দিন পনেরো নাসিংহোমে কাটাতে হল চন্দ্রনাথকে। বেশিরভাগ সময়টাই আই সি ইড-তে। এ সময়টা মাত্র কয়েক ঘণ্টা অফিসে কাটিয়ে বাকি সময়টা নার্সিংহোমে পড়ে থাকত দীপেন। শমিতা কলেজে যেতে চাইত না। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিত সে। বলত, আমি এদিকটা দেখছি! তোমার পার্ট টু-র একজামের দেরি নেই। ক্লাস কামাই করলে রেজাল্ট খারাপ হবে।
বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী, মেয়ে, ছেলের বউ এবং অম্বিকা পাল রোডের প্রতিবেশীদের অনেকেই রোজ নাসিংহোমে এসে চন্দ্রনাথের খবর নিয়ে যেত। আশ্চর্য সব মানুষ। সবসময় তারা শমিতাদের পাশে পাশে থেকেছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত চন্দ্রনাথ বাঁচলেন না। ডাক্তার মিত্র এবং তাঁর টিম দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন ঠিকই কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকানো গেল না।
.
শমিতার মনে পড়ে, বাবার মৃত্যুতে মা একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সে নিজেও কম ভেঙে পড়েনি। এই সময়টা অফিসে ছুটি নিয়ে তাদের আগলে আগলে রেখেছে দীপেন। প্রতিবেশীরাও পাশেই থেকেছে।
এর মধ্যেই চন্দ্রনাথের পারলৌকিক কাজ অর্থাৎ শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ মিটে গেল।
শোকের তীব্রতা চিরকাল একইরকম থাকে না। ধীরে ধীরে তা কমে আসে।
শরৎ ব্যানার্জি রোডের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় যে দুলাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া গিয়েছিল, নার্সিংহোমের বিল মেটাতে তার পুরোটা তো গেছেই, তার ওপর জমানো আরও বেশ কিছু বেরিয়ে গেছে।
দীপেনের সব দিকে নজর। শমিতাকে সঙ্গে করে সে চন্দ্রনাথের অফিসে ছোটাছুটি করে তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্রাচুয়িটির টাকা আদায় করেছিল। বিধবা হিসেবে যে পেনশন লতিকার প্রাপ্য তা নিয়মিত পাওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। পি এফ এবং গ্র্যাচুয়িটির টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে শমিতারা মান্থলি ইন্টারেস্ট নিতে শুরু করেছিল। লতিকা যা পেনশন পান তাতে বাড়িভাড়া, তার পড়ার খরচ মিটিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব। কেন না চাল-ডাল আটা-ময়দা আনাজ মাছ-টাছের দাম তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল।
শমিতার মনে পড়ে চন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এক বছর অর্থাৎ কালাশৌচ কাটতে-না-কাটতেই তার পার্ট টু-র রেজাল্ট বেরুক্ল। চন্দ্রনাথের বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থতা, নার্সিং হোমে দিনের পর দিন ছোটাছুটি, সারাক্ষণ উকণ্ঠা, বাবার মৃত্যুশোক–এত সবের মধ্যেও ফার্স্ট ক্লাসটা পেয়ে গিয়েছিল শমিতা।
দীপেন অপেক্ষা করছিল। বলেছে, গ্র্যাজুয়েশনটা হয়ে গেল। রেজাল্ট বেশ ভালো হয়েছে। আর ডিলে কোরো না। আমার মা খুব উতলা হয়ে উঠেছে। খুব সম্ভব তোমার মা-ও।
দীপেন কী ইঙ্গিত দিয়েছিল বুঝতে অসুবিধা হয়নি। শমিতা বলেছে, আরও দু-আড়াই বছর ওয়েট করতে হবে যে
কেন? দীপেন রীতিমতো অবাক।
বি.এড-টা করে নিতে হবে না? স্কুল সারভিসে ওই ডিগ্রিটা ভেরি ভেরি ইম্পর্টান্ট।
দীপেনের চোখে-মুখে হতাশা ফুটে বেরিয়েছে।–এখনও আড়াই বছর?
তার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে শমিতা বলেছে, আড়াই বছর তো কতটুকু সময়। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
হতাশাটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না দীপেন।–বি.এড-এর পর এম.এ-টা দেবার জন্যে খেপে উঠবে—
আরে না না, বি.এড আর স্কুল সারভিস কমিশনের একজাম ইহজীবনে এই দুটোতেই আমার পড়াশোনার এন্ড। তারপর তো মাস্টারনি হয়ে বসব।
তোমাকে বিশ্বাস নেই।
নিষ্পাপ, সরল বালিকার মতো কলকল করে হাসতে শুরু করেছিল শমিতা। কলকলানি আর থামতেই চায় না। এমন মজার কথা আগে যেন কখনও শোনেনি সে।
দীপেন বলেছে, আমার একটা কথা শুনবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না
বিয়ের পরও তো বি.এড, স্কুল সারভিস কমিশন, ইচ্ছে করলে এম.এ পরীক্ষাতেও বসতে পারো। বাড়ির কোনও ঝামেলা-ঝঞ্জাট তোমাকে পোয়াতে হবে না, কোনও রেসপনসিবিলিটি নিতে হবে না। ক্লাস করবে, পরীক্ষার প্রিপারেশন ছাড়া অন্য কোনও দিকে তাকাতে হবে না। ব্যস
শমিতা বলেছে, তা হয় নাকি? তুমি তো মেয়ে নও, তাই বুঝতে পারবে না। বিয়ের পর মেয়েদের জীবন টোটালি বদলে যায়। নতুন একটা সংসার তখন তার। সবসময় তার মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকবে। এটা করতে পারলাম না, ওটা করতে পারলাম না। মেয়েদের এ হল ইনস্টিংক্ট। পড়াশোনা আর সংসার একসঙ্গে কোনওটাই ঠিকমতো করা হবে না। মোটে আড়াইটা তো বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
দীপেন কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়েছে শমিতা।–প্লিজ
বাইরে থেকে দেখলে শমিতাকে ভারী নরম আর হাসিখুশি মনে হয়। কিন্তু দীপেন ততদিনে জেনে গেছে শমিতার মধ্যে অনমনীয় একটা কাঠিন্য রয়েছে, নাকি একরোখা জেদ? সেটা কোনও ভাবেই নোয়ানো যায় না।
আড়াই বছর পর আর অপেক্ষা করতে হয়নি দীপেনকে। তাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।
দীপেনের কনস্ট্রাকশন কোম্পানির হেড অফিসটা ল্যান্সডাউন রোডে। তার কাজের চাপ ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। অফিসে তো বটেই, কলকাতা এবং তার চারপাশে যে-সব আকাশছোঁয়া হাইরাইজ উঠেছিল সেইসব সাইটেও তাকে যেতে হয়। পালপাড়া থেকে যাতায়াত করে এত সব সমলাতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। তাই কোম্পানি সাদার্ন অ্যাভেনিউতে তাকে থাকার জন্য একটা থ্রি বেডরুমের পনেরোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট দিয়েছিল।
বিয়ের পর সেখানে চলে আসে দীপেন আর শমিতা। দুজনেই তাদের মা লতিকা এবং মমতাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। দীপেনের মা হলেন মমতা। কিন্তু লতিকা পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ; তিনি মেয়ে-জামাই-এর কাছে এসে থাকতে রাজি হননি। মমতাও আসেননি। পালপাড়ার বাড়িতে যেখানে মৃত স্বামীর অসংখ্য স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সেসব আঁকড়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান।