কিন্তু অফিসে প্রচণ্ড কাজের চাপ পড়ায় চন্দ্রনাথের পক্ষে ছুটি নেওয়া সম্ভব হল না। অগত্যা দুদিন কলেজ কামাই করে দীপেনের সঙ্গে আলিপুর আর ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে যেতে হল শমিতাকে। সে কলকাতার নামকরা কলেজে পড়ে, জীবনের প্রথম কুড়িটা বছর কাটিয়েছে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে দারুণ পশ একটা এলাকায়। সেখানকার অনেক ছেলেদের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিল। পুজোর সময় ওই অঞ্চলের অন্য মেয়েদের মতো ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে হই হই করেছে কিন্তু কোনওরকম বাধো বাধো ঠেকত না। এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না। কারণ তার জন্ম সেখানে। একসঙ্গে সবাই বড় হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়ে সবার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের।
শমিতা দারুণ স্মার্ট, দারুণ ঝকঝকে। গাঁইয়া মেয়েদের মতো আড়ষ্ট নয়। যথেষ্ট সাহসীও। কিন্তু আজন্মের চেনা একটা মহল্লা ছেড়ে নতুন একটা জায়গায় এসে খুব অল্প-চেনা এক যুবকের সঙ্গে আলিপুর বা ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে যেতে হবে ভাবতেই সামান্য অস্বস্তি যে হয়নি তা নয়।
তবে দীপেন শমিতার মনোভাবটা খুব সম্ভব আগেই আঁচ করে নিয়েছিল। সে তাকে ট্যাক্সিতে নিয়ে যাবার কথা বলেনি। অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে পাবলিক বাসে আলিপুরে এবং ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে নিয়ে গিয়েছিল। কারণটা বুঝতে পেরেছিল শমিতা। ট্যাক্সি নিলে তারা মাত্র দুজন থাকবে। কিন্তু বাসে অনেক মানুষ। সে যাতে অস্বাচ্ছন্দ্য-বোধ না করে সেজন্য পাবলিক বাসে যাওয়া।
শমিতা লক্ষ করেছে, প্রয়োজনের বেশি বাড়তি একটা কথাও বলেনি দীপেন। তার সম্বন্ধে কোনওরকম কৌতূহল দেখায়নি। কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি।
শুধু রেশন কার্ড আর ভোটার আই ডি কার্ডের ব্যবস্থা করে দেয়নি দীপেন; চন্দ্রনাথের চিকিৎসার ব্যাপারে একদিন শমিতাকে সঙ্গে করে এলাকার ধন্বন্তরি ডাক্তার মিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দিয়েছে।
মনে পড়ে যে যুবকটি নানা ব্যাপারে সাহায্য করেছে, তার কথাবার্তায়, আচরণে কোনও দিন এতটুকু বেচাল দেখা যায়নি; তার ওপর ক্রমশ নির্ভরতা বাড়ছিল। শুধু শমিতারই নয়, তাদের গোটা পরিবারেরই।
প্রথম প্রথম শমিতার সঙ্গে একটু দূরত্ব রেখেই চলেছিল দীপেন। কিন্তু দুজনেই তখন যে বয়সে পা রেখেছে তার নাম দুরন্ত যৌবন। কখন, কীভাবে ওরা পরস্পরের কাছাকাছি চলে এসেছে, অতকাল বাদে আর সেসব খুঁটিনাটি মনে নেই।
খবর না দিলে আগে দীপেন শমিতাদের বাড়ি আসত না। পরের দিকে যে-কোনও সময় চলে আসত। এমনকী তার মা মমতাও মাঝে মাঝে এসে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেতেন।
.
পালপাড়ায় বছর দেড়েক কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন দীপেন সন্ধের দিকে শমিতাদের বাড়ি এসে তাকে বলেছিল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।
শমিতা উৎসুক হল।–বেশ তো, বলো না
এখানে নয়। দেশপ্রিয় পার্কের লাগোয়া একটা রেস্তোরাঁর নাম করে দীপেন বলেছে, কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় ওখানে চলে এসো। আমিও ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।
ভুরু দুটো সামান্য তুলে মজা করে শমিতা বলেছে, কী এমন কথা যে অতদূরে গিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে বলতে হবে? অন্য কোথাও বলা যাবে না?
ওই রেস্তোরাঁটা নতুন খুলেছে। সি ফিশ আর চিকেনের আইটেমগুলো দারুণ বানায়। খেতে খেতে সুখবরটা দেব।
সুখবর! ভুরু আরও উঁচুতে উঠেছিল শমিতার।
হ্যাঁ।
তার মানে সুখাদ্যের সঙ্গে সুখবর?
এগজাক্টলি।
পরদিন রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে জানিয়ে দিয়েছিল দীপেন। কলকাতার একটা বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি তাকে ডেপুটি ম্যানেজারের পোস্টে চাকরির অফার দিয়েছে। স্যালারি ফর্টি ফাইভ থাইজেন্ড। তা ছাড়া অন্য সব পার্কর্স।
প্রথমটা অবাক। তারপর রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে শমিতা।- টিউটোরিয়ালের মাস্টারমশাই থেকে ম্যানেজার! ভাবা যায় না। এ তো অ্যামেজিং ব্যাপার। সবচেয়ে দামি লটারি পাওয়ার মতো ঘটনা। তা রূপকথার গল্পের মতো ঘটনাটা ঘটল কী করে?
দীপেন বলেছে, টিউটোরিয়ালে মাস্টারি করে কটা টাকা আর পাওয়া যায়! তোমাকে আগে জানিয়েছি কিনা মনে নেই। আমি টিউটোরিয়ালে পড়ানো ছাড়াও কলকাতার তিন-চারটে বিরাট বিরাট বড়লোকের বাড়িতে প্রাইভেট টিউশনও করি–
হ্যাঁ, জানিয়েছিলে।
যিনি আমাকে অফারটা দিয়েছেন তিনি জেনিথ কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক হরগোবিন্দ টোডি। তাঁর ছেলে আমার ছাত্র। ক্লাস সিক্স থেকে পড়াচ্ছি। এ বছরের জয়েন্টে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে সিঙ্গাপুরের একটা মেডিকেল কলেজে অ্যাডমিশন পেয়েছে। তাই
ছোঁ মেরে দীপেনের বাকি কথাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে শমিতা বলেছিল, তাই ভীষণ খুশি হয়ে মিস্টার টোডি তোমাকে এই অফরটা দিয়েছেন, তাই তো?
হেসে হেসে আস্তে মাথা নেড়ে দীপেন জানিয়েছে, ঠিক তাই। তারপর বলেছে,
কিন্তু
কী?
কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।
কেন?
কারণটা হল, তোমার কনসেন্ট তো পেতে হবে।
তার মানে?
আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সবই তো তোমাকে সমর্পণ করে বসে আছি তুমি যা ডিসাইড করবে সেটাই ফাইনাল।
শমিতা এত স্মার্ট, এত সপ্রতিভ, তবু তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁট টিপে চোখের কোণ দিয়ে দীপেনের দিকে তাকাতে তার চোখে-মুখে চাপা হাসি ফুটে উঠল।
দীপেন গাঢ় গলায় বলেছে, কী হল, কিছু বলছ না তো। শুধু ঠোঁট টিপে থাকলেই হবে?