মনে পড়ে সুচরিতা সুকান্তাদের আপ্যায়নের জন্য বিপুল আয়োজন করেছিলেন। দুপুরে ঘি-ঘাত, আলু-বেগুন ভাজা এবং ভেটকি মাছের ফ্রাই, এছাড়া নারকেল কুচি দেওয়া ঘন মুগের ডাল, দুরকম তরকারি, পাবদা মাছের ঝাল, তেল-কই, চিংড়ির মালাইকারি, চাটনি, দই এবং কাঁচাগোল্লা আর সরভাজা।
খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তারপর শিতাংশুশেখর সুচরিতাকে বলেছিলেন, যে কারণে আমাদের কলকাতা থেকে আসা এবার সেটা শোনা যাক।
সুচরিতা শমিতার দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত করেছিলেন। শমিতা প্রস্তুত হয়েই ছিল। সে ধীরে ধীরে বলে গিয়েছিল। শরৎ ব্যানার্জি রোডে তার জন্ম থেকে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত সেখানকার এক ভাড়া বাড়িতে কাটানো, তারপর বাধ্য হয়ে শহরতলি পালপাড়ায় যখন উঠে যেতে হল তখন সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখানে আসার পর দীপেনের সঙ্গে তার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা। বাবা চন্দ্রনাথ পালিত ছিলেন শ্বাসকষ্টের রুগি। পালপাড়ায় এসে বেশিদিন তিনি বাঁচেননি। অনার্স নিয়ে বি.এ এবং বি.এড পাশ করার পর স্কুলে চাকরি পাওয়া এবং দীপেনের সঙ্গে বিয়ে। কিন্তু এই বিয়েটা আদৌ সুখের হয়নি; তার কারণ দীপেন। বিয়ের আগে এবং পরে অল্প কিছুদিন যে মানুষটাকে সৎ, ভদ্র, বিনয়ী এবং সহানুভূতিশীল মনে হয়েছে সে রাতারাতি একটি ইতর, লম্পট জন্তুতে পরিণত হল। এমন এক জঘন্য অমানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সে দীপেনকে ছেড়ে মাকে নিয়ে নবাবগঞ্জ চলে আসে। আসার আগেই এখানকার স্কুলে ট্রান্সফার নেবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল।
নবাবগঞ্জে সুচরিতা সাহার মতো একজন মানুষকে অভিভাবক হিসেবে মাথার ওপর পেয়েছে সে। সবসময় তিনি তাকে আগলে আগলে রাখেন।
যাই হোক, এখানে আসার পর তার জীবনে দুটো বড় ঘটনা ঘটে গেছে। মায়ের মৃত্যু এবং দীপেনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ। সে ডিভোর্সের জন্য কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল। দীপেন কনটেস্ট করেনি। একতরফা রায় তার পক্ষেই গিয়েছিল।
মনে পড়ে, সব জানিয়ে তার ব্যাগ থেকে কোর্টের অরিজিনাল রায় এবং তার ফোটোকপি বের করে সিতাংশুশেখরকে দিয়েছিল। তিনি ফোটোকপিটা নিয়ে অরিজিনালটা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
শমিতা বলেছিল, আমি যে ডিভোর্সি সুচরিতাদি বা সুকান্তকে আগে জানাইনি। ভেবেছিলাম সুকান্তর যখন আমার সমন্ধে এত আগ্রহ তখন আপনারা যদি অনুগ্রহ করে এখানে আসেন আমার জীবনের ওই দিকটা আপনাদের সকলকে জানিয়ে দেব। কতটা গ্লানি আর যন্ত্রণা নিয়ে আমাকে কলকাতা ছেড়ে আসতে হয়েছিল, সে শুধু আমিই জানি। একটু থেমে ফের বলেছে, কোনও কিছু গোপন রেখে আপনারা যে কারণে কষ্ট করে নবাবগঞ্জে এসেছেন সেদিকে একটা পা-ও এগোতে চাই না।
ড্রইংরুমে হঠাৎ অপার নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল।
তারপর সিতাংশুশেখর সুচরিতাকে বলেছেন, আজ আমরা উঠছি। আপনি যখন ওর অভিভাবক, যা জানাবার এক সপ্তাহের মধ্যে আপনাকে জানিয়ে দেব।
.
শমিতার মনে পড়েছে, এক সপ্তাহ নয়, চারদিন পরেই স্পিডপোস্টে সিতাংশুশেখরের চিঠি এসেছিল। তিনি জানিয়েছেন, শমিতার ব্যাপারে তিনি তাঁদের পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। দুশ্চরিত্র, লম্পট স্বামীকে ত্যাগ করে আসার মতো মনের জোর তার আছে। তার চেয়ে বেশি যা রয়েছে তা হল প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ। স্বামীর কাছ থেকে শমিতা শুধু চলেই আসেনি, আদালতে মামলা করে বিবাহবিচ্ছেদও ঘটিয়েছে। এই তেজি মেয়েটির দৃঢ়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমাদের পরিবারে কোনও বিবাহ-বিচ্ছিন্না মেয়ে পুত্রবধূ হয়ে আসেনি। কিন্তু সৎ, সাহসী, শিক্ষিতা শমিতার সঙ্গে সুকান্তর আমরা বিয়ে দেব। সেই যে সিতাংশুশেখরের চিঠি এসেছিল, তার ছমাসের মধ্যে সুকান্তর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর পরই সুকান্ত নবাবগঞ্জের নার্সিংহোমের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে একটা বিরাট প্রাইভেট হাসপাতালে জয়েন করে। শমিতাও সরকারি স্কুলের কাজটা ছেড়ে কলকাতারই একটা মিশনারি স্কুলে পড়ানোর চাকরি নেয়।
সুকান্তর সঙ্গে বিয়ের বছর দেড়-দুয়েক পর পালপাড়ার সুরেশ্বর চক্রবর্তী কিংবা সুইট হোম-এর সেই ছেলেটি যার নাম অনিমেষ, তাকে জানিয়েছিল, সুইট হোম-এর আসল মালিক গুপ্তাজি দীপেনের সঙ্গে পার্টনারশিপের যে চুক্তিটা করেছিলেন, তাতে প্রচুর আইনি মারপ্যাঁচ ছিল। গুপ্তাজি ধূর্ত বিজনেসম্যান। দীপেনকে দিয়ে কাজ গুছিয়ে নেবার পর তাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেন। কেয়াতলার বাড়িতেও তাকে আর থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। দীপেনের শরীরও ভেঙে পড়েছে। চরম দুরবস্থায় উদভ্রান্তের মতো তখন তার দিন কাটছে, ইত্যাদি।
শমিতা শুধু নিঃশব্দে শুনেই গেছে। উত্তর দেয়নি। দীপেন সম্বন্ধে তার লেশপাত্র কৌতূহল বা সহানুভূতি ছিল না।
তারপর বছরের পর বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে তাতানের জন্ম হয়েছে। দীপেনের সঙ্গে প্রথম বিয়েটা সম্পূর্ণ ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুকান্তর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েটা তার জীবনকে অফুরান সুখ আর মাধুর্যে ভরে দিয়েছে।
কিন্ত কে ভাবতে পেরেছিল বহুকাল আগের একটা ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের ভগ্নাবশেষের স্মৃতি নিয়ে প্রেমূর্তির মতো পহেলগাঁওয়ে এসে হাজির হবে দীপেন! দুঃসহ সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে শমিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়াল নেই।
৩. সুকান্ত খুব ঘুমকাতুরে
০৪.