ভাবনাগুলো ছত্রখান হয়ে গেল দীপেনের। পরক্ষণে খেয়াল হল কে ডাকবে তাকে? এখানে তো কেউ চেনে না। রীতিমতো চমকেই উঠল সে। কী ভেবে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল একটি ন-দশ বছরের ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টকটকে গায়ের রং, সারল্যে ভরা, নিষ্পাপ মুখ। পরনে খুব দামি শীতের পোশাক। দেখামাত্র আন্দাজ করা যায় সোসাইটির উঁচু স্তরের কোনও বাঙালি কি? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চারিদিকে ইন্ডিয়ার নানা রাজ্য থেকে আসা টুরিস্টরা তাদের মাতৃভাষায় কর কর করে যাচ্ছে। নিজের অজান্তে বাংলাতেই জিগ্যেস করল দীপেন, তুমি কি আমাকে ডাকছিলে?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল ছেলেটি।
দীপেনের মনে যে ধোঁয়াটে ভাবটা ছিল, কেটে গেল। ছেলেটি বাঙালিই। সে জানতে চাইল, আমাকে কিছু বলবে?
উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল দীপেন।
ছেলেটি বলল, আমার বাবা বলছিল, কাশ্মীরে এইসময় বরফ পড়ে। ওই যে পাহাড়টার মাথায় সাদা মতো দেখা যাচ্ছে ওটা কি বরফ?
লিডার নদীর ওপারে যে ছোট পাহাড়টা রয়েছে তার পেছন দিক থেকে পর পর অনেক পাহাড়। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, ওই যে–ওটা।
এই ছোট ছেলেটির মতো তার চোখের দৃষ্টি অত সতেজ নয়। ষাট-সত্তর ফিট দুরের জিনিস কেমন যেন ঘোলাটে ঘোলাটে মনে হয়। দূর পাহাড়ের মাথায় অক্টোবরের শুরুতেই বরফ পড়েছে কিনা তা নিয়ে দীপেন ভাবছে না, সেদিকে তাকাচ্ছেও না। একা একটি ছেলে, সঙ্গে কেউ নেই, আচমকা কোত্থেকে এসে হাজির হল, বোঝা যাচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে তার জন্য উৎকণ্ঠা হচ্ছিল। জিগ্যেস করল, তোমার নাম কী?
দাদু-দিদা-বাবা-মা বলে তাতান, ভালো একটা নামও আছে–সমৃদ্ধ ব্যানার্জি। বলেই তার পুরোনো প্রশ্নে চলে গেল।–বললে না তো, ওটা বরফ কিনা। বলো-বলল, প্লিজ
তাতানের গলার স্বরটি ভারী মিষ্টি; পাখির ডাকের মতো সুরেলা। ছেলেটা মিশুকে তো বটেই, বেশ আদুরে ধরনের। তার মাথায় বরফ ঢুকেছে, সেটি না-জানা অবধি স্বস্তি নেই। দীপেন বলল, তোমাকে একা দেখছি। কার সঙ্গে পহেলগাঁও এসেছ?
মা-বাবার সঙ্গে। বলো না আঙ্কেল।
কোথায় তোমার মা-বাবা?
যেখানে দীপেনরা দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পেছনদিকে বরাবর অনেক দূরে তাকালে বেশ কটা উইলো আর ওকগাছের জটলা। সেদিকে হাত বাড়িয়ে তাতান বলল, ওখানে ঘোড়াওয়ালারা আছে না? মা-বাবা তাদের সঙ্গে কথা বলছে।
এই এলাকার নাড়ি-নক্ষত্র দীপেনের জানা। দূরের ওই গাছগুলোর তলায় ঘোড়াওয়ালাদের ঘাঁটি। দুরকমের ঘোড়া নিয়ে ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। টগবগে বড় ঘোড়া আর টাট্ট। হর্স-রাইডের জন্য টুরিস্টরা ওদের ঘোড়া ভাড়া নেয়। যাদের বয়স বেশি তাদের জন্য বড় ঘোড়া, ছোটদের ছড়ানো হয় টাটুতে। দীপেন আন্দাজ করে নিল তাতানের মা-বাবা ওখানে যখন ঘোড়াওয়ালাদের সঙ্গে হর্স-রাইডের ভাড়া নিয়ে কথা বলছেন, সেই ফাঁকে তাতান এদিকে চলে এসেছে।
দীপেন জিগ্যেস করল, এখানে যে আসবে, মা-বাবাকে কি বলেছ?
শব্দহীন হাসিতে সারা মুখ ভরে গেল তাতানের। চোখ দুটো প্রায় বুজে গেছে। আস্তে আস্তে মাথাটা এধার থেকে ওধারে নাড়তে লাগল সে।
তার মনে না বলেই চলে এসেছে তাতান। তার আধবোজা চোখ থেকে দুষ্টুমির একটা ঝলক বেরিয়ে এল।
না, যতটা সরল দেবশিশু মনে হয়েছিল, আদপেই সে তা নয়। দীপেন বলল, এই যে তুমি হুট করে চলে এলে, মা-বাবা ভাববেন না?
ঘাড় কাত করে তাতান বলল, হু, ভাববে তো।
তা হলে এভাবে চলে এলে কেন?
ইচ্ছে হল যে
এই ছেলের ইচ্ছের তালিকাটা কতখানি লম্বা, ভাবতে চেষ্টা করে দীপেন বলল, মাঝে মাঝে এরকম না বলে কোথাও চলে যাও নাকি?
যাই তো
তারপর?
চোখ-মুখে সেই দুষ্টু-হাসিটা লেগেই আছে তাতানের। ডান হাতটা তুলে মায়ের কায়দাটা দেখিয়ে দিল সে।
চোখ গোলাকার হয়ে গেল দীপেনের। তাতান ব্যক্তিটি যে সামান্য নন সেটা তার চোখ-মুখের ভাবভঙ্গি, হাত তুলে প্রহারের মুদ্রা ফুটিয়ে তোলার কারিগরি দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে। মজাও লাগছিল দীপেনের। সেইসঙ্গে ভাবছিল ছেলেটা মা-বাপকে একেবার তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়ে। বলল, কে তোমাকে বেশি মারেন?
কে আবার, মা। মারতে মারতে পিঠের ছাল তুলে ফেলে।
আর বাবা?
বাবা মারে না; একটুখানি বকাবকি করে। মা যখন মারতে শুরু করে, বাবা বাড়িতে থাকলে আমাকে টেনে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মা আর আমাকে ধরতে পারে না। বাইরে দাঁড়িয়ে বাবার ওপর খুব রাগারাগি করে, চেঁচায় আর বলে, আমাকে আদর দিয়ে বাবা মাথায় তুলেছে।
বোঝা যাচ্ছে শাসন যেটুকু করেন তাতানের মা-ই। ওর বাবা রীতিমতো আশকারাই দেন। দীপেন বলল, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকে না। মা-বাবা নিশ্চয়ই খুব খোঁজাখুঁজি করছেন। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি
এক্ষুনি যাবার তেমন ইচ্ছা ছিল না তাতানের। তবে আপত্তি করল না।-আচ্ছা, চলো–
ঘোড়াওয়ালাদের ঘাঁটিটার দিকে এগিয়ে চলল দুজনে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দীপেন জিগ্যেস করে, তোমরা কোথায় থাকো?
কলকাতায়।
তোমরা ক’ভাইবোন?
আমি একলা।
কোন স্কুলে পড়ো?
সেন্ট জেভিয়ার্স।
বাঃ, ওটা তো ভেরি ফেমাস স্কুল
তাতান হাসল।
কোন ক্লাস?
ফোর।
বেশ কয়েক বছর দীপেনের শরীরের মতো জীবনটাও আগাগোড়া তছনছ হয়ে গেছে। তার একটা ফ্যামিলি লাইফও ছিল, সেটাও ঘেঁটেঘুঁটে ধ্বংসস্তূপ। একটি আধবুড়ো কাজের লোক এসে ঘরদোর সাফ করা, বাজারে যাওয়া, জামাকাপড় কাঁচা, রান্নাবান্না–এসব করে দিয়ে চলে যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সে একেবারে একা। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, কেউ তার ত্রি-সীমানায় ঘেঁষে না। দূষিত, বর্জ্য পদার্থের মতো সে একধারে পড়ে থাকে। তার ওপর একটা মরণ রোগ বাধিয়েছে। সেটা নিঃশব্দে তার শরীরের শাঁস কুরে কুরে খেয়ে চলেছে।