ওদিকে শমিতা আর মানসী পাশের ঘরে গিয়ে জানলার ধারে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়েছে।
মানসী বেশ মিশুকে মেয়ে। চমৎকার কথা বলতে পারে। স্বভাবটা বেশ মিষ্টি। সে বলেছে, শুনেছি, তোমরা লেক মানে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে থাকতে
হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে শমিতা।
ওই জায়গা ছেড়ে এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর পালপাড়ায় এসে নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে?
আসার সময় সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগছিল। উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে শমিতা বলেছে, এখানকার মানুষগুলো খুব ভালো। এমন হেল্পফুল মানুষ আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে নেই বললেই হয়। আর তোমরা আমাদের জন্যে যা করলে
বা রে, আমরা পাশাপাশি থাকব, এটুকু তো করতেই হয়। এই পালপাড়াটা একটা বড় ফ্যামিলির মতো। শুধু আমরা কেন, পাড়ার একজনের দরকারে আরেকজন ছুটে আসে।
টুকটাক কিছু কথাবার্তার পর মানসী বলল, বাবার কাছে শুনেছি, তুমি মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট করেছিলে–
বুঝেছি, আমার বাবা নিশ্চয়ই তাঁকে বলেছে। তিনি বলেছেন তোমাদের। বাবা আমার সম্বন্ধে বলে বেড়াতে ভালোবাসে। বাবার ধারণা তার মেয়ের মতো মেয়ে ওয়ার্ল্ডে বেশি জন্মায়নি। দুটো পরীক্ষায় রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছিল। বলে লাজুক একটু হাসল।হঠাৎ আমার রেজাল্টের কথা জানতে চাইলে?
নিজে তো টায়টোয় সেকেন্ড ডিভিশনে ম্যাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিকের বেড়া ডিঙোতে পেরেছি। কেউ দুর্দান্ত রেজাল্ট করলে ভালো লাগে। তার সঙ্গে গল্প করতে, বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হয়।
শমিতা অবাক। অন্যের সাফল্যে, কৃতিত্বে খুশি হয়, এমন সোজা সরল ঈর্ষাহীন মেয়ে আগে আর দেখেনি সে। শমিতা তাকিয়েই থাকে।
মানসী বলতে লাগল, এই যে আমাদের পাড়ার দীপেনদা, সাইকেলে চেপে এসে পাড়ার লোকেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমাদের কটা জিনিস ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে গেল, বি.এসসি অনার্সে কী রেজাল্ট করেছিল জানো? ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। আমার কী আনন্দ যে হয়েছিল।
শমিতার একটু মজা করতে ইচ্ছা হল।–তার সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল বুঝি?
তার বলার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত ছিল। সরল, অকপট মেয়েটা বুঝে গেল। বলল, ধ্যাৎ, দীপেনদা আমার দাদা। কত ছোটবেলা থেকে দেখছি।
এই নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করল না শমিতা।
মানসী বলতে লাগল, তুমি তো কলেজে পড়ো। কোন কলেজ?
লেডি ব্রাবোর্ন
চোখ কপালে উঠে গেল মানসীর। বাব্বা, ওই কলেজে পড়ার কথা ভাবতেই পারি না। হরিদাসী সমাজপতি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল থেকে যা রেজাল্ট করে বেরিয়েছি তাতে লেডি ব্র্যাবোর্নের দারোয়ান আমাকে গেট পেরুতে দেবে না। পড়া তো দূরের কথা! হায়ার সেকেন্ডারিটা উতরে যাবার পর স্বর্ণময়ী গার্লস কলেজ-এর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারিকে ধরাধরি করে বি.এ-তে পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ
মানে?
দুটো বছর নষ্ট হয়ে গেল।
মানসী কি ফেল-টেল করেছে? জিগ্যেস করতে গিয়ে থমকে গেল শমিতা।
উত্তরটা মানসীই দিল। একবার ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার যে পরীক্ষাটা হয় তার আগে আগে হল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। তারপরের বারও বাধা পড়ল। এবার টাইফয়েড। বি.এ ফাইনালটা আমার বোধ হয় আর দেওয়া হবে না। তার চোখে-মুখে নৈরাশ্য ফুটে ওঠে।
শমিতা ভরসা দেবার সুরে বলল, হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? অসুখ-বিসুখ তো মানুষের হয়ই। তোমার বেলায় পরীক্ষার সময় দুবার হয়েছে বলে বার বার যে হবে তাই কখনও হয় নাকি? এবার পরীক্ষার আগে সাবধানে থাকবে। ডাক্তারের অ্যাডভাইস মতো চলবে। কোনও প্রবলেম হবে না।
একটু ভেবে মানসী বলল, তুমি কোন মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছ?
ইংলিশ। সেই কেজি লেভেল থেকে। কেন?
মানসী কেমন যেন মুষড়ে পড়ল।–আমার মিডিয়াম বেঙ্গলি।
তাতে কী হয়েছে?
আজকাল সব মেয়েই চাকরি-বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি করব। কিন্তু বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি। ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে পারি না। চাকরি ইম্পসিবল–
এক কাজ কর।
কী?
স্পোকেন ইংলিশের একটা কোর্স করে নাও। ইংরেজিটা ভালো বলতে পারবে।
মানসীর চোখে-মুখে উৎসাহ ঝিলিক দিয়ে ওঠে।-রাসবিহারীর মোড়ে একটা স্পোকেন ইংলিশের স্কুল আছে। দু-চারদিনের মধ্যে ভর্তি হয়ে যাব। তুমি আমাকে হেল্প করবে তো?
নিশ্চয়ই।
.
শমিতারা পালপাড়ার আসার পর সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। এলাকার লোকজন হইহই করে তাদের মালপত্র ফ্ল্যাটের ভেতর মোটামুটি গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের গোছানোটা পুরোপুরি মনঃপূত হয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়। ড্রইংরুমের সোফাগুলো মাঝখানে টেনে এনে, ডাইনিং টেবিল আর চেয়ারগুলো একধারে সরিয়ে, অন্য কিছু কিছু জিনিস এদিকে-ওদিকে রেখে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে শমিতারা।
দিন তিনেক কলেজ কামাই হয়েছে শমিতার। চন্দ্রনাথ পাঁচদিন অফিসে যেতে পারেনি। তারপর শমিতার কলেজে আর চন্দ্রনাথের অফিসে যাওয়া শুরু হয়েছে। চন্দ্রনাথের অফিস ডালহৌসিতে। আদিগঙ্গার ওপরের ব্রিজটা পেরিয়ে ওধারে গেলেই বাস স্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে চড়ে বসলেই হল, এক বাসেই অফিস। শরৎ ব্যানার্জি রোডে থাকতে শমিতার কোনওরকম সমস্যা ছিল না। ওখান থেকে হেঁটে গোলপার্কে এসে দুশো চল্লিশ নম্বর বাসে উঠলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভেতর কলেজে পৌঁছোনো যেত। কিন্তু পালাপাড়া থেকে কম করে দু-তিনবার বাস বা মিনিবাস পালটাতে হয়।