সুকান্ত বলল, দেখা হবে না ডক্টর ইসমাইল
সোজাসুজি সুকান্তর চোখর দিকে তাকালেন ডাক্তার ইসমাইল–মানে?
আজ খুব সকালে উনি একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন।
বলেন কী! আমি তো হোটেলের লোকদের বার বার বলে এসেছি, মিস্টার ঘোষের ওপর যেন নজর রাখে।
হোটেলের এমপ্লয়িরা বাধা দিয়েছিল। উনি কারও কথা শোনেননি। জোর করেই চলে গেছেন।
চোখে-মুখে তীব্র উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে ডাক্তার ইসমাইলের। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বিষঃ গলায় বলেন, এ তো সুইসাইডের মতো ব্যাপার।
.
০৫.
ডাক্তার ইসমালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ফের রাস্তায়। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে হোটেল পহেলগাঁও-এর সামনে চলে এল সুকান্ত। বড় রাস্তা থেকে একটা চওড়া নুড়ি-বিছানো ঢালু পথ সোজা হোটেলে গিয়ে ঠেকেছে। সেই পথটায় নামতেই হঠাৎ কী ভেবে ওপর দিকে তাকাল। তাদের সুইটটা দোতলায়; ড্রইংরুম বড় রাস্তার দিকে। চোখে পড়ল, শমিতা পর্দা সরিয়ে জোড়া জানলার কাঁচের পাল্লা খুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
দু-এক লহমা থমকে দাঁড়িয়ে গেল সুকান্ত। তারপর চোখ নামিয়ে হোটেলে ঢুকে লিফটে দোতলায় সোজা নিজেদের স্যুইটেবাইরের দরজাটা ভেজানো ছিল। তার জন্যই কি শমিতা ওটার লক খুলে ওইভাবে রেখে দিয়েছে?
ড্রইংরুমে এসে একটা সোফায় ধপ করে বসে পড়ল সুকান্ত। জানলার কাছ থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে অন্য একটা সোফায় বসল শমিতা। চোখের দৃষ্টি আগের মতোই স্থির। পলক পড়ছে না। চাপা গলায় জিগ্যেস করল, সকালবেলা উঠে কারওকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলে?
সুকান্ত বলল, তোমাদের তখনও ঘুম ভাঙেনি। তাই আর ডাকাডাকি করিনি। ভাবলাম একটু ঘুরে-টুরে আসি। তাই বেরিয়ে পড়লাম।
কোনওদিন তো নটা-সাড়ে নটার আগে বিছানা ছাড়ো না। আজ হঠাৎ তাড়াতাড়ি নিদ্রাভঙ্গ হল যে? শমিতার কণ্ঠস্বরে সামান্য ঝাঁঝ ফুটে বেরোয়।
রোজ কি একসময় ঘুম ভাঙে নাকি? দু-একদিন আগেও তো ভাঙতে পারে।
তা পারে। কিন্তু এত বছর বিয়ে হয়েছে, কোনও দিন তো তোমাকে মর্নিং ওয়াকে যেতে দেখিনি।
কোনও দিন যাইনি বলে আজও যে যাব না, এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?
মুখটা শক্ত হয়ে উঠল শমিতার। কঠিন গলায় বলল, তুমি ওই উটকো লোকটার কাছে গিয়েছিলে
গলার স্বর উঁচুতেও তুলল না সুকান্ত, নীচেও নামাল না। কণ্ঠস্বরকে এক জায়গায় রেখে বলল, গেসটা কারেক্ট। সঠিক অনুমান।
কী বলতে গিয়ে থেমে গেল শমিতা। টের পাচ্ছে তার কপালের দুপাশের রগগুলো দপদপ করছে।
সুকান্ত একই ভঙ্গিতে বলতে লাগল, উটকো হোক, লম্পট হোক, দুশ্চরিত্র বা ঠক-জোচ্চোর যা-ই হোক, একটা মানুষ তো। শুধু মানুষ নয়, ভয়ংকর অসুস্থ মানুষ। দু-দুটো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, বাইপাস হয়েছে।
সুকান্ত টুকরো টুকরোভাবে কাল রাতে এখান থেকে যাবার পর লোকটার কী কী হয়েছে, ডাক্তার ইসমাইল কী কী বলেছেন সব জানিয়ে বলল, ডাক্তার ইসমাইলের বারণ, হোটেল এমপ্লয়িদের আটকানোর চেষ্টা, কোনও কিছুই তাকে ঠেকাতে পারেনি। ডাক্তার ইসমাইল বলেছেন, লোকটা সুইসাইডের পথ ধরেছে। অথচ
নিজের অজান্তেই শমিতা বলল, অথচ কী?
তুমি যদি কাল রাত্তিরে একটু করুণা করতে
শমিতা চমকে উঠল। পৃথিবীতে হাজার হাজার দীপেন ঘোষ রয়েছে। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের এই দীপেন ঘোষ ঠিক কে, কী তার পরিচয়, হয়তো হয়তো বুঝতে পেরেছে সুকান্ত। অথচ তার সঙ্গে বিয়ের আগে সুচরিতাদি, সুকান্ত এবং তার মা-বাবার কাছে অকপটে তার ব্যর্থ, বিধ্বস্ত বিয়ের কথা সবিস্তারে জানিয়ে দিয়েছিল শমিতা। তখন বার বার দীপেনের নাম উঠে এসেছিল। বিয়ের পর এতগুলো বছরে শমিতা, সুকান্ত বা কেউ একবারও দীপেনের নাম উচ্চারণ করেনি। মনে হয়েছিল ওই পর্বটা দীপেন সমেত বাড়ির সবাই চিরতরে ভুলে গেছে।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? নইলে সকাল হতে-না-হতেই সুকান্ত দীপেনের হোটেলে ছুটবে কেন? মানুষের স্মৃতি বা মনের অন্ধকার সব অলিন্দে কত কিছুই তো লুকিয়ে থাকে যা কোনও কোনও মুহূর্তে আচমকা বেরিয়ে আসে।
শমিতা তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। জিগ্যেস করল, কীসের করুণা?
তুমি যদি কাল রাতে লোকটাকে আমাদের সুইটে থেকে যাবার কথা বলতে, সে বেঁচে যেত। আমার ধারণা সে শ্রীনগরের দিকেই গেছে। মনে হয় পথেই মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যাবে। হি উইল ডাই। সে খুব সম্ভব বাঁচবে না।
সুকান্ত কি বিয়ের এতদিন পর তাকে পরখ করতে চাইছে? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল শমিতা।