কলকাতার উত্তরে-দক্ষিণে, পুবে বা পশ্চিমে তখন পুরোনো-গুরোনো সেকেলে বাড়ি-টাড়ি ভেঙে বিশাল বিশাল হাইরাইজ উঠতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, পাইকপাড়া, দমদম, সিঁথি, চেতলা, বেহালা-শহরতলির নানা অঞ্চল রাতারাতি বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে। গ্রেটার কলকাতার স্কাইলাইন। কিন্তু আশ্চর্য, কলকাতার লাগোয়া পালপাড়ার দিকে তখনও প্রোমোটার, ডেভলাপারদের নজর এসে পড়েনি।
চন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন। বেশি সময় লাগল না। ডাইনে-বাঁয়ে তিন-চারটে রাস্তা ঘুরে একটু পরেই ম্যাটাডোর ভ্যান আর ট্যাক্সিটা অম্বিকা পাল রোডে একটা সাদামাঠা দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল। বাড়িটার নম্বর বারো। সেটা একটা সাদামাঠা দোতলা। এরই একতলায় দুকামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন চন্দ্রনাথ।
দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক সুরেশ্বর চক্রবর্তী। ভ্যান আর ট্যাক্সি দেখে নেমে এলেন তিনি এবং তাঁর পরিবারের লোকজন। তা ছাড়া আশপাশের বাড়িগুলো থেকে অনেকেই চলে এসেছে।
সুরেশ্বরের বয়স পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি। এই বয়সেও মেদ-টেদ জমেনি। বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। তবে মাথার চুল একটাও কালো নেই। বেশ হাসিখুশি মানুষ। তাঁর স্ত্রী প্রতিমার রীতিমতো ভারী শরীর। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। একটি কুড়ি-বাইশ বছরের সুশ্রী তরুণী এবং বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের একটি বিবাহিতা মহিলাকে দেখা গেল। তার সিঁথি এবং কপালে সিঁদুর। তাদের সঙ্গে দু-তিনটি ছেলেমেয়েও দেখা গেল। তাদের বয়স তিন থেকে সাত।
সুরেশ্বর এবং প্রতিমা সম্পর্কে খুঁটিনাটি আগেই শমিতা আর লতিকাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ। তাই তাঁদের চিনতে অসুবিধা হল না শমিতার। কিন্তু তরুণী দুটি এবং বাচ্চাগুলোর সঙ্গে সুরেশ্বরের কী সম্পর্ক তখনো জানা যায়নি।
সুরেশ্বর ব্যস্তভাবে ম্যাটাডোর আর ট্যাক্সির কাছে চলে এলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও। হাসিমুখে বললেন, আসুন, আসুন চন্দ্রনাথবাবু। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
ম্যাটাডোর থেকে ড্রাইভার এবং তার হেল্পার নেমে পড়েছিল। চন্দ্রনাথরাও নামলেন। সুরেশ্বর লতিকাকে দেখিয়ে বললেন, আপনি কে, বুঝতে পেরেছি। নমস্কার। বলেই শমিতার দিকে তাকালেন, তুমি নিশ্চয়ই মা জননী। নামটি কী তোমার মা?
শমিতা নাম বলল।
সুরেশ্বর বললেন, নিজেদের বাড়ি মনে করে এখানে থাকবে, কেমন? তারপর নিজের পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রতিমাকে দেখে আগেই বোঝা গিয়েছিল তিনি কে। যার কপালে আর সিঁথিতে সিঁদুর সে হল সবিতাসুরেশ্বরের ছেলের বউ। তরুণীটি তাঁর মেয়ে মানসী। বাচ্চাগুলো তাঁর নাতি-নাতনি-গলু, মিন্টু আর মামুন।
বাড়িটার সামনের দিকে এক চিলতে ফাঁকা ঘাসে ভরা জমি। ম্যাটাডোর ভ্যানের ড্রাইভার আর তার হেল্পার এর মধ্যে ঝপাঝপ চন্দ্রনাথদের মালপত্র–খাট, আলমারি, চেয়ার-টেবিল, গ্যাস-উনুন, বাসন-কোসন, আলনা ইত্যাদি নামিয়ে ফেলেছে।
সুরেশ্বর হাঁ হাঁ করে উঠলেন, এ কী! জিনিসগুলো এখানে ফেলে রাখলে যে! আমি বাবুদের ঘর খুলে দিচ্ছি। মাল সেখানে নিয়ে রাখো
ড্রাইভার রাজি হল না। ম্যাটাডোরের ভাড়া আগাম নেওয়া ছিল। সে ভ্যান চালিয়ে চলে গেল। এদিকে ট্যাক্সিওয়ালা তাড়া দিচ্ছিল। সে আর দাঁড়াতে পারবে না। তার ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া হোক। ভাড়া নিয়ে ট্যাক্সিতে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় নেমে নিমেষে সে উধাও হল।
চন্দ্রনাথ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। মহা মুশকিল হল। এত মাল কীভাবে ঘরে নিয়ে যাব?
সুরেশ্বর ভরসা দেবার সুরে বললেন, চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।
আশেপাশের বাড়ি থেকে যারা এসে জড়ো হয়েছিল তারাও সুরেশ্বরের সঙ্গে সুর মেলায়–আমরা তো আছি। জিনিসগুলো ঘরে নিয়ে যেখানে যেটা রাখতে বলবেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে দেব। আমরা থাকতে মাল বাইরে পড়ে থাকবে না।
একতলার কোণের দিকের দুকামরার ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলেন চন্দ্রনাথরা। সেটা তালাবন্ধ ছিল। সুরেশ্বর চাবি নিয়ে এসেছিলেন। তালা খুলে দিতেই প্রতিবেশী পুরুষ এবং মহিলারা কাজে নেমে পড়ল। এমনকী সুরেশ্বরের মেয়ে আর ছেলের বউও হাত লাগাল। ছোট ছোট জিনিসগুলো নিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা; ভারী ভারী আলমারি চেয়ার-টেবিল, খাট-টাট টানাটানি করতে একেবারে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল পুরুষ প্রতিবেশীরা।
ঠিক এইসময় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ভারী সুদর্শন একটি যুবক সাইকেল চালিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে প্রচুর লোকজন দেখে ঘাসের জমিটায় ঢুকে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সুরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বলল, কাকু, আপনার টেনান্টরা এসে গেছে মনে হচ্ছে।
সুরেশ্বর বললেন, হ্যাঁ। এই কিছুক্ষণ আগে।
তার বাহনটিকে এক কোণে দাঁড় করিয়ে যুবকটি এগিয়ে গেল। চন্দ্রনাথদের দেখিয়ে সুরেশ্বর বললেন, এই যে এঁরা। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন।
যুবকটির নাম দীপেন-দীপেন ঘোষ। রাস্তার মোড়ের মাথায় ছোট একতলা বাড়িটা তাদের। মা আর ছেলের ছোট্ট সংসার। বি.এসসিতে অনার্স নিয়ে দারুণ রেজাল্ট করার পর একটা টিউটোরিয়ালে পড়ায়। চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছে কিন্তু এখনও কিছু জোটাতে পারেনি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সুরেশ্বর চন্দ্রনাথের দিকে তাকালেন।–ছেলেটা খুবই পরোপকারী, হেল্পফুল, মানুষের বিপদে-আপদে