হঠাৎ সবার চোখে পড়ল সূর্য পশ্চিমদিকের পাহাড়গুলোর মাথা ছুঁই ছুঁই করছে। চারিদিকের উঁচু উঁচু আর ছোট ছোট পাহাড়ের ছায়া ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। বাতাস আরও কনকনে। সূর্য দূরের পাহাড়গুলোর ওধারে চলে গেলে অন্ধকার নামতে শুরু করবে।
ব্যস্তভাবে সুকান্ত বলল, ঠান্ডাটা ভীষণ বেড়ে গেল। আপনি এখানে কোথায় উঠেছেন?
আঙুল বাড়িয়ে লিডার নদীর ধারে তার হোটেলটা দেখিয়ে দিল দীপেন। দোতলা ছোট হোটেল। নাম প্যারাগন।
আপনার কোনও আর্জেন্ট কাজ-টাজ আছে?
আমার কখনও কোনও কাজ থাকে না। আমি ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট বেকার। বেড়াতে এসেছি। কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করি। এখানে যাই, সেখানে যাই। শীতটা যখন সহ্য হয় না, হোটেলে ফিরে টিভি চালিয়ে কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়ি। রাত হলে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে ফের কম্বলের নীচে। কাজ বলতে এটুকুই। দীপেন বলছিল ঠিকই, তবে তার চোখ বার বার শমিতার দিকে চলে যাচ্ছিল।
সুকান্ত প্রায় লাফিয়ে উঠল।–ফাইন। আলাপ হল। কাশ্মীরের এই শীতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি? চলুন, চলুন, কফি-টফি খেতে খেতে জমিয়ে গল্প করা যাবে। ওই যে আমাদের হোটেল।
হোটেল প্যারাগন থেকে বেশ খানিকটা দুর লিডার নদীরই ধারে এখানকার সবচেয়ে বড় হোটেল–হোটেল পহেলগাঁও। দীপেন জানে শুধু বড়ই নয়, কাশ্মীরের এই এলাকায় সবচেয়ে পুরোনো এবং অভিজাত পান্থনিবাস। ওখানকার ডাবল-বেড রুমের প্রতিদিনের ভাড়া ছহাজার। তার মতো মানুষ একদিন হয়তো ওই হোটেলটায় থাকতে পারত। কিন্তু সেসব দিন আর নেই।
দীপেন বলল, না না, প্লিজ আপনারা যান।
চলুন তো মশাই বলে স্ত্রীর দিকে ঘাড় ফেরাল সুকান্ত। কী হল, বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে। মিস্টার ঘোষকে রিকোয়েস্ট করো। ভদ্রলোক আমাদের এত উপকার করলেন।
শমিতা এর মধ্যে হয়তো খানিকটা সামলে নিয়েছিল। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল, তুমিই তো এত করে বলছ। আশা করি, উনি আমাদের সঙ্গে যাবেন। তার মুখে ফিকে একটু হাসি ফুটল।
আর কেউ টের না পাক, দীপেন ঠিকই বুঝেছে শমিতার ভেতর তুমুল তোলপাড় চলছে। বাইরে স্বাভাবিকতার যে খোলসটা দেখা যাচ্ছে সেটা পুরোপুরি মেকি।
আরও বারকয়েক না না করল দীপেন। কিন্তু সুকান্ত ছাড়লে তো। শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হল। এতক্ষণ সিঁটিয়ে ছিল তাতান। যে-ই বুঝল মায়ের বকুনি আর মারধরের হাত থেকে আপাতত রেহাই পাওয়া গেছে, গা ছাড়া দিয়ে সে এসে দীপেনের একটা হাত ধরল।-চলো আঙ্কেল-চলো
হোটেল পহেলগাঁও-এর দিকে হাঁটতে হাঁটতে কোনও দিকেই নজর ছিল না দীপেনের। তাতান সমানে কল কল করে চলেছে; সুকান্তও কী সব বলে যাচ্ছে। আবছা আবছা কিছু কিছু শব্দ কানে আসছিল। সে ভাবছিল কখনও কখনও ভ্যাদভেদে, বিস্বাদ, একঘেয়ে জীবনে আচমকা চমকে দেবার মতো এমন কিছু ঘটে যায় যা পরমায়ুর বাকি দিনগুলোকে অপার আনন্দে ঝলমলে করে তোলে। আবার এমন কিছু ঘটে যা অবাঞ্ছিত, দমবন্ধ-করা, সমস্ত ভাবনা-চিন্তাকে উথালপাথাল করে দেয়। আজকের দিনটায় দীপেনের জীবনে ঠিক তাই ঘটল। হয়তো শমিতার জীবনেও। সুদূর পহেলগাঁও-এ পনেরো-ষোলো বছর বাদে নিয়তিতাড়িত দুটি মানুষের যে দেখা হয়ে যাবে, তারা নিজেরাই কি কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল।
.
০২.
হোটেল পহেলগাঁও-এ ডাবল বেড রুম না, বড় বড় দুকামরার একটা সুইট নিয়েই আছে সুকান্ত ব্যানার্জিরা। একটা বেড রুম, অন্যটা ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম। দামি দামি ক্যাবিনেট, কার্পেট, রুম-হিটার দিয়ে সুইটটা সাজানো। এমন একটা সুইট ভাড়া নিয়ে দামি হোটেলে যারা থাকতে পারে তারা সোসাইটি কোন স্তরের মানুষ, তা বলে দিতে হয় না। সেখানে পা দিয়েই টের পাওয়া গেল আরামের, বিলাসের নানা উপকরণ সেখানে ছড়ানো। শমিতা যে কতটা সুখে আছে হোটেলের এই সুসজ্জিত কক্ষটি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দীপেনকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
সুকান্ত ব্যানার্জি বেশ আন্তরিক সুরে বলল, বসুন মিস্টার ঘোষ, বসুন
দীপেনের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এখানে না এলেই ভালো হত। কোনও একটা জোরালো অছিলা খাড়া করে এড়িয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু তেমন সুযোগই তো পাওয়া গেল না। আড়ষ্টভাবে একটা সোফায় বসতে বসতে দীপেন ভাবল, এখানে কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হবে, কে জানে!
সুকান্তও বসে পড়েছিল। দীপেনকে তাতানের ভীষণ ভালো লেগেছে। একরকম তার জন্যই মায়ের হাতের বেদম ঠ্যাঙানির হাত থেকে আজকের দিনটা রেহাই পাওয়া গেছে। সে দীপেনের পাশে ঘন হয়ে বসল।
শমিতা কিন্তু দাঁড়িয়েই আছে। চোখে মুখে কেমন একটা অস্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ। তার দিকে তাকিয়ে সুকান্ত বলল, কী হল, ভদ্রলোককে ধরে নিয়ে এলাম। হসপিটালিটিতে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে যে। কী ভাবছেন উনি! তড়বড় করে বলতে লাগল, এক্ষুনি রুম-সারভিসে বলে দাও কফি-টফি যেন পাঠিয়ে দেয়। খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাক।
কয়েক মিনিটের ভেতর কফি কাবাব কাজুবাদাম কাটলেট-টাটলেট এসে গেল।
তাতান ছাড়া বাকি তিনজন কফির কাপ তুলে নিল। তাতান মনোনিবেশ করল কাটলেট, কাবাবে।
কফিতে চুমুক দিয়ে সুকান্ত হইহই করে উঠল।-রাস্তায় দু-একটা মোটে কথা হয়েছে। এবার আলাপটা জমানো যাক। বললেন, গড়িয়ায় থাকেন।
সুকান্ত যে মজলিশি মানুষ, যৎসামান্য পরিচয়েই তার আঁচ পেয়েছে দীপেন। আস্তে মাথা নাড়ল সোহা।