কিন্তু আজ বিকেলে স্বর্ণালীর কাছে যা শুনেছে এবং কিছুক্ষণ আগে মৃদুলা যা বলে গেল, তাতে একটা সংকেতই রয়েছে। মা আর আগের মা নেই। শিঞ্জিনীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। কেমন অচেনা অচেনা লাগছে তাকে। এতদিন দুজনে একসঙ্গে বসলে তাদের যত কথা হত নিজেদের নিয়েই। আজ তাদের ভেতর আরেক জন ঢুকে পড়েছে। বিমলেশ বসুমল্লিককে চোখে দেখেনি শিঞ্জিনী, কিন্তু তার অস্তিত্ব প্রবল ভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
শিঞ্জিনী অবাক হয়ে ভাবে, মৃদুলা একদিন তার জন্য কী করেছে। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে তিনটে বছর শ্বশুরবাড়ির, বিশেষ করে অনির্বাণের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। সে এক নিদারুণ সংঘাত। তখন দিনরাত আতঙ্কের মধ্যে কাটত মৃদুলার। ঘুমত না, ঠিকমতো খেত না, কেমন যে পাগল পাগল অবস্থা। একটা দুঃস্বপ্ন সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়াত। অনির্বাণ তখনও তার স্বামী। তার ভয়, এই বুঝি শিঞ্জিনীকে অনির্বাণরা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। বিরতিহীন। ঝড়ের মাতামাতি আরও বেড়েছে। বাইরের মতোই শিঞ্জিনীর বুকের ভেতরটা এখন উথালপাথাল।
নিজের অজান্তে কখন যেন হঠাৎ একটা টাইম মেশিন শূন্য থেকে নেমে এসে তাকে তুলে নিয়ে সেই কোন ছেলেবেলায় পৌঁছে দেয়।
.
তখন শিঞ্জিনীর কত আর বয়স। চার কি পাঁচ। ওরা থাকত বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর পেছন দিকের একটা রাস্তায়। সেখানে অনির্বাণদের মাঝারি ধরনের তেতলা বাড়ি। টাকাপয়সার সমস্যা নেই। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করত সে। পোস্টটা বেশ উঁচুর দিকে। তার বাবাও অনেক টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে গেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে ভালো ইন্টারেস্ট পাওয়া যেত।
বাড়িতে সবসুদ্ধ পাঁচটি মানুষ। অনির্বাণ, তার বিধবা মা রত্নময়ী, এক তরুণী বিধবা বৌদি যার নাম তরুলতা, মৃদুলা আর শিঞ্জিনী। তরুলতা অবশ্য মাঝে মাঝে তার বাপের বাড়ি পাতিপুকুরে চলে যেত। কখনও পনেরো-কুড়ি দিন, কখনও বা এক-দুমাস কাটিয়ে আবার ফিরে আসত। যখনই ফিরত, মৃদুলার সঙ্গে তুলকালাম শুরু হয়ে যেত। শিঞ্জিনী লক্ষ্য করেছে, প্রতিটি সংঘর্ষে রত্নময়ী আর অনির্বাণ তরুলতার পক্ষে। অন্যদিকে মা একা। কুৎসিত কলহে, তুমুল চিঙ্কারে সারা বাড়ি নরক হয়ে উঠত। এই মহাযুদ্ধের কারণ কী, সেটা বোঝার বয়স তখনও হয়নি শিঞ্জিনীর।
এসব অনেক পরের কথা। সে শুনেছে, মৃদুলা আর অনির্বাণের বিয়েতে প্রেমের নামগন্ধও ছিল না। ঘটকালিটা করেছিল খবরের কাগজ। ম্যাট্রিমোনিয়াল কলমে বিজ্ঞাপন দেখে ইন্দ্রনাথ যোগাযোগ করেছিলেন। মৃদুলাকে দেখে, তার সঙ্গে কথা বলে খুবই পছন্দ হয়েছিল অনির্বাণদের। বিশেষ করে তরুলতার। যেদিন মৃদুলাকে ওরা দেখতে আসে, সেদিনই নাকি মা আঁচ করেছিল, অনির্বাণ বা রত্নময়ী নন, ওদের বাড়ির আসল কী তরুলতা। ও বাড়িতে তার কথাই শেষ কথা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করে না।
তরুলতা মৃদুলার কানে কানে নাকি বলেছিল, আমিই তোমাকে পছন্দ করে নিয়ে যাচ্ছি। এই কথাটা সবসময় মনে রেখো।
বিয়ের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে তরুলতা কথা বলেছিল। এটা করতে হবে, ওটা না করলে চলবে না। অমুকটা চাই, টমুকটা চাই। অতজন বরযাত্রী আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। রত্নময়ী আর অনির্বাণ নীরবে ঘাড় কাত তার প্রতিটি কথায় সায় দিয়ে গিয়েছিল।
মৃদুলার মা অন্নপূর্ণা তখনও বেঁচে। তরুলতার এই কর্তালি তার পছন্দ হয়নি। বরং খারাপই লেগেছে। যেখানে রত্নময়ী মাথার ওপর রয়েছেন, বিধবা পুত্রবধূ কেন এত ফরফর করে।
অন্নপূর্ণার এই খুঁতখুঁতুনিকে আমল দেননি ইন্দ্রনাথ। একরকম তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনিতে তার এবং অন্নপূর্ণার কারও স্বাস্থই ভালো নয়। দুজনেই পাল্লা দিয়ে ভুগতেন। বেঁচে থাকতে থাকতে একমাত্র মেয়ের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলতে চেয়েছেন ইন্দ্রনাথ। কখন কার কী হয়ে যাবে, কে বলতে পারে। এটাই ছিল তাদের জীবনের শেষ বড় দায়িত্ব।
তরুলতাকে নিয়ে অন্নপূর্ণার মনে সামান্য একটু খিচ যে রয়েছে তা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছিলেন রত্নময়ী। তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও পেশ করেছিলেন। তরুলতা তার বড় ছেলে সুকুমারের স্ত্রী। কবছর আগে রাস্তা পার হতে গিয়ে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় সুকুমারের মৃত্যু হয়। কী আর এমন বয়স তরুলতার! সবে একত্রিশ। ছেলেপুলে হয়নি। ইচ্ছা করলে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত। লেখাপড়া জানা মেয়ে, একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া অসম্ভব ছিল না। এমনকী, ফের বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে পারত। তার সামনে অফুরান ভবিষ্যৎ। রত্নময়ী অনেকবার বুঝিয়েছেন, ফের তার বিয়ে করা উচিত। কিন্তু কোনও কথাই কানে তোলেনি। শ্বশুরবাড়িতে থেকে শোককাতর শাশুড়ি এবং দেওরটিকে আগলে আগলে রেখেছে। ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তরুলতার ওপর নির্ভর না করে উপায় নেই। তাদের সংসারের রক্তমাংসে সে জড়িয়ে গেছে।
একমাত্র মেয়ের বিয়ে। শিঞ্জিনী শুনেছে, রীতিমতো ধুম-ধাম করেই সেটা দিয়েছিলেন ইন্দ্রনাথ। লং প্লেয়িং রেকর্ডে সানাই, চোখধাঁধানো আলো, গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো ছাঁদনাতলা এবং বাসরঘর, নামকরা কেটারারদের দিয়ে ভোজের ব্যবস্থা। সব কিছুই নিখুঁত।