কথামতো চারটে বাজার দশ-পনেরো মিনিট বাদে একটা ফিয়েট গাড়ি চালিয়ে ডাক্তারও এসে গেছে।
গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বাইরের দরজার কাছে চলে এসেছিলেন সুচরিতা ও শমিতা।
ফিয়েট থেকে যে নেমেছিল সে ভারী সুদর্শন এক যুবক। বত্রিশ-তেত্রিশের মতো বয়স। ডাক্তারদের হাতে যেমন থাকে সেইরকম একটা মেডিকেল ব্যাগ। সুপুরুষই নয়, তার চেহারায় রীতিমতো অভিজাত্যের ছাপ।
সুচরিতা শমিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ডাক্তারের নাম সুকান্ত ব্যানার্জি। সুকান্তকে বললেন, শমিতার মা-ই তোমার পেশেন্ট। এসো
লতিকা একটা খাটে শুয়ে ছিলেন। নানাভাবে খুব যত্ন করে তাঁকে পরীক্ষা করেছে সুকান্ত। ই সি জি-ও করা হল। তারপর গম্ভীর মুখে ডাক্তার বলেছে, এঁর তো আগেই একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। হার্টের কন্ডিশন বেশ খারাপ। আমি এক সপ্তাহের ওষুধ লিখে দিচ্ছি। যদি হার্টের কন্ডিশন ইমপ্রুভ করে, ঠিক আছে। ওঁকে বাড়িতে রেখেই টিটমেন্ট করব। নইলে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে। একটু থেমে কুণ্ঠিতভাবে জানিয়েছেন, অবশ্য নার্সিংহোমে খরচটা বুঝতেই তো পারছেন।
উৎকণ্ঠিত শমিতা বলেছে, খরচের জন্যে ভাববেন না। মাকে দয়া করে সুস্থ করে তুলুন–
শেষ পর্যন্ত নার্সিংহোমেই ভর্তি করতে হয়েছিল লতিকাকে। ঠিক যেমনভাবে চন্দ্রনাথকে কয়েক বছর আগে সাদার্ন অ্যাভেনিউর নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সকাল-বিকেল দুবেলা মাকে দেখতে গেছে শমিতা। সুকান্তকে বার বার ব্যাকুলভাবে জিগ্যেস করেছে, মা বাঁচবে তো ডাক্তারবাবু? বলুন-বলুন।
ডাক্তার সুকান্ত ব্যানার্জি বলেছে, আমাদের কাজ হল পেশেন্টকে বাঁচানো। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। সেদিক থেকে কোনও ত্রুটি নেই। তবে কেসটা খুব ক্রিটিকাল।
দেখুন মাত্র কবছর আগে বাবা মারা গেছেন। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
ডাক্তারদের কাছে মৃত্যু কোনও ঘটনাই নয়। এসব দেখতে দেখতে তারা অনেকটাই নিস্পৃহ বা অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। সুকান্তও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু শমিতার ব্যাকুলতা তাকে যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সহৃদয় গলায় বলেছে, অস্থির হবেন না। মনে সাহস রাখুন
ষোলো-সতেরো দিন নার্সিংহোমে কাটাতে হয়েছিল লতিকাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। আরেকটা ম্যাসিভ অ্যাটাক। ডাক্তার সুকান্ত ব্যানার্জি লড়াইটা কম চালায়নি। মৃত্যু এমন এক অদম্য শক্তি যাকে ঠেকানো যায় না। ডাক্তারের সমস্ত যুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে গেল।
শমিতার মনে পড়ে, মা যতদিন নার্সিংহোমে ছিলেন, বোজ দুবেলা উদভ্রান্তের মতো সে তাঁকে দেখতে গেছে। তার সঙ্গে প্রায়ই যেতেন সুচরিতা বা তার স্কুলের অন্য টিচাররা। স্কুলের গভর্নিং বডির মেম্বারও কেউ কেউ যেতেন।
শমিতা জানত, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না সুকান্ত ব্যানার্জির। সে নবাবগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস হাই স্কুলে পড়ায়, তার বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন, ব্যস এটুকুই। শমিতা বুঝতে পারত, তার ওপর সুকান্ত ব্যানার্জির অপার সহানুভূতি এসে পড়েছে। ভারী, বিষণ্ণ গলায় যখন মায়ের মৃত্যুর খবরটা সে দিয়েছে, অবুঝ বালিকার মতো অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল শমিতা। ডাক্তার তাকে শুধু সান্ত্বনাই দেয়নি; ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবার পর ডেডবডি নিয়ে যখন স্কুলের সব শিক্ষিকা-ছাত্রী এবং কর্মকর্তারা শেষকৃত্যের জন্য শ্মশানে গিয়েছিলেন, ডাক্তার তাঁদের সঙ্গে গেছে।
মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পরও সুকান্ত মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করে যেত। যখনই আসত, বার বার বলত, আপনাকে বলেছিলাম, মাকে সুস্থ করে তুলব। কিন্তু পারিনি।
শমিতার মনে হয়েছে, তাকে ভরসা দিয়েও লতিকাকে যে বাঁচাতে পারেনি সেজন্য হয়তো সুকান্তর একটা অপরাধবোধ ছিল।
ধীরে ধীরে কখন যে তরুণ, সহৃদয় ডাক্তারটি তার একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে, প্রথমদিকে শমিতা খেয়াল করেনি। যখন খেয়াল হল, নিজেকে সতর্ক করে নিয়েছে। দীপেনের কথা মনে পড়ে যেত। প্রথম দিকে সে-ও কি কম হৃদয়বান ছিল? দীপেনের ওপর অগাধ আস্থা রেখেছে সে। কত বিশ্বাস করত তাকে। তারপরও সেসব ভাবলে মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
সুকান্তর স্বভাবে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে তাকে বলা যেত না, তুমি আর এসো না। আমার জীবনে যে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে সেটাই যথেষ্ট। অভিজ্ঞতার কথাটা অবশ্য তখন সুকান্তকে জানানো হয়নি।
একদিন সুকান্ত হঠাৎ বলেছে, তোমার জন্যে আমার ভীষণ চিন্তা হয়।
শমিতা চমকে উঠেছে, কীরকম?
তুমি তো একা একা থাকো। বাকি জীবনটা কাটবে কী করে?
আমার ছাত্রীরা আছে, স্কুল আছে। ঠিক কেটে যাবে।
ঠিকঠাক কাটবে, সেটা তুমি জানো?
তেমনই ধারণা।
সেদিন আর কিছু বলেনি সুকান্ত।
মনে আছে, এর মাস সাত-আটেক বাদে সুচরিতা একদিন রাত্তিরে তাঁদের বাড়িতে তাকে খেতে বলেছিলেন। মেয়েটা একা একা থাকে, তাই প্রায়ই শমিতাকে খেতে বলতেন। সেটা নতুন কিছু নয়।
সেদিন রাত্তিরে খেতে খেতে একথা-সেকথার পর সুচরিতা বলেছিলেন, তুই তো আমাকে তোর দিদি বলে মনে করিস? নবাবগঞ্জে আসার পর দুজনের সম্পর্কটা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে সুচরিতা শমিতাকে তুই করে বলতেন; সে বলত তুমি।
শমিতা হেসে হেসে বলেছে, নিশ্চয়ই করি। তুমি তা ভালো করেই জানো।
সুচরিতা একটু চুপ করে থেকে বলেছেন, তা হলে আমার একটা কথা রাখবি?