শিঞ্জিনী চকিত হয়ে ওঠে, তুমি বাইরে যাবে নাকি?
মৃদুলা বলল, ওটা একটা কথার কথা। যদি যাই
শিঞ্জিনী আর কোনও প্রশ্ন করল না।
দোতলায় উঠলেই প্রথম ঘরটা ইন্দ্রনাথের। সেখান থেকে তার দুর্বল স্বর ভেসে এল, খুকু এলি? পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি টের পান কোনটা মেয়ের কোনটা নাতনির আর কোনটা মালতীর। বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে তার ইন্দ্রিয়গুলো প্রখর হয়ে উঠেছে।
রাত্তিরে ইন্দ্রনাথের ঘরের দরজা ভেজানো থাকে। নিজের খাট থেকে নেমে খিল আটকে যে আবার বিছানায় উঠবেন, সে শক্তি তাঁর নেই। মৃদুলা পাশের ঘরেই থাকে। মাঝে মাঝে উঠে এসে বাবাকে দেখে যায়।
মৃদুলা সাড়া দিল, হ্যাঁ। ইন্দ্রনাথের ঘরের দরজাটা সামান্য ঠেলে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, তুমি এখনও জেগে আছ? ঘুমের ওষুধটা খাওনি?
ইন্দ্রনাথের রাতের খাওয়া হয়ে গেলে মালতী একটা অল্প পাওয়ারের নীলাভ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। ওটা ভোর পর্যন্ত জ্বলে।
মৃদু আলায় মশারির ভেতর আবছাভাবে ইন্দ্রনাথের শীর্ণ কাঠামোটা দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, খেয়েছি তো। কিন্তু তুই না ফেরা পর্যন্ত চোখে ঘুম যে আসে না।
আমি কি বাচ্চা মেয়ে? মৃদুলা বলল, কাজ থাকলে দেরি তো হবেই। কেন এত চিন্তা করো?
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন, আর কত দিন তুই আমাকে এমন কষ্ট দিবি?
মৃদুলা থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলে, অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়ো। আর জেগে থাকলে শরীর খারাপ হবে। ইন্দ্রনাথকে আর কোনও অভিযোগ তোলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দেয় সে।
মাঝখানের ঘরটা মৃদুলার। সেখানে এসে সে বলল, তুই নিশ্চয়ই পড়ছিলি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী, হ্যাঁ।
একটানা পড়লে চোখে খুব স্ট্রেন হয়। ভালো করে চোখ ধুয়ে নীচে খাবার ঘরে চলে আয়। আমিও বাইরের শাড়ি-টাড়িগুলো পালটে আসছি। বেশি দেরি করিস না।
নিজের ঘরে এসে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শিঞ্জিনী। যে বইটা পড়তে পড়তে মাকে দরজা খুলে দিতে নীচে নেমে গিয়েছিল, সেটা টেবলে খোল পড়ে আছে। এক সময় বইটা বন্ধ করে চোখে জল ছিটিয়ে, ভালো করে মুছে একতলায় নেমে এল সে।
মৃদুলা তার আগেই চলে এসেছে। তার পরনে এখন বাহারি নাইটি। কিচেনে খাবার গরম করছিল। মেয়ের পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে বলল, বস।
মালতীর কাজে কোনও খুঁত নেই। টেবলের মাঝখানে প্লেট, ফাঁকা জলের গেলাস, জলভর্তি স্টেনলেস স্টিলের জগ ইত্যাদি গুছিয়ে রেখে গেছে। ক্যাসেরোলে পরোটা রয়েছে। আর আছে প্ল্যাস্টিকের কৌটোয় কটা ক্ষীরের পানতুয়া।
শিঞ্জিনী একটা চেয়ারে বসে প্রথমে গেলাসে জল ভরল তারপর মৃদুলা এবং তার নিজের জন্য দুটো বড় প্লেট এবং সেগুলোর পাশে ছোট ছোট কটা গোল পোর্সিলিনের বাটি সাজিয়ে রাখল।
খাবার গরম হয়ে গেছে। মৃদুলা কিচেন থেকে এসে মেয়েকে পরোটা, ছোলার ডাল, মাংস ইত্যাদি দিয়ে নিজেও নিল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর মৃদুলা জিগ্যেস করল, তোর প্রি-টেস্ট যেন কবে?
পরোটার কোনা ছিঁড়ে চামচে করে ছোলার ডাল তুলে একসঙ্গে মুখে পুরে চিবোচ্ছিল শিঞ্জিনী। বলল, বেশি দেরি নেই।
পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে?
হচ্ছে।
এখন অন্য কোনও দিকে মন নয়। হায়ার সেকেন্ডারিটা খুব ইমপর্টেন্ট ব্যাপার। ভালো রেজাল্ট না করলে বড় কলেজে চান্স পাবি না।
জানি। নীরস গলায় শিঞ্জিনী বলল, অন্য কোনও দিকে মন দেবার মতো সময় আমার নেই।
একটু থমকে গেল মৃদুলা। আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, মেয়ের কথায় সূক্ষ্ম কোনও ইঙ্গিত আছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু বোঝা গেল না। তবে বেশ গম্ভীর আর অন্যমনস্ক মনে হল। সে বলল, টিচাররা কেমন ক্লাস নিচ্ছেন?
শিঞ্জিনী বলল, কোনও প্রবলেম নেই। আমাদের টিচারদের মধ্যে কেউ ফাঁকিবাজ নন।
কোচিং ক্লাস কেমন চলছে।
ভালো।
একটু চিন্তা করে মৃদুলা বলল, তোদের ফাইনালও এসে গেল। মাত্র কটা মাস বাকি। টিউটোরিয়ালে একসঙ্গে অনেক ছেলেমেয়েকে পড়ানো হয়। তোর কি মনে হয়, বাড়িতে এসে আলাদা করে পড়াবে, এমন দু-একজন টিউটর দরকার?
শিঞ্জিনী মাথা নাড়ে, না। লাগবে না।
এরপর অনেকটা নীরবে খেয়ে যায় দুজনে। শিঞ্জিনীর কেন যেন মনে হয়, মৃদুলা তার পড়াশোনা সম্পর্কে যা বলল তা নেহাতই দায়সারা। আগে প্রতিদিন খাবার টেবলে বসে কোন মিস কী পড়ালেন, কী নোট দিলেন, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করত। খুব ভালো ছাত্রী ছিল মৃদুলা। শুধু মেয়ের পড়া সম্পর্কেই খোঁজখবর নিত না, ক্লাস আর টিউটোরিয়ালের নোটগুলো খাতা খুলে দেখত। সেগুলো মেয়ে ঠিকমতো রপ্ত করেছে কিনা, নজর রাখত। শিঞ্জিনী আর ইন্দ্রনাথের জন্য অনেকটা সময় দিত সে।
খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। নতচোখে কিছুক্ষণ ইতস্তুত করার পর হঠাৎ মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকায় মৃদুলা। ভেতরে ভেতরে কী একটা দ্বিধা তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। দ্বিধাটা কাটিয়ে সে ডাকে, রূপা-।
শিঞ্জিনীর চোখও ছিল নিজের প্লেটের দিকে নামানো। মায়ের ডাকে চোখ তোলে সে, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করে না।
তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
বলো।
এক ভদ্রলোক তোর সঙ্গে আলাপ করতে চান।
হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে গেল শিঞ্জিনীর। স্বর্ণালী মায়ের সঙ্গে তিনবার যাকে দেখেছিল সেই লোকটাই কী? মায়ের মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে সামান্য চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কে ভদ্রলোক?