তুমি একটা যাচ্ছেতাই
ঠিক আছে, আমি তাই। এখন বলে ফেলো—
মুখ নামিয়ে খুব মৃদু গলায় শমিতা শুধু একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করেছে,হুঁ–
যাক, কনসেন্ট মিলেছে। দু-একদিনের মধ্যে টোড়িজির সঙ্গে দেখা করে ফরম্যাল অ্যাপ্লিকেশনটা দেব–
মনে পড়ে, দীপেনের চোখ-মুখ থেকে খুশি যেন উপচে পড়ছিল। শমিতা নিজেও কি কম খুশি হয়েছে?
একটু চুপচাপ
তারপর দীপেন বলেছে, মাকে তোমার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা জানিয়েছি
শমিতা বলেছিল, আমার মা-বাবাও আমাদের ব্যাপারটা মনে হয় গেস করেছে।
কিছু বলেছেন নাকি?
না। তোমার ওপর মা-বাবার অগাধ বিশ্বাস। তোমাকে দুজনেই ভীষণ পছন্দ করে। তবু আমার ধারণা, কোথায় যেন ওদের একটা হেজিটেশন আছে।
দীপেন বলেছে, থাকাই উচিত।
মানে?
টিউটোরিয়ালে পড়াই, টিউশন করি। স্টেবল কোনও ইনকাম নেই। এরকম একটা ছেলের হাতে কোন বাপ-মা তাঁদের সুন্দরী, বিদুষী মেয়েকে তুলে দিতে চাইবেন? জেনিথ কনস্ট্রাকশন-এর অফারটার কথা জানলে খুব সম্ভব আপত্তি করবেন না। কী বলে?
তুমি খুব ধুরন্ধর। আ স্লাই ফক্স।
দীপেন হাসতে হাসতে বলেছে, মাকে কি ব্যাপারটা ফাইনাল করার জন্যে তোমাদের বাড়ি যেতে বলব?।
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শমিতা বলেছে, নো, নো, নট নাউ। আমার কিছু কন্ডিশন আছে।
হাসিটা ফিকে হয়ে গিয়েছিল দীপেনের।–কী কন্ডিশন?
আমি গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করব। তারপর স্কুল সারভিস কমিশনের একজামটা দেব। আমার একটা চাকরি চাই।
দীপেন অবাক। বলেছে, কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কত স্যালারি পাব, তোমাকে বলেছি। তারপর তোমার চাকরির দরকার কী?
শমিতা বেশ জোর দিয়ে বলেছে, প্রতিটি মেয়ের ফিনান্সিয়ালি স্বাবলম্বী হওয়াটা ভেরি ভেরি ইস্পটান্ট–
দীপেন বুঝতে পারছিল, টেবিলের ওপারে যে মেয়েটি বসে আছে তার মধ্যে প্রচণ্ড দৃঢ়তা রয়েছে। সে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখান থেকে তাকে টলানো যাবে না। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে সে। তারপর বলেছে, অলরাইট, তুমি যা ঠিক করেছ তাই হবে।
.
জীবন নিজের নিয়মে তার নির্ঘণ্ট আগে থেকেই বোধ হয় ঠিক করে রাখে। দেখতে দেখতে বেশ কটা ঘটনা ঘটে গেল। দীপেন চাকরিতে জয়েন করার পর বছর দুই কেটে গেছে। শমিতা বি.এ পার্ট ওয়ানে ফাস্টক্লাস পাওয়ার পর কয়েক মাস পেরুল। আর কিছুদিনের মধ্যে পার্ট টু ফাইনাল। চন্দ্রনাথের রিটায়ারমেন্টের আর মাত্র চার মাস বাকি।
দীপেন সকালের দিকে অফিসে বেরিয়ে যায়। তখন ভীষণ তাড়াহুড়ো থাকে, তাই শমিতাদের বাড়ি আসতে পারে না। কিন্তু সন্ধের পর এসে দু-আড়াই ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। জরুরি কিছু করার থাকলে করে দেয়। এইভাবেই চলছিল।
হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে নিম্নচাপের কারণে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে বাড়ি ফিরলেন চন্দ্রনাথ। শ্বাসকষ্টের রুগি, শীত আর বর্ষাকালটা তাঁর পক্ষে মারাত্মক। হিম এবং বৃষ্টি চন্দ্রনাথের একেবারেই সহ্য হয় না।
সেদিন মাঝরাত থেকে শ্বাসকষ্টটা প্রচণ্ড বেড়ে গেল। বাড়িতে যে ওষুধ-টোষুধ ছিল তাতে বিশেষ কাজ হল না। বুকের ভেতর থেকে অনবরত সাঁই সাঁই আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল চন্দ্রনাথের।
সেই মধ্যরাতে কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না শমিতারা। একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত দোতলা থেকে সুরেশ্বরকে ডেকে আনা হল। তিনি রুগির হাল দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, এখনই ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু তোমাদের বা আমাদের কারও টেলিফোন নেই। ডাক্তার মিত্রকে কী করে কল করব? একটু ভেবে বলতে লাগলেন, আমি দীপুদের বাড়ি যাচ্ছি। ওর নতুন অফিস। অফিস থেকে টেলিফোন লাগিয়ে দিয়েছে। দীপু নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। পালপাড়ায় বেশিরভাগ রাস্তাতে সেই সময় টিম টিম করে মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলত কিন্তু কী কারণে যেন অম্বিকা পাল রোড এবং আশপাশের রাস্তাগুলোর সব স্ট্রিটল্যাম্প নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুরেশ্বর একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। মিনিট দশ-পনেরো পর ফিরে এসে জানিয়েছিলেন, দীপেন ডাক্তার মিত্রকে ফোন না করে সাইকেলে চেপে সোজা তাঁর বাড়ি চলে গেছে।
প্রায় মিনিট চল্লিশেক বাদে ডাক্তার মিত্রকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল দীপেন। এত রাতে কোনও ডাক্তারই রুগির বাড়ি যেতে চান না। ডাক্তার মিত্র যে এসেছিলেন তা দীপেনের কাকুতি-মিনতিতে।
চন্দ্রনাথকে ভালো করে পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তার মিত্রের মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছেন, পেশেন্টের বহুদিনের ব্রিদিং টাবল তো রয়েছে, তার ওপর জ্বরও হয়েছে। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখা গেল–একশো চার ডিগ্রির কাছাকাছি।
ডাক্তার মিত্র এবার বলেছিলেন, পেশেন্টের যা কন্ডিশন তাতে ইমিডিয়েটলি নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে। কয়েকটা টেস্টের পর প্রপার টিটমেন্ট শুরু হবে।
সেদিন রাতে সম্ভব হয়নি। পরদিন অফিসে গেল না দীপেন। শমিতারও কলেজে যাওয়া হল না। সকালে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সাদার্ন অ্যাভেনিউর একটা নার্সিং হোমে তারা চন্দ্রনাথকে ভর্তি করে দিল। ডাক্তার মিত্র এই নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত।
টেস্ট হয়ে যাবার পর জানা গেল চন্দ্রনাথের বরাবরের দুর্বল ফুসফুসে একটা ইনফেকশন অর্থাৎ নিমুনিয়ার সংক্রমণ হয়েছে। তার বৃষ্টিতে ভেজার ফল।