এদিকে সুরেশ্বর, প্রতিমা, সবিতা মাঝে মাঝেই নীচে চলে আসেন। সুরেশ্বর এর মধ্যে শমিতার জেঠু হয়ে গেছেন, প্রমিতা জেঠিমা, আর সবিতা বউদি। শুধু তাঁরাই নন, পাড়ার আরও অনেকেই, পুরুষ বা মহিলা এসে খোঁজখবর নিয়ে যান। এঁদের সবার সঙ্গে অল্পদিনেই বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে। এঁরা কেউ শমিতার কল্যাণী মাসি, কেউ সুধা কাকিমা, কেউ গোপা বউদি, কেউ বা পরিমলদা ইত্যাদি। কিন্তু সেই প্রথম দিনের পর দীপেন তো আসেইনি; রাস্তায়-টাস্তায় তাকে দেখা যায়নি।
পালপাড়ায় এসে ঘর-টর গোছগাছ করে নেওয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাতেই সব ঝক্কি শেষ হয়ে যায় না। বাড়ি বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুতে পুরোনো ঠিকানা বদল করে নতুন ঠিকানা বদলাতে হয়। যেমন রেশন কার্ডে, ভোটার আই ডি কার্ডে। নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার রান্নার গ্যাসের ডিলারকে গিয়ে কাগজপত্র দিয়ে বলতে হয় কোন ঠিকানায় গ্যাস সাপ্লাই করতে হবে। যারা অফিসে কাজ করে তাদের কর্মক্ষেত্রে নতুন ঠিকানা জানাতে হয়। যারা স্কুলে-কলেজে পড়ে তাদেরও তা-ই করতে হয়।
শমিতার মনে পড়ে, পালপাড়ায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই সুরেশ্বর চক্রবর্তীদের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও নিবিড় হয়েছিল। সুরেশ্বরকে সে জেই বলতে শুরু করেছে, তাঁর স্ত্রীকে জেঠিমা। সুরেশ্বরের মেয়ে এবং ছেলের বউ চন্দ্রনাথ আর লতিকাকে ডাকে কাকা আর কাকিমা। এর মধ্যে জানা গেছে সুরেশ্বরের ছেলে অনুপম কানপুরের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। ছুটিছাটায় মাঝে মাঝে এসে দশ-পনেরো দিন করে কাটিয়ে যায়। আর সুরেশ্বর স্টেট গভর্নমেন্টের ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে মাঝারি ধরনের অফিসার ছিলেন। রিটায়ারমেন্টের পর তাঁর হাতে তখন অফুরন্ত সময়। ওপর থেকে প্রতিমা, সবিতা, মানসীরা তো নীচে আসেই, চন্দ্রনাথের অফিসে যেদিন ছুটি থাকে, সেদিন আসেন সুরেশ্বর। বেশ মজলিশি মানুষ, জমিয়ে গল্প-টল্প করতে ভালোবাসেন।
শমিতার মনে আছে এক সপ্তাহ পর কী কারণে যেন বুধবার চন্দ্রনাথের অফিসে ছুটি ছিল। বিকেলের দিকে সুরেশ্বর এলেন। চা খেতে খেতে চন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
চন্দ্রনাথ হঠাৎ বলে উঠলেন, দাদা, কটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই
সুরেশ্বর উৎসুক চোখে তাকালেন।-হ্যাঁ হ্যাঁ, কী করতে হবে বলুন
কোথায় কোথায় ঠিকানা বদল করতে হবে, জানিয়ে চন্দ্রনাথ বললেন, শমির কলেজ আর আমার অফিসের ব্যাপারটা আমরা ঠিক করে নেব। কিন্তু বাকিগুলো আপনি ছাড়া গতি নেই। তা ছাড়া এখানে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন সুরেশ্বর। তারপর বললেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা আর গ্যাস সাপ্লাইয়ের অ্যাড্রেস চেঞ্জ করতে অসুবিধে হবে না। আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে ব্যবস্থা করে দেব। গ্যাস ডিলার আর যে ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্ট আছে তার ম্যানেজার আমার ছোট ভাইয়ের মতো। কোনও অসুবিধে হবে না। দু-চারদিনের মধ্যে সব হয়ে যাবে। তবে আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু
কিন্তু কী?
ভোটার আইডি কার্ড আর রেশন কার্ডের অ্যাড্রেস কীভাবে চেঞ্জ করতে হয়, আমার জানা নেই।
তা হলে?
কিছুক্ষণ ভেবে বলেছেন, চিন্তা নেই। দীপেনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তো
চন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেছে।হা হা, যেদি আমরা এখানে এলাম, একটি ছেলে সাইকেল চেপে যেতে যেতে আমাদের দেখে নেমে এসে পাড়ার অন্যদের সঙ্গে মালপত্র ধরাধরি করে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়েছিল, তার কথা বলছেন তো?
হ্যাঁ। ওর সঙ্গে নানা লেভেলের ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকজনের জানাশোনা আছে। ও ঠিক ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। আমি আজ রাত্তিরে ওর সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলব।
শমিতা একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, জেঠু, আপনি তো জানেন বাবা অসুস্থ মানুষ। ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভোগে। শরৎ ব্যানার্জি রোডে থাকার সময় আমাদের একজন হাউস ফিজিশিয়ান ছিলেন। খুব বড় ডাক্তার। তিনি বাবার চিকিৎসা করতেন। কিন্তু আমরা এতদূরে চলে এসেছি। আসার সময় তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম, কল দিলে তিনি এখানে আসবেন কিনা। ডক্টর দত্তগুপ্তর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বললেন, এতদুরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বাবার লাংসের সমস্যাটা মাঝে মাঝেই ভীষণ বেড়ে যায়। তাই কাছাকাছি থাকেন বা তাঁর চেম্বার আছে, এমন একজন ডাক্তার যে চাই।
সুরেশ্বর বললেন, ওটা নিয়ে সমস্যা হবে না। আদিগঙ্গার ব্রিজের ওপারে ডাক্তার মিত্রের বাড়ি। বাড়িতেই চেম্বার। এই এলাকার ধন্বন্তরি। আমার সঙ্গে জানাশোনা আছে। তবে দীপেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি। কারণ ডাক্তার মিত্রের ছেলে দীপেনের টিউটোরিয়ালের ছাত্র। ও ডাক্তার মিত্রকে বললে অনেক বেশি কাজ হবে।
.
পালপাড়ায় আসার দিন চোদ্দো-পনেরোর মধ্যে ব্যাঙ্কে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হল। রান্নার গ্যাসের ডিলারের কাছে গিয়ে পুরোনো কাগজপত্র জমা দিয়ে ঠিকানা বদল করা হল। চন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজ দুটো করে দিলেন সুরেশ্বর। বাকি রইল রেশন কার্ড আর ভোটার আই ডি কার্ড। সে দুটো করিয়ে দেবার কথা দীপেনের। ভোটের কার্ডে ঠিকানা বদলের জন্য চন্দ্রনাথকে স্থানীয় কাউন্সিলারের সুপারিশ, বাড়ি-ভাড়ার রসিদ ইত্যাদি নিয়ে যেতে হবে আলিপুরের অফিসে। আর নতুন রেশন কার্ডের জন্য যেতে হবে ফুড ডিপার্টমেন্টের অফিসে।