- বইয়ের নামঃ গহনগোপন
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে
গহনগোপন – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
০১.
প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বা অক্টোবরের গোড়ায় কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়ে দীপেন। এবারও তার হেরফের হয়নি।
সবে অক্টোবর পড়েছে। বাংলা ক্যালেন্ডারে এটা আশ্বিন মাস! কলকাতার বাতাসে এখন পুজো পুজো গন্ধ। শহরের রাস্তায় রাস্তায় আর পার্কে পার্কে প্যান্ডেল বাঁধা চলছে পূর্ণোদ্যমে। আর কয়েক দিনের মধ্যে দশভুজা বাপের বাড়ি আসবেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ বাঙালির সবচেয়ে বড় পার্বণও দীপেনকে কলকাতায় ধরে রাখতে পারেনি।
মাঝখানে তিনটে বছর বাদ দিলে কোনওবার সে গেছে ঈশ্বরের আপন দেশ কেরালায়, কোনওবার রাজস্থানে, কোনওবার অমরকন্টকে বা গোয়র সমুদ্রসৈকতে। দশ পা হাঁটলেই ফুরিয়ে যাবে, ভারত তো এমন একরত্তি দেশ নয়; এ প্রায় এক মহাদেশ। দীপেনের বয়স যখন একুশ কি বাইশ, তখন থেকেই বছরের এই সময়টায় তার ভারতভ্রমণ চলছে।
এ-বছরে সে এসেছে কাশ্মীরে। এই নিয়ে তিনবার। কলকাতা থেকে জেট এয়ারের উড়ানে দিল্লি, সেখান থেকে কানেক্টিং ফ্লাইটে শ্রীনগর। শ্রীনগরে দুরাত কাটিয়ে তিনদিন হল দীপেন এসেছে পহেলগাঁও। উঠেছে লিডার নদীর ধারে ছোটখাটো একটা হোটেলে।
সারা ভারতভূমি জুড়ে যেখানে যত ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে, প্রায় সবই চষে ফেলেছে দীপেন। যেখানে সে একবার যায় সেখানে দুবার তার পা পড়ে না। কিন্তু কাশ্মীর তার কাছে ভেরি ভেরি স্পেশাল। ভূস্বর্গ কি এমনি এমনি বলে? তাই এখানে তিন-তিনবার।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছিল দীপেন। লিডার নদীর পাশ দিয়ে মসৃণ পাহাড়ি রাস্তাটা কোথাও সামান্য উঁচু, কোথাও সামান্য নীচু। স্বচ্ছন্দে হাঁটা যায়; পাহাড়ি-পথ বলে হাঁফ ধরে না।
দীপেনের বয়স পঞ্চাশ পেরোয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই সারা শরীর জুড়ে ভাঙন ধরেছে। চোখের তলায় কালচে ছোপ, গাল বসা, গায়ের চামড়া কুঁচকে-মুচকে গেছে। কপালে ভাঁজ। হাতের শিরাগুলো বড় বেশি প্রকট। অদৃশ্য ঘুণপোকারা রক্তে-মাংসে ঘাঁটি গেড়ে ধ্বংসের কাজ অনেকটাই শেষ করে ফেলেছে। তার পরনে সাত-আট বছরের পুরোনো গরম ট্রাউজার্স, শার্ট, সোয়েটার, কোট, মাথায় উলের টুপি। স্বাস্থ্য যখন টান টান, মজবুত ছিল, শীতের এই পোশাক চমৎকার মানিয়ে যেত। কিন্তু এখন ক্ষয়াটে, শীর্ণ দেহে সেগুলো ঝলঝল করে। শরীর শুকিয়ে গেছে কিন্তু কোট-প্যান্টগুলোর মাপ তো পাল্লা দিয়ে ছোট হয়ে যায়নি। তাই ভীষণ বেখাপ্পা দেখায়।
পা থেকে মাথা অবধি এত যে ভাঙচুর, তবু বোঝা যায় একসময় সে বেশ সপুরুষ ছিল।
পহেলগাঁওয়ের রাস্তাটা ধরে হাঁটছিল দীপেন। তার কোনও গন্তব্য নেই। শুধুই লক্ষ্যহীন হাঁটা। কলকাতায় এবছর আক্টোবরের গোড়াতেও বেশ গরম রয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরে? এর মধ্যেই কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। হিম-ঋতুটা যে এখন থেকে জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
ভরদুপুরে রোদের উষ্ণতা গায়ে মেখে হাঁটতে ভালোই লাগছে দীপেনের। রাস্তায় প্রচুর মানুষজন। বোঝা যাচ্ছে এরা সব টুরিস্ট। আগের বছর দুই জঙ্গি হামলার জন্য টুরিস্টরা আসছিল না। এবছর পরিবেশ খুব শান্ত, গুলি-গোলা ঝামেলা-ঝঞ্জাট নেই। পর্যটকরা তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চারপাশ থেকে অবিরল কলকলানি কানে আসছে। গুজরাতি, মারাঠি, হিন্দি, ওড়িয়া–এসব তো আছেই, তবে সব ছাপিয়ে বাংলাটাই বেশি শোনা যাচ্ছে।
বাঙালি এক জাত বটে। পায়ের তলায় তাদের সরষে। ছুটি পেলে তো ভালোই, নইলে ছুটি নিয়ে লটবহর কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেখানেই যাও, তা জোহানেসবার্গই হোক বা টোকিও গ্ল্যাসগো পাপুয়া নিউগিনি হাওয়াই বা লিসবন–সর্বত্র কম করে দশ-বিশটা বঙ্গবাসীর দর্শন মিলবেই। তা ছাড়া নিজেদের বিশাল ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া তো আছেই।
দীপেনের ডানপাশে লিডার নদী। তার পাড়ে অনেকটা গ্যাপ দিয়ে গ্যাপ দিয়ে বেশ কটা হোটেল। নদীটা কত আর দুরে? খুব বেশি হলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ ফিট। হোটেলগুলোর মধ্যে অনেকটা করে ফাঁক থাকায় রাস্তা থেকে নদীটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ, অগভীর জলধারাটির নীচের অজস্র নুড়ি, পাথরের টুকরো এবং বালুকণাগুলোকেও বুঝিবা গুনে নেওয়া যায়। নুড়ি-টুড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে ঝুম ঝুম আওয়াজ তুলে বয়ে চলেছে। লিডার। দিন-রাত একই সিমফনি।
দীপেনের বাঁ পাশেও ছোট পাহাড়। তার নীচের দিকে রাস্তা ঘেঁষে লাইন দিয়ে কাশ্মীরি শাল, সোয়েটার আর অজস্র কাশ্মীরি হ্যাঁন্ডিক্রাফটের দোকান; শো-রুম। ওপরের দিকে নানা ধরনের বাংলো, বেশিরভাগই কাঠের তৈরি। পিকচার পোস্টকার্ডে যেমনটা দেখা যায়, অনেকটা সেইরকম।
নদীর দিকে চোখ রেখে অন্যমনস্কর মতো পা ফেলছিল দীপেন। নানা এলোমেলো চিন্তা আর হতাশা উড়ো মেঘের মতো মাথায় ঢুকে যাচ্ছিল। তিনবার সে পহেলগাঁও এল। খুব ইচ্ছা ছিল লিডার নদী অনেক দূরে যেখানে বাঁক ঘুরে চলে গেছে সেখানে জম্মু ও কাশ্মীর গভর্নমেন্টের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের যে লগ কেবিনগুলো আছে তার একটায় কটা দিন কাটাবে, নদী থেকে ট্রাউট মাছ ধরবে, তা ছাড়া চন্দনওয়াড়ি হয়ে অমরনাথ যাবে। কিন্তু কোনওটাই হয়নি বা হবেও না। কেননা ব্যাঙ্কের সুদের ওপর ভরসা করে সে কোনওরকমে টিকে আছে। ব্যাঙ্ক যেভাবে দু-চারমাস পর পর ইন্টারেস্ট কমাচ্ছে তাতে–কিন্তু হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, আঙ্কল-আঙ্কল।