তুমি যা বলো তাই তো করি। কিন্তু কথাটা কী?
আমার ইচ্ছে, তুই সুকান্তকে বিয়ে কর।
কয়েক লহমা একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে শমিতা। তারপর জিগ্যেস করেছে, তোমার ইচ্ছে, না ডাক্তার সুকান্ত ব্যানার্জির ইচ্ছে?
সুচরিতা বলেছেন, আমাদের দুজনেরই।
লঘু সুরে শমিতা বলেছিল, বেশ তো আছি। ঝামেলা-ঝাট নেই। একেবারে মুক্ত বিহঙ্গ। এর মধ্যে বিয়ে, ঘর-সংসার এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে লাইফটাকে জটিল, গোলমেলে করে তোলার কোনও মানে হয়? বিয়ে-টিয়ে মানেই তো হাজারটা প্রবলেম।
কোনও মেয়েই তো পড়ে থাকছে না। দু-চারটে এক্সেপশন থাকতে পারে। বাকি সবাই তত সাতপাক ঘুরে দিব্যি সংসারধর্ম পালন করছে। তাদের কি প্রবলেম-টবলেম হচ্ছে?
চোখের সামনে তো অনেক কিছুই দেখছি। কেউ যদি সাধ করে বধ্যভূমিতে গিয়ে ঢোকে, আমার কিছু করার নেই। আমি যেমন আছি তেমনই থাকি না।
তোর যা বয়স তাতে এই মেল-ডমিনেটেড সোসাইটিতে একা একা থাকা নিরাপদ নয়। দিনকাল বড্ড খারাপ। ঘর-সংসার তো আছেই, তা ছাড়া নিরাপত্তার জন্যে মাথার ওপর একজন নির্ভরযোগ্য কারও থাকা দরকার।
তুমিই তো আছ মাথার ওপর।
আমার তো একটা ফ্যামিলি লাইফ আছে। তোর জামাইবাবু আর্মি অফিসার। কিছুদিন অরুণাচলে রইল তো, কিছুদিন রাজস্থান বর্ডারে। একমাত্র ছেলে পড়ছে বাঙ্গালোরে। জামাইবাবুর রিটায়ারমেন্ট আসছে বছর। সে ফিরে এসে আমার স্কন্ধারোহণ করবে। ছেলেটা ঘরকুনো, সে বাইরে পড়ে থাকতে চায় না। পড়াশোনা শেষ হলে কলকাতায় ফিরে কোনও কলেজ-টলেজে পড়ানোর কাজ নেবে। তখন আমার জমজমাট ফ্যামিলি লাইফ। সেসব সামলে তোকে কতটুকু সময় দিতে পারব।
আহা, আমাকে তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বার করে নাও না।
সে তো যে-কোনও সময় পারা যায়। কিন্তু বিয়ে না হলে কোনও মেয়ের লাইফে পূর্ণতা আসে না।
যত সব মান্ধাতার বাপের আমলের ধ্যানধারণা। তুমি কোনও সিঙ্গল উম্যানকে দেখোনি।
দেখেছি। তাদের শেষ জীবনে লোনলিনস কী ভয়ংকর তা-ও চোখে পড়েছে। নিরাপত্তার জন্যে একটি পুরুষ দরকার। অল্প বয়সে বাবা, তারপর স্বামী, স্বামী যদি আগেই মারা যায় তখন ছেলে। আমাদের সোসাইটিতে একটি মেয়ের লাইফের সাইকেল মোটামুটি এইরকম। ব্যতিক্রমও কিছু কিছু আছে। বিধবা মায়ের সঙ্গে অনেক ছেলে আজকাল কীরকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করে তার নমুনা মাঝে মাঝে কাগজে পড়ি। কিন্তু সবাই তো তেমন নয়। সে যাক, শুধু ফিজিক্যাল নিড নয়, নিরাপত্তা আর কম্পেনিয়নশিপের জন্যে মেয়েদের লাইফে একজন পুরুষের প্রয়োজন। শেষ বয়সের একাকিত্ব ভীষণ কষ্টকর রে শমিতা–
শমিতা হেসেছে।–দিদি, তুমি খুব দূরদর্শী দেখছি।
তোর থেকে আমি অনেক বছরের বড়। জীবনে অনেক দেখেছি। অভিজ্ঞতাও প্রচুর। তাই ভবিষ্যতের অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই।
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়া চলল।
তারপর সুচরিতা বলেছেন, কী রে, কিছু বললি না যে–
দীপেনের সঙ্গে কয়েকটা বছরের স্মৃতি আগের মতো ততটা দগদগে না হলেও একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে, তবু সেই দিনগুলো মনে পড়লেই ভীষণ অস্থির লাগে। আনমনার মতো শমিতা বলেছে, আমাকে একটু ভাবতে দাও
ঠিক আছে। সারা জীবনের ব্যাপার। ভেবে নে। চুলগুলো কালো থাকতে থাকতে ডিসিশনটা নিয়ে ফেল–
কিছুদিন অপেক্ষা করার পর তাড়া লাগাতে লাগলেন সুচরিতা। ভাবছি ভাবছি করে আরও মাসখানেক কাটিয়ে দিয়েছে শমিতা। তারপর বলেছে, দিদি, আমার কিছু বক্তব্য আছে।
বেশ তো। বল
সুকান্ত ব্যানার্জি যে আমাকে বিয়ে করতে চায়, তা কি ওর ফ্যামিলির সবাই জানেন?
জানেন। সুকান্ত তাঁদের বলেছে।
নবাবগঞ্জে আসার আগে আমার লাইফে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যা তুমিও জানো না। সুকান্ত ব্যানার্জির মা-বাবারা এলে তাঁদের সামনে সব বলব। তুমি আর সুকান্তও সামনে বসে সব শুনবে। তারপর সুকান্তরা মানে ওর মা-বাবা এবং সে নিজে কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন সুচরিতা। তারপর বলেছেন, ঠিক আছে, আমার বাড়িতেই নেক্সট রবিবার সুকান্তদের ইনভাইট করব। তোর মা-বাবা নেই। তোর মা-বাবার ভূমিকাটা আমাকেই পালন করতে হবে দেখছি।
শমিতা হেসেছে। এখন তো আমার মাথার ওপর তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা বাবা দিদি-সবই তুমি।
.
মনে পড়ে রবিবার সুকান্ত তার মা-বাবাকে সঙ্গে করে দুপুরের আগে আগেই সুচরিতাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। তাদের যথেষ্ট সমাদর করে ড্রইংরুমে এনে বসানো হয়েছিল।
তখন গরমকাল। চা-কফি নয়, বরফের টুকরো মেশানো ঘোলের শরবত এবং মিষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন সুচরিতা।
মুখোমুখি বসে প্রথমে পরিচয় পর্বটা চুকল। তারপর কুশল প্রশ্ন, সামান্য কিছু কথাবার্তা।
সুকান্তর বাবা সিতাংশুশেখর ব্যানার্জির বয়স ষাট পেরিয়েছে। তিনি ছিলেন এ জি বেঙ্গলের বড় অফিসার। বছর তিনেক হল অবসর নিয়েছেন। মা স্নেহলতা ব্যানার্জি, একটা নামকরা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার; দেড় বছর আগে তাঁরও রিটায়ারমেন্ট হয়েছে। স্বামীর মতো এখন তাঁরও অবসরের জীবন।
দুজনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। কথাবার্তায় আভিজাত্যের ছাপ। চোখে-মুখে প্রশান্তি। ওঁদের তাকানো, কথা বলার ভঙ্গি, মৃদু হাসি–এসব বুঝিয়ে দিচ্ছিল শমিতাকে তাঁদের ভালো লেগেছে।