সুকান্ত জিগ্যেস করল, বাড়িতে আর কে কে আছে?
আমি একাই।
চোখ কপালে তুলে একটা নকল বিস্ময়ের ভঙ্গি করল সুকান্ত।–দারা পুত্র পরিবার কেউ নেই?
মাথাটা ডাইনে থেকে বাঁয়ে, বাঁয়ে থেকে ডাইনে বারকয়েক দোলাল দীপেন।–শুধু একটা কাজের লোক এসে দু-বেলা রান্না-টান্না করে দিয়ে যায়। যদি মনে করেন সে আমার ফ্যামিলি মেম্বার তা হলে তাই।
চোখ গোলাকার করে সুকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকায়।সংসারের কোনওরকম ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট নেই। একেবারে মুক্তপুরুষ-কী বলে?
শমিতা উত্তর দিল না।
সুকান্তর চোখ আবার ফিরে এল দীপেনের দিকে।বেশ আছেন মিস্টার ঘোষ।
দীপেনের চোখ-মুখে নির্জীব, ফিকে একটু হাসি ফুটে উঠতে-না-উঠতেই মিলিয়ে গেল।
সুকান্ত এবার বলল, সবে পরিচয় হয়েছে। বেশি কৌতূহল প্রকাশ করতে নেই। যদিও অশোভন, তবু একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছে।
ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিটা চলছেই। সুকান্ত কী জানতে চাইছে, কে জানে! সতর্কভাবে দীপেন বলল, বলুন–
আপনি কি কোনও সারভিসে আছেন বা অন্য কিছু করেন?
অস্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রাটা একটু কমল দীপেনের।-আমি কিছুই করি না। না সারভিস, না বিজনেস। একেবারে নিষ্কর্মা, বেকার। বলেই খেয়াল হল সুকান্ত যে স্তরের মানুষ, অশোভন জেনেও একজন সদ্য পরিচিতকে সে কী করে না করে, এ জাতীয় গাঁইয়া মার্কা প্রশ্ন করবে কেন? পরক্ষণে নিজের অজান্তে তার চোখ দুটো শমিতার দিকে চলে গেল। শমিতা ঠোঁট টিপে, একদৃষ্টে পলকহীন তাকেই লক্ষ করছে।
হোটেলে আসার পর তার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি শমিতা। আগেও বলেছে কি? মনে পড়ল না দীপেনের। শমিতাকে কেমন যেন আড়ষ্ট, সতর্ক দেখাচ্ছে। কিন্তু সুকান্তর মতো তারও কি তার সম্বন্ধে কৌতূহল রয়েছে? সমস্ত ব্যাপারটা দুর্বোধ্য, ঘোলাটে লাগছে দীপেনের কাছে। অস্বাচ্ছন্দ্যটা যেটুকু কমেছিল তার কয়েকগুণ বেড়ে ফিরে এল যেন।
সুকান্ত হইচই বাধিয়ে বলল, ওই দেখুন, আপনাকেই শুধু এটা-ওটা জিগ্যেস করে চলেছি। অথচ আমাদের সম্বন্ধেও তো আপনাকে জানানো দরকার।
মাত্র ঘণ্টা দেড়-দুই হল তাদের পরিচয় হয়েছে, হয়তো জীবনে আর কখনও সুকান্তদের সঙ্গে দেখা হবে না। তা হলে এত জানাজানির প্রয়োজনটা কী? তক্ষুনি দীপেনের খেয়াল হয় মাঝখানে শমিতা রয়েছে। সুকান্তর প্রশ্নগুলো কি তারও হতে পারে? অস্বস্তি তো ছিলই, ক্রমশ যেন কুঁকড়ে যেতে লাগল সে।
সুকান্ত বলতে লাগল, জানেন মিস্টার ঘোষ, আমরা ওল্ড কলকাত্তাইয়া। পাঁচ-ছ জেনারেশন ধরে ওখানে আছি। ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন ইংরেজ আমলে একটা বিরাট ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। তাঁর ছেলে ওই ফার্মেই বিরাট পোস্টে ছিলেন। ঠাকুরদা, আমার বাবা আর দুই কাকা হাইকোর্টের লইয়ার। তারপর আমাদের জেনারেশন। আমরা কেউ বাপ-ঠাকুরদার পথে হাঁটিনি। আমি ডাক্তার, আমার ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার, খুড়তুতো ভাইরা কেউ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কেউ ব্যাঙ্কার, কেউ বা প্রফেসর। আপনি তো বললেন একেবারে একা। আমরা কিন্তু উলটো। কয়েক জেনারেশন ধরে আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাবা, কাকা, মা, কাকিমা, খুড়তুতো ভাই-টাই, তাদের বউরা, নিজের ছেলে, ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে আছি। আমাদের টোটাল ফ্যামিলি মেম্বার কত জানেন? সাতাশ। হোল বেঙ্গল চষে ফেলুন, এত বড় ফ্যামিলি কমই পাবেন। খুব বেশি হলে পাঁচ-দশটা। এখন নিজের বউ, দু-একটা বাচ্চা নিয়ে ছোট ছোট সব ফ্যামিলি।
দীপেন হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিল। সুকান্ত ব্যানার্জি নিজেদের সম্বন্ধে এমন সাতকাহন কেঁদে বসল কেন? অচেনা একটি মানুষকে এসব শোনাবার পেছনে কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে কি?
বলতে বলতে সুকান্ত দীপেনের দিকে তাকাল।–সব শুনছেন তো মিস্টার ঘোষ?
আস্তে মাথা নড়ল দীপেন। আবছা গলায় বলল, শুনছি।
পাইকপাড়ায় গিয়ে যদি ব্যানার্জি ভিলা-র নাম করবেন যে-কেউ দেখিয়ে দেবে। প্যালেসের মতো চারতলা বাড়িটা বানিয়েছিলেন আমার ঠাকুরদার বাবা। ওটা ওই এলাকার ল্যান্ডমার্ক। ওটা খুব শিগগিরই হেরিটেজ বিল্ডিং হয়ে যাবে।
চকিতে দীপেনের খেয়াল হল, নিজেদের বংশগরিমা, রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি, আভিজাত্য-টাত্য নিয়ে আধঘন্টা ধরে সুকান্ত একটানা যা জাহির করল তার পেছনে কোথাও কি চাপা আত্মম্ভরিতা রয়েছে? সে কি বোঝাতে চেয়েছে, দেখো আমাদের পারিবারিক স্টেটাসের কাছে তুমি কত তুচ্ছ, কত অকিঞ্চিৎকর। দীপেন জানে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানাতে চায়, আমরা এই করেছি, সেই করেছি, আমাদের এত সুনাম, এত বৈভব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অপরিচিত একটি লোককে ডেকে এনে অবিরল এই নিয়ে কীর্তন গাওয়ার কারণটার তলকূল আগেও পায়নি সে, এখনও পেল না। ব্যাপারটা তার কাছে ধোঁয়াটে হয়ে রইল।
আচমকা সুকান্তর খেয়াল হল দীপেন হাত থেকে কফির মগটা নামিয়ে রেখেছে। প্লেটে প্লেটে সুখাদ্যগুলি তেমনই পড়ে আছে। সুকান্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।-এ কী মিস্টার ঘোষ, আপনি তো কিছুই ছোঁননি। আমি সমানে বকবক করে যাচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই বোরড ফিল করছিলেন। কফিটা জুড়িয়ে গেছে। শমিতার দিকে ফিরে বলল, আমাদের গেস্ট, তুমি একটু লক্ষ রাখবে তো? রুম-সারভিসে বলে দাও, ঠান্ডা কফি-টফি ফেরত নিয়ে গিয়ে গরম খাবার-টাবার দিয়ে যায় যেন