বিব্রতভাবে শমিতা বলেছে, ওঠো–ওঠো। এখন অস্থির হলে চলবে না। অঞ্জনাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিতে দিতে শমিতা বলেছে, কতটা কী করতে পারব জানি না। তবে তোমার যাতে ক্ষতি না হয় তার একটা চেষ্টা নিশ্চয়ই করব। তোমার মোবাইল নাম্বার আর বাড়ির অ্যাড্রেসটা আমাকে দাও। কাল না হলে পরশু তোমাকে ফোন করব। আমি না-বলা পর্যন্ত অফিসে যাবে না। অঞ্জনার ফোন নাম্বার সেভ করে তার বাড়ির অ্যাড্রেস টুকে নিয়ে শমিতা বলেছে, তোমার সম্বন্ধে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। কতদূর পড়াশোনা করেছ?
গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেছি।
গুড। লেখাপড়া কোন মিডিয়ামে?
বাংলা। তবে স্পোকেন ইংলিশে দুটো কোর্স করেছি। ফুয়েন্টলি বলতে পারি।
ঠিক আছে। তোমাকে তো আবার ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত যেতে হবে। অনেকটা রাস্তা। এবার উঠে পড়া যাক।
.
মনে পড়ে অঞ্জনা যেদিন তার স্কুলে এসে দেখা করেছিল সেদিন বেশি রাত করে নেশায় চুর হয়ে বাড়ি ফেরেনি দীপেন। দশটা সাড়ে-দশটার মধ্যেই চলে এসেছিল।
বেশ কিছুদিন ধরেই এক ফ্ল্যাটে থাকলেও এক বেডরুমে তারা রাত কাটায় না। নিজের ঘরে আধশোওয়া হয়ে টিভির নিউজ চ্যানেলে তাকিয়ে ছিল শমিতা। সংবাদ-পাঠিকা সেদিনের খবরগুলো পর পর পড়ে যাচ্ছিলেন; খবরের সঙ্গে টিভির পর্দায় ছবি ফুটে উঠছিল। কিছুই প্রায় শুনছিল না শমিতা; ছবিগুলোর দিকেও সেভাবে নজর নেই। বার বার অঞ্জনার ধ্বস্ত চেহারাটা তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল।
ড্রইংরুমে দীপেনের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছে শমিতা। দীপেন যে আগে আগে চলে এসেছে তা একরকম ভালোই হয়েছে। নইলে মধ্যারাতে বেহেড মাতালের সঙ্গে কথা বলা মানেই তুমুল ধুন্ধুমার বেধে যাওয়া। কেয়াতলার বনেদি পাড়ার নৈশ প্রশান্তিকে খান খান করে জড়ানো গলায় লোকটা চিৎকার জুড়ে দিত।
শমিতা তার মেরুদণ্ডে সবটুকু ক্রোধ, অসন্তোষ এবং জেদ পুরে সটান ড্রইংরুমে চলে এসেছিল। আজ চূড়ান্ত কিছু একটা করার জন্য নিজেকে সে তৈরি করে নিয়েছে।
দীপেনকে অন্যদিনের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। মদ্যপানের মাত্রাটা সেদিন কোনও কারণে বেশ কম ছিল বলেই হয়তো।
শমিতা এগিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসল। দীপেন কাছাকাছি একটা সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলছিল। একটা কাজের লোক হুকুম তামিল করার জন্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শমিতা তাকে বলেছে, নরেশ, তুমি এখন যাও। ডাকলে আসবে।
আড়চোখে একবার শমিতার দিকে তাকিয়েছে দীপেন। শমিতা বলেছে, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
জুতো খুলে শমিতার দিকে তাকিয়েছে দীপেন।–বলো—
নরেশ বেরিয়ে গিয়েছিল। ড্রইংরুমে তখন শমিতা আর দীপেন ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। শমিতা বলেছে, এতদিন মাঝরাতে নেশা চুর হয়ে বাড়িতে এসে হল্লা করেছ, কেয়াতলার লোকজন তা জেনে গেছে। কিন্তু তোমার আরেকটা গুণের খবর আমি ছাড়া এখানকার আর কেউ বোধহয় এখনও জানে না। জানলে মহাপুরুষ হিসেবে ফুল-চন্দন দিয়ে তোমার পুজো করতে শুরু করবে।
দাঁতে দাঁত চেপে, কেটে কেটে দীপেন বলেছে, হোয়াট ডু ইউ মিন
মদ ছিল। তার সঙ্গে মেয়েমানুষ জুটিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ! বা-বাবা
দীপেন উত্তর দেয়নি। তার চোখ থেকে আগুনের হলকা ছুটছিল। মনে হচ্ছিল তার সমস্ত শরীরটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
সোজাসোজি দীপেনের চোখের দিকে তাকিয়ে শমিতা এবার বলেছে, অঞ্জনা একটা ভদ্র পরিবারের মেয়ে। নিজেদের সংসার বাঁচানোর জন্যে তোমার কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। তার ওপরও তোমার নজর গিয়ে পড়েছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! এমন একটা ভদ্র, ভালো মেয়ের জীবনটা রুইন করে দিতে চাইছ! তোমার মতো ইতর, জঘন্য, নর্দমার পোকার সঙ্গে থাকছি, ভাবতেও গা ঘিন ঘিন করে। আর পারছি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এখানে আর থাকতে চাই না।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল দীপেন। অসহ্য ক্রোধে এবং উত্তেজনায় তার গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলেছে, কেউ এখানে থাকার জন্যে তোমার পায়ে ধরছে না। এই মুহূর্তে তুমি চলে যেতে পারো।
এখন রাত বারোটা বাজে। রাতটুকু ভোর হলেই চলে যাব। শমিতা নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
.
মনে আছে, বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি শমিতা। ভোরবেলায় সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে, সেই সময় একটা কাপড়ের বড় ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তখনও দীপেনের ঘুম ভাঙেনি। দু-তিনটে কাজের লোক ততক্ষণে উঠে পড়েছে। বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখতে দেখতে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দুই ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাদের থামিয়ে দিয়েছে শমিতা। ওদের সঙ্গে কথাটথা বললে দীপেনের ঘুম ভেঙে যাবে, সেটা সে চায়নি।
আগের রাতে দীপেনের সঙ্গে তুমুল ব্যাপারটা ঘটে যাবার পর নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। ওটার ভেতর রয়েছে কটা শাড়ি-ব্লাউজ, ম্যাক্সি, চেকবুক, ব্যাঙ্কের পাশবুক, ভোটার আই ডি কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদি টুকিটাকি দরকারি সব জিনিস।
ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরিয়ে লিফটে নীচে নেমে সোজা রাস্তায়। একটা ট্যাক্সি ধরে শমিতা যখন পালপাড়ায় পৌঁছোল, বেশ রোদ উঠে গেছে। তার মা লতিকা বাইরের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। দোতলার ব্যালকনিতে বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তী দাঁত ব্রাশ করছিলেন। শমিতাকে দেখে দুজনেই অবাক।