কাজের লোক বলাইকে বাদ দিলে কথা বলার প্রায় কেউ নেই তার। বহুদূরের পহেলগাঁওয়ের রাস্তায় হঠাৎই তাতান নিজের থেকে এসে ভাব জমিয়েছে। ভারী মিষ্টি, একটু একটু দুষ্টু এই ছেলেটার সঙ্গ কী ভালো যে লাগছে! দীপেনের নুয়ে-পড়া ক্ষয়াটে শরীরে অনন্তকাল আগের তার যুবা বয়সের খানিকটা এনার্জি যেন ফিরে এসেছে।
তাতান, তার মা-বাবা, তাদের বাড়ির অন্য লোকজন সম্বন্ধে খুব কৌতূহল হচ্ছিল দীপেনের। কী জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দূর থেকে কোনও মহিলার তীব্র, চকিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।-ওই তো তাতান, ওই তো-
চমকে সেদিকে তাকাতেই দীপেনের চোখে পড়ল, একজন সুন্দরী মহিলা, দামি শাড়ির ওপর গরম লেডিস কোট পরা, তার সঙ্গী একজন ভারী সুদর্শন মাঝবয়সি ভদ্রলোক, পরনে টাউজার্স, শার্টের ওপর ফুল-স্লিপ পুল-ওভারভিড়ের ভেতর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় ঊধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে।
দীপেনরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাশ থেকে তাতান নীচু গলায় বলল, আমার মা আর বাবা
মাত্র কয়েক লহমা। পুরুষ এবং মহিলাটি কাছে চলে এল।
পুরুষটি অর্থাৎ তাতানের বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না তাতান। তুমি আমাদের পাগল করে ছাড়বে। বলতে বলতেই তার চোখ এসে পড়ল দীপেনের ওপর। আপনার সঙ্গে আমাদের ছেলে; ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো!
দীপেন বলল, আমি একজন ট্যুরিস্ট। আপনাদের ছেলে নিজেই এসে আমার সঙ্গে আলাপ করেছে। তারপর তাদের মধ্যে যা যা কথা হয়েছে সব জানিয়ে বলতে লাগল, আপনারা কোথায় আছেন শুনে নিয়ে আপনাদের কাছে ওকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলাম। ভালোই হল, রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল। একটু হেসে ফের বলল, অনেক দূরে একটা পাহাড়ের সাদা পিক দেখে বার বার জিগ্যেস করছিল, ওখানে বরফ পড়েছে কিনা—
আমারই দোষ। বলেছিলাম এর মধ্যে কাশ্মীরে বরফ পড়ে। সেটাই ওর মাথায় ঢুকে গেছে। বরফ বরফ করে অস্থির করে তুলছিল। আমরা হর্স-রাইডের জন্যে ঘোড়া ঠিক করছিলাম; কখন এদিকে চলে এসেছে, প্রথমটা টের পাইনি। তার পর খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। কপাল ভালো, আপনার মতো একজন ভদ্রলোকের কাছে ছেলেটা গিয়েছিল।
দীপেন জিগ্যেস করল, আপনাদের না-বলে এরকম বেরিয়ে পড়ে নাকি?
মাঝে মাঝেই। মাথায় একটা কিছু চাপলেই হল। দেশটা বদমাশ খুনি কিডন্যাপারে ভরে গেছে। ভদ্রলোক আর কটা? কোনদিন যে কার পাল্লায় পড়বে। সবসময় ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের টেনশানে থাকতে হয়। আপনি যা করলেন সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
একটু বিব্রতভাবে হাসল দীপেন।-না না, ধন্যবাদ পাওয়ার মতো এমন কিছু কিন্তু করিনি।
কী করেছেন, সেটা আমি জানি
ওদিকে মহিলাটি আগুন-চোখে তাতানের দিকে তাকিয়ে ছিল। চাপা, গনগনে গলায় সে বলছিল, অবাধ্য, পাজি ছেলে। একেবারে জ্বালিয়ে মারলে। আজ তোমার কী হাল করি, দেখো। হাড়-মাংস আলাদা করে ছাড়ব। এসো এদিকে
তাতান অপরাধী অপরাধী মুখ করে, ঠোঁট টিপে মায়ের দিকে মিটিমিটি তাকাতে তাকাতে এক দৌড়ে তার বাবার গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল। দীপেন আন্দাজ করল, এই ঘোর সংকটে বাবাই তার একমাত্র রক্ষাকর্তা।
তাতানের বাবা দীপেনের দিকে তাকিয়েই ছিল। বলল, আপনি আমাদের এত বড় একটা উপকার করলেন, কিন্তু পরিচয়ই তো হল না। আমার নাম সুকান্ত ব্যানার্জি। ডাক্তারি করি। আর ইনি শমিতা-আমার স্ত্রী; একটা মিশনারি স্কুলে হিস্ট্রি পড়ান। বলেই হাতজোড় করল।
এতক্ষণ ডক্টর সুকান্ত ব্যানার্জি আর তাতানকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল দীপেন। মহিলাটি, অর্থাৎ শমিতাকে সেভাবে লক্ষ করেনি। শমিতা নামটা তার কানে খট করে লেগেছিল। কিন্তু কোটি কোটি বাঙালির মধ্যে শমিতা কি একজনই? হাজার হাজার শমিতা রয়েছে। হাতজোড় করে মহিলার দিকে ভালো করে তাকাতেই তার ভাঙাচোরা, শীর্ণ শরীরের ভেতর দুর্বল হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি মুহূর্তে যেন থমকে গেল। কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল সে। পনেরো-ষোলো বছর পর আবার দেখা শমিতাকে চিনতে তার অসুবিধা হয়নি। সামান্য মেদ জমেছে চেহারায় এবং আরও অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে।
শমিতাও হাতদুটো জড়ো করে বুকের কাছে তুলে এনেছিল। ধ্বস্ত, জীর্ণ প্রেতের মতো মানুষটাকে আগে তেমন লক্ষ করেনি। তাতানকে নিয়ে সে এতটাই উৎকণ্ঠিত ছিল যে, খেয়াল করার কথা নয়। এবার কিন্তু শমিতা চিনতে পেরেছে। মুহূর্তে সব রক্ত সরে গিয়ে মুখটা একেবারে ছাইবর্ণ হয়ে যায়। তার গলার ভেতর থেকে ফ্যাসফেসে আওয়াজ বেরিয়ে এল।-নমস্কার।
তারা কেউ লক্ষ করেনি, সুকান্ত ব্যানার্জি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাত্র দু-এক মিনিট। পনেরো-ষোলো বছর পর দেখা একটি পুরুষ এবং একটি নারীর কাছে সময়টা যেন কয়েক যুগেরও বেশি।
একসময় সুকান্ত ব্যানার্জির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।-আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানতে পারিনি।
চমকে উঠল দীপেন। ঝটিতি তার চোখ সুকান্তর দিকে ঘুরে গেল। শ্বাসটানা গলায় নিজের নামটা জানিয়ে বলল, বলার মতো তেমন কোনও পরিচয় আমার নেই। আমি সামান্য একজন মানুষ।
সামান্য কি অসামান্য, সেটা অন্যকে ভাবতে দিন। বোধহয় কলকাতায় থাকেন?
হ্যাঁ, গড়িয়ায়। সেটা গ্রেটার ক্যালকাটায় ঢুকে গেছে। সেই হিসাবেই কলকাতায় থাকি, বলা যায়। দেড় কামরার ছোট একটা ফ্ল্যাট আমার। পায়রার খোপ আর কী। সে চুপ করে গেল।