সুরেশ্বর জিগ্যেস করেছেন, কী রে, এত সকালে?
শমিতা একটু হেসেছে।অনেকদিন মাকে দেখেনি। মনটা খারাপ লাগছিল। তাই চলে এলাম।
ভালো করেছিস। দীপু আসবে না?
উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেছে শমিতা। পরক্ষণে সামলে নিয়েছে।ও ভীষণ ব্যস্ত। আসতে পারবে বলে মনে হয় না। বলেই বারান্দায় উঠে লতিকাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল।
লতিকা মেয়েকে লক্ষ করছিলেন। এই সকালবেলা খবর-টবর না দিয়ে হুট করে শমিতার চলে আসা, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি তাঁর। কেমন একটা খটকা লাগছিল। শমিতার চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করেছিলেন, হঠাৎ এভাবে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে চলে এলি! কী হয়েছে রে?
শমিতা বলেছে, পরে বলব। আমার মুখ-টুখ ধোয়া হয়নি। আগে বাথরুমের কাজ সেরে আসি! তুমি ততক্ষণে চা বসিয়ে দাও
কিছুক্ষণ পর চা খেতে খেতে দীপেন সম্পর্কে সমস্ত কিছু জানিয়ে বলেছে, দীপেন যে কতটা পালটে গেছে, তার কতটা অধঃপতন ঘটেছে, ভাবতে পারবে না মা। এমন জঘন্য ইতরের সঙ্গে আমার পক্ষে থাকা একটা দিনও আর সম্ভব না। তাই চলে আসতে বাধ্য হলাম।
উৎকণ্ঠিত লতিকা পুরোনো ধ্যান ধারণার মানুষ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে তিনি অচ্ছেদ্য বন্ধ মনে করতেন। বলেছেন, দীপেনকে বোঝা, ও যা করছে সেটা ঠিক নয়। তুই একটু চেষ্টা করলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। রাগের মাথায় কিছু একটা করে বসিস না।
শমিতা বলেছে, হাজারটা বুঝিয়েও কোনও কাজ হবে না। ও শোধরাবে না।
লতিকা নিরীহ, ভীতু মানুষ। আকণ্ঠ উদ্বেগ আর দুর্ভাবনা নিয়ে তিনি জিগ্যেস করেছেন, তা হলে কী করতে চাস তুই?
আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল শমিতা। সে বলেছে, সব জানতে পারবে। একটু অপেক্ষা করো।
লতিকা আর কোনও প্রশ্ন করেননি।
মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল শমিতা। এবার তাকে পর পর দুটো জরুরি ফোন করতে হবে। প্রথম ফোনটা অঞ্জনাকে, দ্বিতীয়টা তার স্কুলের কলিগ মালবিকা গুহকে।
একবারেই অঞ্জনাকে পাওয়া গেল। শমিতা বলেছে, তুমি সুইট হোম-এর চাকরিটা ছেড়ে দাও। আজই রেজিগনেশান পাঠিয়ে দেবে।
কিন্তু আমাদের ফ্যামিলি বাকিটা শেষ না করে অঞ্জনা চুপ করে গেছে।
মেয়েটা কী বলতে চেয়েছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি শমিতার। সে বলেছে, ভয় নেই। কাল তোমাকে স্পিডপোস্টে একটা চেক পাঠিয়ে দেব। দমদমের স্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর মাসের পর মাস যা স্যালারি পেয়েছে, স্কুলে যাতায়াতের জন্য বাসভাড়া, অটোভাড়া ছাড়া বাকি সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা হয়েছে। দীপেন অবশ্য তাকে একটা গাড়ি দিতে চেয়েছিল। শমিতা রাজি হয়নি। অন্য সব টিচাররা বাসে-মিনিবাসে যেভাবে যাওয়া-আসা করত সে-ও সেইভাবেই যেত, আসত। শমিতা উড়নচণ্ড স্বভাবের মেয়ে নয়, তাই ব্যাঙ্কে যে টাকা জমেছিল তার অঙ্কটা বেশ ভালোই।
আপনি আমাকে টাকা দেবেনঅঞ্জনার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছে সে শুধু অবাকই হয়নি, বিহ্বল হয়ে পড়েছে।
শমিতা তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়েছিল। বলেছে, তোমাদের সংসারটাকে বাঁচাতে হবে তো। তার চেয়েও বড় ব্যাপার তোমার সম্মান রক্ষা করা। একটু থেমে ফের শুরু করেছে, তুমি গ্র্যাজুয়েট, কম্পিউটারে কোর্স করেছ, ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে পারো। নানা জায়গায় চেষ্টা করো, চাকরি একটা ঠিক জুটে যাবে। আমিও আমার জানাশোনা সবাইকে তোমার কথা বলব। হতাশ হোয়ো না; মনের জোর রাখো।–আর হ্যাঁ, যতদিন না চাকরি-বাকরি কিছু একটা হচ্ছে, আমি টাকা পাঠিয়ে যাব।
অভিভূত অঞ্জনা ভারী গলায় বলেছে, আপনার ঋণ কোনওদিন
তাকে থামিয়ে দিয়েছে শমিতা।-ওসব ঋণ-টিন থাক। একটা খবর তোমাকে দেওয়া হয়নি। আমি দীপেন ঘোষের বাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে চলে এসেছি। এখানেও থাকব না। মাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাব।
চমকে উঠেছে অঞ্জনা?–কোথায় যাবেন ম্যাডাম?
পরে তোমাকে জানিয়ে দেব।
দুনম্বর ফোনটা মালবিকা গুহকে। মালবিকা শমিতার চেয়ে বছর দশেকের সিনিয়র। অবিবাহিত। স্কুলের কাছাকাছি নাগেরবাজারে তাদের বিরাট বাড়ি। রুগণ, শয্যাশায়ী বাবা আর সে ছাড়া আর কেউ নেই। বাবার অসুস্থতার জন্য তার বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি। স্কুলে সে ফিজিক্স পড়ায়। মালবিকাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে শমিতা, ভালোবাসে। মালবিকাও তাকে স্নেহ করে। সম্পর্কটা দিদি এবং ছোট বোনের মতো।
ফোনে শমিতা মালবিকাকে বলেছে, দিদি, আমি কাল রাতে দীপেনের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে এসেছি।
কী বলছিস তুই?
গলা শুনে মনে হল মালবিকা চমকে উঠেছে। শমিতা বলেছে, ঠিকই বলছি। সবটা শুনলে কারণ বুঝতে পারবে। দীপেনের সঙ্গে কিছুদিন ধরে যা যা ঘটেছে সবিস্তার জানিয়ে জিগ্যেস করেছে, এবার বলো, এই লোকটার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানো যায়?
বিষণ্ণ গলায় মালবিকা বলেছে, ভেরি স্যাড। তবে তুই ঠিক ডিসিশন নিয়েছিস।
কিন্তু
কিন্তু কী?
এখন কী করবি?
শমিতা জানিয়েছে, কলকাতায় তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। কেননা এখানে তার জানাশোনা প্রচুর লোকজন রয়েছে। দীপেনকে ছেড়ে সে যে চলে এসেছে, এটা চাপা দিয়ে রাখা যাবে না, মুহূর্তে চাউর হয়ে যাবে। কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির গন্ধ পেলে সবাই তাকে ছেকে ধরবে। কেন নিজের সংসার ছেড়ে চলে এলে? কী এমন হয়েছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্নে নাজেহাল করে ছাড়বে, কেউ বা আড়ালে হাসাহাসি করবে, কিন্তু সামনাসামনি মুখটা করুণ করে বলবে, আহা, তোমার লাইফে এমনটা ঘটবে ভাবতে পারিনি। বড় কষ্ট হচ্ছে—