শমিতা বলেছে, এরা আমাকে অতিষ্ঠ করে মারবে। স্কুলে আমাদের বেশিরভাগ কলিগরা কে কেমন, তুমি তো জানোই। সবাই মালবিকা গুহ নাকি? তারাও আমাকে ছাড়বে না। সামনে আহা-উঁহু করবে, পেছনে আহ্লাদে আটখানা হবে। তাই ঠিক করেছি, কলকাতায় থাকব না। তবে মুখ থেকে কথা খসালেই তো কোথাও চলে যাওয়া যায় না। বাইরের কোনও স্কুলে চলে যাবার চেষ্টা করব। আশা করি কিছু একটা জুটে যাবে।-মালবিকাদি, আমাকে কিন্তু একটু হেল্প করতে হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ বল না কী হেল্প চাই।
আমার মাকে আর আমাকে তিন-চারটে মাস তোমাদের বাড়িতে থাকতে দেবে? মানে যতদিন না বাইরে একটা কিছু জোটাতে পারছি—
যতদিন ইচ্ছে তোরা আমাদের কাছে এসে থাক। আমাদের তেতলা বাড়ির দুটো ফ্লোর তো ফাঁকাই পড়ে আছে।
আরেকটা সাহায্য চাই।
বল
অঞ্জনার কথা তোমাকে জানিয়েছি। তোমার তো অনেক জানাশোনা। তাদের কারওকে বলে ওর জন্যে যদি একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও
চেষ্টা করব। কম্পিউটার যখন জানে, আশা করি, কিছু একটা হয়ে যাবে।
.
মনে আছে, যেদিন সে কেয়াতলা থেকে চলে আসে সেদিনই বিকেলে লতিকাকে নিয়ে নাগেরবাজারে মালবিকাদের বাড়ি চলে গিয়েছিল। যাবার আগে বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তীকে তাদের ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে বলেছে, জেঠু, এগুলো আপনার কাছে থাক। আপাতত মাকে নিয়ে আমি অন্য একটা জায়গায় যাচ্ছি।
সুরেশ্বর অবাক। জিগ্যেস করেছেন, কোথায় যাবি?
আপনাকে পরে জানাব।
নাগেরবাজারে খুব বেশিদিন থাকতে হয়নি শমিতাদের। মাত্র দুমাস কয়েকদিন। তার মধ্যেই একে-ওকে ধরে নবাবগঞ্জের একটা স্কুলে ট্রান্সফারের বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল। অঞ্জনারও একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মালবিকার এক পিসতুতো ভাই নামকরা একটা ইংরেজি দৈনিকের নিউজ এডিটর। মালবিকা তাকে বলে সেখানে কম্পোজিটরের কাজটা জুটিয়ে দিয়েছে।
নবাবগঞ্জ শহরটা কলকাতা থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছিল নিষ্ফলা কাঁকুরে জমি। স্বাধীনতার পর ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা এইসব জমি কিনে নানারকম কলকারখানা বসাতে লাগলেন। স্টিল প্ল্যান্ট, কাগজকল, কেমিকেল ফ্যাক্টরি, ওষুধ তৈরির কারখানা, রংয়ের কারখানা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়ে অগুনতি মানুষ আসতে লাগল। শুধু বাঙালিরাই না, বিহারি, তামিল, ওড়িয়া, এমনি দেশের নানা প্রান্তের লোকজন।
এত মানুষ থাকবে কোথায়? তাই অনেকটা এলাকা জুড়ে নবাবগঞ্জ শহর গড়ে উঠল। প্ল্যানড টাউনশিপ। প্রশস্ত কংক্রিটের সড়কের দুধারে বিরাট বিরাট সব বিল্ডিং। শুধু বাসস্থানই নয়, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শপিং কমপ্লেক্স, ফুটবল স্টেডিয়াম, সিনেমা হল–কিছু বাকি রইল না। রাতারাতি সব তৈরি হয়ে গেল। বড় বড় ব্যাঙ্কগুলো এখানে ব্রাঞ্চ খুলল। পোস্ট অফিস, আদালত, সরকারি-বেসরকারি অজস্র অফিস খোলা হল।
নবাবগঞ্জ গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল-এ বদলি হয়ে এসেছিল শমিতা। হেডমিস্ট্রেস সুচরিতা সাহা চমৎকার মানুষ। তিনি শমিতাদের জন্য স্কুলের কাছাকাছি একটা তিন কামরার ছোট বাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। প্রথম কয়েকটা দিন তিনি অবশ্য শমিতাদের ভাড়া বাড়িতে উঠতে দেননি; নিজের কাছেই রেখেছিলেন।
এর মধ্যে সুরেশ্বর চক্রবর্তীকে ফোন করে কেন কলকাতা ছেড়ে মাকে নিয়ে তাকে নবাবগঞ্জে আসতে হয়েছে সব জানিয়ে তাদের মালপত্র পাঠিয়ে দিতে বলেছিল। তিন-চারদিনের মধ্যে খাট, আলমারি, ফ্রিজ এবং সংসারের আরও নানা জিনিস লরির মাথায় চেপে চলে এসেছে। সুচরিতা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লোকজন দিয়ে শমিতাদের নতুন ভাড়াবাড়িটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন।
নতুন জায়গায় এসে থিতু হয়ে বসার পর শমিতা লইয়ার মারফত দীপেনকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছিল। দীপেন আপত্তি করেনি। বছরখানেক আইন-আদালত করার পর মিউঁচুয়াল সেপারেশন অর্থাৎ আইনসম্মত বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
.
মনে আছে, বাবার মৃত্যুর পর থেকে শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল লতিকার। স্বামীর মৃত্যুশোক তো ছিলই, তার ওপর শমিতার বিবাহিত জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। পর পর দুটো ধাক্কা সামলাতে পারেননি লতিকা। তাঁর হার্টের সমস্যা দেখা দিল। বেশিরভাগ সময় বুকে ব্যথা হচ্ছিল।
একদিন মায়ের কষ্টটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে দাঁড়াল। নবাবগঞ্জে কোনও ডাক্তারের সঙ্গে জানাশোনা ছিল না শমিতার। দিশেহারার মতো সে সুচরিতার কাছে ছুটেছে।
সুচরিতা বলেছেন, চিন্তা কোরো না। এখানকার সবচেয়ে বড় নার্সিংহোম নবাবগঞ্জ কেয়ার অ্যান্ড কিওর সেন্টার-এ একজন হার্ট স্পেশালিস্ট এসেছে কলকাতা থেকে। বয়সে কম হলেও খুব ভালো ডাক্তার। অল্পদিনেই তার যথেষ্ট সুনাম হয়েছে। নার্সিংহোমে ছাড়াও বাইরের পেশেন্টও দেখে। আমার ছোট ভাইয়ের মতো। এক্ষুনি তাকে ফোন করছি– মোবাইলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছিলেন। বিকেলের দিকে তিনি শমিতাদের বাড়ি আসবেন। চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে।
মনে পড়ে, সেদিন স্কুলে যায়নি শমিতা। সুচরিতা হেডমিস্ট্রেস; তাঁর ওপর স্কুলের হাজারটা দায়িত্ব। তবু কয়েকটা ক্লাস করে টিফিন পিরিয়ডে শমিতাদের বাড়ি চলে এসেছিলেন।