ছুটি নিয়ে লটবহর কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেখানেই যাও, তা জোহানেসবার্গই হোক বা টোকিও গ্ল্যাসগো পাপুয়া নিউগিনি হাওয়াই বা লিসবন–সর্বত্র কম করে দশ-বিশটা বঙ্গবাসীর দর্শন মিলবেই। তা ছাড়া নিজেদের বিশাল ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া তো আছেই।

দীপেনের ডানপাশে লিডার নদী। তার পাড়ে অনেকটা গ্যাপ দিয়ে গ্যাপ দিয়ে বেশ কটা হোটেল। নদীটা কত আর দুরে? খুব বেশি হলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ ফিট। হোটেলগুলোর মধ্যে অনেকটা করে ফাঁক থাকায় রাস্তা থেকে নদীটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ, অগভীর জলধারাটির নীচের অজস্র নুড়ি, পাথরের টুকরো এবং বালুকণাগুলোকেও বুঝিবা গুনে নেওয়া যায়। নুড়ি-টুড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে ঝুম ঝুম আওয়াজ তুলে বয়ে চলেছে। লিডার। দিন-রাত একই সিমফনি।

দীপেনের বাঁ পাশেও ছোট পাহাড়। তার নীচের দিকে রাস্তা ঘেঁষে লাইন দিয়ে কাশ্মীরি শাল, সোয়েটার আর অজস্র কাশ্মীরি হ্যাঁন্ডিক্রাফটের দোকান; শো-রুম। ওপরের দিকে নানা ধরনের বাংলো, বেশিরভাগই কাঠের তৈরি। পিকচার পোস্টকার্ডে যেমনটা দেখা যায়, অনেকটা সেইরকম।

নদীর দিকে চোখ রেখে অন্যমনস্কর মতো পা ফেলছিল দীপেন। নানা এলোমেলো চিন্তা আর হতাশা উড়ো মেঘের মতো মাথায় ঢুকে যাচ্ছিল। তিনবার সে পহেলগাঁও এল। খুব ইচ্ছা ছিল লিডার নদী অনেক দূরে যেখানে বাঁক ঘুরে চলে গেছে সেখানে জম্মু ও কাশ্মীর গভর্নমেন্টের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের যে লগ কেবিনগুলো আছে তার একটায় কটা দিন কাটাবে, নদী থেকে ট্রাউট মাছ ধরবে, তা ছাড়া চন্দনওয়াড়ি হয়ে অমরনাথ যাবে। কিন্তু কোনওটাই হয়নি বা হবেও না। কেননা ব্যাঙ্কের সুদের ওপর ভরসা করে সে কোনওরকমে টিকে আছে। ব্যাঙ্ক যেভাবে দু-চারমাস পর পর ইন্টারেস্ট কমাচ্ছে তাতে–কিন্তু হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, আঙ্কল-আঙ্কল।

ভাবনাগুলো ছত্রখান হয়ে গেল দীপেনের। পরক্ষণে খেয়াল হল কে ডাকবে তাকে? এখানে তো কেউ চেনে না। রীতিমতো চমকেই উঠল সে। কী ভেবে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল একটি ন-দশ বছরের ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টকটকে গায়ের রং, সারল্যে ভরা, নিষ্পাপ মুখ। পরনে খুব দামি শীতের পোশাক। দেখামাত্র আন্দাজ করা যায় সোসাইটির উঁচু স্তরের কোনও বাঙালি কি? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চারিদিকে ইন্ডিয়ার নানা রাজ্য থেকে আসা টুরিস্টরা তাদের মাতৃভাষায় কর কর করে যাচ্ছে। নিজের অজান্তে বাংলাতেই জিগ্যেস করল দীপেন, তুমি কি আমাকে ডাকছিলে?

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল ছেলেটি।

দীপেনের মনে যে ধোঁয়াটে ভাবটা ছিল, কেটে গেল। ছেলেটি বাঙালিই। সে জানতে চাইল, আমাকে কিছু বলবে?

উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল দীপেন।

ছেলেটি বলল, আমার বাবা বলছিল, কাশ্মীরে এইসময় বরফ পড়ে। ওই যে পাহাড়টার মাথায় সাদা মতো দেখা যাচ্ছে ওটা কি বরফ?

লিডার নদীর ওপারে যে ছোট পাহাড়টা রয়েছে তার পেছন দিক থেকে পর পর অনেক পাহাড়। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, ওই যে–ওটা।

এই ছোট ছেলেটির মতো তার চোখের দৃষ্টি অত সতেজ নয়। ষাট-সত্তর ফিট দুরের জিনিস কেমন যেন ঘোলাটে ঘোলাটে মনে হয়। দূর পাহাড়ের মাথায় অক্টোবরের শুরুতেই বরফ পড়েছে কিনা তা নিয়ে দীপেন ভাবছে না, সেদিকে তাকাচ্ছেও না। একা একটি ছেলে, সঙ্গে কেউ নেই, আচমকা কোত্থেকে এসে হাজির হল, বোঝা যাচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে তার জন্য উৎকণ্ঠা হচ্ছিল। জিগ্যেস করল, তোমার নাম কী?

দাদু-দিদা-বাবা-মা বলে তাতান, ভালো একটা নামও আছে–সমৃদ্ধ ব্যানার্জি। বলেই তার পুরোনো প্রশ্নে চলে গেল।–বললে না তো, ওটা বরফ কিনা। বলো-বলল, প্লিজ

তাতানের গলার স্বরটি ভারী মিষ্টি; পাখির ডাকের মতো সুরেলা। ছেলেটা মিশুকে তো বটেই, বেশ আদুরে ধরনের। তার মাথায় বরফ ঢুকেছে, সেটি না-জানা অবধি স্বস্তি নেই। দীপেন বলল, তোমাকে একা দেখছি। কার সঙ্গে পহেলগাঁও এসেছ?

মা-বাবার সঙ্গে। বলো না আঙ্কেল।

কোথায় তোমার মা-বাবা?

যেখানে দীপেনরা দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পেছনদিকে বরাবর অনেক দূরে তাকালে বেশ কটা উইলো আর ওকগাছের জটলা। সেদিকে হাত বাড়িয়ে তাতান বলল, ওখানে ঘোড়াওয়ালারা আছে না? মা-বাবা তাদের সঙ্গে কথা বলছে।

এই এলাকার নাড়ি-নক্ষত্র দীপেনের জানা। দূরের ওই গাছগুলোর তলায় ঘোড়াওয়ালাদের ঘাঁটি। দুরকমের ঘোড়া নিয়ে ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। টগবগে বড় ঘোড়া আর টাট্ট। হর্স-রাইডের জন্য টুরিস্টরা ওদের ঘোড়া ভাড়া নেয়। যাদের বয়স বেশি তাদের জন্য বড় ঘোড়া, ছোটদের ছড়ানো হয় টাটুতে। দীপেন আন্দাজ করে নিল তাতানের মা-বাবা ওখানে যখন ঘোড়াওয়ালাদের সঙ্গে হর্স-রাইডের ভাড়া নিয়ে কথা বলছেন, সেই ফাঁকে তাতান এদিকে চলে এসেছে।

দীপেন জিগ্যেস করল, এখানে যে আসবে, মা-বাবাকে কি বলেছ?

শব্দহীন হাসিতে সারা মুখ ভরে গেল তাতানের। চোখ দুটো প্রায় বুজে গেছে। আস্তে আস্তে মাথাটা এধার থেকে ওধারে নাড়তে লাগল সে।

তার মনে না বলেই চলে এসেছে তাতান। তার আধবোজা চোখ থেকে দুষ্টুমির একটা ঝলক বেরিয়ে এল।

না, যতটা সরল দেবশিশু মনে হয়েছিল, আদপেই সে তা নয়। দীপেন বলল, এই যে তুমি হুট করে চলে এলে, মা-বাবা ভাববেন না?

ঘাড় কাত করে তাতান বলল, হু, ভাববে তো।

তা হলে এভাবে চলে এলে কেন?

ইচ্ছে হল যে

এই ছেলের ইচ্ছের তালিকাটা কতখানি লম্বা, ভাবতে চেষ্টা করে দীপেন বলল, মাঝে মাঝে এরকম না বলে কোথাও চলে যাও নাকি?

যাই তো

তারপর?

চোখ-মুখে সেই দুষ্টু-হাসিটা লেগেই আছে তাতানের। ডান হাতটা তুলে মায়ের কায়দাটা দেখিয়ে দিল সে।

চোখ গোলাকার হয়ে গেল দীপেনের। তাতান ব্যক্তিটি যে সামান্য নন সেটা তার চোখ-মুখের ভাবভঙ্গি, হাত তুলে প্রহারের মুদ্রা ফুটিয়ে তোলার কারিগরি দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে। মজাও লাগছিল দীপেনের। সেইসঙ্গে ভাবছিল ছেলেটা মা-বাপকে একেবার তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়ে। বলল, কে তোমাকে বেশি মারেন?

কে আবার, মা। মারতে মারতে পিঠের ছাল তুলে ফেলে।

আর বাবা?

বাবা মারে না; একটুখানি বকাবকি করে। মা যখন মারতে শুরু করে, বাবা বাড়িতে থাকলে আমাকে টেনে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মা আর আমাকে ধরতে পারে না। বাইরে দাঁড়িয়ে বাবার ওপর খুব রাগারাগি করে, চেঁচায় আর বলে, আমাকে আদর দিয়ে বাবা মাথায় তুলেছে।

বোঝা যাচ্ছে শাসন যেটুকু করেন তাতানের মা-ই। ওর বাবা রীতিমতো আশকারাই দেন। দীপেন বলল, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকে না। মা-বাবা নিশ্চয়ই খুব খোঁজাখুঁজি করছেন। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি

এক্ষুনি যাবার তেমন ইচ্ছা ছিল না তাতানের। তবে আপত্তি করল না।-আচ্ছা, চলো–

ঘোড়াওয়ালাদের ঘাঁটিটার দিকে এগিয়ে চলল দুজনে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দীপেন জিগ্যেস করে, তোমরা কোথায় থাকো?

কলকাতায়।

তোমরা ক’ভাইবোন?

আমি একলা।

কোন স্কুলে পড়ো?

সেন্ট জেভিয়ার্স।

বাঃ, ওটা তো ভেরি ফেমাস স্কুল

তাতান হাসল।

কোন ক্লাস?

ফোর।

বেশ কয়েক বছর দীপেনের শরীরের মতো জীবনটাও আগাগোড়া তছনছ হয়ে গেছে। তার একটা ফ্যামিলি লাইফও ছিল, সেটাও ঘেঁটেঘুঁটে ধ্বংসস্তূপ। একটি আধবুড়ো কাজের লোক এসে ঘরদোর সাফ করা, বাজারে যাওয়া, জামাকাপড় কাঁচা, রান্নাবান্না–এসব করে দিয়ে চলে যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সে একেবারে একা। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, কেউ তার ত্রি-সীমানায় ঘেঁষে না। দূষিত, বর্জ্য পদার্থের মতো সে একধারে পড়ে থাকে। তার ওপর একটা মরণ রোগ বাধিয়েছে। সেটা নিঃশব্দে তার শরীরের শাঁস কুরে কুরে খেয়ে চলেছে।

কাজের লোক বলাইকে বাদ দিলে কথা বলার প্রায় কেউ নেই তার। বহুদূরের পহেলগাঁওয়ের রাস্তায় হঠাৎই তাতান নিজের থেকে এসে ভাব জমিয়েছে। ভারী মিষ্টি, একটু একটু দুষ্টু এই ছেলেটার সঙ্গ কী ভালো যে লাগছে! দীপেনের নুয়ে-পড়া ক্ষয়াটে শরীরে অনন্তকাল আগের তার যুবা বয়সের খানিকটা এনার্জি যেন ফিরে এসেছে।

তাতান, তার মা-বাবা, তাদের বাড়ির অন্য লোকজন সম্বন্ধে খুব কৌতূহল হচ্ছিল দীপেনের। কী জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দূর থেকে কোনও মহিলার তীব্র, চকিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।-ওই তো তাতান, ওই তো-

চমকে সেদিকে তাকাতেই দীপেনের চোখে পড়ল, একজন সুন্দরী মহিলা, দামি শাড়ির ওপর গরম লেডিস কোট পরা, তার সঙ্গী একজন ভারী সুদর্শন মাঝবয়সি ভদ্রলোক, পরনে টাউজার্স, শার্টের ওপর ফুল-স্লিপ পুল-ওভারভিড়ের ভেতর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় ঊধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে।

দীপেনরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাশ থেকে তাতান নীচু গলায় বলল, আমার মা আর বাবা

মাত্র কয়েক লহমা। পুরুষ এবং মহিলাটি কাছে চলে এল।

পুরুষটি অর্থাৎ তাতানের বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না তাতান। তুমি আমাদের পাগল করে ছাড়বে। বলতে বলতেই তার চোখ এসে পড়ল দীপেনের ওপর। আপনার সঙ্গে আমাদের ছেলে; ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো!

দীপেন বলল, আমি একজন ট্যুরিস্ট। আপনাদের ছেলে নিজেই এসে আমার সঙ্গে আলাপ করেছে। তারপর তাদের মধ্যে যা যা কথা হয়েছে সব জানিয়ে বলতে লাগল, আপনারা কোথায় আছেন শুনে নিয়ে আপনাদের কাছে ওকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলাম। ভালোই হল, রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল। একটু হেসে ফের বলল, অনেক দূরে একটা পাহাড়ের সাদা পিক দেখে বার বার জিগ্যেস করছিল, ওখানে বরফ পড়েছে কিনা—

আমারই দোষ। বলেছিলাম এর মধ্যে কাশ্মীরে বরফ পড়ে। সেটাই ওর মাথায় ঢুকে গেছে। বরফ বরফ করে অস্থির করে তুলছিল। আমরা হর্স-রাইডের জন্যে ঘোড়া ঠিক করছিলাম; কখন এদিকে চলে এসেছে, প্রথমটা টের পাইনি। তার পর খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। কপাল ভালো, আপনার মতো একজন ভদ্রলোকের কাছে ছেলেটা গিয়েছিল।

দীপেন জিগ্যেস করল, আপনাদের না-বলে এরকম বেরিয়ে পড়ে নাকি?

মাঝে মাঝেই। মাথায় একটা কিছু চাপলেই হল। দেশটা বদমাশ খুনি কিডন্যাপারে ভরে গেছে। ভদ্রলোক আর কটা? কোনদিন যে কার পাল্লায় পড়বে। সবসময় ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের টেনশানে থাকতে হয়। আপনি যা করলেন সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

একটু বিব্রতভাবে হাসল দীপেন।-না না, ধন্যবাদ পাওয়ার মতো এমন কিছু কিন্তু করিনি।

কী করেছেন, সেটা আমি জানি

ওদিকে মহিলাটি আগুন-চোখে তাতানের দিকে তাকিয়ে ছিল। চাপা, গনগনে গলায় সে বলছিল, অবাধ্য, পাজি ছেলে। একেবারে জ্বালিয়ে মারলে। আজ তোমার কী হাল করি, দেখো। হাড়-মাংস আলাদা করে ছাড়ব। এসো এদিকে

তাতান অপরাধী অপরাধী মুখ করে, ঠোঁট টিপে মায়ের দিকে মিটিমিটি তাকাতে তাকাতে এক দৌড়ে তার বাবার গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল। দীপেন আন্দাজ করল, এই ঘোর সংকটে বাবাই তার একমাত্র রক্ষাকর্তা।

তাতানের বাবা দীপেনের দিকে তাকিয়েই ছিল। বলল, আপনি আমাদের এত বড় একটা উপকার করলেন, কিন্তু পরিচয়ই তো হল না। আমার নাম সুকান্ত ব্যানার্জি। ডাক্তারি করি। আর ইনি শমিতা-আমার স্ত্রী; একটা মিশনারি স্কুলে হিস্ট্রি পড়ান। বলেই হাতজোড় করল।

এতক্ষণ ডক্টর সুকান্ত ব্যানার্জি আর তাতানকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল দীপেন। মহিলাটি, অর্থাৎ শমিতাকে সেভাবে লক্ষ করেনি। শমিতা নামটা তার কানে খট করে লেগেছিল। কিন্তু কোটি কোটি বাঙালির মধ্যে শমিতা কি একজনই? হাজার হাজার শমিতা রয়েছে। হাতজোড় করে মহিলার দিকে ভালো করে তাকাতেই তার ভাঙাচোরা, শীর্ণ শরীরের ভেতর দুর্বল হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি মুহূর্তে যেন থমকে গেল। কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল সে। পনেরো-ষোলো বছর পর আবার দেখা শমিতাকে চিনতে তার অসুবিধা হয়নি। সামান্য মেদ জমেছে চেহারায় এবং আরও অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে।

শমিতাও হাতদুটো জড়ো করে বুকের কাছে তুলে এনেছিল। ধ্বস্ত, জীর্ণ প্রেতের মতো মানুষটাকে আগে তেমন লক্ষ করেনি। তাতানকে নিয়ে সে এতটাই উৎকণ্ঠিত ছিল যে, খেয়াল করার কথা নয়। এবার কিন্তু শমিতা চিনতে পেরেছে। মুহূর্তে সব রক্ত সরে গিয়ে মুখটা একেবারে ছাইবর্ণ হয়ে যায়। তার গলার ভেতর থেকে ফ্যাসফেসে আওয়াজ বেরিয়ে এল।-নমস্কার।

তারা কেউ লক্ষ করেনি, সুকান্ত ব্যানার্জি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাত্র দু-এক মিনিট। পনেরো-ষোলো বছর পর দেখা একটি পুরুষ এবং একটি নারীর কাছে সময়টা যেন কয়েক যুগেরও বেশি।

একসময় সুকান্ত ব্যানার্জির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।-আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানতে পারিনি।

চমকে উঠল দীপেন। ঝটিতি তার চোখ সুকান্তর দিকে ঘুরে গেল। শ্বাসটানা গলায় নিজের নামটা জানিয়ে বলল, বলার মতো তেমন কোনও পরিচয় আমার নেই। আমি সামান্য একজন মানুষ।

সামান্য কি অসামান্য, সেটা অন্যকে ভাবতে দিন। বোধহয় কলকাতায় থাকেন?

হ্যাঁ, গড়িয়ায়। সেটা গ্রেটার ক্যালকাটায় ঢুকে গেছে। সেই হিসাবেই কলকাতায় থাকি, বলা যায়। দেড় কামরার ছোট একটা ফ্ল্যাট আমার। পায়রার খোপ আর কী। সে চুপ করে গেল।

হঠাৎ সবার চোখে পড়ল সূর্য পশ্চিমদিকের পাহাড়গুলোর মাথা ছুঁই ছুঁই করছে। চারিদিকের উঁচু উঁচু আর ছোট ছোট পাহাড়ের ছায়া ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। বাতাস আরও কনকনে। সূর্য দূরের পাহাড়গুলোর ওধারে চলে গেলে অন্ধকার নামতে শুরু করবে।

ব্যস্তভাবে সুকান্ত বলল, ঠান্ডাটা ভীষণ বেড়ে গেল। আপনি এখানে কোথায় উঠেছেন?

আঙুল বাড়িয়ে লিডার নদীর ধারে তার হোটেলটা দেখিয়ে দিল দীপেন। দোতলা ছোট হোটেল। নাম প্যারাগন।

আপনার কোনও আর্জেন্ট কাজ-টাজ আছে?

আমার কখনও কোনও কাজ থাকে না। আমি ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট বেকার। বেড়াতে এসেছি। কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করি। এখানে যাই, সেখানে যাই। শীতটা যখন সহ্য হয় না, হোটেলে ফিরে টিভি চালিয়ে কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়ি। রাত হলে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে ফের কম্বলের নীচে। কাজ বলতে এটুকুই। দীপেন বলছিল ঠিকই, তবে তার চোখ বার বার শমিতার দিকে চলে যাচ্ছিল।

সুকান্ত প্রায় লাফিয়ে উঠল।–ফাইন। আলাপ হল। কাশ্মীরের এই শীতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি? চলুন, চলুন, কফি-টফি খেতে খেতে জমিয়ে গল্প করা যাবে। ওই যে আমাদের হোটেল।

হোটেল প্যারাগন থেকে বেশ খানিকটা দুর লিডার নদীরই ধারে এখানকার সবচেয়ে বড় হোটেল–হোটেল পহেলগাঁও। দীপেন জানে শুধু বড়ই নয়, কাশ্মীরের এই এলাকায় সবচেয়ে পুরোনো এবং অভিজাত পান্থনিবাস। ওখানকার ডাবল-বেড রুমের প্রতিদিনের ভাড়া ছহাজার। তার মতো মানুষ একদিন হয়তো ওই হোটেলটায় থাকতে পারত। কিন্তু সেসব দিন আর নেই।

দীপেন বলল, না না, প্লিজ আপনারা যান।

চলুন তো মশাই বলে স্ত্রীর দিকে ঘাড় ফেরাল সুকান্ত। কী হল, বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে। মিস্টার ঘোষকে রিকোয়েস্ট করো। ভদ্রলোক আমাদের এত উপকার করলেন।

শমিতা এর মধ্যে হয়তো খানিকটা সামলে নিয়েছিল। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল, তুমিই তো এত করে বলছ। আশা করি, উনি আমাদের সঙ্গে যাবেন। তার মুখে ফিকে একটু হাসি ফুটল।

আর কেউ টের না পাক, দীপেন ঠিকই বুঝেছে শমিতার ভেতর তুমুল তোলপাড় চলছে। বাইরে স্বাভাবিকতার যে খোলসটা দেখা যাচ্ছে সেটা পুরোপুরি মেকি।

আরও বারকয়েক না না করল দীপেন। কিন্তু সুকান্ত ছাড়লে তো। শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হল। এতক্ষণ সিঁটিয়ে ছিল তাতান। যে-ই বুঝল মায়ের বকুনি আর মারধরের হাত থেকে আপাতত রেহাই পাওয়া গেছে, গা ছাড়া দিয়ে সে এসে দীপেনের একটা হাত ধরল।-চলো আঙ্কেল-চলো

হোটেল পহেলগাঁও-এর দিকে হাঁটতে হাঁটতে কোনও দিকেই নজর ছিল না দীপেনের। তাতান সমানে কল কল করে চলেছে; সুকান্তও কী সব বলে যাচ্ছে। আবছা আবছা কিছু কিছু শব্দ কানে আসছিল। সে ভাবছিল কখনও কখনও ভ্যাদভেদে, বিস্বাদ, একঘেয়ে জীবনে আচমকা চমকে দেবার মতো এমন কিছু ঘটে যায় যা পরমায়ুর বাকি দিনগুলোকে অপার আনন্দে ঝলমলে করে তোলে। আবার এমন কিছু ঘটে যা অবাঞ্ছিত, দমবন্ধ-করা, সমস্ত ভাবনা-চিন্তাকে উথালপাথাল করে দেয়। আজকের দিনটায় দীপেনের জীবনে ঠিক তাই ঘটল। হয়তো শমিতার জীবনেও। সুদূর পহেলগাঁও-এ পনেরো-ষোলো বছর বাদে নিয়তিতাড়িত দুটি মানুষের যে দেখা হয়ে যাবে, তারা নিজেরাই কি কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল।

.

০২.

হোটেল পহেলগাঁও-এ ডাবল বেড রুম না, বড় বড় দুকামরার একটা সুইট নিয়েই আছে সুকান্ত ব্যানার্জিরা। একটা বেড রুম, অন্যটা ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম। দামি দামি ক্যাবিনেট, কার্পেট, রুম-হিটার দিয়ে সুইটটা সাজানো। এমন একটা সুইট ভাড়া নিয়ে দামি হোটেলে যারা থাকতে পারে তারা সোসাইটি কোন স্তরের মানুষ, তা বলে দিতে হয় না। সেখানে পা দিয়েই টের পাওয়া গেল আরামের, বিলাসের নানা উপকরণ সেখানে ছড়ানো। শমিতা যে কতটা সুখে আছে হোটেলের এই সুসজ্জিত কক্ষটি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দীপেনকে দেখিয়ে দিচ্ছে।

সুকান্ত ব্যানার্জি বেশ আন্তরিক সুরে বলল, বসুন মিস্টার ঘোষ, বসুন

দীপেনের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এখানে না এলেই ভালো হত। কোনও একটা জোরালো অছিলা খাড়া করে এড়িয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু তেমন সুযোগই তো পাওয়া গেল না। আড়ষ্টভাবে একটা সোফায় বসতে বসতে দীপেন ভাবল, এখানে কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হবে, কে জানে!

সুকান্তও বসে পড়েছিল। দীপেনকে তাতানের ভীষণ ভালো লেগেছে। একরকম তার জন্যই মায়ের হাতের বেদম ঠ্যাঙানির হাত থেকে আজকের দিনটা রেহাই পাওয়া গেছে। সে দীপেনের পাশে ঘন হয়ে বসল।

শমিতা কিন্তু দাঁড়িয়েই আছে। চোখে মুখে কেমন একটা অস্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ। তার দিকে তাকিয়ে সুকান্ত বলল, কী হল, ভদ্রলোককে ধরে নিয়ে এলাম। হসপিটালিটিতে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে যে। কী ভাবছেন উনি! তড়বড় করে বলতে লাগল, এক্ষুনি রুম-সারভিসে বলে দাও কফি-টফি যেন পাঠিয়ে দেয়। খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাক।

কয়েক মিনিটের ভেতর কফি কাবাব কাজুবাদাম কাটলেট-টাটলেট এসে গেল।

তাতান ছাড়া বাকি তিনজন কফির কাপ তুলে নিল। তাতান মনোনিবেশ করল কাটলেট, কাবাবে।

কফিতে চুমুক দিয়ে সুকান্ত হইহই করে উঠল।-রাস্তায় দু-একটা মোটে কথা হয়েছে। এবার আলাপটা জমানো যাক। বললেন, গড়িয়ায় থাকেন।

সুকান্ত যে মজলিশি মানুষ, যৎসামান্য পরিচয়েই তার আঁচ পেয়েছে দীপেন। আস্তে মাথা নাড়ল সোহা।

সুকান্ত জিগ্যেস করল, বাড়িতে আর কে কে আছে?

আমি একাই।

চোখ কপালে তুলে একটা নকল বিস্ময়ের ভঙ্গি করল সুকান্ত।–দারা পুত্র পরিবার কেউ নেই?

মাথাটা ডাইনে থেকে বাঁয়ে, বাঁয়ে থেকে ডাইনে বারকয়েক দোলাল দীপেন।–শুধু একটা কাজের লোক এসে দু-বেলা রান্না-টান্না করে দিয়ে যায়। যদি মনে করেন সে আমার ফ্যামিলি মেম্বার তা হলে তাই।

চোখ গোলাকার করে সুকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকায়।সংসারের কোনওরকম ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট নেই। একেবারে মুক্তপুরুষ-কী বলে?

শমিতা উত্তর দিল না।

সুকান্তর চোখ আবার ফিরে এল দীপেনের দিকে।বেশ আছেন মিস্টার ঘোষ।

দীপেনের চোখ-মুখে নির্জীব, ফিকে একটু হাসি ফুটে উঠতে-না-উঠতেই মিলিয়ে গেল।

সুকান্ত এবার বলল, সবে পরিচয় হয়েছে। বেশি কৌতূহল প্রকাশ করতে নেই। যদিও অশোভন, তবু একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছে।

ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিটা চলছেই। সুকান্ত কী জানতে চাইছে, কে জানে! সতর্কভাবে দীপেন বলল, বলুন–

আপনি কি কোনও সারভিসে আছেন বা অন্য কিছু করেন?

অস্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রাটা একটু কমল দীপেনের।-আমি কিছুই করি না। না সারভিস, না বিজনেস। একেবারে নিষ্কর্মা, বেকার। বলেই খেয়াল হল সুকান্ত যে স্তরের মানুষ, অশোভন জেনেও একজন সদ্য পরিচিতকে সে কী করে না করে, এ জাতীয় গাঁইয়া মার্কা প্রশ্ন করবে কেন? পরক্ষণে নিজের অজান্তে তার চোখ দুটো শমিতার দিকে চলে গেল। শমিতা ঠোঁট টিপে, একদৃষ্টে পলকহীন তাকেই লক্ষ করছে।

হোটেলে আসার পর তার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি শমিতা। আগেও বলেছে কি? মনে পড়ল না দীপেনের। শমিতাকে কেমন যেন আড়ষ্ট, সতর্ক দেখাচ্ছে। কিন্তু সুকান্তর মতো তারও কি তার সম্বন্ধে কৌতূহল রয়েছে? সমস্ত ব্যাপারটা দুর্বোধ্য, ঘোলাটে লাগছে দীপেনের কাছে। অস্বাচ্ছন্দ্যটা যেটুকু কমেছিল তার কয়েকগুণ বেড়ে ফিরে এল যেন।

সুকান্ত হইচই বাধিয়ে বলল, ওই দেখুন, আপনাকেই শুধু এটা-ওটা জিগ্যেস করে চলেছি। অথচ আমাদের সম্বন্ধেও তো আপনাকে জানানো দরকার।

মাত্র ঘণ্টা দেড়-দুই হল তাদের পরিচয় হয়েছে, হয়তো জীবনে আর কখনও সুকান্তদের সঙ্গে দেখা হবে না। তা হলে এত জানাজানির প্রয়োজনটা কী? তক্ষুনি দীপেনের খেয়াল হয় মাঝখানে শমিতা রয়েছে। সুকান্তর প্রশ্নগুলো কি তারও হতে পারে? অস্বস্তি তো ছিলই, ক্রমশ যেন কুঁকড়ে যেতে লাগল সে।

সুকান্ত বলতে লাগল, জানেন মিস্টার ঘোষ, আমরা ওল্ড কলকাত্তাইয়া। পাঁচ-ছ জেনারেশন ধরে ওখানে আছি। ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন ইংরেজ আমলে একটা বিরাট ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। তাঁর ছেলে ওই ফার্মেই বিরাট পোস্টে ছিলেন। ঠাকুরদা, আমার বাবা আর দুই কাকা হাইকোর্টের লইয়ার। তারপর আমাদের জেনারেশন। আমরা কেউ বাপ-ঠাকুরদার পথে হাঁটিনি। আমি ডাক্তার, আমার ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার, খুড়তুতো ভাইরা কেউ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কেউ ব্যাঙ্কার, কেউ বা প্রফেসর। আপনি তো বললেন একেবারে একা। আমরা কিন্তু উলটো। কয়েক জেনারেশন ধরে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাবা, কাকা, মা, কাকিমা, খুড়তুতো ভাই-টাই, তাদের বউরা, নিজের ছেলে, ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে আছি। আমাদের টোটাল ফ্যামিলি মেম্বার কত জানেন? সাতাশ। হোল বেঙ্গল চষে ফেলুন, এত বড় ফ্যামিলি কমই পাবেন। খুব বেশি হলে পাঁচ-দশটা। এখন নিজের বউ, দু-একটা বাচ্চা নিয়ে ছোট ছোট সব ফ্যামিলি।

দীপেন হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিল। সুকান্ত ব্যানার্জি নিজেদের সম্বন্ধে এমন সাতকাহন কেঁদে বসল কেন? অচেনা একটি মানুষকে এসব শোনাবার পেছনে কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে কি?

বলতে বলতে সুকান্ত দীপেনের দিকে তাকাল।–সব শুনছেন তো মিস্টার ঘোষ?

আস্তে মাথা নড়ল দীপেন। আবছা গলায় বলল, শুনছি।

পাইকপাড়ায় গিয়ে যদি ব্যানার্জি ভিলা-র নাম করবেন যে-কেউ দেখিয়ে দেবে। প্যালেসের মতো চারতলা বাড়িটা বানিয়েছিলেন আমার ঠাকুরদার বাবা। ওটা ওই এলাকার ল্যান্ডমার্ক। ওটা খুব শিগগিরই হেরিটেজ বিল্ডিং হয়ে যাবে।

চকিতে দীপেনের খেয়াল হল, নিজেদের বংশগরিমা, রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি, আভিজাত্য-টাত্য নিয়ে আধঘন্টা ধরে সুকান্ত একটানা যা জাহির করল তার পেছনে কোথাও কি চাপা আত্মম্ভরিতা রয়েছে? সে কি বোঝাতে চেয়েছে, দেখো আমাদের পারিবারিক স্টেটাসের কাছে তুমি কত তুচ্ছ, কত অকিঞ্চিৎকর। দীপেন জানে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানাতে চায়, আমরা এই করেছি, সেই করেছি, আমাদের এত সুনাম, এত বৈভব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অপরিচিত একটি লোককে ডেকে এনে অবিরল এই নিয়ে কীর্তন গাওয়ার কারণটার তলকূল আগেও পায়নি সে, এখনও পেল না। ব্যাপারটা তার কাছে ধোঁয়াটে হয়ে রইল।

আচমকা সুকান্তর খেয়াল হল দীপেন হাত থেকে কফির মগটা নামিয়ে রেখেছে। প্লেটে প্লেটে সুখাদ্যগুলি তেমনই পড়ে আছে। সুকান্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।-এ কী মিস্টার ঘোষ, আপনি তো কিছুই ছোঁননি। আমি সমানে বকবক করে যাচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই বোরড ফিল করছিলেন। কফিটা জুড়িয়ে গেছে। শমিতার দিকে ফিরে বলল, আমাদের গেস্ট, তুমি একটু লক্ষ রাখবে তো? রুম-সারভিসে বলে দাও, ঠান্ডা কফি-টফি ফেরত নিয়ে গিয়ে গরম খাবার-টাবার দিয়ে যায় যেন

তাতান অবশ্য তার প্লেটগুলো সাফ করে ফেলেছে। শমিতা আর সুকান্ত দু-এক চুমুক কফি খেয়েছিল কিন্তু প্লেটে হাত দেয়নি।

দীপেন বাধা দেবার আগেই শমিতা রুম-সারভিসে ফোন করে দিয়েছে এবং কয়েক মিনিটের ভেতর গরম গরম টাটকা খাবার চলে এসেছে

সুকান্ত বলল, এবার শুরু করুন মিস্টার ঘোষ

দীপেন কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বুকে চিন চিন করে ব্যথা শুরু হল। চেনা লক্ষণ। একটা বড় ধরনের স্ট্রোক হবার পর ডাক্তার দত্তগুপ্ত তাকে সবসময় ব্যথানাশক বড়ি সঙ্গে রাখতে বলেছিলেন। যেখানেই দীপেন যায়, একপাতা ওই বড়ি তার পকেটেই থাকে।

ওষুধের প্যাকেটটা দ্রুত বের করে একটা বড়ি জিভের তলায় রাখল দীপেন।

সুকান্ত, শমিতা আর তাতান দীপেনের দিকের তাকিয়ে ছিল। সুকান্ত জিগ্যেস করল, ওটা কী খেলেন মিস্টার ঘোষ, সরবিট্রেট?

দীপেন উত্তর দিল না।

সুকান্ত জিগ্যেস করল, যাদের হার্টের সমস্যা আছে, মাঝে মাঝে যখন বুকে পেইন হয় তাদের ওই ওষুধটা খেতে হয়। আপনার কি সেরকম কোনও প্রবলেম আছে?

আছে। একটা ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। বাইপাস সার্জারি করতে হয়।

যে সুকান্ত কৌশলে তাদের বংশ, বনেদিয়ানা ইত্যাদি সম্বন্ধে সাত কাহনের জায়গায় চোদ্দো কাহন ফেঁদে বসেছিল তার ভেতর থেকে হঠাৎ দায়িত্বশীল চিকিৎসকটি যেন বেরিয়ে এল।সরি মিস্টার ঘোষ, আমি এটা জানতাম না। কাবাব-টাবাব দেওয়া ঠিক হয়নি।

দীপেন বলল, আজকেই তো আলাপ হয়েছে। জানবেন কী করে? নিজের অজান্তেই তার চোখ শমিতার দিকে চলে যায়। মহিলাটির চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেই চকিতে মিলিয়ে গেল।

সুকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকায়।–মিস্টার ঘোষের জন্যে চিকেন স্যুপ-টুপ দিয়ে যেতে বলো। যেন খুব লাইট হয়।

একবার কাবাব, ফিশফিঙ্গার জুড়িয়ে জল হওয়া, এবার হঠাৎ বুকের ব্যথাটা চাগিয়ে ওঠা–দু-দুবার তার জন্য দামি দামি খাবার নষ্ট তো হলই, বিলটা সুকান্ত ব্যানার্জিদেরই মেটাতে হবে। বিড়ম্বনার একশেষ। চুড়ান্ত বিব্রত দীপেন দুহাত নেড়ে বলতে লাগল, না না, প্লিজ কিছু আনাবেন না। আমি এবার যাব। বলেই দ্রুত উঠে দাঁড়ায় সে।

সুকান্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।–যাবেন কী মশাই! আমি একজন ডাক্তার। হার্ট স্পেশালিস্ট। আপনাকে এই অবস্থায় যেতে দিতে পারি না।

বলে কী লোকটা? মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? দীপেন তাকিয়ে থাকে।

সুকান্ত থামেনি।-আপনার বাইপাস হয়েছে। পাহাড়-টাহাড়ে বেড়াতে আসা ভীষণ রিস্কি। সে যাক, আমাদের টু-বেডরুম সুইট। আজ রাতটা এখানেই থেকে যান। আমাদের কোনওরকম অসুবিধা হবে না। সংকোচের কোনও কারণ নেই।

এর মধ্যে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। আর বুকের ব্যথানাশক বড়িটা মুখের লালায় গলে গিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় যন্ত্রণাটা আর নেই দীপেনের। এখানে থেকে যাওয়া মানে জটিল ফাঁদে আটকে যাওয়া। নিজেকে মুহূর্তে শক্ত করে নিল সে। বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডক্টর ব্যানার্জি। আমাকে আমার হোটেলে ফিরতেই হবে।

দীপেন দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল, আর তখনই তার চোখে পড়ল, শ্বাসরুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে শমিতা। সে চলে যাচ্ছে দেখে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। খুব সম্ভব মুক্তির নিঃশ্বাস। দীপেন তাদের স্যুইটে রাত্তিরে থাকুক, খুব সম্ভব সেটা কোনওভাবেই সে চাইছিল না।

মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল দীপেন। সুকান্তও উঠে পড়েছে। ব্যস্তভাবে বলল, আরে আরে, আপনি তো ভীষণ জেদি লোক দেখছি। ডাক্তার হিসেবে বারণ করছি, তবু শুনছেন না?

দীপেন উত্তর দিল না। এর মধ্যে সে দরজার কাছাকাছি চলে গেছে।

একটু দাঁড়ান, যখন থাকতে চাইছেন না, কী আর করা যাবে। আপনাকে আপনার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি।

দীপেন বলল, দয়া করে একজন অচেনা লোকের জন্যে আপনি আর কষ্ট করবেন না। আমি একাই চলে যেতে পারব।

অচেনা কোথায়? পরিচয় তো হয়েই গেছে। সুকান্ত লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল কিন্তু আর আগেই দীপেন দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে।

আশ্চর্য লোক তো- সুকান্ত ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করে কয়েক লহমা দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ফিরে এসে তার সেই সোফাটায় বসল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, এত করে বললাম তবু থাকল না?

শমিতা অন্যমনস্কর মতো বলল, সে যখন থাকতে চাইছিল না তখন এত জোরাজুরি করার কী দরকার ছিল?

স্থির দৃষ্টিতে শমিতাকে লক্ষ করতে করতে সুকান্ত বলল, লোকটা হার্টের পেশেন্ট। তাই

পহেলগাঁওয়ে যে টুরিস্টরা বেড়াতে এসেছে, তাদের মধ্যে আরও কেউ কেউ এই ধরনের পেশেন্ট থাকতে পারে। তাদের রোগের খবর জানতে পারলে আমাদের স্যুইটে থাকতে দেবে নাকি? বলে আর দাঁড়াল না শমিতা। ভেতর দিকের রুমটায় চলে গেল।

অদ্ভুত মিহি একটা হাসির রেখা চকিতের জন্য সুকান্তর ঠোঁটে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।

২. রুম-সারভিসে ফোন

০৩.

রুম-সারভিসে ফোন করে ডিনার আনিয়ে নিয়েছিল সুকান্ত। সে লক্ষ করেছে ভালো করে খেতে পারেনি শমিতা। আঁচ করা যাচ্ছিল তার মধ্যে যেন তুমুল আলোড়ন চলছে। অন্যমনস্কর মতো খাবার নাড়াচাড়া করে একটু-আধটু মুখে তুলে সে উঠে পড়েছে।

সুকান্ত জিগ্যেস করেছে, কী হল, কিছুই তো খেলে না!

শমিতা বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না।

খাওয়ার জন্য জোরাজুরি তো করেইনি সুকান্ত। আর কোনও প্রশ্নও করল না।

ভেতরের বেডরুমটা বেশ বড়। মাঝখানে ডাবল-বেড খাটের গা ঘেঁষে একটা সিঙ্গল-বেড এমনভাবে সাজানো যাতে সুকান্তরা তিনজন পাশাপাশি শুতে পারে।

রুম হিটার থাকায় পুরো সুইটটাই বেশ গরম এবং আরামদায়ক। খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে সুকান্ত আর তাতান বেডরুমে চলে এল।

সুকান্ত লক্ষ করল, ডাবল-বেড খাটটার একধারে মাথা-মুখ-টুখ কম্বলে ঢেকে শুয়ে আছে শমিতা। শীতকালে আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে শোওয়া তার অভ্যাস।

সুকান্ত ধীরে ধীরে খাটে উঠে শমিতার পাশে শুয়ে পড়ল, তার এধারে তাতান। তারা দুজনেই গলা অবধি কম্বল টেনে দিল।

শিয়রের দিকে একটা নীচু টেবিলে কম পাওয়ারের টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। তার হালকা নরম আলোয় ঘরটা ভরে আছে।

সুকান্ত সামান্য কাত হয়ে নীচু গলায় জিগ্যেস করল, কী হল, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

হুঁ, বিরক্ত কোরো না। শমিতার কণ্ঠস্বর জড়ানো জড়ানো।

পনেরো মিনিটও হয়নি, ড্রইংরুম থেকে উঠে এসে শুয়েছে শমিতা। এর মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই হয় নাকি? নিশ্চয়ই জেগে আছে। সুকান্ত আর ডাকাডাকি করল না। দু-এক লহমা তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিল-ল্যাম্পটা নিভিয়ে চিত হয়ে শুল। এইভাবে শোওয়াটাই তার অনেককালের অভ্যাস।

সারা বেডরুম এখন অন্ধকারে ডুবে আছে। তার ওপর রুম-হিটারের উত্তাপ। সুকান্ত রীতিমতো ঘুমকাতুরে। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় ঘুমে তার দুচোখ জুড়ে এল। ওদিকে তাতানও জেগে নেই। ঘুমের ব্যাপারে বাবার ধাতটা পেয়েছে সে।

সুকান্ত যা আন্দাজ করেছিল ঠিক তাই। শমিতা ঘুমোয়নি।

পহেলগাঁওয়ের এই রাত একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু লিডার নদী অবিরল ঝুম ঝুম আওয়াজ তুলে বয়ে চলেছে। নদীর ওপারে গল্ফ ক্লাবের দিক থেকে মাঝে মাঝে কোনও রাতজাগা পাখি অদ্ভুত আওয়াজ করে ডেকে উঠছে। কাশ্মীরের এই পাখিটার নাম জানে না শমিতা। সুকান্ত তার পেশেন্ট, নার্সিংহোম ইত্যাদি নিয়ে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে সময় করে স্ত্রী এবং ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে। কোনওবার যায় অমরকন্টক, কোনওবার গোয়া, কোনওবার অজন্তা-ইলোরা, কখনো বা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোথাও। এইভাবে তাদের সফর চলে। দেশ-বিদেশে কত জায়গাতেই তো তারা বেড়াতে গেছে। কিন্তু অন্য কোথাও এমন বিষাদ-মাখানো পাখির ডাক কখনও শোনেনি শমিতা। কিন্তু পাখির ডাকাডাকি বা লিডার নদীর অবিরাম কলকলানি, কিছুই যেন তেমন শুনতে পাচ্ছিল না সে। ক্রমশ সেসব অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল আর সময়ের অদৃশ্য উজান টান পনেরো-ষোলো বছর আগের দিনগুলোতে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।

.

একসময় শমিতার বাবা চন্দ্রনাথ পালিত আর মা লতিকা পালিত থাকতেন লেক মার্কেটের লাগোয়া শরৎ ব্যানার্জি রোডে। ওটা কলকাতার সেরা একটা পশ এলাকা। চারিদিকে ঝাঁ-চকচকে নতুন নতুন হাইরাইজ, ঝকঝকে সব রাস্তা। চোখ-ধাঁধানো শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, রেস্তোরাঁ। উত্তর দিকে দু-পা গেলে দেশপ্রিয় পার্ক, দক্ষিণে লেক অর্থাৎ রবীন্দ্র সরোবর। গোটা অঞ্চলটা কসমোপলিটান। বাঙালি, গুজরাতি, মারাঠি, তামিল, কে নেই? কোনওরকম রাজনৈতিক আকচা-আকচি ছিল না। বোমাবাজি মারদাঙ্গার কথা ওখানেই কেউ ভাবতেই পারে না। খুবই শান্ত, ভদ্র পরিবেশ। এলাকার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষিত। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উঁচু উঁচু পোস্টে ছিলেন। এছাড়া কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, নামকরা চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, গায়ক, জনপ্রিয় অভিনেতা–এরকম অনেকে। সবাই এঁদের সন্ত্ৰমের চোখে দেখত।

শরৎ ব্যানার্জি রোডে তিন কামরার খোলামেলা, প্রশস্ত ফ্ল্যাটে পঁচিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন চন্দ্রনাথ এবং লতিকা। খুব উঁচু স্তরের অফিসার ছিলেন না চন্দ্রনাথ। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো সেকশনের ইনচার্জ। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসের টানটাও বেড়ে যাচ্ছিল। লতিকার পুতুল পুতুল চেহারা। সবসময় মুখে হাসি লেগে আছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নির্ঝঞ্ঝাট ভালোমানুষ।

লেকের কাছাকাছি এই জমকালো এলাকাটায় বাড়িভাড়া বরাবরই একেবারে আকাশ-ছোঁয়া। ভাড়ার অঙ্ক শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে।

পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো সেকশনের একজন ইনচার্জ যে এখানে এতকাল কাটিয়ে দিয়েছেন তার কারণ তিনি পুরোনো ভাড়াটে এবং বাড়িওয়ালা মানুষটি শান্ত-শিষ্ট গোছের। টাকাপয়সার খাই তাঁর ছিল না।

শরৎ ব্যানার্জি রোডের ওই বাড়িতেই শমিতার জন্ম। সেখানেই তার বড় হয়ে ওঠা। পাঠভবন স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর হিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে লেডি ব্র্যাবোন কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই সমস্যাটা দেখা দিল। বাড়িওয়ালা শিবনাথ মুখুজ্জে হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাকে মারা যেতে বিরাট সমস্যা দেখা দিল। নতুন বাড়িওয়ালা হয়ে বসল দিবাকর-শিবনাথ মুখুজ্জের একমাত্র ছেলে। সে বাপের ঠিক উলটো। শিবনাথের পারলৌকিক কাজ মিটে যাবার মাসখানেক বাদে দিবাকর এক ছুটির দিনে শমিতাদের ফ্ল্যাটে এসে হাজির। লেশমাত্র ভণিতা-উনিতা না করে সটান বলে ফেলল, ভাড়া বাড়াতে হবে। এতকাল যে টাকায় চন্দ্রনাথরা থেকে এসেছেন দিবাকরের দাবি তার আটগুণ। সেটা অনায্য বা বাড়াবাড়ি কিছু নয়। চন্দ্রনাথরা এগারোশো স্কোয়ার ফিটের তিন কামরার ভাড়া দিতেন দুহাজার। তখন দক্ষিণ কলকাতার ওই পশ এরিয়ায় ওই মাপের একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া কম করে ষোলো-সতেরো হাজার।

কিন্তু চন্দ্রনাথের মতো ছোটখাটো সেকশন ইনচার্জের পক্ষে মাসের শেষে এত টাকা গুণে দেওয়া অসম্ভব। অফিসে মাইনে তাঁর বেশ খানিকটা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু চাল ডাল তেল মশলা মাছ তরি-তরকারির দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে সংসার খরচও। তার ওপর পুরোনো শ্বাসকষ্টটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রচুর ওষুধ খেতে হয়। নেবুলাইজার নিতে হয়। সপ্তাহে কম করে দুদিন অক্সিজেন। সংসার এবং শমিতার পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি চিকিৎসার খরচ চালাতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছিল চন্দ্রনাথের। ওদিকে রিটায়ারমেন্টের বেশি বাকি নেই। মেরে কেটে তিন কি সাড়ে তিন বছর। দুহাজার টাকা ভাড়া দিতেন, সেটা যদি আচমকা ষোলো হাজারে চড়ে যায় বাকি চোদ্দো হাজার কোত্থেকে জোগাবেন? আচমকা মাথায় বাজ পড়ার মতো হাল। চোখে অন্ধকার দেখছিলেন চন্দ্রনাথ। হাতজোড় করে বলেছিলেন, আমি আর হাজারখানেক নাহয় দেব। আমার অবস্থা তো জানো, এর বেশি দিতে হলে না খেয়ে মরতে হবে। একটু করুণা করো।

কিন্তু হাজার কাকুতি-মিনতি করেও কাজের কাজ কিছুই হল না। দিবাকর তার দাবিতে অনড় রইল। হয় চন্দ্রনাথ ষোলো হাজার দেবেন, নইলে বাড়ি ছাড়তে হবে। দিবাকর অবশ্য পুরোপুরি অবিবেচক নয়। বাড়ি ছাড়ার জন্য চন্দ্রনাথকে সে দুমাস সময় আর নগদ দেড় লাখ টাকাও দিতে চেয়েছে।

দিবাকর হুকুমনামা জারি করেছে বলেই যে বাড়ি ছাড়তে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ভাড়াটেদের স্বপক্ষে অনেক জোরালো আইন-টাইন আছে। রেন্ট-কন্ট্রোল, লোয়ার কোর্ট, হায়ার কোর্ট ইত্যাদি। কিন্তু চন্দ্রনাথের মতো রুগ্ণ, শ্বাসকষ্টের পেশেন্টের পক্ষে এতসব ঝাক্কি পোয়ানোর মতো শক্তি বা এনার্জি কোনওটাই নেই তাঁর। মামলা-টামলা যে চালাবেন, তত টাকাই বা কোথায়? নিতনি ঝগড়ুটে, মামলাবাজ নন। খুবই নিরীহ, নিঝাট মানুষ।

দিবাকারের কথাতেই রাজি হতে হল চন্দ্রনাথকে। তবে অনেক বলেকয়ে বাড়ি ছাড়ার জন্য টাকার অঙ্কটা দেড় লাখ থেকে দুলাখ করে নিয়েছিলেন। তারপর শুরু হয়েছিল বাড়ি খোঁজা। কিন্তু দু-আড়াই হাজার টাকায় খাস কলকাতা শহরে একটা রোয়াকও মিলবে না।

শেষ পর্যন্ত এক দালাল ধরে পালপাড়ায় অম্বিকা পাল রোড়ে তিন হাজারে দুকামরার একটা ফ্ল্যাট পাওয়া গেল। শর্ত হল, দশ হাজার টাকা ডিপোজিট এবং আগাম দুমাসের ভাড়া। দালালের সঙ্গে বার তিনেক পালপাড়ায় গিয়ে বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে টাকাপয়সা মিটিয়ে রসিদ নিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ।

তার কদিন বাদে এক হেমন্তের বিকেলে একটা ম্যাটাডোর ভ্যানে সংসারের যাবতীয় মালপত্র বোঝাই করে পালপাড়ার দিকে রওনা হলেন চন্দ্রনাথ। পঁচিশ বছরে সেই তাঁদের প্রথম ঠিকানা বদল।

টালিগঞ্জের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আদিগঙ্গার শীর্ণ ধারাটির ওপর কংক্রিটের ছোট ব্রিজ পেরিয়ে বেশ খানিকটা যাবার পর পালপাড়া।

শমিতার মনে আছে, লটবহর বোঝাই ম্যাটাডোরটা আগে আগে চলছে। তার পেছনে একটা ট্যাক্সিতে তারা তিনজন। লম্বা ব্যাকসিটের মাঝখানে লতিকা, একধারের জানলার পাশে চন্দ্রনাথ, আরেক ধারের জানলার পাশে শমিতা। সে বাইরে তাকিয়েছিল। জন্মের পর থেকে উনিশ-কুড়ি বছর অবধি যে মেয়ে রবীন্দ্র সরোবরের পাশের ঝকঝকে পশ এলাকায় কাটিয়ে এসেছে তাকে কোন এক ধ্যাদ্দেড়ে, পালপাড়ায় গিয়ে থাকতে হবে, ভাবতেই কদিন ধরে মন খারাপ শমিতার। কিন্তু কিছুই করার নেই। তীব্র হতাশা, বিরক্তি এবং অসন্তোষ ভেতরে ভেতরে জমা হচ্ছিল। সেটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

ম্যাটাডোর ভ্যানের ড্রাইভারকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল পালপাড়ায় কোথায় যেতে হবে। এইরকম ভ্যানওয়ালারা সারা বছর কলকাতার এক মাথা থেকে আরেক মাথা তো বটেই, চারপাশের শহরতলি চষে বেড়াচ্ছে। এলাকা আর রাস্তার নাম জানিয়ে দিলেই হল; ঠিক পৌঁছে দেবে। গ্রেটার কলকাতার নাড়ি-নক্ষত্র তাদের জানা।

আগে আগে চলেছে ম্যাটাডোর ভ্যান, সেটার পেছনে শমিতাদের ট্যাক্সি।

একসময় টালিগঞ্জের চৌহদ্দি পেছনে ফেলে আদিগঙ্গার ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে খানিকটা যেতেই চন্দ্রনাথ বলেছেন, শমি, আমরা প্রায় এসে গেছি। আর চার-পাঁচ মিনিট গেলেই, ব্যস।

শমিতা উত্তর দিল না। জানলার বাইরে যেমন তাকিয়ে ছিল তেমনি তাকিয়ে রইল। এটাই যে পালপাড়া বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কেননা নতুন বাড়ি ঠিক করার পর চন্দ্রনাথ মেয়ে আর স্ত্রীকে এখানকার এমন নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন যে সেটা ছবির মতো মনে গেঁথে গেছে। গাড়ি পালপাড়ায় ঢোকার পর একবারও মনে হয়নি জায়গাটা অচেনা।

শমিতার চোখে পড়ছিল পালপাড়া পুরোপুরি শহরও নয়, আবার গ্রামও নয়। শহর এবং গ্রামের আধাখেঁচড়া মিশ্রণ। এখানে মিলিয়ে-মিশিয়ে পিচের রাস্তা যেমন রয়েছে তেমনি কটা কাঁচা রাস্তাও। যেতে যেতে যে কটা রাস্তা শমিতার চোখে পড়েছে সেগুলোর দুধারে লাইন দিয়ে সেকেলে একতলা, দোতলা। মাঝে মাঝে দু-চারটে জমকালো তেতলা কি চারতলা। টিনের বা টালির চালের বাড়ি একটাও না। এলাকাটার গায়ে প্রাচীনত্বের ছাপ মারা। শরৎ ব্যানার্জি রোড, লেক রোড, ল্যান্সডাউন রোড বা সাদার্ন অ্যাভেনিউ থেকে পালপাড়া আর কত দূরে? কিন্তু শমিতার মনে হল, তারা যেন মহানগর থেকে অনেক-অনেক দূরে আদ্যিকালের কোনও এক শহরে এসে পড়েছে। রাস্তায় লোকজন দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে তারা কয়েক পুরুষ ধরে বুঝি-বা এখানে রয়েছে।

কলকাতার উত্তরে-দক্ষিণে, পুবে বা পশ্চিমে তখন পুরোনো-গুরোনো সেকেলে বাড়ি-টাড়ি ভেঙে বিশাল বিশাল হাইরাইজ উঠতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, পাইকপাড়া, দমদম, সিঁথি, চেতলা, বেহালা-শহরতলির নানা অঞ্চল রাতারাতি বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে। গ্রেটার কলকাতার স্কাইলাইন। কিন্তু আশ্চর্য, কলকাতার লাগোয়া পালপাড়ার দিকে তখনও প্রোমোটার, ডেভলাপারদের নজর এসে পড়েনি।

চন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন। বেশি সময় লাগল না। ডাইনে-বাঁয়ে তিন-চারটে রাস্তা ঘুরে একটু পরেই ম্যাটাডোর ভ্যান আর ট্যাক্সিটা অম্বিকা পাল রোডে একটা সাদামাঠা দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল। বাড়িটার নম্বর বারো। সেটা একটা সাদামাঠা দোতলা। এরই একতলায় দুকামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন চন্দ্রনাথ।

দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক সুরেশ্বর চক্রবর্তী। ভ্যান আর ট্যাক্সি দেখে নেমে এলেন তিনি এবং তাঁর পরিবারের লোকজন। তা ছাড়া আশপাশের বাড়িগুলো থেকে অনেকেই চলে এসেছে।

সুরেশ্বরের বয়স পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি। এই বয়সেও মেদ-টেদ জমেনি। বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। তবে মাথার চুল একটাও কালো নেই। বেশ হাসিখুশি মানুষ। তাঁর স্ত্রী প্রতিমার রীতিমতো ভারী শরীর। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। একটি কুড়ি-বাইশ বছরের সুশ্রী তরুণী এবং বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের একটি বিবাহিতা মহিলাকে দেখা গেল। তার সিঁথি এবং কপালে সিঁদুর। তাদের সঙ্গে দু-তিনটি ছেলেমেয়েও দেখা গেল। তাদের বয়স তিন থেকে সাত।

সুরেশ্বর এবং প্রতিমা সম্পর্কে খুঁটিনাটি আগেই শমিতা আর লতিকাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ। তাই তাঁদের চিনতে অসুবিধা হল না শমিতার। কিন্তু তরুণী দুটি এবং বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সুরেশ্বরের কী সম্পর্ক তখনো জানা যায়নি।

সুরেশ্বর ব্যস্তভাবে ম্যাটাডোর আর ট্যাক্সির কাছে চলে এলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও। হাসিমুখে বললেন, আসুন, আসুন চন্দ্রনাথবাবু। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

ম্যাটাডোর থেকে ড্রাইভার এবং তার হেল্পার নেমে পড়েছিল। চন্দ্রনাথরাও নামলেন। সুরেশ্বর লতিকাকে দেখিয়ে বললেন, আপনি কে, বুঝতে পেরেছি। নমস্কার। বলেই শমিতার দিকে তাকালেন, তুমি নিশ্চয়ই মা জননী। নামটি কী তোমার মা?

শমিতা নাম বলল।

সুরেশ্বর বললেন, নিজেদের বাড়ি মনে করে এখানে থাকবে, কেমন? তারপর নিজের পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রতিমাকে দেখে আগেই বোঝা গিয়েছিল তিনি কে। যার কপালে আর সিঁথিতে সিঁদুর সে হল সবিতাসুরেশ্বরের ছেলের বউ। তরুণীটি তাঁর মেয়ে মানসী। বাচ্চাগুলো তাঁর নাতি-নাতনি-গলু, মিন্টু আর মামুন।

বাড়িটার সামনের দিকে এক চিলতে ফাঁকা ঘাসে ভরা জমি। ম্যাটাডোর ভ্যানের ড্রাইভার আর তার হেল্পার এর মধ্যে ঝপাঝপ চন্দ্রনাথদের মালপত্র–খাট, আলমারি, চেয়ার-টেবিল, গ্যাস-উনুন, বাসন-কোসন, আলনা ইত্যাদি নামিয়ে ফেলেছে।

সুরেশ্বর হাঁ হাঁ করে উঠলেন, এ কী! জিনিসগুলো এখানে ফেলে রাখলে যে! আমি বাবুদের ঘর খুলে দিচ্ছি। মাল সেখানে নিয়ে রাখো

ড্রাইভার রাজি হল না। ম্যাটাডোরের ভাড়া আগাম নেওয়া ছিল। সে ভ্যান চালিয়ে চলে গেল। এদিকে ট্যাক্সিওয়ালা তাড়া দিচ্ছিল। সে আর দাঁড়াতে পারবে না। তার ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া হোক। ভাড়া নিয়ে ট্যাক্সিতে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় নেমে নিমেষে সে উধাও হল।

চন্দ্রনাথ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। মহা মুশকিল হল। এত মাল কীভাবে ঘরে নিয়ে যাব?

সুরেশ্বর ভরসা দেবার সুরে বললেন, চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।

আশেপাশের বাড়ি থেকে যারা এসে জড়ো হয়েছিল তারাও সুরেশ্বরের সঙ্গে সুর মেলায়–আমরা তো আছি। জিনিসগুলো ঘরে নিয়ে যেখানে যেটা রাখতে বলবেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে দেব। আমরা থাকতে মাল বাইরে পড়ে থাকবে না।

একতলার কোণের দিকের দুকামরার ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলেন চন্দ্রনাথরা। সেটা তালাবন্ধ ছিল। সুরেশ্বর চাবি নিয়ে এসেছিলেন। তালা খুলে দিতেই প্রতিবেশী পুরুষ এবং মহিলারা কাজে নেমে পড়ল। এমনকী সুরেশ্বরের মেয়ে আর ছেলের বউও হাত লাগাল। ছোট ছোট জিনিসগুলো নিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা; ভারী ভারী আলমারি চেয়ার-টেবিল, খাট-টাট টানাটানি করতে একেবারে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল পুরুষ প্রতিবেশীরা।

ঠিক এইসময় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ভারী সুদর্শন একটি যুবক সাইকেল চালিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে প্রচুর লোকজন দেখে ঘাসের জমিটায় ঢুকে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সুরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বলল, কাকু, আপনার টেনান্টরা এসে গেছে মনে হচ্ছে।

সুরেশ্বর বললেন, হ্যাঁ। এই কিছুক্ষণ আগে।

তার বাহনটিকে এক কোণে দাঁড় করিয়ে যুবকটি এগিয়ে গেল। চন্দ্রনাথদের দেখিয়ে সুরেশ্বর বললেন, এই যে এঁরা। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন।

যুবকটির নাম দীপেন-দীপেন ঘোষ। রাস্তার মোড়ের মাথায় ছোট একতলা বাড়িটা তাদের। মা আর ছেলের ছোট্ট সংসার। বি.এসসিতে অনার্স নিয়ে দারুণ রেজাল্ট করার পর একটা টিউটোরিয়ালে পড়ায়। চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছে কিন্তু এখনও কিছু জোটাতে পারেনি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সুরেশ্বর চন্দ্রনাথের দিকে তাকালেন।–ছেলেটা খুবই পরোপকারী, হেল্পফুল, মানুষের বিপদে-আপদে

হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে দীপেন বলেছে, আর বলবেন না, কান লাল হয়ে উঠছে। কিন্তু ও কী, আমাদের পাড়ার লোকেরা মালপত্র টেনে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা

কারণটা বুঝিয়ে দিলেন সুরেশ্বর। যারা মালপত্র টানাটানি করছিল ওদিক থেকে তারা ডাকাডাকি শুরু করল, এই যে দীপু, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ালে চলবে না। এধারে আয়, আলমারি-টালমারিগুলোর ভীষণ ওয়েট। ঘাম ছুটে যাচ্ছে।

দীপেন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, পাঁচটা বেজে বারো। ছটায় আমার টিউটোরিয়াল ক্লাস। আধঘণ্টার বেশি থাকতে পারব না।

একটি মহিলা বলল, আধঘণ্টাই শ্রমদান করে যা। সেটুকুই যথেষ্ট।

হাসিমুখে এগিয়ে গেল দীপেন। বেশিরভাগ জিনিস আগে ঢোকানো হয়েছিল। বাকি কাজটুকু কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হল।

তারপর এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না দীপেন, সাইকেলে উঠে পড়তে পড়তে চন্দ্রনাথকে বলল, কোনও কিছুর জন্যে যদি আমাকে দরকার হয়, সুরেশ্বরকাকুকে বলবেন। উনি খবর দিলেই চলে আসব। ঘাসের জমিটুকু পেরিয়ে সাইকেলে স্পিড তুলে সে বেরিয়ে গেল।

পালপাড়ায় ভাড়াবাড়িতে উঠে আসার কথা যখন হচ্ছিল তখন থেকেই শমিতার মন খারাপ। সেদিন ট্যাক্সিতে আসার সময় ভেতরে ভেতরে একেবারে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু অম্বিকা পাল রোডে পৌঁছে কী ভালো যে লেগেছিল।

এতকাল তারা যেখানে কাটিয়ে এল তার বাইরের চেহারাটা যতই ঝাঁ-চকচকে হোক না, ওখানকার মানুষজন নিজেদের কেরিয়ার, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ইত্যাদি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত, এতটাই ডুবে আছে যে নিজস্ব ওই পরিধির বাইরে তাদের নজর যায় না। পাশাপাশি হয়তো বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু কেউ কারও খবর রাখে না। দেখা হলে আলগা একটু হাসি, কেমন আছেন, ভালো আছি ব্যস, এটুকুই।

কিন্তু পালপাড়ায় আসার পর চারপাশের মানুষজন যেভাবে ঝাঁপিয়ে এল, হাতে হাতে যেভাবে মালপত্র ফ্ল্যাটের ভেতরে নিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিল, অন্য কোথাও এমনটা ভাবা যায় না! চারপাশের শহরতলি নিয়ে তো গ্রেটার ক্যালকাটা। পালপাড়া তে তারই একটা অংশ। কলকাতার মধ্যে কতরকম কলকাতা যে আছে!

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে শমিতা। পালপাড়ায় এসে কত মানুষজন দেখল সে। তারা যথেষ্ট ভালোমানুষ, সহৃদয়। কিন্তু কেন যেন দীপেনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কতক্ষণ আর সে এখানে ছিল! মাত্র কয়েক মিনিট। যথেষ্ট সুপুরুষ, ভদ্র, বিনয়ী। যা কথা বলার চন্দ্রনাথের সঙ্গেই বলেছে। শমিতা জানে সে সুন্দরী। ছেলেরা তাকে দেখলে ছোঁক ছোঁক করে। কিন্তু দীপেন কেমন যেন নির্লিপ্ত। তার দিকে সেভাবে তাকায়ওনি। তবু সবাইকে ছাপিয়ে তাকেই মনে পড়ছে। মনের ব্যাপারটা বড় বেশি রহস্যময়। অনেক সময় কোনও কার্য-কারণ থাকে না, তবু কখন যে সেখানে কী ঘটে যায়।

ওদিকে গোছগাছ হয়ে গেলে আশপাশের বাড়ির মহিলা এবং পুরুষেরা আবার আসব বলে চলে গেল।

শমিতারা টুকরো ঘাসের জমির একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তী বললেন, চলুন, আপনাদের গৃহপ্রবেশটা হয়ে যাক। চন্দ্রনাথদের সঙ্গে করে কোণের ফ্ল্যাটটায় ঢুকলেন তিনি।

দুটো প্রশস্ত বেডরুম, মাঝারি আকারের একটা ড্রইংরুম। তা ছাড়া রয়েছে কিচেন। যেটুকু খুঁত তা হল একটাই মাত্র বাথরুম। জানলাগুলো কিন্তু বেশ বড় বড়। হেমন্তের শেষবেলাতেও খোলা জানলা দিয়ে দুটো ঘরেই বেশ আলো এসেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়াও আসছে।

সুরেশ্বর শমিতাকে জিগ্যেস করলেন, কী, বাড়ি পছন্দ হয়েছে?

একটু হেসে মাথা সামান্য কাত করল শমিতা।

সুরেশ্বরের হাতে ফ্ল্যাটের তালাচাবি রয়েছে। চন্দ্রনাথের হাতে সেগুলো দিয়ে বললেন, আপাতত, এগুলো আপনাদের কাছে থাক। লটবহর থেকে নিজেদের তালাচাবি বের হলে ওগুলো আমাদের ফেরত দেবেন। তার কিছু নেই। আপনারা এখন বিশ্রাম করুন। আমরা ওপরে গিয়ে চাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ বলেই স্ত্রীর দিকে তাকালেন। –চন্দ্রনাথবাবুরা কিন্তু রাত্তিরে আমাদের সঙ্গে খাবেন।

প্রতিমা হাসলেন। এই নিয়ে কম করে দশবার বললে। আমার মনে আছে, মনে আছে, মনে আছে।

শমিতার মা লতিকা সংকোচের সুরে বললেন, দিদি, আমাদের জন্যে অনেক করেছেন। আর কষ্ট করে রান্না চড়াবেন না। আমাদের সঙ্গে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ, গ্যাস-ট্যাস সব আছে। রাত্তিরে ভাতে-ভাত করে নেব।

প্রতিমা বললেন, চাল-ডাল আজ আর বের করতে হবে না। আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। কাল থেকে যা করার করবেন।

এত আন্তরিকতা তো উপেক্ষা করা যায় না। মৃদু হেসে লতিকা বললেন, আমাদের জন্যে

তাঁকে শেষ করতে দিলেন না প্রতিমা। দুই ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে থামিয়ে দিলেন।

সুরেশ্বর চক্রবর্তীরা চলে গেলেন। তাঁর মেয়ে মানসী কিন্তু থেকে গেল। শমিতাকে খুব সম্ভব তার ভালো লেগে গিয়েছিল। বলল, চলো, তোমার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করি।

বাড়ি বদল করা অর্থাৎ এক জায়গা থেকে শেকড় উপড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার ঝক্কি কি? শ্বাসকষ্টের রুগি চন্দ্রনাথ একটা ঘরে শুয়ে পড়েছেন। শ্বাস টানতে অস্বস্তি হচ্ছিল। লতিকা তাঁকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে পাশে বসলেন। ধীরে ধীরে কষ্টটা কমে এল চন্দ্রনাথের। শ্বাসপ্রশ্বাস ফের স্বাভাবিক হয়ে এল। কষ্টের লক্ষণ বুঝে কখন কোন ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে, কখন নেবুলাইজার বা অক্সিজেন দিতে হবে সব জানেন লতিকা। চন্দ্রনাথের ডাক্তার সমস্ত তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

ওদিকে শমিতা আর মানসী পাশের ঘরে গিয়ে জানলার ধারে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়েছে।

মানসী বেশ মিশুকে মেয়ে। চমৎকার কথা বলতে পারে। স্বভাবটা বেশ মিষ্টি। সে বলেছে, শুনেছি, তোমরা লেক মানে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে থাকতে

হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে শমিতা।

ওই জায়গা ছেড়ে এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর পালপাড়ায় এসে নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে?

আসার সময় সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগছিল। উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে শমিতা বলেছে, এখানকার মানুষগুলো খুব ভালো। এমন হেল্পফুল মানুষ আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে নেই বললেই হয়। আর তোমরা আমাদের জন্যে যা করলে

বা রে, আমরা পাশাপাশি থাকব, এটুকু তো করতেই হয়। এই পালপাড়াটা একটা বড় ফ্যামিলির মতো। শুধু আমরা কেন, পাড়ার একজনের দরকারে আরেকজন ছুটে আসে।

টুকটাক কিছু কথাবার্তার পর মানসী বলল, বাবার কাছে শুনেছি, তুমি মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট করেছিলে–

বুঝেছি, আমার বাবা নিশ্চয়ই তাঁকে বলেছে। তিনি বলেছেন তোমাদের। বাবা আমার সম্বন্ধে বলে বেড়াতে ভালোবাসে। বাবার ধারণা তার মেয়ের মতো মেয়ে ওয়ার্ল্ডে বেশি জন্মায়নি। দুটো পরীক্ষায় রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছিল। বলে লাজুক একটু হাসল।হঠাৎ আমার রেজাল্টের কথা জানতে চাইলে?

নিজে তো টায়টোয় সেকেন্ড ডিভিশনে ম্যাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিকের বেড়া ডিঙোতে পেরেছি। কেউ দুর্দান্ত রেজাল্ট করলে ভালো লাগে। তার সঙ্গে গল্প করতে, বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হয়।

শমিতা অবাক। অন্যের সাফল্যে, কৃতিত্বে খুশি হয়, এমন সোজা সরল ঈর্ষাহীন মেয়ে আগে আর দেখেনি সে। শমিতা তাকিয়েই থাকে।

মানসী বলতে লাগল, এই যে আমাদের পাড়ার দীপেনদা, সাইকেলে চেপে এসে পাড়ার লোকেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমাদের কটা জিনিস ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে গেল, বি.এসসি অনার্সে কী রেজাল্ট করেছিল জানো? ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। আমার কী আনন্দ যে হয়েছিল।

শমিতার একটু মজা করতে ইচ্ছা হল।–তার সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল বুঝি?

তার বলার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত ছিল। সরল, অকপট মেয়েটা বুঝে গেল। বলল, ধ্যাৎ, দীপেনদা আমার দাদা। কত ছোটবেলা থেকে দেখছি।

এই নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করল না শমিতা।

মানসী বলতে লাগল, তুমি তো কলেজে পড়ো। কোন কলেজ?

লেডি ব্রাবোর্ন

চোখ কপালে উঠে গেল মানসীর। বাব্বা, ওই কলেজে পড়ার কথা ভাবতেই পারি না। হরিদাসী সমাজপতি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল থেকে যা রেজাল্ট করে বেরিয়েছি তাতে লেডি ব্র্যাবোর্নের দারোয়ান আমাকে গেট পেরুতে দেবে না। পড়া তো দূরের কথা! হায়ার সেকেন্ডারিটা উতরে যাবার পর স্বর্ণময়ী গার্লস কলেজ-এর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারিকে ধরাধরি করে বি.এ-তে পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ

মানে?

দুটো বছর নষ্ট হয়ে গেল।

মানসী কি ফেল-টেল করেছে? জিগ্যেস করতে গিয়ে থমকে গেল শমিতা।

উত্তরটা মানসীই দিল। একবার ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার যে পরীক্ষাটা হয় তার আগে আগে হল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। তারপরের বারও বাধা পড়ল। এবার টাইফয়েড। বি.এ ফাইনালটা আমার বোধ হয় আর দেওয়া হবে না। তার চোখে-মুখে নৈরাশ্য ফুটে ওঠে।

শমিতা ভরসা দেবার সুরে বলল, হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? অসুখ-বিসুখ তো মানুষের হয়ই। তোমার বেলায় পরীক্ষার সময় দুবার হয়েছে বলে বার বার যে হবে তাই কখনও হয় নাকি? এবার পরীক্ষার আগে সাবধানে থাকবে। ডাক্তারের অ্যাডভাইস মতো চলবে। কোনও প্রবলেম হবে না।

একটু ভেবে মানসী বলল, তুমি কোন মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছ?

ইংলিশ। সেই কেজি লেভেল থেকে। কেন?

মানসী কেমন যেন মুষড়ে পড়ল।–আমার মিডিয়াম বেঙ্গলি।

তাতে কী হয়েছে?

আজকাল সব মেয়েই চাকরি-বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি করব। কিন্তু বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি। ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে পারি না। চাকরি ইম্পসিবল–

এক কাজ কর।

কী?

স্পোকেন ইংলিশের একটা কোর্স করে নাও। ইংরেজিটা ভালো বলতে পারবে।

মানসীর চোখে-মুখে উৎসাহ ঝিলিক দিয়ে ওঠে।-রাসবিহারীর মোড়ে একটা স্পোকেন ইংলিশের স্কুল আছে। দু-চারদিনের মধ্যে ভর্তি হয়ে যাব। তুমি আমাকে হেল্প করবে তো?

নিশ্চয়ই।

.

শমিতারা পালপাড়ার আসার পর সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। এলাকার লোকজন হইহই করে তাদের মালপত্র ফ্ল্যাটের ভেতর মোটামুটি গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের গোছানোটা পুরোপুরি মনঃপূত হয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়। ড্রইংরুমের সোফাগুলো মাঝখানে টেনে এনে, ডাইনিং টেবিল আর চেয়ারগুলো একধারে সরিয়ে, অন্য কিছু কিছু জিনিস এদিকে-ওদিকে রেখে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে শমিতারা।

দিন তিনেক কলেজ কামাই হয়েছে শমিতার। চন্দ্রনাথ পাঁচদিন অফিসে যেতে পারেনি। তারপর শমিতার কলেজে আর চন্দ্রনাথের অফিসে যাওয়া শুরু হয়েছে। চন্দ্রনাথের অফিস ডালহৌসিতে। আদিগঙ্গার ওপরের ব্রিজটা পেরিয়ে ওধারে গেলেই বাস স্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে চড়ে বসলেই হল, এক বাসেই অফিস। শরৎ ব্যানার্জি রোডে থাকতে শমিতার কোনওরকম সমস্যা ছিল না। ওখান থেকে হেঁটে গোলপার্কে এসে দুশো চল্লিশ নম্বর বাসে উঠলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভেতর কলেজে পৌঁছোনো যেত। কিন্তু পালাপাড়া থেকে কম করে দু-তিনবার বাস বা মিনিবাস পালটাতে হয়।

এদিকে সুরেশ্বর, প্রতিমা, সবিতা মাঝে মাঝেই নীচে চলে আসেন। সুরেশ্বর এর মধ্যে শমিতার জেঠু হয়ে গেছেন, প্রমিতা জেঠিমা, আর সবিতা বউদি। শুধু তাঁরাই নন, পাড়ার আরও অনেকেই, পুরুষ বা মহিলা এসে খোঁজখবর নিয়ে যান। এঁদের সবার সঙ্গে অল্পদিনেই বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে। এঁরা কেউ শমিতার কল্যাণী মাসি, কেউ সুধা কাকিমা, কেউ গোপা বউদি, কেউ বা পরিমলদা ইত্যাদি। কিন্তু সেই প্রথম দিনের পর দীপেন তো আসেইনি; রাস্তায়-টাস্তায় তাকে দেখা যায়নি।

পালপাড়ায় এসে ঘর-টর গোছগাছ করে নেওয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাতেই সব ঝক্কি শেষ হয়ে যায় না। বাড়ি বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুতে পুরোনো ঠিকানা বদল করে নতুন ঠিকানা বদলাতে হয়। যেমন রেশন কার্ডে, ভোটার আই ডি কার্ডে। নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার রান্নার গ্যাসের ডিলারকে গিয়ে কাগজপত্র দিয়ে বলতে হয় কোন ঠিকানায় গ্যাস সাপ্লাই করতে হবে। যারা অফিসে কাজ করে তাদের কর্মক্ষেত্রে নতুন ঠিকানা জানাতে হয়। যারা স্কুলে-কলেজে পড়ে তাদেরও তা-ই করতে হয়।

শমিতার মনে পড়ে, পালপাড়ায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই সুরেশ্বর চক্রবর্তীদের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও নিবিড় হয়েছিল। সুরেশ্বরকে সে জেই বলতে শুরু করেছে, তাঁর স্ত্রীকে জেঠিমা। সুরেশ্বরের মেয়ে এবং ছেলের বউ চন্দ্রনাথ আর লতিকাকে ডাকে কাকা আর কাকিমা। এর মধ্যে জানা গেছে সুরেশ্বরের ছেলে অনুপম কানপুরের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। ছুটিছাটায় মাঝে মাঝে এসে দশ-পনেরো দিন করে কাটিয়ে যায়। আর সুরেশ্বর স্টেট গভর্নমেন্টের ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে মাঝারি ধরনের অফিসার ছিলেন। রিটায়ারমেন্টের পর তাঁর হাতে তখন অফুরন্ত সময়। ওপর থেকে প্রতিমা, সবিতা, মানসীরা তো নীচে আসেই, চন্দ্রনাথের অফিসে যেদিন ছুটি থাকে, সেদিন আসেন সুরেশ্বর। বেশ মজলিশি মানুষ, জমিয়ে গল্প-টল্প করতে ভালোবাসেন।

শমিতার মনে আছে এক সপ্তাহ পর কী কারণে যেন বুধবার চন্দ্রনাথের অফিসে ছুটি ছিল। বিকেলের দিকে সুরেশ্বর এলেন। চা খেতে খেতে চন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

চন্দ্রনাথ হঠাৎ বলে উঠলেন, দাদা, কটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই

সুরেশ্বর উৎসুক চোখে তাকালেন।-হ্যাঁ হ্যাঁ, কী করতে হবে বলুন

কোথায় কোথায় ঠিকানা বদল করতে হবে, জানিয়ে চন্দ্রনাথ বললেন, শমির কলেজ আর আমার অফিসের ব্যাপারটা আমরা ঠিক করে নেব। কিন্তু বাকিগুলো আপনি ছাড়া গতি নেই। তা ছাড়া এখানে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।

খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন সুরেশ্বর। তারপর বললেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা আর গ্যাস সাপ্লাইয়ের অ্যাড্রেস চেঞ্জ করতে অসুবিধে হবে না। আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে ব্যবস্থা করে দেব। গ্যাস ডিলার আর যে ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্ট আছে তার ম্যানেজার আমার ছোট ভাইয়ের মতো। কোনও অসুবিধে হবে না। দু-চারদিনের মধ্যে সব হয়ে যাবে। তবে আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু

কিন্তু কী?

ভোটার আইডি কার্ড আর রেশন কার্ডের অ্যাড্রেস কীভাবে চেঞ্জ করতে হয়, আমার জানা নেই।

তা হলে?

কিছুক্ষণ ভেবে বলেছেন, চিন্তা নেই। দীপেনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তো

চন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেছে।হা হা, যেদি আমরা এখানে এলাম, একটি ছেলে সাইকেল চেপে যেতে যেতে আমাদের দেখে নেমে এসে পাড়ার অন্যদের সঙ্গে মালপত্র ধরাধরি করে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়েছিল, তার কথা বলছেন তো?

হ্যাঁ। ওর সঙ্গে নানা লেভেলের ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকজনের জানাশোনা আছে। ও ঠিক ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। আমি আজ রাত্তিরে ওর সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলব।

শমিতা একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, জেঠু, আপনি তো জানেন বাবা অসুস্থ মানুষ। ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভোগে। শরৎ ব্যানার্জি রোডে থাকার সময় আমাদের একজন হাউস ফিজিশিয়ান ছিলেন। খুব বড় ডাক্তার। তিনি বাবার চিকিৎসা করতেন। কিন্তু আমরা এতদূরে চলে এসেছি। আসার সময় তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম, কল দিলে তিনি এখানে আসবেন কিনা। ডক্টর দত্তগুপ্তর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বললেন, এতদুরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বাবার লাংসের সমস্যাটা মাঝে মাঝেই ভীষণ বেড়ে যায়। তাই কাছাকাছি থাকেন বা তাঁর চেম্বার আছে, এমন একজন ডাক্তার যে চাই।

সুরেশ্বর বললেন, ওটা নিয়ে সমস্যা হবে না। আদিগঙ্গার ব্রিজের ওপারে ডাক্তার মিত্রের বাড়ি। বাড়িতেই চেম্বার। এই এলাকার ধন্বন্তরি। আমার সঙ্গে জানাশোনা আছে। তবে দীপেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি। কারণ ডাক্তার মিত্রের ছেলে দীপেনের টিউটোরিয়ালের ছাত্র। ও ডাক্তার মিত্রকে বললে অনেক বেশি কাজ হবে।

.

পালপাড়ায় আসার দিন চোদ্দো-পনেরোর মধ্যে ব্যাঙ্কে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হল। রান্নার গ্যাসের ডিলারের কাছে গিয়ে পুরোনো কাগজপত্র জমা দিয়ে ঠিকানা বদল করা হল। চন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজ দুটো করে দিলেন সুরেশ্বর। বাকি রইল রেশন কার্ড আর ভোটার আই ডি কার্ড। সে দুটো করিয়ে দেবার কথা দীপেনের। ভোটের কার্ডে ঠিকানা বদলের জন্য চন্দ্রনাথকে স্থানীয় কাউন্সিলারের সুপারিশ, বাড়ি-ভাড়ার রসিদ ইত্যাদি নিয়ে যেতে হবে আলিপুরের অফিসে। আর নতুন রেশন কার্ডের জন্য যেতে হবে ফুড ডিপার্টমেন্টের অফিসে।

কিন্তু অফিসে প্রচণ্ড কাজের চাপ পড়ায় চন্দ্রনাথের পক্ষে ছুটি নেওয়া সম্ভব হল না। অগত্যা দুদিন কলেজ কামাই করে দীপেনের সঙ্গে আলিপুর আর ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে যেতে হল শমিতাকে। সে কলকাতার নামকরা কলেজে পড়ে, জীবনের প্রথম কুড়িটা বছর কাটিয়েছে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে দারুণ পশ একটা এলাকায়। সেখানকার অনেক ছেলেদের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিল। পুজোর সময় ওই অঞ্চলের অন্য মেয়েদের মতো ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে হই হই করেছে কিন্তু কোনওরকম বাধো বাধো ঠেকত না। এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না। কারণ তার জন্ম সেখানে। একসঙ্গে সবাই বড় হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়ে সবার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের।

শমিতা দারুণ স্মার্ট, দারুণ ঝকঝকে। গাঁইয়া মেয়েদের মতো আড়ষ্ট নয়। যথেষ্ট সাহসীও। কিন্তু আজন্মের চেনা একটা মহল্লা ছেড়ে নতুন একটা জায়গায় এসে খুব অল্প-চেনা এক যুবকের সঙ্গে আলিপুর বা ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে যেতে হবে ভাবতেই সামান্য অস্বস্তি যে হয়নি তা নয়।

তবে দীপেন শমিতার মনোভাবটা খুব সম্ভব আগেই আঁচ করে নিয়েছিল। সে তাকে ট্যাক্সিতে নিয়ে যাবার কথা বলেনি। অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে পাবলিক বাসে আলিপুরে এবং ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে নিয়ে গিয়েছিল। কারণটা বুঝতে পেরেছিল শমিতা। ট্যাক্সি নিলে তারা মাত্র দুজন থাকবে। কিন্তু বাসে অনেক মানুষ। সে যাতে অস্বাচ্ছন্দ্য-বোধ না করে সেজন্য পাবলিক বাসে যাওয়া।

শমিতা লক্ষ করেছে, প্রয়োজনের বেশি বাড়তি একটা কথাও বলেনি দীপেন। তার সম্বন্ধে কোনওরকম কৌতূহল দেখায়নি। কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি।

শুধু রেশন কার্ড আর ভোটার আই ডি কার্ডের ব্যবস্থা করে দেয়নি দীপেন; চন্দ্রনাথের চিকিৎসার ব্যাপারে একদিন শমিতাকে সঙ্গে করে এলাকার ধন্বন্তরি ডাক্তার মিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দিয়েছে।

মনে পড়ে যে যুবকটি নানা ব্যাপারে সাহায্য করেছে, তার কথাবার্তায়, আচরণে কোনও দিন এতটুকু বেচাল দেখা যায়নি; তার ওপর ক্রমশ নির্ভরতা বাড়ছিল। শুধু শমিতারই নয়, তাদের গোটা পরিবারেরই।

প্রথম প্রথম শমিতার সঙ্গে একটু দূরত্ব রেখেই চলেছিল দীপেন। কিন্তু দুজনেই তখন যে বয়সে পা রেখেছে তার নাম দুরন্ত যৌবন। কখন, কীভাবে ওরা পরস্পরের কাছাকাছি চলে এসেছে, অতকাল বাদে আর সেসব খুঁটিনাটি মনে নেই।

খবর না দিলে আগে দীপেন শমিতাদের বাড়ি আসত না। পরের দিকে যে-কোনও সময় চলে আসত। এমনকী তার মা মমতাও মাঝে মাঝে এসে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেতেন।

.

পালপাড়ায় বছর দেড়েক কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন দীপেন সন্ধের দিকে শমিতাদের বাড়ি এসে তাকে বলেছিল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।

শমিতা উৎসুক হল।–বেশ তো, বলো না

এখানে নয়। দেশপ্রিয় পার্কের লাগোয়া একটা রেস্তোরাঁর নাম করে দীপেন বলেছে, কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় ওখানে চলে এসো। আমিও ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।

ভুরু দুটো সামান্য তুলে মজা করে শমিতা বলেছে, কী এমন কথা যে অতদূরে গিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে বলতে হবে? অন্য কোথাও বলা যাবে না?

ওই রেস্তোরাঁটা নতুন খুলেছে। সি ফিশ আর চিকেনের আইটেমগুলো দারুণ বানায়। খেতে খেতে সুখবরটা দেব।

সুখবর! ভুরু আরও উঁচুতে উঠেছিল শমিতার।

হ্যাঁ।

তার মানে সুখাদ্যের সঙ্গে সুখবর?

এগজাক্টলি।

পরদিন রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে জানিয়ে দিয়েছিল দীপেন। কলকাতার একটা বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি তাকে ডেপুটি ম্যানেজারের পোস্টে চাকরির অফার দিয়েছে। স্যালারি ফর্টি ফাইভ থাইজেন্ড। তা ছাড়া অন্য সব পার্কর্স।

প্রথমটা অবাক। তারপর রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে শমিতা।- টিউটোরিয়ালের মাস্টারমশাই থেকে ম্যানেজার! ভাবা যায় না। এ তো অ্যামেজিং ব্যাপার। সবচেয়ে দামি লটারি পাওয়ার মতো ঘটনা। তা রূপকথার গল্পের মতো ঘটনাটা ঘটল কী করে?

দীপেন বলেছে, টিউটোরিয়ালে মাস্টারি করে কটা টাকা আর পাওয়া যায়! তোমাকে আগে জানিয়েছি কিনা মনে নেই। আমি টিউটোরিয়ালে পড়ানো ছাড়াও কলকাতার তিন-চারটে বিরাট বিরাট বড়লোকের বাড়িতে প্রাইভেট টিউশনও করি–

হ্যাঁ, জানিয়েছিলে।

যিনি আমাকে অফারটা দিয়েছেন তিনি জেনিথ কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক হরগোবিন্দ টোডি। তাঁর ছেলে আমার ছাত্র। ক্লাস সিক্স থেকে পড়াচ্ছি। এ বছরের জয়েন্টে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে সিঙ্গাপুরের একটা মেডিকেল কলেজে অ্যাডমিশন পেয়েছে। তাই

ছোঁ মেরে দীপেনের বাকি কথাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে শমিতা বলেছিল, তাই ভীষণ খুশি হয়ে মিস্টার টোডি তোমাকে এই অফরটা দিয়েছেন, তাই তো?

হেসে হেসে আস্তে মাথা নেড়ে দীপেন জানিয়েছে, ঠিক তাই। তারপর বলেছে,

কিন্তু

কী?

কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।

কেন?

কারণটা হল, তোমার কনসেন্ট তো পেতে হবে।

তার মানে?

আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সবই তো তোমাকে সমর্পণ করে বসে আছি তুমি যা ডিসাইড করবে সেটাই ফাইনাল।

শমিতা এত স্মার্ট, এত সপ্রতিভ, তবু তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁট টিপে চোখের কোণ দিয়ে দীপেনের দিকে তাকাতে তার চোখে-মুখে চাপা হাসি ফুটে উঠল।

দীপেন গাঢ় গলায় বলেছে, কী হল, কিছু বলছ না তো। শুধু ঠোঁট টিপে থাকলেই হবে?

তুমি একটা যাচ্ছেতাই

ঠিক আছে, আমি তাই। এখন বলে ফেলো—

মুখ নামিয়ে খুব মৃদু গলায় শমিতা শুধু একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করেছে,হুঁ–

যাক, কনসেন্ট মিলেছে। দু-একদিনের মধ্যে টোড়িজির সঙ্গে দেখা করে ফরম্যাল অ্যাপ্লিকেশনটা দেব–

মনে পড়ে, দীপেনের চোখ-মুখ থেকে খুশি যেন উপচে পড়ছিল। শমিতা নিজেও কি কম খুশি হয়েছে?

একটু চুপচাপ

তারপর দীপেন বলেছে, মাকে তোমার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা জানিয়েছি

শমিতা বলেছিল, আমার মা-বাবাও আমাদের ব্যাপারটা মনে হয় গেস করেছে।

কিছু বলেছেন নাকি?

না। তোমার ওপর মা-বাবার অগাধ বিশ্বাস। তোমাকে দুজনেই ভীষণ পছন্দ করে। তবু আমার ধারণা, কোথায় যেন ওদের একটা হেজিটেশন আছে।

দীপেন বলেছে, থাকাই উচিত।

মানে?

টিউটোরিয়ালে পড়াই, টিউশন করি। স্টেবল কোনও ইনকাম নেই। এরকম একটা ছেলের হাতে কোন বাপ-মা তাঁদের সুন্দরী, বিদুষী মেয়েকে তুলে দিতে চাইবেন? জেনিথ কনস্ট্রাকশন-এর অফারটার কথা জানলে খুব সম্ভব আপত্তি করবেন না। কী বলে?

তুমি খুব ধুরন্ধর। আ স্লাই ফক্স।

দীপেন হাসতে হাসতে বলেছে, মাকে কি ব্যাপারটা ফাইনাল করার জন্যে তোমাদের বাড়ি যেতে বলব?।

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শমিতা বলেছে, নো, নো, নট নাউ। আমার কিছু কন্ডিশন আছে।

হাসিটা ফিকে হয়ে গিয়েছিল দীপেনের।–কী কন্ডিশন?

আমি গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করব। তারপর স্কুল সারভিস কমিশনের একজামটা দেব। আমার একটা চাকরি চাই।

দীপেন অবাক। বলেছে, কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কত স্যালারি পাব, তোমাকে বলেছি। তারপর তোমার চাকরির দরকার কী?

শমিতা বেশ জোর দিয়ে বলেছে, প্রতিটি মেয়ের ফিনান্সিয়ালি স্বাবলম্বী হওয়াটা ভেরি ভেরি ইস্পটান্ট–

দীপেন বুঝতে পারছিল, টেবিলের ওপারে যে মেয়েটি বসে আছে তার মধ্যে প্রচণ্ড দৃঢ়তা রয়েছে। সে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখান থেকে তাকে টলানো যাবে না। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে সে। তারপর বলেছে, অলরাইট, তুমি যা ঠিক করেছ তাই হবে।

.

জীবন নিজের নিয়মে তার নির্ঘণ্ট আগে থেকেই বোধ হয় ঠিক করে রাখে। দেখতে দেখতে বেশ কটা ঘটনা ঘটে গেল। দীপেন চাকরিতে জয়েন করার পর বছর দুই কেটে গেছে। শমিতা বি.এ পার্ট ওয়ানে ফাস্টক্লাস পাওয়ার পর কয়েক মাস পেরুল। আর কিছুদিনের মধ্যে পার্ট টু ফাইনাল। চন্দ্রনাথের রিটায়ারমেন্টের আর মাত্র চার মাস বাকি।

দীপেন সকালের দিকে অফিসে বেরিয়ে যায়। তখন ভীষণ তাড়াহুড়ো থাকে, তাই শমিতাদের বাড়ি আসতে পারে না। কিন্তু সন্ধের পর এসে দু-আড়াই ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। জরুরি কিছু করার থাকলে করে দেয়। এইভাবেই চলছিল।

হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে নিম্নচাপের কারণে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে বাড়ি ফিরলেন চন্দ্রনাথ। শ্বাসকষ্টের রুগি, শীত আর বর্ষাকালটা তাঁর পক্ষে মারাত্মক। হিম এবং বৃষ্টি চন্দ্রনাথের একেবারেই সহ্য হয় না।

সেদিন মাঝরাত থেকে শ্বাসকষ্টটা প্রচণ্ড বেড়ে গেল। বাড়িতে যে ওষুধ-টোষুধ ছিল তাতে বিশেষ কাজ হল না। বুকের ভেতর থেকে অনবরত সাঁই সাঁই আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল চন্দ্রনাথের।

সেই মধ্যরাতে কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না শমিতারা। একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত দোতলা থেকে সুরেশ্বরকে ডেকে আনা হল। তিনি রুগির হাল দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, এখনই ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু তোমাদের বা আমাদের কারও টেলিফোন নেই। ডাক্তার মিত্রকে কী করে কল করব? একটু ভেবে বলতে লাগলেন, আমি দীপুদের বাড়ি যাচ্ছি। ওর নতুন অফিস। অফিস থেকে টেলিফোন লাগিয়ে দিয়েছে। দীপু নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। পালপাড়ায় বেশিরভাগ রাস্তাতে সেই সময় টিম টিম করে মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলত কিন্তু কী কারণে যেন অম্বিকা পাল রোড এবং আশপাশের রাস্তাগুলোর সব স্ট্রিটল্যাম্প নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুরেশ্বর একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। মিনিট দশ-পনেরো পর ফিরে এসে জানিয়েছিলেন, দীপেন ডাক্তার মিত্রকে ফোন না করে সাইকেলে চেপে সোজা তাঁর বাড়ি চলে গেছে।

প্রায় মিনিট চল্লিশেক বাদে ডাক্তার মিত্রকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল দীপেন। এত রাতে কোনও ডাক্তারই রুগির বাড়ি যেতে চান না। ডাক্তার মিত্র যে এসেছিলেন তা দীপেনের কাকুতি-মিনতিতে।

চন্দ্রনাথকে ভালো করে পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তার মিত্রের মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছেন, পেশেন্টের বহুদিনের ব্রিদিং টাবল তো রয়েছে, তার ওপর জ্বরও হয়েছে। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখা গেল–একশো চার ডিগ্রির কাছাকাছি।

ডাক্তার মিত্র এবার বলেছিলেন, পেশেন্টের যা কন্ডিশন তাতে ইমিডিয়েটলি নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে। কয়েকটা টেস্টের পর প্রপার টিটমেন্ট শুরু হবে।

সেদিন রাতে সম্ভব হয়নি। পরদিন অফিসে গেল না দীপেন। শমিতারও কলেজে যাওয়া হল না। সকালে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সাদার্ন অ্যাভেনিউর একটা নার্সিং হোমে তারা চন্দ্রনাথকে ভর্তি করে দিল। ডাক্তার মিত্র এই নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত।

টেস্ট হয়ে যাবার পর জানা গেল চন্দ্রনাথের বরাবরের দুর্বল ফুসফুসে একটা ইনফেকশন অর্থাৎ নিমুনিয়ার সংক্রমণ হয়েছে। তার বৃষ্টিতে ভেজার ফল।

দিন পনেরো নাসিংহোমে কাটাতে হল চন্দ্রনাথকে। বেশিরভাগ সময়টাই আই সি ইড-তে। এ সময়টা মাত্র কয়েক ঘণ্টা অফিসে কাটিয়ে বাকি সময়টা নার্সিংহোমে পড়ে থাকত দীপেন। শমিতা কলেজে যেতে চাইত না। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিত সে। বলত, আমি এদিকটা দেখছি! তোমার পার্ট টু-র একজামের দেরি নেই। ক্লাস কামাই করলে রেজাল্ট খারাপ হবে।

বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী, মেয়ে, ছেলের বউ এবং অম্বিকা পাল রোডের প্রতিবেশীদের অনেকেই রোজ নাসিংহোমে এসে চন্দ্রনাথের খবর নিয়ে যেত। আশ্চর্য সব মানুষ। সবসময় তারা শমিতাদের পাশে পাশে থেকেছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত চন্দ্রনাথ বাঁচলেন না। ডাক্তার মিত্র এবং তাঁর টিম দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন ঠিকই কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকানো গেল না।

.

শমিতার মনে পড়ে, বাবার মৃত্যুতে মা একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সে নিজেও কম ভেঙে পড়েনি। এই সময়টা অফিসে ছুটি নিয়ে তাদের আগলে আগলে রেখেছে দীপেন। প্রতিবেশীরাও পাশেই থেকেছে।

এর মধ্যেই চন্দ্রনাথের পারলৌকিক কাজ অর্থাৎ শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ মিটে গেল।

শোকের তীব্রতা চিরকাল একইরকম থাকে না। ধীরে ধীরে তা কমে আসে।

শরৎ ব্যানার্জি রোডের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় যে দুলাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া গিয়েছিল, নার্সিংহোমের বিল মেটাতে তার পুরোটা তো গেছেই, তার ওপর জমানো আরও বেশ কিছু বেরিয়ে গেছে।

দীপেনের সব দিকে নজর। শমিতাকে সঙ্গে করে সে চন্দ্রনাথের অফিসে ছোটাছুটি করে তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচুয়িটির টাকা আদায় করেছিল। বিধবা হিসেবে যে পেনশন লতিকার প্রাপ্য তা নিয়মিত পাওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। পি এফ এবং গ্র্যাচুয়িটির টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে শমিতারা মান্থলি ইন্টারেস্ট নিতে শুরু করেছিল। লতিকা যা পেনশন পান তাতে বাড়িভাড়া, তার পড়ার খরচ মিটিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব। কেন না চাল-ডাল আটা-ময়দা আনাজ মাছ-টাছের দাম তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল।

শমিতার মনে পড়ে চন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এক বছর অর্থাৎ কালাশৌচ কাটতে-না-কাটতেই তার পার্ট টু-র রেজাল্ট বেরুক্ল। চন্দ্রনাথের বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থতা, নার্সিং হোমে দিনের পর দিন ছোটাছুটি, সারাক্ষণ উকণ্ঠা, বাবার মৃত্যুশোক–এত সবের মধ্যেও ফার্স্ট ক্লাসটা পেয়ে গিয়েছিল শমিতা।

দীপেন অপেক্ষা করছিল। বলেছে, গ্র্যাজুয়েশনটা হয়ে গেল। রেজাল্ট বেশ ভালো হয়েছে। আর ডিলে কোরো না। আমার মা খুব উতলা হয়ে উঠেছে। খুব সম্ভব তোমার মা-ও।

দীপেন কী ইঙ্গিত দিয়েছিল বুঝতে অসুবিধা হয়নি। শমিতা বলেছে, আরও দু-আড়াই বছর ওয়েট করতে হবে যে

কেন? দীপেন রীতিমতো অবাক।

বি.এড-টা করে নিতে হবে না? স্কুল সারভিসে ওই ডিগ্রিটা ভেরি ভেরি ইম্পর্টান্ট।

দীপেনের চোখে-মুখে হতাশা ফুটে বেরিয়েছে।–এখনও আড়াই বছর?

তার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে শমিতা বলেছে, আড়াই বছর তো কতটুকু সময়। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

হতাশাটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না দীপেন।–বি.এড-এর পর এম.এ-টা দেবার জন্যে খেপে উঠবে—

আরে না না, বি.এড আর স্কুল সারভিস কমিশনের একজাম ইহজীবনে এই দুটোতেই আমার পড়াশোনার এন্ড। তারপর তো মাস্টারনি হয়ে বসব।

তোমাকে বিশ্বাস নেই।

নিষ্পাপ, সরল বালিকার মতো কলকল করে হাসতে শুরু করেছিল শমিতা। কলকলানি আর থামতেই চায় না। এমন মজার কথা আগে যেন কখনও শোনেনি সে।

দীপেন বলেছে, আমার একটা কথা শুনবে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না

বিয়ের পরও তো বি.এড, স্কুল সারভিস কমিশন, ইচ্ছে করলে এম.এ পরীক্ষাতেও বসতে পারো। বাড়ির কোনও ঝামেলা-ঝঞ্জাট তোমাকে পোয়াতে হবে না, কোনও রেসপনসিবিলিটি নিতে হবে না। ক্লাস করবে, পরীক্ষার প্রিপারেশন ছাড়া অন্য কোনও দিকে তাকাতে হবে না। ব্যস

শমিতা বলেছে, তা হয় নাকি? তুমি তো মেয়ে নও, তাই বুঝতে পারবে না। বিয়ের পর মেয়েদের জীবন টোটালি বদলে যায়। নতুন একটা সংসার তখন তার। সবসময় তার মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকবে। এটা করতে পারলাম না, ওটা করতে পারলাম না। মেয়েদের এ হল ইনস্টিংক্ট। পড়াশোনা আর সংসার একসঙ্গে কোনওটাই ঠিকমতো করা হবে না। মোটে আড়াইটা তো বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

দীপেন কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়েছে শমিতা।–প্লিজ

বাইরে থেকে দেখলে শমিতাকে ভারী নরম আর হাসিখুশি মনে হয়। কিন্তু দীপেন ততদিনে জেনে গেছে শমিতার মধ্যে অনমনীয় একটা কাঠিন্য রয়েছে, নাকি একরোখা জেদ? সেটা কোনও ভাবেই নোয়ানো যায় না।

আড়াই বছর পর আর অপেক্ষা করতে হয়নি দীপেনকে। তাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।

দীপেনের কনস্ট্রাকশন কোম্পানির হেড অফিসটা ল্যান্সডাউন রোডে। তার কাজের চাপ ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। অফিসে তো বটেই, কলকাতা এবং তার চারপাশে যে-সব আকাশছোঁয়া হাইরাইজ উঠেছিল সেইসব সাইটেও তাকে যেতে হয়। পালপাড়া থেকে যাতায়াত করে এত সব সমলাতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। তাই কোম্পানি সাদার্ন অ্যাভেনিউতে তাকে থাকার জন্য একটা থ্রি বেডরুমের পনেরোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট দিয়েছিল।

বিয়ের পর সেখানে চলে আসে দীপেন আর শমিতা। দুজনেই তাদের মা লতিকা এবং মমতাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। দীপেনের মা হলেন মমতা। কিন্তু লতিকা পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ; তিনি মেয়ে-জামাই-এর কাছে এসে থাকতে রাজি হননি। মমতাও আসেননি। পালপাড়ার বাড়িতে যেখানে মৃত স্বামীর অসংখ্য স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সেসব আঁকড়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান।

এদিকে স্কুল সারভিস কমিশনের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গিয়েছিল। এই পরীক্ষাতেও দারুণ রেজাল্ট করেছে শমিতা। তিন মাসের মধ্যে দমদমে একটা নামকরা স্কুলে চাকরিও পেয়ে গেল সে। স্কুলে ছুটিছাটা অনেক বেশি। ছুটির দিনগুলো শমিতা মা আর শাশুড়ির কাছে গিয়ে কাটিয়ে আসত। কিন্তু দীপেনের অফিসে প্রচণ্ড প্রেশার, তাই সে পালপাড়ায় খুব বেশি যেতে পারত না। এইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল।

.

মনে পড়ে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে আসার পর সে আর দীপেন যেন একটা স্বপ্নের উড়ানে উঠে ভেসে বেড়াচ্ছিল। দিনগুলো বড়ই সুখের।

বছর দেড়-দুই কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে এসে ড্রইংরুমের সোফায় অ্যাটাচি কেসটা ছুঁড়ে দিয়ে বসতে বসতে দীপেন বলেছিল, শমি, তোমাকে একটা দুর্দান্ত খবর দেব। তার চোখ-মুখ থেকে উত্তেজনা এবং উল্লাস যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল।

শমিতা বলেছে, আগে বাথরুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো। চা-টা খাও। তারপর তোমার দুর্দান্ত খবর শোনা যাবে।

না না, এক্ষুনি শুনতে হবে– শমিতার হাতে ধরে তাকে পাশে বসিয়ে দিতে দিতে দীপেন বলেছে, দারুণ একটা অফার এসেছে। চান্স অফ আ লাইফটাইম

উৎসুক চোখে দীপেনের দিকে তাকিয়ে শমিতা জিগ্যেস করেছে, কীসের চান্স?

দীপেন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। বলে যাচ্ছিল, আমাদের বাকি লাইফটা একেবারে পালটে যাবে। ড্রিম, বুঝলে ড্রিম।

কী আশ্চর্য, ড্রিম-টিম, লাইফ পালটে যাওয়া, সবই বুঝলাম। কীসের ড্রিম, কীসের লাইফ পালটাবে, তা কিন্তু এখনও বলোনি।

বলছি, বলছি–

এরপর দীপেন যা বলেছে তা এইরকম। জেনিথ কনস্ট্রাকশন-এর কাজ করতে করতে দীনদয়াল গুপ্তার সঙ্গে আলাপ। তিনিও রিয়েলটি বিজনেসে আছেন। তাঁর কোম্পানির নাম স্টার কনস্ট্রাকশন। কিছুদিন ধরেই তিনি দীপেনকে তার সানি পার্ক-এর বাড়িতে ডাকছিলেন। ব্যস্ততার কারণে যাওয়া যচ্ছিল না। আজ অফিসের প্রেশার কিছুটা কম থাকায় দীনদয়াল গুপ্তকে ফোন করে সানি পার্কে চলে গিয়েছিল। দীনদয়ালজি নতুন আরেকটা ফার্ম খুলতে চান। নামও ঠিক করে ফেলেছেন। সুইট হোম। তিনি চান তাঁর এই নতুন ফার্মে দীপেন জয়েন করুক।

শমিতা মন দিয়ে শুনে যাচ্ছিল। বলেছে, দীনদয়াল গুপ্তার তো একটা কোম্পানি আছে। তার ওপর আরও একটা! মানে

হেসে হেসে দীপেন বলেছে, মানুষের অ্যাম্বিশনের কি শেষ আছে! রিয়েল এস্টেটের বিজনেস এখন রমরম করে চলছে। ফ্ল্যাটের ডিমান্ড যতটা, সাপ্লাই তার চেয়ে অনেক কম। পুরোনো ফার্ম তো রয়েছেই, তার পাশাপাশি নতুন একটা খুললে আরও প্রফিট, কোটি কোটি টাকা

কিন্তু

কীসের কিন্তু?

তুমি জেনিথ কনস্ট্রাকশনে আছ। টোডিজি তোমাকে এত ভালোবাসেন। প্রচুর টাকা স্যালারি দেন। সেই সঙ্গে কতরকম পার্ক, থাকার জন্যে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে এত বড় ফ্ল্যাট। স্কুলে চাকরি এখন আর আগের মতো নেই। আমি ভালো একটা অ্যামাউন্ট পাই। দুজনের যা ইনকাম, কটা মিডল ক্লাস ফ্যামিলি তো ভাবতে পারে? আমার

শমিতাকে থামিয়ে দিয়ে দীপেন বলছে, সবটা আগে শুনে নাও

ঠিক আছে, বলো–

নতুন কোম্পানিতে আমি একজন এমপ্লয়ি হয়ে থাকব না। ইনভেস্টমেন্ট যা করার তার পুরোটাই করবেন দীনদয়ালজি। আমি হব তাঁর ওয়ার্কিং পার্টনার। প্রফিটের টেন পারসেন্ট আমার। কেয়াতলায় আমাদের থাকার জন্যে দীনদয়ালজিদের একটা নতুন বিল্ডিংয়ের পুরো একটা ফ্লোর পাওয়া যাবে।

মনটা খুঁতখুঁত করছিল শমিতার। দুজনের যা দরকার, প্রয়োজনের তুলনায় সেই অঙ্কটা পাঁচ-ছগুণ বেশি। এর বেশি টাকা দিয়ে কী হবে? সে জিগ্যেস করেছে, দীনদয়ালজি তোমার খবর পেলেন কী করে?

রিয়েল এস্টেট এমন এক বিজনেস, কে কোন কোম্পানিতে কী ধরনের সারভিস দিচ্ছে অন্যেরো তার খবর রাখে।

কিন্তু টোডিজি কী মনে করবেন?

দেখো, যে সুযোগটা আচমকা এসে গেছে বাকি লাইফটাইমে সেটা আর সেকেন্ড টাইম আসবে না। এটা আমি ছাড়তে পারি না। আর টোডিজির কথা বলছ তো?

হ্যাঁ।

ওঁকে আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি চিনি। উনি আমাকে কোত্থেকে কোথায় তুলে এনেছেন, সবসময় আমার তা মনে আছে। যতদিন বেঁচে আছি, মনে থাকবে। আমি চাইলে আরও কয়েক হাজার টাকা মাইনে নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু কোনওদিনই আমাকে ওঁর কোম্পানির পার্টনার করে নেবেন না।

একটু চুপচাপ।

তারপর ফের শুরু করলেন দীপেন।–জেনিথ কনস্ট্রাকশন ছাড়ার আগে আমি টোডিডির সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আশা করি তাঁর অনুমতি পাওয়া যাবে।

.

শমিতার মনে আছে, দীনদয়াল গুপ্তার অফারটা আসার একমাসের মধ্যে তারা কেয়াতলায় উঠে গিয়েছিল। এটাও লেকের কাছাকাছি। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকা। দীপেনও সুইট হোম-এ জয়েন করেছে। উৎসাহে তখন সে টগবগ করে ফুটছে। সকাল সাতটা-সাড়ে-সাতটায় বেরিয়ে যায়; ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা।

বছরখানেক এভাবেই চলল। মুখের কথায় তো একটা কোম্পানি দাঁড়ায় না। তার পেছনে থাকে অনেক পরিকল্পনা, প্রচণ্ড পরিশ্রম। প্রতিটি স্টেপ হিসেব করে ফেলতে ফেলতে এগোতে হয়। ক্যালকুলেশন বা প্ল্যানিংয়ে ভুল-ত্রুটি থাকলে সমস্ত ব্যাপারটা ডানা ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়বে। তার আর আকাশে ওড়া হবে না।

মনে পড়ে একটা বছর কিংবা আর একটু বেশি সময় লেগেছিল। তারপর সুইট হোম-এর উড়ান শুরু হল। বিল্ডিং তৈরি হয় সেরা মেটিরিয়াল দিয়ে, ফ্ল্যাটের মাপের মধ্যে কারচুপি নেই, যে তারিখে ফ্ল্যাট ডেলিভারি দেবার কড়ার করা হয়, ঠিক সেই তারিখেই দেওয়া হয়। ক্লিন বিজনেস সুইট হোম শুরুতেই ব্র্যান্ড নেম হয়ে উঠল। এতটাই সুনাম ছড়িয়ে পড়ল যে এই শহরের তো বটেই, ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডা থেকে অনেক প্রবাসী বাঙালি অন-লাইনে ফ্ল্যাট বুক করতে লাগল। রিটায়ারমেন্টের পর দেশে ফিরে বাকি জীবন এখানেই তারা কাটিয়ে দিতে চায়।

সেই সঙ্গে টাকাও আসতে লাগল অঢেল। আর এই বিপুল অর্থই দীপেন আর শমিতার জীবনটাকে আগাগোড়া ভেঙেচুরে খান খান করে দিল।

আগে মাঝে মাঝে দু-একটা সিগারেট-টিগারেট খেত দীপেন। কিন্তু কেয়াতলায় আসার কিছুদিন পর থেকে ফ্যামিলি ডিসিপ্লিন বলতে বিশেষ কিছুই আর টিকে থাকল না। রাত্তিরে কখন বাড়ি ফিরবে তার ঠিক নেই। কোনওদিন দীপেন ফিরত বারোটা কি একটায়। কোনও দিন তারও পরে। তার মুখ থেকে মদের গন্ধ পাওয়া যেত। মদ্যপানটা শমিতার ঘোর অপছন্দ। মাতালদের সে প্রচণ্ড ঘৃণা করত। সেটা জানা ছিল দীপেনের। তাই বাড়াবাড়ি রকমের ড্রিংকটা করত না। তবু যতটা সম্ভব সতর্ক হয়েই বাড়ি ফিরত। কিন্তু ঠিক ধরা পড়ে যেত।

শমিতা বলত, ড্রিংকু শুরু করলে! এ তো আমি ভাবতেই পারি না।

কাঁচুমাচু মুখে সাফাই দিত দীপেন, আমাদের যা কাজ তাতে প্রায় রোজই পার্টি লেগে থাকে। এই দু-এক সিপ। বিজনেসের জন্যে এটুকু না করলে

আগে যে সতর্কতা বা সংকোচ ছিল, পরে আর তা রইল না। বেপরোয়া ভঙ্গিতে বেহেড মাতাল হয়ে টলতে টলতে মধ্যরাতে কিংবা শেষ রাত্তিরে ফিরে আসতে লাগল দীপেন।

একটা ভদ্র, সৎ, শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ কীভাবে চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে কোনও কোনও দিন মুষড়ে পড়ত শমিতা, কোনও দিন তার মাথায় আগুন ধরে যেত। ঘৃণায় চোখ-মুখ কুঁচকে যেত তার। একদিন সে বলেছে, এভাবে রাত্তিরে বাড়ি ফেরো, তোমার লজ্জা করে না?

দীপেন হিংস্র, বুনো জন্তু মতো গর্জে উঠেছে।–শাট আপ, আমি কারও বাপের পয়সায় মদ খাই না।

স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিছু একটা উত্তর দিতে চেয়েছিল কিন্তু গলায় স্বর ফোটেনি। ঠোঁট দুটো শুধু থরথর কাঁপছিল।

সেদিন দীপেনের মাথায় কী চেপেছিল, কে জানে! সে আরও উগ্র হয়ে উঠেছে।-মিডল ক্লাস গাঁইয়া মেয়েদের মতো প্যানপ্যানানি ঘ্যানঘ্যাননি আর কক্ষনো করবে না। নেভার। টলতে টলতে ড্রইংরুমের একধারে যে ডিভানটা ছিল তার ওপর হুড়মুড় করে আছড়ে পড়েছে।

যে মানুষটাকে একদিন শ্রদ্ধা করত, বিশ্বাস করত, যার ওপর ভরসা রাখত, সে কি এই দীপেন? নিদারুণ কষ্ট আর অসহ্য রাগে মাথার ভেতরটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। দীপেনকে কি আগে ভালো করে চিনতে বা বুঝতে পারেনি সে? শমিতার গোপন গর্ব ছিল মানুষকে যাচাই করে নেবার মতো অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে। কিন্তু দীপেনকে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে এত বড় ভুলটা তার হল কী করে? এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে সে একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি।

সেই রাতেই তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল। তারই মধ্যে দীপেনকে শোধরাতে কম চেষ্টা করেনি শমিতা। সকালের দিকটা মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে দীপেন। কিন্তু মাঝরাত্তিরে যখন সে ফেরে সেইসময় তার মাথায় একরোখা, ভয়ংকর জিন ভর করে থাকে। শমিতা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিল।

.

মনে পড়ে, এইসব মাসকয়েক চলল। সকালের দিকে কাজ-চলা গোছের দু-চারটে কথা; রাত্তিরে যে মূর্তিতে দীপেন ফিরে আসে তার ধারে-কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছা করে না, সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।

একটা পুরুষ এবং একটি নারীর সম্পর্কের গিটটা তখন অনেকটা আলগা হয়ে গেছে। বলা যায়, কোনওরকমে টিকে আছে। সেই সময় একদিন স্কুলে যায়নি শমিতা। আগের রাত থেকেই জ্বর জ্বর লাগছিল। দুপুরবেলা শুয়ে শুয়ে অন্যমনস্কর মতো একটা ইংরেজি মান্থলি ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। মোবাইল স্ক্রিনে নাম এবং নাম্বার ফুটে উঠেছে। অনিমেষ চৌধুরি।

খুব অবাক হয়ে গেছে শমিতা। অনিমেষকে ভালোই চেনে সে। দীপেনদের সুইট হোম-এ সে জুনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট। কত আর বয়স হবে বাইশ কি তেইশ। খুবই ভদ্র, বিনয়ী। একটু লাজুক ধরনেরও। কোনও কারণে দীপেন অফিসে, যেতে না পারলে কখনও-সখনও জরুরি কাজে অনিমেষ এ বাড়িতে তার কাছে এসেছে। ছেলেটার সঙ্গে শমিতার ভালোই আলাপ হয়েছে।

অনিমেষ শমিতাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। কিন্তু আগে কখনও ফোন করেনি। কী হতে পারে? রিংটোন বেজেই চলেছে। একটু দ্বিধা, তারপর ফোন তুলে নিয়ে হ্যালো বলতেই অনিমেষের চাপা, সতর্ক কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছে, ম্যাডাম, একটা বিশেষ দরকারে আপনাকে বিরক্ত করতে হল।

নরম গলায় শমিতা বলেছে, মোটেও বিরক্ত হচ্ছি না। যা বলতে চাইছ, বলো

ম্যাডাম, ভীষণ সংকোচ হচ্ছে, আবার ভয়ও হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে না বলেও বাকিটা আর শেষ করল না অনিমেষ।

শমিতা বলেছে, কোনও সংকোচ নেই। নির্ভয়ে বলো।

একটু চুপ করে থেকে অনিমেষ বলেছে, ব্যাপারটা স্যারকে নিয়ে

স্যার মানে দীপেন। আধ-শোওয়া হয়ে কথা বলছিল শমিতা। এবার উঠে বসেছে। অনিমেষের কথাগুলোতে, বলার ভঙ্গিতে কীসের একটা সংকেত যেন ছিল। শমিতা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না। বলেছে, বলো না। তোমাকে তো বলেছি, ভয় নেই।

শমিতা ভরসা দিলেও অনিমেষ কিন্তু দ্বিধা বা ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শুকনো গলায় বলেছে, স্যার জানতে পারলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। আমাদের ফ্যামিলি টোটালি রুইনড হবে।

স্যার জানতে পারবে না। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার এতটুকু ক্ষতি হবে না। শমিতা বুঝতে পারছিল অনিমেষ দীপেনের ব্যাপারে কোনও সুখবর দেবে না। তার ভেতরকার অস্বাচ্ছন্দ্যটা ঠেলে সরিয়ে প্রবল উৎকণ্ঠা যেন চেপে বসতে শুরু করেছে।

ঢোঁক গিলে অনিমেষ বলেছে, স্যার মেয়েদের নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন।

মানে?

কীভাবে যে আপনাকে বোঝাব?

যা বোঝার আমি খানিকটা বুঝেছি। বাকিটা বলো–

স্যার প্রায়ই রোজ কোনও-না-কোনও মেয়েকে নিয়ে হোটেলে চলে যান। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাটান। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে?

মাঝরাত্তিরে বা শেষ রাত্তিরে নেশায় চুর চুর হয়ে বাড়ি ফেরাটা তখন দীপেনের ডেইলি রুটিনের মধ্যে ঢুকে গেছে। এ নিয়ে শমিতার প্রবল বিতৃষ্ণা, তবু দাম্পত্যটা টিকিয়ে রাখার জন্য বিষ-তেতো বড়ি গেলার মতো মেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু মেয়েমানুষ নিয়ে বেলেল্লাপনা, ভাবা যায়? নরকের কোন খাসমহলে পৌঁছে গেছে দীপেন! মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল শমিতার। স্নায়ুমণ্ডলী ছিঁড়েছুঁড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার চারপাশের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে।

শমিতা রুদ্ধশ্বাসে জিগ্যেস করেছে, তুমি যা বলেছ সেটা যদি মিথ্যে হয় তার রেজাল্ট কী হতে পারে জানো?

জানি ম্যাডাম। শুধু আমিই না, অফিসের প্রায় সবাই জানে। এই নিয়ে ফুসফুস গুজগুজ চলছেই। আমার ভীষণ খারাপ লাগে। ম্যাডাম, আমি আপনাকে রেসপেক্ট করি। কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।

অনিমেষের কথাগুলো শেষ দিকে যেন শুনতে পাচ্ছিল না শমিতা। জিগ্যেস করেছিল, এই মেয়েরা কারা?

বাইরের মেয়ে। পয়সা ঢাললে এদের পাওয়া যায়। অথচ এরা সব ভালো ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। শিক্ষিতা, সুন্দরী। সোসাইটি কোন জাহান্নামে যাচ্ছে, ভাবতে পারবেন না। বলতে বলতে একটু থেমে ফের শুরু করেছে, কিন্তু

কিন্তু কী?

রিসেন্টলি অফিসের একটি মেয়ের ওপর নজর পড়েছে। মেয়েটা খুব ভালো। নাম অঞ্জনা। বাবা নেই। মা বারোমাস ভোগে। দুটো ছোট ভাইবোন আছে। তারা কলেজে পড়ে। অঞ্জনাই একমাত্র আর্নিং মেম্বার। শুনেছি, স্যার দু-একদিন তাকে লং ড্রাইভ কিংবা হোটেলে নিয়ে যেতে চেয়েছেন; এখনও পারেননি। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে অঞ্জনা। অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছে। কিন্তু মুখের কথা খসালেই আজকাল চাকরি এখন জোটে না। সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সুইট হোম-এর কাজটা ছাড়লে তাদের ফ্যামিলি একেবারে শেষ হয়ে যাবে। অনিমেষ ব্যাকুলভাবে বলেছে, ম্যাডাম, আপনি ওকে বাঁচান–

আমি। শমিতা চমকে উঠেছে।

হ্যাঁ, আপনি। অনিমেষ বলেছে, আপনি ছাড়া ওকে রক্ষা করার আর কেউ নেই।

কী উত্তর দেবে, ভেবে পাচ্ছিল না শমিতা। সে চুপ করে থেকেছে।

অনিমেষ এবার বলেছে, ম্যাডাম, অঞ্জনাকে বলেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে। বাড়িতে যেতে বারণ করেছি। আপনাদের বাড়িতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। স্যার কোনওভাবে জানতে পারলে একটা বিশ্রী সিচুয়েশনের সৃষ্টি হবে। তাই ওকে আপনার স্কুলে দেখা করতে বলেছি।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কেটেছে। পালপাড়ার সেই ভদ্র, সহৃদয়, আপাদমস্তক সৎ যুবকটির বদলে যাওয়ার অর্ধেকটা নিজের চোখে দেখেছে শমিতা। বাকি আধাআধির পরিবর্তনটা যে কতটা ভয়াবহ তার বিবরণ অনিমেষের মুখে শুনতে শুনতে কখনও কুঁকড়ে গেছে সে, কখনও ঘৃণায় সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠেছে, কখনও বা গনগনে আঁচে সে ঝলসে গেছে। ভেতরের তোলপাড়টা একটু থিতিয়ে এলে শমিতা সিদ্ধান্ত নিল কিছু একটা তাকে করতেই হবে। বলেছে, ঠিক আছে, অঞ্জনা যত তাড়াতাড়ি পারে, আমার স্কুলে যেন চলে আসে। তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না। তবু ওর মুখ থেকে সবটা শুনতে চাই

.

মনে পড়ে দু-একদিনের মধ্যে কিন্তু আসেনি অঞ্জনা। পুরো একটি সপ্তাহ পেরোবার পর স্কুলের লাস্ট পিরিয়ড তখন চলছে, তারপরেই ছুটির ঘণ্টা বাজবে, দারোয়ান একটা স্লিপ নিয়ে এল। অঞ্জন দত্ত। জানাল, ভিজিটরস রুমে তাকে বসিয়ে রেখেছে। খবরটা দিয়ে সে চলে গেল।

দশ-বারো মিনিটের মধ্যেই ক্লাস শেষ হল। কাঁধে লেডিস ব্যাগটা ঝুলিয়ে সটান দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট রুমটিতে চলে এসেছে শমিতা।

এই সময় বাইরের লোকজন কেউ স্কুলে আসে না। ছাত্রীদের অভিভাবক বা অন্য কারও প্রয়োজন থাকলে তাঁদের আসার কথা স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে। তাই বিশাল ভিজিটরস রুমে একটিমাত্র তরুণী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তার ধ্বস্ত, উৎকণ্ঠিত চেহারা বুঝিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটি কে হতে পারে।

শমিতা বলেছে, তুমি নিশ্চয়ই অঞ্জনা।

মেয়েটি ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।-হ্যাঁ। আগে কেউ কারওকে না দেখলেও সে-ও বুঝতে পেরেছে কে তার সামনে দাঁড়িয়ে।

শমিতা বলেছে, বোসো–

দুজনে মুখোমুখি বসে পড়েছিল। শমিতা এবার বলেছিল, অনিমেষ তোমার ব্যাপারে সব জানিয়েছে। তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। ডিটেলে বলবে।

অঞ্জনা মাথা নীচু করে বলে গিয়েছিল। অনিমেষ যা জানিয়েছে তা আরও বিস্তৃতভাবে। সেই সঙ্গে নতুন কিছু জুড়ে দিয়েছে। কদিন ধরে দীপেন চাপ দিচ্ছিল, সপ্তাহখানেকের জন্য অঞ্জনাকে তার সঙ্গে গোপালপুর অন সিতে যেতে হবে। গেলে অঞ্জনার লাভই হবে। অফিসে বড় রকমের প্রোমোশনের ব্যবস্থা করে দেবে দীপেন। স্যালারি কম করে আট-দশ হাজার টাকা বেড়ে যাবে। তা ছাড়া নানারকম পার্কর্স এবং সব সময়ের জন্য একটা গাড়ি।

শুনে মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল শমিতার। জিগ্যেস করেছে, তারপর?

ভয়ে আমি অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু স্যার রেগুলার আমাকে মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছেন। কী করব ভেবে পাচ্ছি না; একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। চাকরি ছাড়লে আমাদের ফ্যামিলিটা শেষ হয়ে যাবে। আর অফিসে গেলে-ম্যাডাম, আপনি আমাকে রক্ষা করুন। বলে প্রায় আছড়ে পড়ে শমিতার দুটো পা আঁকড়ে ধরেছিল অঞ্জনা।

বিব্রতভাবে শমিতা বলেছে, ওঠো–ওঠো। এখন অস্থির হলে চলবে না। অঞ্জনাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিতে দিতে শমিতা বলেছে, কতটা কী করতে পারব জানি না। তবে তোমার যাতে ক্ষতি না হয় তার একটা চেষ্টা নিশ্চয়ই করব। তোমার মোবাইল নাম্বার আর বাড়ির অ্যাড্রেসটা আমাকে দাও। কাল না হলে পরশু তোমাকে ফোন করব। আমি না-বলা পর্যন্ত অফিসে যাবে না। অঞ্জনার ফোন নাম্বার সেভ করে তার বাড়ির অ্যাড্রেস টুকে নিয়ে শমিতা বলেছে, তোমার সম্বন্ধে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। কতদূর পড়াশোনা করেছ?

গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেছি।

গুড। লেখাপড়া কোন মিডিয়ামে?

বাংলা। তবে স্পোকেন ইংলিশে দুটো কোর্স করেছি। ফুয়েন্টলি বলতে পারি।

ঠিক আছে। তোমাকে তো আবার ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত যেতে হবে। অনেকটা রাস্তা। এবার উঠে পড়া যাক।

.

মনে পড়ে অঞ্জনা যেদিন তার স্কুলে এসে দেখা করেছিল সেদিন বেশি রাত করে নেশায় চুর হয়ে বাড়ি ফেরেনি দীপেন। দশটা সাড়ে-দশটার মধ্যেই চলে এসেছিল।

বেশ কিছুদিন ধরেই এক ফ্ল্যাটে থাকলেও এক বেডরুমে তারা রাত কাটায় না। নিজের ঘরে আধশোওয়া হয়ে টিভির নিউজ চ্যানেলে তাকিয়ে ছিল শমিতা। সংবাদ-পাঠিকা সেদিনের খবরগুলো পর পর পড়ে যাচ্ছিলেন; খবরের সঙ্গে টিভির পর্দায় ছবি ফুটে উঠছিল। কিছুই প্রায় শুনছিল না শমিতা; ছবিগুলোর দিকেও সেভাবে নজর নেই। বার বার অঞ্জনার ধ্বস্ত চেহারাটা তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল।

ড্রইংরুমে দীপেনের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছে শমিতা। দীপেন যে আগে আগে চলে এসেছে তা একরকম ভালোই হয়েছে। নইলে মধ্যারাতে বেহেড মাতালের সঙ্গে কথা বলা মানেই তুমুল ধুন্ধুমার বেধে যাওয়া। কেয়াতলার বনেদি পাড়ার নৈশ প্রশান্তিকে খান খান করে জড়ানো গলায় লোকটা চিৎকার জুড়ে দিত।

শমিতা তার মেরুদণ্ডে সবটুকু ক্রোধ, অসন্তোষ এবং জেদ পুরে সটান ড্রইংরুমে চলে এসেছিল। আজ চূড়ান্ত কিছু একটা করার জন্য নিজেকে সে তৈরি করে নিয়েছে।

দীপেনকে অন্যদিনের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। মদ্যপানের মাত্রাটা সেদিন কোনও কারণে বেশ কম ছিল বলেই হয়তো।

শমিতা এগিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসল। দীপেন কাছাকাছি একটা সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলছিল। একটা কাজের লোক হুকুম তামিল করার জন্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শমিতা তাকে বলেছে, নরেশ, তুমি এখন যাও। ডাকলে আসবে।

আড়চোখে একবার শমিতার দিকে তাকিয়েছে দীপেন। শমিতা বলেছে, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

জুতো খুলে শমিতার দিকে তাকিয়েছে দীপেন।–বলো—

নরেশ বেরিয়ে গিয়েছিল। ড্রইংরুমে তখন শমিতা আর দীপেন ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। শমিতা বলেছে, এতদিন মাঝরাতে নেশা চুর হয়ে বাড়িতে এসে হল্লা করেছ, কেয়াতলার লোকজন তা জেনে গেছে। কিন্তু তোমার আরেকটা গুণের খবর আমি ছাড়া এখানকার আর কেউ বোধহয় এখনও জানে না। জানলে মহাপুরুষ হিসেবে ফুল-চন্দন দিয়ে তোমার পুজো করতে শুরু করবে।

দাঁতে দাঁত চেপে, কেটে কেটে দীপেন বলেছে, হোয়াট ডু ইউ মিন

মদ ছিল। তার সঙ্গে মেয়েমানুষ জুটিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ! বা-বাবা

দীপেন উত্তর দেয়নি। তার চোখ থেকে আগুনের হলকা ছুটছিল। মনে হচ্ছিল তার সমস্ত শরীরটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

সোজাসোজি দীপেনের চোখের দিকে তাকিয়ে শমিতা এবার বলেছে, অঞ্জনা একটা ভদ্র পরিবারের মেয়ে। নিজেদের সংসার বাঁচানোর জন্যে তোমার কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। তার ওপরও তোমার নজর গিয়ে পড়েছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! এমন একটা ভদ্র, ভালো মেয়ের জীবনটা রুইন করে দিতে চাইছ! তোমার মতো ইতর, জঘন্য, নর্দমার পোকার সঙ্গে থাকছি, ভাবতেও গা ঘিন ঘিন করে। আর পারছি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এখানে আর থাকতে চাই না।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল দীপেন। অসহ্য ক্রোধে এবং উত্তেজনায় তার গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলেছে, কেউ এখানে থাকার জন্যে তোমার পায়ে ধরছে না। এই মুহূর্তে তুমি চলে যেতে পারো।

এখন রাত বারোটা বাজে। রাতটুকু ভোর হলেই চলে যাব। শমিতা নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

.

মনে আছে, বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি শমিতা। ভোরবেলায় সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে, সেই সময় একটা কাপড়ের বড় ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তখনও দীপেনের ঘুম ভাঙেনি। দু-তিনটে কাজের লোক ততক্ষণে উঠে পড়েছে। বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখতে দেখতে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দুই ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাদের থামিয়ে দিয়েছে শমিতা। ওদের সঙ্গে কথাটথা বললে দীপেনের ঘুম ভেঙে যাবে, সেটা সে চায়নি।

আগের রাতে দীপেনের সঙ্গে তুমুল ব্যাপারটা ঘটে যাবার পর নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। ওটার ভেতর রয়েছে কটা শাড়ি-ব্লাউজ, ম্যাক্সি, চেকবুক, ব্যাঙ্কের পাশবুক, ভোটার আই ডি কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদি টুকিটাকি দরকারি সব জিনিস।

ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরিয়ে লিফটে নীচে নেমে সোজা রাস্তায়। একটা ট্যাক্সি ধরে শমিতা যখন পালপাড়ায় পৌঁছোল, বেশ রোদ উঠে গেছে। তার মা লতিকা বাইরের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। দোতলার ব্যালকনিতে বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তী দাঁত ব্রাশ করছিলেন। শমিতাকে দেখে দুজনেই অবাক।

সুরেশ্বর জিগ্যেস করেছেন, কী রে, এত সকালে?

শমিতা একটু হেসেছে।অনেকদিন মাকে দেখেনি। মনটা খারাপ লাগছিল। তাই চলে এলাম।

ভালো করেছিস। দীপু আসবে না?

উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেছে শমিতা। পরক্ষণে সামলে নিয়েছে।ও ভীষণ ব্যস্ত। আসতে পারবে বলে মনে হয় না। বলেই বারান্দায় উঠে লতিকাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল।

লতিকা মেয়েকে লক্ষ করছিলেন। এই সকালবেলা খবর-টবর না দিয়ে হুট করে শমিতার চলে আসা, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি তাঁর। কেমন একটা খটকা লাগছিল। শমিতার চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করেছিলেন, হঠাৎ এভাবে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে চলে এলি! কী হয়েছে রে?

শমিতা বলেছে, পরে বলব। আমার মুখ-টুখ ধোয়া হয়নি। আগে বাথরুমের কাজ সেরে আসি! তুমি ততক্ষণে চা বসিয়ে দাও

কিছুক্ষণ পর চা খেতে খেতে দীপেন সম্পর্কে সমস্ত কিছু জানিয়ে বলেছে, দীপেন যে কতটা পালটে গেছে, তার কতটা অধঃপতন ঘটেছে, ভাবতে পারবে না মা। এমন জঘন্য ইতরের সঙ্গে আমার পক্ষে থাকা একটা দিনও আর সম্ভব না। তাই চলে আসতে বাধ্য হলাম।

উৎকণ্ঠিত লতিকা পুরোনো ধ্যান ধারণার মানুষ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে তিনি অচ্ছেদ্য বন্ধ মনে করতেন। বলেছেন, দীপেনকে বোঝা, ও যা করছে সেটা ঠিক নয়। তুই একটু চেষ্টা করলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। রাগের মাথায় কিছু একটা করে বসিস না।

শমিতা বলেছে, হাজারটা বুঝিয়েও কোনও কাজ হবে না। ও শোধরাবে না।

লতিকা নিরীহ, ভীতু মানুষ। আকণ্ঠ উদ্বেগ আর দুর্ভাবনা নিয়ে তিনি জিগ্যেস করেছেন, তা হলে কী করতে চাস তুই?

আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল শমিতা। সে বলেছে, সব জানতে পারবে। একটু অপেক্ষা করো।

লতিকা আর কোনও প্রশ্ন করেননি।

মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল শমিতা। এবার তাকে পর পর দুটো জরুরি ফোন করতে হবে। প্রথম ফোনটা অঞ্জনাকে, দ্বিতীয়টা তার স্কুলের কলিগ মালবিকা গুহকে।

একবারেই অঞ্জনাকে পাওয়া গেল। শমিতা বলেছে, তুমি সুইট হোম-এর চাকরিটা ছেড়ে দাও। আজই রেজিগনেশান পাঠিয়ে দেবে।

কিন্তু আমাদের ফ্যামিলি বাকিটা শেষ না করে অঞ্জনা চুপ করে গেছে।

মেয়েটা কী বলতে চেয়েছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি শমিতার। সে বলেছে, ভয় নেই। কাল তোমাকে স্পিডপোস্টে একটা চেক পাঠিয়ে দেব। দমদমের স্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর মাসের পর মাস যা স্যালারি পেয়েছে, স্কুলে যাতায়াতের জন্য বাসভাড়া, অটোভাড়া ছাড়া বাকি সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা হয়েছে। দীপেন অবশ্য তাকে একটা গাড়ি দিতে চেয়েছিল। শমিতা রাজি হয়নি। অন্য সব টিচাররা বাসে-মিনিবাসে যেভাবে যাওয়া-আসা করত সে-ও সেইভাবেই যেত, আসত। শমিতা উড়নচণ্ড স্বভাবের মেয়ে নয়, তাই ব্যাঙ্কে যে টাকা জমেছিল তার অঙ্কটা বেশ ভালোই।

আপনি আমাকে টাকা দেবেনঅঞ্জনার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছে সে শুধু অবাকই হয়নি, বিহ্বল হয়ে পড়েছে।

শমিতা তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়েছিল। বলেছে, তোমাদের সংসারটাকে বাঁচাতে হবে তো। তার চেয়েও বড় ব্যাপার তোমার সম্মান রক্ষা করা। একটু থেমে ফের শুরু করেছে, তুমি গ্র্যাজুয়েট, কম্পিউটারে কোর্স করেছ, ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে পারো। নানা জায়গায় চেষ্টা করো, চাকরি একটা ঠিক জুটে যাবে। আমিও আমার জানাশোনা সবাইকে তোমার কথা বলব। হতাশ হোয়ো না; মনের জোর রাখো।–আর হ্যাঁ, যতদিন না চাকরি-বাকরি কিছু একটা হচ্ছে, আমি টাকা পাঠিয়ে যাব।

অভিভূত অঞ্জনা ভারী গলায় বলেছে, আপনার ঋণ কোনওদিন

তাকে থামিয়ে দিয়েছে শমিতা।-ওসব ঋণ-টিন থাক। একটা খবর তোমাকে দেওয়া হয়নি। আমি দীপেন ঘোষের বাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে চলে এসেছি। এখানেও থাকব না। মাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাব।

চমকে উঠেছে অঞ্জনা?–কোথায় যাবেন ম্যাডাম?

পরে তোমাকে জানিয়ে দেব।

দুনম্বর ফোনটা মালবিকা গুহকে। মালবিকা শমিতার চেয়ে বছর দশেকের সিনিয়র। অবিবাহিত। স্কুলের কাছাকাছি নাগেরবাজারে তাদের বিরাট বাড়ি। রুগণ, শয্যাশায়ী বাবা আর সে ছাড়া আর কেউ নেই। বাবার অসুস্থতার জন্য তার বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি। স্কুলে সে ফিজিক্স পড়ায়। মালবিকাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে শমিতা, ভালোবাসে। মালবিকাও তাকে স্নেহ করে। সম্পর্কটা দিদি এবং ছোট বোনের মতো।

ফোনে শমিতা মালবিকাকে বলেছে, দিদি, আমি কাল রাতে দীপেনের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে এসেছি।

কী বলছিস তুই?

গলা শুনে মনে হল মালবিকা চমকে উঠেছে। শমিতা বলেছে, ঠিকই বলছি। সবটা শুনলে কারণ বুঝতে পারবে। দীপেনের সঙ্গে কিছুদিন ধরে যা যা ঘটেছে সবিস্তার জানিয়ে জিগ্যেস করেছে, এবার বলো, এই লোকটার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানো যায়?

বিষণ্ণ গলায় মালবিকা বলেছে, ভেরি স্যাড। তবে তুই ঠিক ডিসিশন নিয়েছিস।

কিন্তু

কিন্তু কী?

এখন কী করবি?

শমিতা জানিয়েছে, কলকাতায় তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। কেননা এখানে তার জানাশোনা প্রচুর লোকজন রয়েছে। দীপেনকে ছেড়ে সে যে চলে এসেছে, এটা চাপা দিয়ে রাখা যাবে না, মুহূর্তে চাউর হয়ে যাবে। কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির গন্ধ পেলে সবাই তাকে ছেকে ধরবে। কেন নিজের সংসার ছেড়ে চলে এলে? কী এমন হয়েছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্নে নাজেহাল করে ছাড়বে, কেউ বা আড়ালে হাসাহাসি করবে, কিন্তু সামনাসামনি মুখটা করুণ করে বলবে, আহা, তোমার লাইফে এমনটা ঘটবে ভাবতে পারিনি। বড় কষ্ট হচ্ছে—

শমিতা বলেছে, এরা আমাকে অতিষ্ঠ করে মারবে। স্কুলে আমাদের বেশিরভাগ কলিগরা কে কেমন, তুমি তো জানোই। সবাই মালবিকা গুহ নাকি? তারাও আমাকে ছাড়বে না। সামনে আহা-উঁহু করবে, পেছনে আহ্লাদে আটখানা হবে। তাই ঠিক করেছি, কলকাতায় থাকব না। তবে মুখ থেকে কথা খসালেই তো কোথাও চলে যাওয়া যায় না। বাইরের কোনও স্কুলে চলে যাবার চেষ্টা করব। আশা করি কিছু একটা জুটে যাবে।-মালবিকাদি, আমাকে কিন্তু একটু হেল্প করতে হবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ বল না কী হেল্প চাই।

আমার মাকে আর আমাকে তিন-চারটে মাস তোমাদের বাড়িতে থাকতে দেবে? মানে যতদিন না বাইরে একটা কিছু জোটাতে পারছি—

যতদিন ইচ্ছে তোরা আমাদের কাছে এসে থাক। আমাদের তেতলা বাড়ির দুটো ফ্লোর তো ফাঁকাই পড়ে আছে।

আরেকটা সাহায্য চাই।

বল

অঞ্জনার কথা তোমাকে জানিয়েছি। তোমার তো অনেক জানাশোনা। তাদের কারওকে বলে ওর জন্যে যদি একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও

চেষ্টা করব। কম্পিউটার যখন জানে, আশা করি, কিছু একটা হয়ে যাবে।

.

মনে আছে, যেদিন সে কেয়াতলা থেকে চলে আসে সেদিনই বিকেলে লতিকাকে নিয়ে নাগেরবাজারে মালবিকাদের বাড়ি চলে গিয়েছিল। যাবার আগে বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তীকে তাদের ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে বলেছে, জেঠু, এগুলো আপনার কাছে থাক। আপাতত মাকে নিয়ে আমি অন্য একটা জায়গায় যাচ্ছি।

সুরেশ্বর অবাক। জিগ্যেস করেছেন, কোথায় যাবি?

আপনাকে পরে জানাব।

নাগেরবাজারে খুব বেশিদিন থাকতে হয়নি শমিতাদের। মাত্র দুমাস কয়েকদিন। তার মধ্যেই একে-ওকে ধরে নবাবগঞ্জের একটা স্কুলে ট্রান্সফারের বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল। অঞ্জনারও একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মালবিকার এক পিসতুতো ভাই নামকরা একটা ইংরেজি দৈনিকের নিউজ এডিটর। মালবিকা তাকে বলে সেখানে কম্পোজিটরের কাজটা জুটিয়ে দিয়েছে।

নবাবগঞ্জ শহরটা কলকাতা থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছিল নিষ্ফলা কাঁকুরে জমি। স্বাধীনতার পর ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা এইসব জমি কিনে নানারকম কলকারখানা বসাতে লাগলেন। স্টিল প্ল্যান্ট, কাগজকল, কেমিকেল ফ্যাক্টরি, ওষুধ তৈরির কারখানা, রংয়ের কারখানা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইসব ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়ে অগুনতি মানুষ আসতে লাগল। শুধু বাঙালিরাই না, বিহারি, তামিল, ওড়িয়া, এমনি দেশের নানা প্রান্তের লোকজন।

এত মানুষ থাকবে কোথায়? তাই অনেকটা এলাকা জুড়ে নবাবগঞ্জ শহর গড়ে উঠল। প্ল্যানড টাউনশিপ। প্রশস্ত কংক্রিটের সড়কের দুধারে বিরাট বিরাট সব বিল্ডিং। শুধু বাসস্থানই নয়, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শপিং কমপ্লেক্স, ফুটবল স্টেডিয়াম, সিনেমা হল–কিছু বাকি রইল না। রাতারাতি সব তৈরি হয়ে গেল। বড় বড় ব্যাঙ্কগুলো এখানে ব্রাঞ্চ খুলল। পোস্ট অফিস, আদালত, সরকারি-বেসরকারি অজস্র অফিস খোলা হল।

নবাবগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল-এ বদলি হয়ে এসেছিল শমিতা। হেডমিস্ট্রেস সুচরিতা সাহা চমৎকার মানুষ। তিনি শমিতাদের জন্য স্কুলের কাছাকাছি একটা তিন কামরার ছোট বাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। প্রথম কয়েকটা দিন তিনি অবশ্য শমিতাদের ভাড়া বাড়িতে উঠতে দেননি; নিজের কাছেই রেখেছিলেন।

এর মধ্যে সুরেশ্বর চক্রবর্তীকে ফোন করে কেন কলকাতা ছেড়ে মাকে নিয়ে তাকে নবাবগঞ্জে আসতে হয়েছে সব জানিয়ে তাদের মালপত্র পাঠিয়ে দিতে বলেছিল। তিন-চারদিনের মধ্যে খাট, আলমারি, ফ্রিজ এবং সংসারের আরও নানা জিনিস লরির মাথায় চেপে চলে এসেছে। সুচরিতা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লোকজন দিয়ে শমিতাদের নতুন ভাড়াবাড়িটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন।

নতুন জায়গায় এসে থিতু হয়ে বসার পর শমিতা লইয়ার মারফত দীপেনকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছিল। দীপেন আপত্তি করেনি। বছরখানেক আইন-আদালত করার পর মিউঁচুয়াল সেপারেশন অর্থাৎ আইনসম্মত বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

.

মনে আছে, বাবার মৃত্যুর পর থেকে শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল লতিকার। স্বামীর মৃত্যুশোক তো ছিলই, তার ওপর শমিতার বিবাহিত জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। পর পর দুটো ধাক্কা সামলাতে পারেননি লতিকা। তাঁর হার্টের সমস্যা দেখা দিল। বেশিরভাগ সময় বুকে ব্যথা হচ্ছিল।

একদিন মায়ের কষ্টটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে দাঁড়াল। নবাবগঞ্জে কোনও ডাক্তারের সঙ্গে জানাশোনা ছিল না শমিতার। দিশেহারার মতো সে সুচরিতার কাছে ছুটেছে।

সুচরিতা বলেছেন, চিন্তা কোরো না। এখানকার সবচেয়ে বড় নার্সিংহোম নবাবগঞ্জ কেয়ার অ্যান্ড কিওর সেন্টার-এ একজন হার্ট স্পেশালিস্ট এসেছে কলকাতা থেকে। বয়সে কম হলেও খুব ভালো ডাক্তার। অল্পদিনেই তার যথেষ্ট সুনাম হয়েছে। নার্সিংহোমে ছাড়াও বাইরের পেশেন্টও দেখে। আমার ছোট ভাইয়ের মতো। এক্ষুনি তাকে ফোন করছি– মোবাইলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছিলেন। বিকেলের দিকে তিনি শমিতাদের বাড়ি আসবেন। চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে।

মনে পড়ে, সেদিন স্কুলে যায়নি শমিতা। সুচরিতা হেডমিস্ট্রেস; তাঁর ওপর স্কুলের হাজারটা দায়িত্ব। তবু কয়েকটা ক্লাস করে টিফিন পিরিয়ডে শমিতাদের বাড়ি চলে এসেছিলেন।

কথামতো চারটে বাজার দশ-পনেরো মিনিট বাদে একটা ফিয়েট গাড়ি চালিয়ে ডাক্তারও এসে গেছে।

গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বাইরের দরজার কাছে চলে এসেছিলেন সুচরিতা ও শমিতা।

ফিয়েট থেকে যে নেমেছিল সে ভারী সুদর্শন এক যুবক। বত্রিশ-তেত্রিশের মতো বয়স। ডাক্তারদের হাতে যেমন থাকে সেইরকম একটা মেডিকেল ব্যাগ। সুপুরুষই নয়, তার চেহারায় রীতিমতো অভিজাত্যের ছাপ।

সুচরিতা শমিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ডাক্তারের নাম সুকান্ত ব্যানার্জি। সুকান্তকে বললেন, শমিতার মা-ই তোমার পেশেন্ট। এসো

লতিকা একটা খাটে শুয়ে ছিলেন। নানাভাবে খুব যত্ন করে তাঁকে পরীক্ষা করেছে সুকান্ত। ই সি জি-ও করা হল। তারপর গম্ভীর মুখে ডাক্তার বলেছে, এঁর তো আগেই একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। হার্টের কন্ডিশন বেশ খারাপ। আমি এক সপ্তাহের ওষুধ লিখে দিচ্ছি। যদি হার্টের কন্ডিশন ইমপ্রুভ করে, ঠিক আছে। ওঁকে বাড়িতে রেখেই টিটমেন্ট করব। নইলে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে। একটু থেমে কুণ্ঠিতভাবে জানিয়েছেন, অবশ্য নার্সিংহোমে খরচটা বুঝতেই তো পারছেন।

উৎকণ্ঠিত শমিতা বলেছে, খরচের জন্যে ভাববেন না। মাকে দয়া করে সুস্থ করে তুলুন–

শেষ পর্যন্ত নার্সিংহোমেই ভর্তি করতে হয়েছিল লতিকাকে। ঠিক যেমনভাবে চন্দ্রনাথকে কয়েক বছর আগে সাদার্ন অ্যাভেনিউর নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সকাল-বিকেল দুবেলা মাকে দেখতে গেছে শমিতা। সুকান্তকে বার বার ব্যাকুলভাবে জিগ্যেস করেছে, মা বাঁচবে তো ডাক্তারবাবু? বলুন-বলুন।

ডাক্তার সুকান্ত ব্যানার্জি বলেছে, আমাদের কাজ হল পেশেন্টকে বাঁচানো। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। সেদিক থেকে কোনও ত্রুটি নেই। তবে কেসটা খুব ক্রিটিকাল।

দেখুন মাত্র কবছর আগে বাবা মারা গেছেন। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

ডাক্তারদের কাছে মৃত্যু কোনও ঘটনাই নয়। এসব দেখতে দেখতে তারা অনেকটাই নিস্পৃহ বা অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। সুকান্তও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু শমিতার ব্যাকুলতা তাকে যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সহৃদয় গলায় বলেছে, অস্থির হবেন না। মনে সাহস রাখুন

ষোলো-সতেরো দিন নার্সিংহোমে কাটাতে হয়েছিল লতিকাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। আরেকটা ম্যাসিভ অ্যাটাক। ডাক্তার সুকান্ত ব্যানার্জি লড়াইটা কম চালায়নি। মৃত্যু এমন এক অদম্য শক্তি যাকে ঠেকানো যায় না। ডাক্তারের সমস্ত যুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে গেল।

শমিতার মনে পড়ে, মা যতদিন নার্সিংহোমে ছিলেন, বোজ দুবেলা উদভ্রান্তের মতো সে তাঁকে দেখতে গেছে। তার সঙ্গে প্রায়ই যেতেন সুচরিতা বা তার স্কুলের অন্য টিচাররা। স্কুলের গভর্নিং বডির মেম্বারও কেউ কেউ যেতেন।

শমিতা জানত, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না সুকান্ত ব্যানার্জির। সে নবাবগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলে পড়ায়, তার বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন, ব্যস এটুকুই। শমিতা বুঝতে পারত, তার ওপর সুকান্ত ব্যানার্জির অপার সহানুভূতি এসে পড়েছে। ভারী, বিষণ্ণ গলায় যখন মায়ের মৃত্যুর খবরটা সে দিয়েছে, অবুঝ বালিকার মতো অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল শমিতা। ডাক্তার তাকে শুধু সান্ত্বনাই দেয়নি; ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবার পর ডেডবডি নিয়ে যখন স্কুলের সব শিক্ষিকা-ছাত্রী এবং কর্মকর্তারা শেষকৃত্যের জন্য শ্মশানে গিয়েছিলেন, ডাক্তার তাঁদের সঙ্গে গেছে।

মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পরও সুকান্ত মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করে যেত। যখনই আসত, বার বার বলত, আপনাকে বলেছিলাম, মাকে সুস্থ করে তুলব। কিন্তু পারিনি।

শমিতার মনে হয়েছে, তাকে ভরসা দিয়েও লতিকাকে যে বাঁচাতে পারেনি সেজন্য হয়তো সুকান্তর একটা অপরাধবোধ ছিল।

ধীরে ধীরে কখন যে তরুণ, সহৃদয় ডাক্তারটি তার একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে, প্রথমদিকে শমিতা খেয়াল করেনি। যখন খেয়াল হল, নিজেকে সতর্ক করে নিয়েছে। দীপেনের কথা মনে পড়ে যেত। প্রথম দিকে সে-ও কি কম হৃদয়বান ছিল? দীপেনের ওপর অগাধ আস্থা রেখেছে সে। কত বিশ্বাস করত তাকে। তারপরও সেসব ভাবলে মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

সুকান্তর স্বভাবে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে তাকে বলা যেত না, তুমি আর এসো না। আমার জীবনে যে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে সেটাই যথেষ্ট। অভিজ্ঞতার কথাটা অবশ্য তখন সুকান্তকে জানানো হয়নি।

একদিন সুকান্ত হঠাৎ বলেছে, তোমার জন্যে আমার ভীষণ চিন্তা হয়।

শমিতা চমকে উঠেছে, কীরকম?

তুমি তো একা একা থাকো। বাকি জীবনটা কাটবে কী করে?

আমার ছাত্রীরা আছে, স্কুল আছে। ঠিক কেটে যাবে।

ঠিকঠাক কাটবে, সেটা তুমি জানো?

তেমনই ধারণা।

সেদিন আর কিছু বলেনি সুকান্ত।

মনে আছে, এর মাস সাত-আটেক বাদে সুচরিতা একদিন রাত্তিরে তাঁদের বাড়িতে তাকে খেতে বলেছিলেন। মেয়েটা একা একা থাকে, তাই প্রায়ই শমিতাকে খেতে বলতেন। সেটা নতুন কিছু নয়।

সেদিন রাত্তিরে খেতে খেতে একথা-সেকথার পর সুচরিতা বলেছিলেন, তুই তো আমাকে তোর দিদি বলে মনে করিস? নবাবগঞ্জে আসার পর দুজনের সম্পর্কটা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে সুচরিতা শমিতাকে তুই করে বলতেন; সে বলত তুমি।

শমিতা হেসে হেসে বলেছে, নিশ্চয়ই করি। তুমি তা ভালো করেই জানো।

সুচরিতা একটু চুপ করে থেকে বলেছেন, তা হলে আমার একটা কথা রাখবি?

তুমি যা বলো তাই তো করি। কিন্তু কথাটা কী?

আমার ইচ্ছে, তুই সুকান্তকে বিয়ে কর।

কয়েক লহমা একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে শমিতা। তারপর জিগ্যেস করেছে, তোমার ইচ্ছে, না ডাক্তার সুকান্ত ব্যানার্জির ইচ্ছে?

সুচরিতা বলেছেন, আমাদের দুজনেরই।

লঘু সুরে শমিতা বলেছিল, বেশ তো আছি। ঝামেলা-ঝাট নেই। একেবারে মুক্ত বিহঙ্গ। এর মধ্যে বিয়ে, ঘর-সংসার এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে লাইফটাকে জটিল, গোলমেলে করে তোলার কোনও মানে হয়? বিয়ে-টিয়ে মানেই তো হাজারটা প্রবলেম।

কোনও মেয়েই তো পড়ে থাকছে না। দু-চারটে এক্সেপশন থাকতে পারে। বাকি সবাই তত সাতপাক ঘুরে দিব্যি সংসারধর্ম পালন করছে। তাদের কি প্রবলেম-টবলেম হচ্ছে?

চোখের সামনে তো অনেক কিছুই দেখছি। কেউ যদি সাধ করে বধ্যভূমিতে গিয়ে ঢোকে, আমার কিছু করার নেই। আমি যেমন আছি তেমনই থাকি না।

তোর যা বয়স তাতে এই মেল-ডমিনেটেড সোসাইটিতে একা একা থাকা নিরাপদ নয়। দিনকাল বড্ড খারাপ। ঘর-সংসার তো আছেই, তা ছাড়া নিরাপত্তার জন্যে মাথার ওপর একজন নির্ভরযোগ্য কারও থাকা দরকার।

তুমিই তো আছ মাথার ওপর।

আমার তো একটা ফ্যামিলি লাইফ আছে। তোর জামাইবাবু আর্মি অফিসার। কিছুদিন অরুণাচলে রইল তো, কিছুদিন রাজস্থান বর্ডারে। একমাত্র ছেলে পড়ছে বাঙ্গালোরে। জামাইবাবুর রিটায়ারমেন্ট আসছে বছর। সে ফিরে এসে আমার স্কন্ধারোহণ করবে। ছেলেটা ঘরকুনো, সে বাইরে পড়ে থাকতে চায় না। পড়াশোনা শেষ হলে কলকাতায় ফিরে কোনও কলেজ-টলেজে পড়ানোর কাজ নেবে। তখন আমার জমজমাট ফ্যামিলি লাইফ। সেসব সামলে তোকে কতটুকু সময় দিতে পারব।

আহা, আমাকে তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বার করে নাও না।

সে তো যে-কোনও সময় পারা যায়। কিন্তু বিয়ে না হলে কোনও মেয়ের লাইফে পূর্ণতা আসে না।

যত সব মান্ধাতার বাপের আমলের ধ্যানধারণা। তুমি কোনও সিঙ্গল উম্যানকে দেখোনি।

দেখেছি। তাদের শেষ জীবনে লোনলিনস কী ভয়ংকর তা-ও চোখে পড়েছে। নিরাপত্তার জন্যে একটি পুরুষ দরকার। অল্প বয়সে বাবা, তারপর স্বামী, স্বামী যদি আগেই মারা যায় তখন ছেলে। আমাদের সোসাইটিতে একটি মেয়ের লাইফের সাইকেল মোটামুটি এইরকম। ব্যতিক্রমও কিছু কিছু আছে। বিধবা মায়ের সঙ্গে অনেক ছেলে আজকাল কীরকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করে তার নমুনা মাঝে মাঝে কাগজে পড়ি। কিন্তু সবাই তো তেমন নয়। সে যাক, শুধু ফিজিক্যাল নিড নয়, নিরাপত্তা আর কম্পেনিয়নশিপের জন্যে মেয়েদের লাইফে একজন পুরুষের প্রয়োজন। শেষ বয়সের একাকিত্ব ভীষণ কষ্টকর রে শমিতা–

শমিতা হেসেছে।–দিদি, তুমি খুব দূরদর্শী দেখছি।

তোর থেকে আমি অনেক বছরের বড়। জীবনে অনেক দেখেছি। অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তাই ভবিষ্যতের অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়া চলল।

তারপর সুচরিতা বলেছেন, কী রে, কিছু বললি না যে–

দীপেনের সঙ্গে কয়েকটা বছরের স্মৃতি আগের মতো ততটা দগদগে না হলেও একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে, তবু সেই দিনগুলো মনে পড়লেই ভীষণ অস্থির লাগে। আনমনার মতো শমিতা বলেছে, আমাকে একটু ভাবতে দাও

ঠিক আছে। সারা জীবনের ব্যাপার। ভেবে নে। চুলগুলো কালো থাকতে থাকতে ডিসিশনটা নিয়ে ফেল–

কিছুদিন অপেক্ষা করার পর তাড়া লাগাতে লাগলেন সুচরিতা। ভাবছি ভাবছি করে আরও মাসখানেক কাটিয়ে দিয়েছে শমিতা। তারপর বলেছে, দিদি, আমার কিছু বক্তব্য আছে।

বেশ তো। বল

সুকান্ত ব্যানার্জি যে আমাকে বিয়ে করতে চায়, তা কি ওর ফ্যামিলির সবাই জানেন?

জানেন। সুকান্ত তাঁদের বলেছে।

নবাবগঞ্জে আসার আগে আমার লাইফে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যা তুমিও জানো না। সুকান্ত ব্যানার্জির মা-বাবারা এলে তাঁদের সামনে সব বলব। তুমি আর সুকান্তও সামনে বসে সব শুনবে। তারপর সুকান্তরা মানে ওর মা-বাবা এবং সে নিজে কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন সুচরিতা। তারপর বলেছেন, ঠিক আছে, আমার বাড়িতেই নেক্সট রবিবার সুকান্তদের ইনভাইট করব। তোর মা-বাবা নেই। তোর মা-বাবার ভূমিকাটা আমাকেই পালন করতে হবে দেখছি।

শমিতা হেসেছে। এখন তো আমার মাথার ওপর তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা বাবা দিদি-সবই তুমি।

.

মনে পড়ে রবিবার সুকান্ত তার মা-বাবাকে সঙ্গে করে দুপুরের আগে আগেই সুচরিতাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। তাদের যথেষ্ট সমাদর করে ড্রইংরুমে এনে বসানো হয়েছিল।

তখন গরমকাল। চা-কফি নয়, বরফের টুকরো মেশানো ঘোলের শরবত এবং মিষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন সুচরিতা।

মুখোমুখি বসে প্রথমে পরিচয় পর্বটা চুকল। তারপর কুশল প্রশ্ন, সামান্য কিছু কথাবার্তা।

সুকান্তর বাবা সিতাংশুশেখর ব্যানার্জির বয়স ষাট পেরিয়েছে। তিনি ছিলেন এ জি বেঙ্গলের বড় অফিসার। বছর তিনেক হল অবসর নিয়েছেন। মা স্নেহলতা ব্যানার্জি, একটা নামকরা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার; দেড় বছর আগে তাঁরও রিটায়ারমেন্ট হয়েছে। স্বামীর মতো এখন তাঁরও অবসরের জীবন।

দুজনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। কথাবার্তায় আভিজাত্যের ছাপ। চোখে-মুখে প্রশান্তি। ওঁদের তাকানো, কথা বলার ভঙ্গি, মৃদু হাসি–এসব বুঝিয়ে দিচ্ছিল শমিতাকে তাঁদের ভালো লেগেছে।

মনে পড়ে সুচরিতা সুকান্তাদের আপ্যায়নের জন্য বিপুল আয়োজন করেছিলেন। দুপুরে ঘি-ঘাত, আলু-বেগুন ভাজা এবং ভেটকি মাছের ফ্রাই, এছাড়া নারকেল কুচি দেওয়া ঘন মুগের ডাল, দুরকম তরকারি, পাবদা মাছের ঝাল, তেল-কই, চিংড়ির মালাইকারি, চাটনি, দই এবং কাঁচাগোল্লা আর সরভাজা।

খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তারপর শিতাংশুশেখর সুচরিতাকে বলেছিলেন, যে কারণে আমাদের কলকাতা থেকে আসা এবার সেটা শোনা যাক।

সুচরিতা শমিতার দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত করেছিলেন। শমিতা প্রস্তুত হয়েই ছিল। সে ধীরে ধীরে বলে গিয়েছিল। শরৎ ব্যানার্জি রোডে তার জন্ম থেকে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত সেখানকার এক ভাড়া বাড়িতে কাটানো, তারপর বাধ্য হয়ে শহরতলি পালপাড়ায় যখন উঠে যেতে হল তখন সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখানে আসার পর দীপেনের সঙ্গে তার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা। বাবা চন্দ্রনাথ পালিত ছিলেন শ্বাসকষ্টের রুগি। পালপাড়ায় এসে বেশিদিন তিনি বাঁচেননি। অনার্স নিয়ে বি.এ এবং বি.এড পাশ করার পর স্কুলে চাকরি পাওয়া এবং দীপেনের সঙ্গে বিয়ে। কিন্তু এই বিয়েটা আদৌ সুখের হয়নি; তার কারণ দীপেন। বিয়ের আগে এবং পরে অল্প কিছুদিন যে মানুষটাকে সৎ, ভদ্র, বিনয়ী এবং সহানুভূতিশীল মনে হয়েছে সে রাতারাতি একটি ইতর, লম্পট জন্তুতে পরিণত হল। এমন এক জঘন্য অমানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সে দীপেনকে ছেড়ে মাকে নিয়ে নবাবগঞ্জ চলে আসে। আসার আগেই এখানকার স্কুলে ট্রান্সফার নেবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল।

নবাবগঞ্জে সুচরিতা সাহার মতো একজন মানুষকে অভিভাবক হিসেবে মাথার ওপর পেয়েছে সে। সবসময় তিনি তাকে আগলে আগলে রাখেন।

যাই হোক, এখানে আসার পর তার জীবনে দুটো বড় ঘটনা ঘটে গেছে। মায়ের মৃত্যু এবং দীপেনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ। সে ডিভোর্সের জন্য কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল। দীপেন কনটেস্ট করেনি। একতরফা রায় তার পক্ষেই গিয়েছিল।

মনে পড়ে, সব জানিয়ে তার ব্যাগ থেকে কোর্টের অরিজিনাল রায় এবং তার ফোটোকপি বের করে সিতাংশুশেখরকে দিয়েছিল। তিনি ফোটোকপিটা নিয়ে অরিজিনালটা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

শমিতা বলেছিল, আমি যে ডিভোর্সি সুচরিতাদি বা সুকান্তকে আগে জানাইনি। ভেবেছিলাম সুকান্তর যখন আমার সমন্ধে এত আগ্রহ তখন আপনারা যদি অনুগ্রহ করে এখানে আসেন আমার জীবনের ওই দিকটা আপনাদের সকলকে জানিয়ে দেব। কতটা গ্লানি আর যন্ত্রণা নিয়ে আমাকে কলকাতা ছেড়ে আসতে হয়েছিল, সে শুধু আমিই জানি। একটু থেমে ফের বলেছে, কোনও কিছু গোপন রেখে আপনারা যে কারণে কষ্ট করে নবাবগঞ্জে এসেছেন সেদিকে একটা পা-ও এগোতে চাই না।

ড্রইংরুমে হঠাৎ অপার নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল।

তারপর সিতাংশুশেখর সুচরিতাকে বলেছেন, আজ আমরা উঠছি। আপনি যখন ওর অভিভাবক, যা জানাবার এক সপ্তাহের মধ্যে আপনাকে জানিয়ে দেব।

.

শমিতার মনে পড়েছে, এক সপ্তাহ নয়, চারদিন পরেই স্পিডপোস্টে সিতাংশুশেখরের চিঠি এসেছিল। তিনি জানিয়েছেন, শমিতার ব্যাপারে তিনি তাঁদের পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। দুশ্চরিত্র, লম্পট স্বামীকে ত্যাগ করে আসার মতো মনের জোর তার আছে। তার চেয়ে বেশি যা রয়েছে তা হল প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ। স্বামীর কাছ থেকে শমিতা শুধু চলেই আসেনি, আদালতে মামলা করে বিবাহবিচ্ছেদও ঘটিয়েছে। এই তেজি মেয়েটির দৃঢ়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমাদের পরিবারে কোনও বিবাহ-বিচ্ছিন্না মেয়ে পুত্রবধূ হয়ে আসেনি। কিন্তু সৎ, সাহসী, শিক্ষিতা শমিতার সঙ্গে সুকান্তর আমরা বিয়ে দেব। সেই যে সিতাংশুশেখরের চিঠি এসেছিল, তার ছমাসের মধ্যে সুকান্তর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর পরই সুকান্ত নবাবগঞ্জের নার্সিংহোমের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে একটা বিরাট প্রাইভেট হাসপাতালে জয়েন করে। শমিতাও সরকারি স্কুলের কাজটা ছেড়ে কলকাতারই একটা মিশনারি স্কুলে পড়ানোর চাকরি নেয়।

সুকান্তর সঙ্গে বিয়ের বছর দেড়-দুয়েক পর পালপাড়ার সুরেশ্বর চক্রবর্তী কিংবা সুইট হোম-এর সেই ছেলেটি যার নাম অনিমেষ, তাকে জানিয়েছিল, সুইট হোম-এর আসল মালিক গুপ্তাজি দীপেনের সঙ্গে পার্টনারশিপের যে চুক্তিটা করেছিলেন, তাতে প্রচুর আইনি মারপ্যাঁচ ছিল। গুপ্তাজি ধূর্ত বিজনেসম্যান। দীপেনকে দিয়ে কাজ গুছিয়ে নেবার পর তাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেন। কেয়াতলার বাড়িতেও তাকে আর থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। দীপেনের শরীরও ভেঙে পড়েছে। চরম দুরবস্থায় উদভ্রান্তের মতো তখন তার দিন কাটছে, ইত্যাদি।

শমিতা শুধু নিঃশব্দে শুনেই গেছে। উত্তর দেয়নি। দীপেন সম্বন্ধে তার লেশপাত্র কৌতূহল বা সহানুভূতি ছিল না।

তারপর বছরের পর বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে তাতানের জন্ম হয়েছে। দীপেনের সঙ্গে প্রথম বিয়েটা সম্পূর্ণ ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুকান্তর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েটা তার জীবনকে অফুরান সুখ আর মাধুর্যে ভরে দিয়েছে।

কিন্ত কে ভাবতে পেরেছিল বহুকাল আগের একটা ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের ভগ্নাবশেষের স্মৃতি নিয়ে প্রেমূর্তির মতো পহেলগাঁওয়ে এসে হাজির হবে দীপেন! দুঃসহ সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে শমিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়াল নেই।

৩. সুকান্ত খুব ঘুমকাতুরে

০৪.

সুকান্ত খুব ঘুমকাতুরে। অনেক বেলায় তার মুখ ভাঙে। বিশেষ করে শীতকালে আর বর্ষায় তো কথাই নেই। নটা-সাড়ে নটার আগে তাকে বিছানা থেকে টেনে হেঁচড়েও ভোলা যায় না।

হোটেল পহেলগাঁওয়ের রুম-হিটারের আরামদায়ক উষ্ণতায় ভারী কম্বলের তলায় তার জম্পেশ করে ঘুমোবার কথা।

কিন্তু এতকালের রুটিনটার হেরফের হয়ে গেল। কাল রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। সাতটা বাজতে না-বাজতেই আজ সে উঠে পড়ল।

তার একপাশে শমিতা, আরেক পাশে তাতান। দুজনেই গভীর ঘুমের আরকে ডুবে আছে। কয়েক লহমা সুকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু শমিতার মুখটা দেখা যাচ্ছে না; কেননা দীর্ঘকালের অভ্যাসে সে কম্বল মুড়ি দিয়ে রয়েছে। তবে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের হালকা শব্দ কানে আসছে।

স্ত্রী বা ছেলে কারওকেই জাগাল না সুকান্ত। নিঃশব্দে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে মুখ-টুথ ধুয়ে ফিরে এসে পোশাক বদলে তার ওপর গরম ফুল-স্প্রিভ পুল-ওভার চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আজ সকালের প্রথম কাজটা কী হবে, কাল রাতে শুয়ে শুয়েই তা ঠিক করে রেখেছিল সে।

রোদ উঠে গিয়েছিল। কাশ্মীর উপত্যকায় সকালের দিকের শীতল রোদ। কনকনে হাওয়াও দিচ্ছে। লিডার নদী ঝুম ঝুম সুরেলা আওয়াজ তুলে বয়েই চলেছে।

হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছিল সুকান্ত। চারদিকে প্রচুর লোকজন। তাদের মধ্যে ট্যুরিস্টই বেশি।

সুকান্ত কোনও দিকে তাকাল না; পাঁচ-সাত মিনিটের ভেতর হোটেল প্যারাগন-এ চলে এল। রিসেপশন ডেস্কে একটি যুবক বসে ছিল। সে ইংরেজিতে বলল, গুড মর্নিং স্যার। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

সুকান্ত জানায়, কলকাতা থেকে একজন টুরিস্ট এখানে এসে উঠেছেন। তাঁর নাম দীপেন ঘোষ। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

সরি স্যার

সরি কেন?

আজ খুব সকালে, তখনও ভালো করে রোদ ওঠেনি, তিনি আমাদের ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুর কোম্পানি থেকে একটা গাড়ি ঠিক করে দিতে বলেন। অথচ কাল দুপুরে লাঞ্চের পর বেড়াতে বেরিয়ে বেশ রাত করে মিস্টার ঘোষ যখন ফিরলেন তখন তিনি ভীষণ অসুস্থ। দুহাতে বুক চেপে ধরে ছিলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার ইসমাইলকে খবর দিলাম। তিনি এসে পেশেন্টকে পরীক্ষা করে বললেন, হার্টের কন্ডিশন মোটেও ভালো নয়। নানারকম টেস্ট করতে হবে। ওষুধ লিখে দিয়ে আপাতত তিনদিন কমপ্লিট বেড়-রেস্ট। আমরা ওষুধ কিনে এনে খাইয়ে দিলাম। কিন্তু আজ সকালে তিনি একটা গাড়ি ডেকে দেবার জন্যে ইনসিস্ট করতে লাগলেন। আমরা ডাক্তার ইসমাইলের কথাগুলো তাঁকে বার বার মনে করিয়ে দিলাম। মিস্টার ঘোষ কোনও কথাই শুনলেন না। বোর্ডারের মর্জি। কী করতে পারি! গাড়ি ডাকতেই হল। তিনি হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমাদের আর কিছু করার ছিল না স্যার

সুকান্ত বেশ কিছুক্ষণ হতবাক দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জিগ্যেস করে, ডাক্তার ইসমাইল সাহেব কোথায় থাকেন? আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

রিসেপশনিস্ট যুবকটি জানায়, ডাক্তার সাহেব কাছেই থাকেন। সামনের রাস্তা দিয়ে ডানদিকে মিনিট তিন-চারেক হাঁটলেই রাস্তার ওপারে যে নীচু নীচু পাহাড়গুলো রয়েছে সেখানেই তাঁর বাংলো। যে-কোনও লোককে জিগ্যেস করলেই দেখিয়ে দেবে।

ধন্যবাদ জানিয়ে একটু পরেই ডাক্তার ইসমাইলের বাংলোর চলে এল সুকান্ত।

ডাক্তার ইসমাইলের বয়স ষাট পেরিয়েছে। নিজের দোতলা বাংলোর একতলায় তাঁর চেম্বার। ভারী সজ্জন, সুভদ্র মানুষ। তাঁর দিকে তাকালে মনে সম্ভ্রম জাগে। নিজের পরিচয় দিতেই বেশ সমাদর করে সুকান্তকে বসালেন। বললেন, আপনিও ডাক্তার। গুড। আমরা তা হলে একই ঝাঁকের পঞ্জী।

সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সুকান্ত বলল, আপনার কাছে একটা প্রয়োজনে এসেছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন

হোটেল প্যারাগন থেকে কাল বেশ অনেকটা রাত্তিরে একজন পেশেন্টকে দেখার জন্যে আপনাকে কল দেওয়া হয়েছিল

আপনি জানলেন কীভাবে?

ওই হোটেলের রিসেপশন থেকে আমাকে বলেছে।

আপনি দীপেন ঘোষকে চেনেন?

খুব সামান্য। এখানে এসে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ওঁর সম্বন্ধে আমি জানতে চাই। মানে পেশেন্টের ফিজিক্যাল কন্ডিশনটা কেমন দেখেছিলেন?

দেখুন, দীপেন ঘোষ দিন চার-পাঁচেক আগে পহেলগাঁওয়ে এসেছেন। এসেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বললেন, কয়েক বছর আগে তাঁর পর পর দুটো অ্যাটাক হয়। প্রথমটা তত মারাত্মক নয়। কিন্তু সেকেন্ডটা ম্যাসিভ। তারপর বাইপাস করায় মোটামুটি ভালোই আছেন। জানালেন তাঁর বেড়াবার খুব শখ। যেখানেই যান প্রথমে সেখানকার কোনও ডাক্তারের সঙ্গে কনট্যাক্ট করেন। হার্টের ব্যাপার কখন কী ঘটে যাবে, আগে থেকে তো বলা যায় না। যিনি ওঁর বাইপাস করেছেন সেই সার্জনের প্রেসক্রিপশন দেখালেন। আমি ওঁর হার্টের কন্ডিশন দেখলাম। ইয়াং বয়সের মতো টগবগে হওয়া সম্ভব নয়; তার ওপর বাইপাস হয়েছে। তবু দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ওঁর ডাক্তার ঠিক মেডিসিনই প্রেসক্রাইব করেছেন। কিন্তু কাল রাতে ওঁকে পরীক্ষা করে চমকে উঠি। হার্টের অবস্থা ভালো নয়। মনে হয় কোনও কারণে মেন্টাল শিক পেয়েছেন কিংবা কোনওরকম মানসিক প্রেশার। আমি ওঁর জন্যে ওষুধের ব্যবস্থা করে তিন দিনের ফুল বেড-রেস্টের কথা বলে আসি।–বেলা আরেকটু বাড়লে ওঁকে একবার দেখে আসব।

সুকান্ত বলল, দেখা হবে না ডক্টর ইসমাইল

সোজাসুজি সুকান্তর চোখর দিকে তাকালেন ডাক্তার ইসমাইল–মানে?

আজ খুব সকালে উনি একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন।

বলেন কী! আমি তো হোটেলের লোকদের বার বার বলে এসেছি, মিস্টার ঘোষের ওপর যেন নজর রাখে।

হোটেলের এমপ্লয়িরা বাধা দিয়েছিল। উনি কারও কথা শোনেননি। জোর করেই চলে গেছেন।

চোখে-মুখে তীব্র উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে ডাক্তার ইসমাইলের। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বিষঃ গলায় বলেন, এ তো সুইসাইডের মতো ব্যাপার।

.

০৫.

ডাক্তার ইসমালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ফের রাস্তায়। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে হোটেল পহেলগাঁও-এর সামনে চলে এল সুকান্ত। বড় রাস্তা থেকে একটা চওড়া নুড়ি-বিছানো ঢালু পথ সোজা হোটেলে গিয়ে ঠেকেছে। সেই পথটায় নামতেই হঠাৎ কী ভেবে ওপর দিকে তাকাল। তাদের সুইটটা দোতলায়; ড্রইংরুম বড় রাস্তার দিকে। চোখে পড়ল, শমিতা পর্দা সরিয়ে জোড়া জানলার কাঁচের পাল্লা খুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

দু-এক লহমা থমকে দাঁড়িয়ে গেল সুকান্ত। তারপর চোখ নামিয়ে হোটেলে ঢুকে লিফটে দোতলায় সোজা নিজেদের স্যুইটেবাইরের দরজাটা ভেজানো ছিল। তার জন্যই কি শমিতা ওটার লক খুলে ওইভাবে রেখে দিয়েছে?

ড্রইংরুমে এসে একটা সোফায় ধপ করে বসে পড়ল সুকান্ত। জানলার কাছ থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে অন্য একটা সোফায় বসল শমিতা। চোখের দৃষ্টি আগের মতোই স্থির। পলক পড়ছে না। চাপা গলায় জিগ্যেস করল, সকালবেলা উঠে কারওকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলে?

সুকান্ত বলল, তোমাদের তখনও ঘুম ভাঙেনি। তাই আর ডাকাডাকি করিনি। ভাবলাম একটু ঘুরে-টুরে আসি। তাই বেরিয়ে পড়লাম।

কোনওদিন তো নটা-সাড়ে নটার আগে বিছানা ছাড়ো না। আজ হঠাৎ তাড়াতাড়ি নিদ্রাভঙ্গ হল যে? শমিতার কণ্ঠস্বরে সামান্য ঝাঁঝ ফুটে বেরোয়।

রোজ কি একসময় ঘুম ভাঙে নাকি? দু-একদিন আগেও তো ভাঙতে পারে।

তা পারে। কিন্তু এত বছর বিয়ে হয়েছে, কোনও দিন তো তোমাকে মর্নিং ওয়াকে যেতে দেখিনি।

কোনও দিন যাইনি বলে আজও যে যাব না, এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?

মুখটা শক্ত হয়ে উঠল শমিতার। কঠিন গলায় বলল, তুমি ওই উটকো লোকটার কাছে গিয়েছিলে

গলার স্বর উঁচুতেও তুলল না সুকান্ত, নীচেও নামাল না। কণ্ঠস্বরকে এক জায়গায় রেখে বলল, গেসটা কারেক্ট। সঠিক অনুমান।

কী বলতে গিয়ে থেমে গেল শমিতা। টের পাচ্ছে তার কপালের দুপাশের রগগুলো দপদপ করছে।

সুকান্ত একই ভঙ্গিতে বলতে লাগল, উটকো হোক, লম্পট হোক, দুশ্চরিত্র বা ঠক-জোচ্চোর যা-ই হোক, একটা মানুষ তো। শুধু মানুষ নয়, ভয়ংকর অসুস্থ মানুষ। দু-দুটো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, বাইপাস হয়েছে।

সুকান্ত টুকরো টুকরোভাবে কাল রাতে এখান থেকে যাবার পর লোকটার কী কী হয়েছে, ডাক্তার ইসমাইল কী কী বলেছেন সব জানিয়ে বলল, ডাক্তার ইসমাইলের বারণ, হোটেল এমপ্লয়িদের আটকানোর চেষ্টা, কোনও কিছুই তাকে ঠেকাতে পারেনি। ডাক্তার ইসমাইল বলেছেন, লোকটা সুইসাইডের পথ ধরেছে। অথচ

নিজের অজান্তেই শমিতা বলল, অথচ কী?

তুমি যদি কাল রাত্তিরে একটু করুণা করতে

শমিতা চমকে উঠল। পৃথিবীতে হাজার হাজার দীপেন ঘোষ রয়েছে। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের এই দীপেন ঘোষ ঠিক কে, কী তার পরিচয়, হয়তো হয়তো বুঝতে পেরেছে সুকান্ত। অথচ তার সঙ্গে বিয়ের আগে সুচরিতাদি, সুকান্ত এবং তার মা-বাবার কাছে অকপটে তার ব্যর্থ, বিধ্বস্ত বিয়ের কথা সবিস্তারে জানিয়ে দিয়েছিল শমিতা। তখন বার বার দীপেনের নাম উঠে এসেছিল। বিয়ের পর এতগুলো বছরে শমিতা, সুকান্ত বা কেউ একবারও দীপেনের নাম উচ্চারণ করেনি। মনে হয়েছিল ওই পর্বটা দীপেন সমেত বাড়ির সবাই চিরতরে ভুলে গেছে।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? নইলে সকাল হতে-না-হতেই সুকান্ত দীপেনের হোটেলে ছুটবে কেন? মানুষের স্মৃতি বা মনের অন্ধকার সব অলিন্দে কত কিছুই তো লুকিয়ে থাকে যা কোনও কোনও মুহূর্তে আচমকা বেরিয়ে আসে।

শমিতা তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। জিগ্যেস করল, কীসের করুণা?

তুমি যদি কাল রাতে লোকটাকে আমাদের সুইটে থেকে যাবার কথা বলতে, সে বেঁচে যেত। আমার ধারণা সে শ্রীনগরের দিকেই গেছে। মনে হয় পথেই মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যাবে। হি উইল ডাই। সে খুব সম্ভব বাঁচবে না।

সুকান্ত কি বিয়ের এতদিন পর তাকে পরখ করতে চাইছে? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল শমিতা।

Exit mobile version