হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে দীপেন বলেছে, আর বলবেন না, কান লাল হয়ে উঠছে। কিন্তু ও কী, আমাদের পাড়ার লোকেরা মালপত্র টেনে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা
কারণটা বুঝিয়ে দিলেন সুরেশ্বর। যারা মালপত্র টানাটানি করছিল ওদিক থেকে তারা ডাকাডাকি শুরু করল, এই যে দীপু, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ালে চলবে না। এধারে আয়, আলমারি-টালমারিগুলোর ভীষণ ওয়েট। ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
দীপেন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, পাঁচটা বেজে বারো। ছটায় আমার টিউটোরিয়াল ক্লাস। আধঘণ্টার বেশি থাকতে পারব না।
একটি মহিলা বলল, আধঘণ্টাই শ্রমদান করে যা। সেটুকুই যথেষ্ট।
হাসিমুখে এগিয়ে গেল দীপেন। বেশিরভাগ জিনিস আগে ঢোকানো হয়েছিল। বাকি কাজটুকু কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হল।
তারপর এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না দীপেন, সাইকেলে উঠে পড়তে পড়তে চন্দ্রনাথকে বলল, কোনও কিছুর জন্যে যদি আমাকে দরকার হয়, সুরেশ্বরকাকুকে বলবেন। উনি খবর দিলেই চলে আসব। ঘাসের জমিটুকু পেরিয়ে সাইকেলে স্পিড তুলে সে বেরিয়ে গেল।
পালপাড়ায় ভাড়াবাড়িতে উঠে আসার কথা যখন হচ্ছিল তখন থেকেই শমিতার মন খারাপ। সেদিন ট্যাক্সিতে আসার সময় ভেতরে ভেতরে একেবারে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু অম্বিকা পাল রোডে পৌঁছে কী ভালো যে লেগেছিল।
এতকাল তারা যেখানে কাটিয়ে এল তার বাইরের চেহারাটা যতই ঝাঁ-চকচকে হোক না, ওখানকার মানুষজন নিজেদের কেরিয়ার, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ইত্যাদি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত, এতটাই ডুবে আছে যে নিজস্ব ওই পরিধির বাইরে তাদের নজর যায় না। পাশাপাশি হয়তো বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু কেউ কারও খবর রাখে না। দেখা হলে আলগা একটু হাসি, কেমন আছেন, ভালো আছি ব্যস, এটুকুই।
কিন্তু পালপাড়ায় আসার পর চারপাশের মানুষজন যেভাবে ঝাঁপিয়ে এল, হাতে হাতে যেভাবে মালপত্র ফ্ল্যাটের ভেতরে নিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিল, অন্য কোথাও এমনটা ভাবা যায় না! চারপাশের শহরতলি নিয়ে তো গ্রেটার ক্যালকাটা। পালপাড়া তে তারই একটা অংশ। কলকাতার মধ্যে কতরকম কলকাতা যে আছে!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে শমিতা। পালপাড়ায় এসে কত মানুষজন দেখল সে। তারা যথেষ্ট ভালোমানুষ, সহৃদয়। কিন্তু কেন যেন দীপেনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কতক্ষণ আর সে এখানে ছিল! মাত্র কয়েক মিনিট। যথেষ্ট সুপুরুষ, ভদ্র, বিনয়ী। যা কথা বলার চন্দ্রনাথের সঙ্গেই বলেছে। শমিতা জানে সে সুন্দরী। ছেলেরা তাকে দেখলে ছোঁক ছোঁক করে। কিন্তু দীপেন কেমন যেন নির্লিপ্ত। তার দিকে সেভাবে তাকায়ওনি। তবু সবাইকে ছাপিয়ে তাকেই মনে পড়ছে। মনের ব্যাপারটা বড় বেশি রহস্যময়। অনেক সময় কোনও কার্য-কারণ থাকে না, তবু কখন যে সেখানে কী ঘটে যায়।
ওদিকে গোছগাছ হয়ে গেলে আশপাশের বাড়ির মহিলা এবং পুরুষেরা আবার আসব বলে চলে গেল।
শমিতারা টুকরো ঘাসের জমির একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তী বললেন, চলুন, আপনাদের গৃহপ্রবেশটা হয়ে যাক। চন্দ্রনাথদের সঙ্গে করে কোণের ফ্ল্যাটটায় ঢুকলেন তিনি।
দুটো প্রশস্ত বেডরুম, মাঝারি আকারের একটা ড্রইংরুম। তা ছাড়া রয়েছে কিচেন। যেটুকু খুঁত তা হল একটাই মাত্র বাথরুম। জানলাগুলো কিন্তু বেশ বড় বড়। হেমন্তের শেষবেলাতেও খোলা জানলা দিয়ে দুটো ঘরেই বেশ আলো এসেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়াও আসছে।
সুরেশ্বর শমিতাকে জিগ্যেস করলেন, কী, বাড়ি পছন্দ হয়েছে?
একটু হেসে মাথা সামান্য কাত করল শমিতা।
সুরেশ্বরের হাতে ফ্ল্যাটের তালাচাবি রয়েছে। চন্দ্রনাথের হাতে সেগুলো দিয়ে বললেন, আপাতত, এগুলো আপনাদের কাছে থাক। লটবহর থেকে নিজেদের তালাচাবি বের হলে ওগুলো আমাদের ফেরত দেবেন। তার কিছু নেই। আপনারা এখন বিশ্রাম করুন। আমরা ওপরে গিয়ে চাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ বলেই স্ত্রীর দিকে তাকালেন। –চন্দ্রনাথবাবুরা কিন্তু রাত্তিরে আমাদের সঙ্গে খাবেন।
প্রতিমা হাসলেন। এই নিয়ে কম করে দশবার বললে। আমার মনে আছে, মনে আছে, মনে আছে।
শমিতার মা লতিকা সংকোচের সুরে বললেন, দিদি, আমাদের জন্যে অনেক করেছেন। আর কষ্ট করে রান্না চড়াবেন না। আমাদের সঙ্গে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ, গ্যাস-ট্যাস সব আছে। রাত্তিরে ভাতে-ভাত করে নেব।
প্রতিমা বললেন, চাল-ডাল আজ আর বের করতে হবে না। আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। কাল থেকে যা করার করবেন।
এত আন্তরিকতা তো উপেক্ষা করা যায় না। মৃদু হেসে লতিকা বললেন, আমাদের জন্যে
তাঁকে শেষ করতে দিলেন না প্রতিমা। দুই ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে থামিয়ে দিলেন।
সুরেশ্বর চক্রবর্তীরা চলে গেলেন। তাঁর মেয়ে মানসী কিন্তু থেকে গেল। শমিতাকে খুব সম্ভব তার ভালো লেগে গিয়েছিল। বলল, চলো, তোমার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করি।
বাড়ি বদল করা অর্থাৎ এক জায়গা থেকে শেকড় উপড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার ঝক্কি কি? শ্বাসকষ্টের রুগি চন্দ্রনাথ একটা ঘরে শুয়ে পড়েছেন। শ্বাস টানতে অস্বস্তি হচ্ছিল। লতিকা তাঁকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে পাশে বসলেন। ধীরে ধীরে কষ্টটা কমে এল চন্দ্রনাথের। শ্বাসপ্রশ্বাস ফের স্বাভাবিক হয়ে এল। কষ্টের লক্ষণ বুঝে কখন কোন ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে, কখন নেবুলাইজার বা অক্সিজেন দিতে হবে সব জানেন লতিকা। চন্দ্রনাথের ডাক্তার সমস্ত তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।