Site icon BnBoi.Com

নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়

নিজেই নায়ক - প্রফুল্ল রায়

১. নমস্কার, আমি রাজীব

০১.

নমস্কার, আমি রাজীব–রাজীব সরকার। আপনারা আমাকে চেনেন না, দ্যাখেননি। আমার নামটা আগে কখনও শুনেছেন কি? আপনাদের চোখ-মুখের কুঞ্চন দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে–শোনেননি।

আমি তো জনগনের নেতা অর্থাৎ লিডার-টিডার নই যে আমার নামে দেয়ালে দেয়ালে জাতির মুক্তিসূর্য রাজীব সরকার–যুগ যুগ জীও লেখা থাকবে। আমি আট দশ কি পনেরো লাখ টাকা দামের ফিল্মস্টারও নই বা গ্ল্যামারওলা একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়, অথবা আন্তর্জাতিক চোরা চালানদার। এ সব হতে পারলে খবরের কাগজে আর রঙিন পস ম্যাগাজিনগুলোতে অনবরত ছবি বেরুত। আর ছবি যখন বেরোয় না এবং কেউ যখন রাজীব সরকার জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটায় না তখন আমার নামটা আপনাদের শোনবার কোনও কারণই নেই।

লিডার স্মাগলার চিত্রতারকা–এ সবের কিছুই যদি না হই তা হলে আমি কী? আমি যে ঠিক কী, নিজের মুখে আর বলতে চাই না। আমার নানারকম কীর্তিকলাপ দেখে আপনাদের তা বুঝে নিতে হবে।

জানেন, কিছুদিন আগে আমার একবার দারুণ ইচ্ছা হয়েছিল সব গ্রেট ম্যানের মতো নিজের একখানা অটোবায়োগ্রাফি, মানে জীবন-চরিত লিখে ফেলি। শুনে আমার বিজনেস পার্টনার মেরী লতিকা বিশ্বাস বলেছে, তুমি কে হে যে লোকে তোমার বায়োগ্রাফি পড়বে! পিপলের সঙ্গে ইয়ার্কি দিতে যেও না, তার রেজাল্ট বিপজ্জনক। লতিকা বিশ্বাস কে, আমার কি জাতীয় বিজনেসের সে পার্টনার, এসব পরে বলছি, কিন্তু তার কথা শুনবার পর আমি রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম এবং জীবন-চরিত লেখার বাসনাটাকে আপাতত স্থগিতও রেখেছি।

লতিকার মতো আপনারাও হয়তো বলতে পারেন, তোমার সম্বন্ধে আমাদের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তবু পিপলকে মানে আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন, এক কথায় আমাকে নাকচ করে দেবেন না। আপনারা আমার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলতে থাকুন; দেখবেন এক সময় সামনে অনেকগুলো অচেনা দরজা খুলে গেছে আর আমি আপনাদের এক দারুণ রহস্যময় ওয়ার্ল্ডে পৌঁছে দিয়েছি।

আমার নামটা ইতিমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন। আপনাদের সুবিধার্থে নিজের সম্বন্ধে আরো দু-একটা ছোটখাটো খবর দিয়ে রাখছি।

আমার বয়স ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ। যা বয়স, আমাকে ঠিক তা-ই দেখায়। আমার হাইট পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি; বাঙালিদের পক্ষে এই উচ্চতা খারাপ নয়। ঈষৎ কোঁচকানো চুল নিখুঁতভাবে ব্যাকব্রাশ করা; দাড়ি চমৎকার কামানো। গায়ের রঙ কালো আর ফর্সার মাঝামাঝি; অর্থাৎ বাদামি। চামড়া টান-টান মসৃণ; তাতে পালিশ করা চকচকে ভাব আছে। আমার কপাল বেশ চওড়া, চোখ মাঝারি, মুখ লম্বাটে, ভারী ঠোঁট, নাকটা মোটার দিকে। আমি কিঞ্চিৎ মদ্যপান করে থাকি; সেই সঙ্গে নিয়ম করে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ। সেহেতু আমার চোখের তলায়, থুতনিতে বা পেটে অ্যালকোহল কোনও পলি জমাতে পারেনি। আমার বুকের মাপ প্রায় চল্লিশ ইঞ্চি, সরু কোমর, মাংসল শক্ত পায়ের গোছ। খুব সুন্দর না হলেও আপনারা আমাকে একজন বলিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয় পুরুষমানুষ বলতে পারেন।

পোশাক-টোশাকের ব্যাপারে আমি খুব শৌখিন নই। তবু কাজকর্ম বা প্রফেসান–যাই বলুন, তার খাতিরে আমাকে সর্বক্ষণ ফিটফাট থাকতে হয়। আমি দামি ইজিপসিয়ান কটনের শার্ট বা ট্রাউজার পরে থাকি, নতুবা স্মাগল-করা টেরিকটের পোশাক। যে আমেরিকান আর ফ্রেঞ্চ পারফিউম ব্যবহার করি তার গন্ধ আমাকে ঘিরে একশো গজ রেডিয়াসের বাতাসে ভুর ভুর করতে থাকে। কিন্তু এটা আমার বাইরের দিক। আমার একটা ভেতরের দিকও আছে। যাকে ইনার সেল্ফ বলে, তার কথাই বলছি। এই ইনার সেলফ ব্যাপারটা সব মানুষেরই থাকে। সে যা-ই হোক, বাইরের বা ভেতরের কোনও দিক সম্বন্ধেই আমি আর কিছু বলব না। আমার ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার জনগণ, অর্থাৎ আপনারা আমার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলবেন কিনা সেটা আপনাদের বিবেচনার বিষয়। এ নিয়ে আপনারা ভাবতে থাকুন; আমি নিজের কাজ করে যাই।

এই মুহূর্তে ট্যাক্সি থেকে নেমে থিয়েটার রোডের একটা একুশতলা স্কাই-স্ক্রেপারের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার ডান হাতে এটা দামি ব্রিফ কেস। এখন প্রায় দুটো বাজে। ফেব্রুয়ারি মাসের আজ বাইশ তারিখ। অর্থাৎ শীত শেষ হয়ে সময়টা গরমের দিকে গড়াচ্ছে। গড়াচ্ছেই শুধু, গরমটা পুরোপুরি পড়েনি। শীতের ম্যাড়মেড়ে রোদ এখন অনেক ঝলমলে; তবে তাতে ধার নেই। দক্ষিণ দিক থেকে উল্টোপাল্টা হাওয়া দিচ্ছে; যে হাওয়া রীতিমতো আরামদায়ক। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশটা নীল আয়নার মতো দিগন্তের ফ্রেমে যেন আটকে আছে।

আস্তে আস্তে পা ফেলে আমি সামনের বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঢুকলেই ডানদিকে পর পর চারটে লিফটু। এটা লিফট-বক্সে গিয়ে বোতাম টিপতেই সেটা হাউইয়ের মতো ওপরে উঠতে লাগল। আমি যাব এ-বাড়িরই ফোরটিনথ ফ্লোরে। ঝিঁঝির ডাকের মতো অটোমেটিক লিফটের একটানা মসৃণ শব্দ আমার কানে বেজে চলল।

পুরো এক মিনিটও লাগল না, লিফটটা ফোরটিন্থ ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়ে যেতে আপনা থেকেই দরজা খুলে গেল। আমি বাইরের লম্বা প্যাসেজে বেরিয়ে এলাম। প্যাসেজটা সোজা অনেক দূরে চলে গেছে। আর দু-ধারে পর পর অগুনতি ঘর।

এই বিশাল একুশতলা বাড়ির সবগুলো ফ্লোর জুড়েই নানারকম সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, ফরেন এয়ার লাইন্স আর ট্রাভেল এজেন্সির সাজানো কাউন্টার।

পিপল অর্থাৎ জনগণের কেউ কি আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন? এসে থাকলে বাঁদিকের পর পর তিনটে ঘর লক্ষ্য করুন।

আপাতত তিনটে ঘরের মাথায় তিনখানা ঝকমকে সাইনবোর্ড রয়েছে। প্রথম ঘরটার সাইনবোর্ডে লেখা আছে : এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন। দ্বিতীয় ঘরের সাইনবোর্ডটা এই রকম : ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ণ। তৃতীয়টি লেখা আছে? পার্সোনাল।

আপাতদৃষ্টিতে এ তিনটে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আসলে তা নয়। কেন নয় সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

যাই হোক প্রতিটি সাইনবোর্ড থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্ম কী হতে পারে তার মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। তবু মাঝে মাঝে খবরের কাগজে এদের যে বিজ্ঞাপন বেলোয় তাতে বিশদভাবে অনেক কিছু লেখা থাকে। যেমন ধরুন, এইড ইলেকসান কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন থাকে; সিওর সাকসেস। সাকসেস গ্যারান্টেড নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে আমাদের সাহায্য নিন। ভাবী এম-এল-এ, এমপি, কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের সুবর্ণ সুযোগ। ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্নের বিজ্ঞাপনে থাকে যে কোনও অনুসন্ধানের কাজে আমরা সহায়তা করে থাকি। যোগাযোগ করুন। পার্সোনালের বিজ্ঞাপনে থাকে ও ব্যক্তিগত যে কোনও বিষয়ে আপনাদের সেবার জন্য সর্বদাই আমরা প্রস্তুত। প্রয়োজনে সবরকম গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে।

হে জনগণ, আপনাদের আগে-ভাগেই জানিয়ে রাখছি ওই সাইনবোর্ডগুলো কিন্তু চিরকাল এক রকম থাকে না। দু-মাস, চার মাস, এমনকী কোনও কোনও সময় পনেরো দিন বাদেও ওগুলো বদলে যায়। যেমন ধরুন, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন হয়ে যায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ব্যুরো, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন হয়ে যায় এইড ক্লাব ফর ফ্লাড-অ্যাফেক্টেড পিপল ইত্যাদি ইত্যাদি। চারদিরে হাওয়া-টাওয়া বুঝে সাইনবোর্ড পাল্টে দেওয়া হয়; এই আর কি। কিন্তু এসব কথা পরে।

প্রথম ঘরটা অর্থাৎ এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের গা ঘেঁষে সরু একটা প্যাসেজ ভেতর দিকে চলে গেছে। সেখানে আছে মাঝারি মাপের একটা চেম্বার। আমি রাজীব সরকার প্যাসেজটা দিয়ে সোজা সেই চেম্বার চলে এলাম।

চেম্বারটা সমান দু-অংশে ভাগ করা। মাঝখানে কাচের  পার্টিসান ওয়াল। ওয়ালের এধারে এবং ওধারে দুটো দিকই চমৎকার করে সাজানো। লাল কার্পেটে মোড়া মেঝে, গ্লাস-টপ সেক্রেটারিয়েট টেবল, ফোম-বসানো রিভলভিং চেয়ার, ঝকঝকে রঙিন টেলিফোন, ফাইল-টাইল রাখার জন্যে প্লাইউডের কাজ করা র‍্যাক, ছোট অথচ সুদৃশ্য বুক কেস। চেম্বারের পিছন দিকে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা এয়ার কুলারও রয়েছে; সেটা গোটা কামরার শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

কাচের  দেয়ালের একদিকে বসি আমি; অন্যদিকটা আমার বিজনেস পার্টনার মেরী লতিকা বিশ্বাসের।

চেম্বারে আমার দিকটায় ঢুকতে ঢুকতে চোখে পড়ল লতিকা পার্টিসান ওয়ালের ওপাশে বসে আছে। আমাকে দেখে সে একটু হাসল; আমিও হাসলাম। তারপর হাতের ব্রিফকেসটা টেবলে রেখে কুপ করে শরীরটা রিভলভিং চেয়ারে ছেড়ে দিলাম।

আমাদের এই চেম্বারের সামনের দিকে সমান্তরাল রেখার মতো আরেকটা সরু প্যাসেজ রয়েছে। তারপর সেই তিনটে অফিস অর্থাৎ এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন আর পার্সোনাল। ওই অফিসগুলোর পিছন দিকের দেয়ালের খানিকটা করে অংশ কাচের। লতিকা আর আমি আমাদের ঘরে বসে ওই তিনটে আফিসের ওপরই নজর রাখতে পারি।

ওই অফিসগুলোও চমৎকার করে সাজানো। আমাদের এই চেম্বারের মতোই কার্পেট, টেলিফোন, রিভলভিং চেয়ার, এয়ার কুলার সবই সেখানে রয়েছে। তবে বসবার ব্যবস্থা এমনভাবে করা আছে যাতে ওই অফিস তিনটের কোনওটা থেকেই আমাদের চেম্বার দেখা যায় না। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, রামায়ণে কে যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে তীর ছুড়ত-কী যেন ক্যারেক্টারটার নাম-ও, হ্যাঁ মেঘনাদ, আমরাও ঠিক তেমনি সবার চোখে ধুলো দিয়ে এই চেম্বারে বসে থাকি। আমরা সবাইকে দেখি কিন্তু আমাদের কেউ দেখতে পায় না।

এই মুহূর্তে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের অফিসে বসে আছে সমরেশ, পার্সোনালে আছে রীতেশ আর ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসানে মীনাক্ষী। ওদের বয়স পঁচিশ থেকে আটাশের মধ্যে। রীতেশ ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির কমার্স গ্র্যাজুয়েট, মীনাক্ষী যাদবপুর থেকে কম্পারেটিভ লিটারেচারে সেকেন্ড ক্লাস এম-এ, আর সমরেশ শিবপুরের বি-ই। পাশ-টাশ করে চাকরি-বাকরির জন্যে ছসাত বছর ওরা গোটা কলকাতা চষে ফেলেছে। কোথাও কিছু জোটাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে ঠেকেছে।

এয়ার কুলারটা পুরোদমে চালানোই ছিল। এক মিনিটের মধ্যে আমার ঘাম শুকিয়ে গায়ের চামড়া জুড়িয়ে গেল।

লতিকা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, আজ এত দেরি হল?

যাতে পরস্পরের কথা শুনতে অসুবিধা না হয় সেজন্য কাচের  দেয়ালের এক জায়গায় একটা গোল ফুটো রয়েছে। সেই ফোকর দিয়ে বললাম, মেন্টাল হসপিটালে গিয়েছিলাম

লতিকা চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিল। বলল, কী ব্যাপার? তাকে বেশ চিন্তিও আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

লতিকার বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ; আমার চাইতে দু-তিন বছরের ছোট। তবে তিরিশের বেশি তাকে দেখায় না। দুর্দান্ত সুন্দরী নয় সে। মাঝারি চোখ, গায়ের রঙটা অবশ্য পাকা গমের মতো, নাকে-মুখে তেমন ধার নেই। তবে স্বাস্থ্য খুব ভালো; কোমল মসৃণ মাংসে তার কণ্ঠার হাড় ঢাকা। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা বাদামি চুল, পাতলা রক্তাক্ত ঠোঁট। থুতনির তলায় মুসুর ডালের মতো লালচে একটা তিলও রয়েছে। এই তিলটা লতিকার চেহারায় এক ধরনের তীব্র আকর্ষণ এনে দিয়েছে। মোট কথা, সব মিলিয়ে সে দারুণ স্মার্ট আর ঝকঝকে মেয়ে। লতিকারা বাঙালি ক্রিশ্চান।

বললাম, মার পাগলামিটা আবার বেড়েছে। সকালে হসপিটাল থেকে খবর পাঠিয়েছিল। তাই দেখে এলাম।

সিরিয়াস কিছু?

সিরিয়াস তো নিশ্চয়ই।

লতিকার মুখে উৎকণ্ঠার ছায়াটা গাঢ় হল। সে জিগ্যেস করল, ডাক্তাররা কী করতে বলছে?

আমাদের এইসব কেসে কিছুই করণীয় নেই। যা করবার হসপিটালই করবে। এনি ওয়ে, ডোন্ট ওরি। যা হবার তা হবেই; ভেবে কিছু লাভ নেই। বলে আমি হাসলাম। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আমি এমন একটি ক্যারেক্টার যে, যে-কোনও অবস্থায় হাসতে পারে। কাপড়-টাপড়ে যেমন মিলের ছাপ মারা থাকে তেমনি আমার মুখে সব সময় একটি পেটেন্ট হাসির স্ট্যাম্প মারা আছে। এই হাসিটা আমার ট্রেডমার্ক।

লতিকা মায়ের বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না। আমি এবার জিগ্যেস করলাম, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের কোনও খবর আছে?

লতিকা মাথা নাড়ল, না।

বলো কী! হোল কান্ট্রি জুড়ে ইলেকসানের সিজন আসছে; তবু কোনও ব্রাদার-ইন-ল মুখ দেখাচ্ছে না–স্ট্রেঞ্জ! এক কাজ করো-কাল ডেলি কাগজগুলোতে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দেবে। ভালো করে রাইট-আপ লিখে দিও–

আচ্ছা।

ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টও কেউ আসেনি?

না।

হোয়াট অ্যাবাউট পার্সোনাল?

একই অবস্থা।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, কোনও কারণেই আমার মুখ থেকে হাসি মুছে যায় না; দুশ্চিন্তা-টুশ্চিন্তা আমার হাজার কিলোমিটারের মধ্যেও নেই। হেসে হেসেই লতিকাকে বললাম, এ সব বিজনেসে যে রকম রিসেশন চলছে তাতে রেড লাইট জ্বেলে দিতে হবে দেখছি। বাবা গণেশকে উল্টে আবার নতুন বিজনেস ফঁদতে হবে।

আর কিছুদিন দেখো না-বলতে বলতেই হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল লতিকার। খানিকটা ব্যস্তভাবেই সে বলে উঠল, আরে একটা কথা বলতেই তোমাকে ভুলে গেছি।

কী?

একটি মহিলা পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে তিনবার ফোন করেছিলেন। মহিলা!

রিভলভিং চেয়ারটা লতিকার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম, কত বয়েস?

গলা শুনে বয়স বোঝা যায় নাকি? লতিকার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল। যায় না বুঝি?

হয়তো যায়; তবে আমি খেয়াল করিনি।

না করারই কথা। মেয়েদের গলা সম্বন্ধে তোমার আর কী ইন্টারেস্ট!

দ্যাটস ট্রু; ইন্টারেস্টটা তোমারই হওয়ার কথা। এবার থেকে মেয়েরা ফোন করলে বয়েস জিগ্যেস করে রাখব।

দারুণ বলেছ। ব্যাপারটা কী জানো, কম বয়সের মেয়েরা ফোন করলে আনন্দ হয়। আমি হেসে ফেললাম, যাক গে, এখন বলো মহিলাটি কী চান?

লতিকা বলল, উনি বলছিলেন ওঁর একটা ব্যক্তিগত কাজে আমাদের দেবেন; কাজটা যেমন পার্সোনাল তেমনি কনফিডেন্সিয়াল। এতে খুব স্ট্রিক্টলি গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

বেশ। কাজটা কী?

সেটা উনি টেলিফোনে বলতে চান না।

ওঁকে আমাদের অফিসে আসতে বললে না কেন?

বলেছিলাম। কিন্তু উনি এখানে আসতে চান না। উনি চাইছেন আমরাই ওঁর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলি। আমদের সঙ্গে আলোচনা করে মহিলা যদি কনভিন্সড হন, কাজটা আমরা পাব।

আচ্ছা

লতিকা বলতে লাগল, আমি ওঁকে কোনও কথা দিইনি। যতবার ফোন করেছেন ততবারই ওঁকে বলেছি পরে ফোন করতে। তারপর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।

তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তোমার কী মনে হয়, ডেকে নিয়ে গিয়ে কাঁদে ফেলবে?

বুঝতে পারছি না। লতিকাকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাল।

দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আবার যদি মহিলা ফোন করেন দেখা যাবে।

আমার কথা শেষ হবার আগেই ঘুঘুর ডাকের মতো শব্দ করে টেলিফোন বেজে উঠল। নিশ্চয়ই সেই মহিলার ফোন হবে।

হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জনগণ, পৃথিবীর কোনও ব্যাপারেই আমার কৌতূহল নেই। যা ঘটবার–ঘটবেই, যা হবার হবেই। আগে থেকে ব্যস্ত হয়ে বা হুড়োহুড়ি করে ব্লাড প্রেসারকে একটা বিপজ্জনক সীমানায় টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। লাইফকে আমি মোটামুটি এভাবেই নিয়েছি। ফলে আমার রক্তচাপ সব সময় নর্মাল। এদিক থেকে আপনারা আমাকে একজন নিরাসক্ত দার্শনিক ভাবতে পারেন। দার্শনিক! ফিলজফার। কথাটা শুনে নিশ্চয়ই আপনারা শার্টের হাতার নীচে নাক ঢেকে হাসছেন। হাসুন, আর যা-ই করুন আমি একজন ফিলজফারই।

কোনও ব্যাপারেই আগে থেকে আমি মাথা ঘামাই না। তবু ওই মহিলার টেলিফোনটা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আগ্রহ বোধ করলাম। ফোনটা তুলতে গিয়ে কী মনে হতে তাড়াতাড়ি ঘাড় ফেরাতে গিয়ে লতিকার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। লতিকা চোখ সামান্য কুঁচকে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছে আর গালের ভেতর জিভটা খুব আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসছে।

আমিও চোখ টিপে হাসলাম। তারপর ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই সমরেশের মোটা খ্যাসখেসে গলা শোনা গেল, রাজীবদা, আপনাকে একটু আসতে হবে। ইন্টারনাল কানেকনে সামনের অফিস তিনটের সঙ্গে আমাদের চেম্বারের টেলিফোনে যোগাযোগ রয়েছে। কোনও ব্যাপারে আটকে গেলে বা জরুরি পরামর্শের দরকার হলে ওখানে যারা থাকে আমার সঙ্গে কথা বলে নেয়। আমি না থাকলে লতিকার সঙ্গে কথা বলে। এই মুহূর্তে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন থেকে সমরেশ আমার লাইনটা ধরেছে।

অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স আর কাকে বলে! কোথায় একটি অচেনা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনব, তা নয়। সমরেশ কথা বলছে! ছোকরা এমনিতে খুবই সুপুরুষ, চেহারাটা দেখবার মতো, কিন্তু গলার স্বর যাচ্ছেতাই। ছেলেবেলায় অনবরত ফ্যারেনজাইটিসে ভোগার ফলে গলাটা ওই রমক হয়ে গেছে।

লতিকা তাকিয়েই আছে। টেলিফোনের মুখটা এক হাতে চেপে তাড়াতাড়ি লতিকাকে সেই কথাটা বলে নিলাম, অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। মহিলা নয়–আমাদের সমরেশ। বলেই হাত সরিয়ে সমরেশকে বললাম, কী ব্যাপার সমরেশ, যেতে হবে কেন?

গলার স্বর যতটা সম্ভব নামিয়ে খুব সতর্কভাবে সমরেশ বলল, এক ভদ্রলোক এসেছেন, ম্যানেজ করতে পারছি না।

খানিকটা ঝুঁকে এইড-ইলেকসন কর্পোরেশনের পিছন দিকের দেয়ালের কাঁচ দিয়ে দেখে নিলাম সমরেশের মুখোমুখি প্রকাণ্ড চেহারার মধ্যবয়সি একটি লোক বসে রয়েছে। বললাম, ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। বলেই টেলিফোনটা ক্রেডলে নামিয়ে রেখে লতিকার দিকে তাকালাম।

লতিকা জিগ্যেস করল, সমরেশ কী বলছে?

আঙুল দিয়ে সমরেশের সামনাসামনি সেই বিশাল লোকটাকে দেখাতে দেখাতে বললাম, এইড-ইলেকসানের নেটে বোধহয় একটা মালদার শিকার ঢুকেছে; সমরেশ ঠিক খেলিয়ে তুলতে পারছে না। যাই, গিয়ে দেখি ক্যাচ-কট-কট করা যায় কিনা

আমাদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সামনের সরু প্যাসেজটা দিয়ে ডানদিকের সেই করিডরে চলে এলাম। এখানে একটা ছোট দরজা আছে; যাকে সাইড-ডোর বলা হয় অনেকটা সেই রকম। দরজাটা ঠেলে এইড-কর্পোরেশনের ভেতরে চলে এলাম।

আমাকে দেখে সমরেশ তার চেয়ার ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। আর আমি তার ফাঁকা চেয়ারটায় সেই লোকটির মুখোমুখি বসলাম। আমাকে দেখিয়ে সমরেশ সেই লোকটিকে বলল, আপনি এঁর সঙ্গে কথা বলুন

এবার ভালো করে লোকটিকে লক্ষ্য করলাম। আমার চেম্বার থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম–লোকটা মধ্যবয়সি। সারা গায়ে বোপ চর্বির স্তূপ। গোলাকার শরীর, গোল মুখে ছোট ছোট চোখ, চওড়া কপাল, চুলে কলপ-লাগানো। থুতনির তলায় তিনটে থাক পড়েছে লোকটার; অনেকটা গলকম্বলের মতো দেখায়। তার পরণে সিল্কের পাঞ্জাবি, আর মিলের ফিনফিনে ধুতি, পায়ে চকচকে পাম্প-সু। দু-হাতের মোটা মোটা আঙুলগুলোতে কম করে সাতটা আংটি, গলায় সোনার চেন, হাতে গোল্ডেন ব্যাণ্ডে বাঁধা দামি চৌকো ফরেন রিস্টওয়াচ। চেহারা-টেহারা দেখে বেশ শাঁসালো ক্লায়েন্টই মনে হচ্ছে।

আমার সেই ট্রেড মার্ক নেওয়া পেটেন্ট হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বললাম, বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি–

লোকটি বলল, আমার নাম হীরাচন্দ আগরওয়াল।

নমস্কার।

নমস্কার, দিন কয়েক আগে নিউজ পেপারে আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখেছি। ইলেকসানের ব্যাপারে আপনারা তো সাহায্য করে থাকেন।

টেবলের ওপর ঝুঁকে বললাম, নিশ্চয়ই; ওটাই আমাদের বিজনেস।

বিজ্ঞাপনটা দেখে কদিন ধরে ভাবছিলাম আপনাদের অফিসে আসব। শেষ পর্যন্ত চলেই এলাম।

সো কাইন্ড অফ ইউ।

হীরাচন্দ আগরওয়াল একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমি এবার ইলেকসানে নামতে চাই। আপনারা আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন, বলুন

দু-ভাবে সাহায্য করে থাকি। অর্ডিনারি আর স্পেশ্যাল–দু-রকম ব্যবস্থা আছে। আমাদের কাস্টমাররা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সাহায্য করব।

ব্যাপারটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন

অবশ্যই

আমি যা বললাম সংক্ষেপে এই রকম–স্পেশ্যাল ব্যবস্থায় আমরা নির্বাচন-প্রার্থীর জন্যে মিটিং-এর অ্যারেঞ্জমেন্ট করি, লোকজন জুটিয়ে প্রসেসান বার করি, ক্যান্ডিডেটের ছবি দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাই, সিনেমা হলে স্লাইড দিই, মাইকে অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের মতো দিনরাত ভোট ফর অমুক বলে ইলেকসানের আগে পর্যন্ত চেঁচিয়ে যাই। প্রার্থী চোর ভেজালদার-স্মাগলার-ফেরেব্বাজ যাই হোক না, দেশসেবক, দানবীর ইত্যাদি ইত্যাদি অ্যাডজেকটিভ জুড়ে তার একখানা জীবনী ছেপে বাড়ি বাড়ি বিলি করি। ক্যান্ডিডেট যা বক্তৃতা দেবে তার কপি লিখে রেগুলার রিহার্সাল দিইয়ে নিই। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটিয়ে ক্যারেক্টার অ্যাস্যাসিনেশন মানে চরিত্র হননের ক্যাম্পেন চালিয়ে যাই। আমাদের আরেকটা স্পেশ্যালিটি হল প্রতিটি মিটিং-এ একজন করে চিত্রতারকা কিংবা পপ-সিঙ্গার নিয়ে আসি। এতে সভার গুরুত্ব বাড়ে, লোকজনও বেশি হয়। মোদ্দা কথা, মাঝে মাঝে মিটিং আর প্রসেসানের সময় ক্যান্ডিডেটকে হাজির হলেই চলবে। নইলে বাকি সময়টা নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে সে ঘুমোতে পারে। তবে এই স্পেশ্যাল ব্যবস্থার জন্য রেটটাও স্পেশ্যাল।

হীরাচন্দ বলল, রেটটা যদি বলেন

এম-পি-দের জন্যে পঞ্চাশ হাজার, এম-এল-এ-দের জন্যে পঁচিশ, কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের জন্যে দশ, আর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের জন্যে পাঁচ। ধন্যবাদ। অর্ডিনারি ব্যবস্থাটা কী রকম?

এতে আমরা শুধু ডেস্ক-ওয়ার্ক করে থাকি; ফিল্ডে নামি না। যেমন ধরুন পোস্টার ডিজাইন থেকে বক্তৃতার কপি পর্যন্ত তৈরি করে দিই। কীভাবে মিটিং করতে হবে, প্রসেসান বার করতে হবে তার প্ল্যান ছকে দিই। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজটা ক্যান্ডিডেটকে তার লোকজন দিয়ে করিয়ে নিতে হয়। অর্ডিনারি ব্যবস্থার রেট কেমন?

হাফ।

হীরাচন্দ আগরওয়াল এক মুহূর্ত কী চিন্তা করল। তারপর বলল, স্পেশ্যালটাই আমার বেশি পছন্দ। তাতে ঝামেলা নেই। একটু থেমে আবার বলল, আমি বিজনেসম্যান। বুঝতেই পারছেন ধান্দার পেছনে ছুটে ছুটে একেবারে সময় পাই না। কিন্তু ইলেকসানটা আমাকে জিততেই হবে। ওটা একটা প্রেস্টিজের ব্যাপারকী বলেন?

সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, তা তো বটেই।

দু-চারটে পয়সা রামজির কৃপায় আমার হয়েছে। এখন কিছু প্রেস্টিজ চাই আর পাওয়ার।

তা তো বটেই।

তা হলে আমার দায়িত্বটা আপনারাই নিন।

এ তো আমাদের সৌভাগ্য। এখন বলুন আপনি কী হতে চান–এম-পি, এম-এল-এ, কর্পোরেশনের কাউন্সিলার না মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার?

আমি এম-এল-এ হতে চাই।

ভেরি গুড। প্লিজ এক মিনিট–আমার গা ঘেঁসেই সমরেশ বসে আছে। তাকে বললাম, রেজিস্ট্রি খাতাটা দাও তো

সমরেশ বাঁধানো মোটা একটা খাতা আমার সামনে রাখল। সেটা খুলে পকেট থেকে পেন বার করতে করতে বললাম, আপনার বায়োডেটা বলে যান; আমাদের কাজের জন্যে দরকার হবে। আপনার নামটা তো জেনেছি। বাবার নাম? বলতে বলতে হীরাচন্দর নাম লিখে ফেললাম।

সোনাচাঁদ আগরওয়াল

সোনাচাঁদের ছেলে হীরাচাঁদ! আপনার বয়েস?

বাহান্ন।

বিজনেসম্যান তত বললেন। কীসের বিজনেস?

ছোটখাটো দুটো লোহার কারখানা আর একটা সোপ ফ্যাক্টরি আছে। বড়বাজারে কাপড়ের গদিও আছে। আর শেয়ার মার্কেটে কিছু ধান্দা করি। টুকতে ঢুকতে বললাম, আপনাদের বংশে কেউ জেল-টেল খেটেছে?

হীরাচন্দ নড়েচড়ে বসল। সন্দিগ্ধভাবে বলল, মানে?

খেটেছে কিনা বলুন না

খানিক্ষণ চিন্তা করে হীরাচন্দ বলল, আমার ঠাকুরমার ভাই চোরাই সোনা রাখার জন্যে দুমাস জেল খেটেছিল।

ফাইন। ওই জেল খাটাটা আপনার ঠাকুরদার ওপর চাপিয়ে মেয়াদটা বাড়িয়ে দুবছর করে দেব। কেন বলুন তো?

বুঝতে পারছি না।

বুঝিয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলুন আপনার ঠাকুরদার নাম কী?

মোতিচন্দ।

আমি বলতে লাগলাম, আপনার একটা জীবনচরিত লিখতে হবে তো। তাতে লিখব বৃটিশ আমলে নির্যাতিত দেশকর্মী মোতিচন্দ আগরওয়ালের পৌত্র হীরাচ আগরওয়ালকে ভোট দিন।

হীরাচন্দ প্রায় লাফিয়ে উঠল, চোরাই সোনার জন্যে জেল-খাটাটাকে এভাবে কাজে লাগাবেন! আপনার জবাব নেই। মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায় এসেছি, আমার এম-এল-এ হওয়া কেউ রুখতে পারবে না। বলুন–আপনাদের কাজ চালু করার জন্যে কী রকম অ্যাডভান্স দিতে হবে?

আমাদের বাঁধা রেট-টোয়েন্টি পারসেন্ট অ্যাডভান্স নিয়ে থাকি

তার মানে পাঁচ হাজার টাকা–এ পকেট ও পকেট হাতড়ে পঞ্চাশখানা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দিল হীরাচন্দ। তারপর হাতের ভর দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। আচ্ছা চলি-নমস্কার। আমায় আবার শেয়ার মার্কেটে ছুটতে হবে।

আপনার রিসিটটা নিয়ে যান।

কিছু দরকার নেই। আমি লোক চিনি–বিশাল চেহারা নিয়ে হেলেদুলে চলে গেল হীরাচন্দ আগরওয়াল।

সমরেশ বলল, এ হে, একটা কথা জিগ্যেস করতে এক্কেবারে ভুলে গেছেন রাজীবদা।

কী কথা? খাতাটা বন্ধ করতে করতে মুখ তুলে তাকালাম।

কোন কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে লোকটা দাঁড়াবে তা কিন্তু জেনে নেননি।

নিশ্চিন্তে থাকো। ক্যাশ যখন দিয়ে গেছে তখন গরজা ওর। দু-একদিনের মধ্যে আবার ও আসবে। তখন কনস্টিটিউয়েন্সির খবরটা জেনে নিলেই চলবে। কিন্তু তার দরকার হবে কি? বলে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে চোখ টিপলাম। সমরেশ হেসে হেসে মাথা নাড়তে লাগল অর্থাৎ দরকার হবে না।

একটু পর নিজের চেম্বারে ফিরে এসে হীরাচরে সেই পাঁচ হাজার টাকা লতিকাকে দিতে দিতে বললাম, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের প্রথম ইনকাম, জয় মা ভোটেশ্বরী। একবার যখন ফাঁদে ইঁদুর পড়তে শুরু করেছে তখন আঁকা বেঁধে আরো অনেকেই এসে যাবে, না কী বলে?

হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে নিতে লতিকা বলল, দেখা যাক।

এ রকম গোটা পনেরো-কুড়ি হীরাচন্দ ক্যাঁচাকলে গলা ঢোকালেই এইড-ইলেকক্সন কর্পোরেশনকে লিকুইডেশনে দেওয়া যেতে পারে।

পরের কথা পরে ভাবলেও চলবে। এখন বলল, এই টাকাটা কী করব?

চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে আমাদের এখানে চাকরির জন্যে ঘোরাঘুরি করছে না?

হ্যাঁ প্রায়ই আসছে। কিন্তু কোনও কাজকর্ম নেই–কী দেব?

ঠিক আছে, এই টাকাটা থেকে আপাতত ওদের বেকারভাতা দিয়ে যাও।

তারপর যদি কিছু বাঁচে রিজার্ভ ফান্ডে রেখে দেবে।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে উঠল। ইন্টারনাল কানেকানে পার্সোনাল থেকে রীতেশের গলা ভেসে এল, বাইরের একটা লাইন আছে রাজীবদা–

বললাম, দাও

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, এটা কি পার্সোন্যালের অফিস?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এর আগেও আমি তিনবার ফোন করেছি।

রিসিভারটা কানে রেখেই লতিকার দিকে ফিরে চোখ টিপলাম। লতিকা তাকিয়ে ছিল, আমার ইঙ্গিতটা বুঝে ফিসফিসিয়ে উঠল, সেই মহিলা নাকি? টেলিফোনের মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে বললাম, মনে হচ্ছে; দেখা যাক–বলেই দ্রুত হাতটা সরিয়ে মহিলার সঙ্গে কথা শুরু করলাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, শুনেছি আপনি ফোন করেছিলাম। বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি।

আপনাকে একটা ব্যক্তিগত কাজের দায়িত্ব দেব। সে বিষয়ে কথাবার্তা বলার জন্যে অনুগ্রহ করে একবার আমাদের বাড়ি আসতে হবে।

মহিলার কণ্ঠস্বর ঈষৎ ভারী, তবে তাতে এক ধরনের সুরেলা মাদকতা আছে। এই মাদকতার ভাবটা ভেতরে ভেতরে আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। লতিকাকে যা বলেছিলাম মহিলাকেও ঠিক তাই বললাম, আপনার দরকারের কথাটা ফোনে বলা যায় না?

ওধার থেকে মহিলার গলা ভেসে এল, না

এক পলক চুপ করে থেকে বললাম, কবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে হবে?

আজই, সন্ধের দিকে চলে আসুন–সে অ্যাট সিক্স থার্টি।

আসব। আপনার ঠিকানাটা

মহিলা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটা নম্বর দিলেন। ডায়েরিতে টুকে নিতে নিতে বললাম, আচ্ছা নমস্কার।

মহিলাও প্রতি-নমস্কার জানিয়ে বললেন, সন্ধেবেলা আপনার জন্যে কিন্তু আমি অপেক্ষা করছি।

ঠিক আছে-আমি টেলিফোন রেখে দিলাম। তারপর ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল লতিকা একদৃষ্টে আমাকে লক্ষ্য করছে। তার চোখে-ঠোঁটে-চিবুকে এক ধরনের চাপা কৌতুকের হাসি চকচকিয়ে উঠেছে। চোখাচোখি হতেই সে মজা করে বলল, তা হলে যাচ্ছ।

বললাম, যেতেই হবে। আফটার অল এটা আমাদের প্রফেশন। তারপর সোজাসুজি লতিকার চোখের দিকে তাকিয়ে কাচের  পার্টিসান-ওয়ালটার দিকে অনেকখানি ঝুঁকলাম। নীচু গলায় বললাম, তোমার আপত্তি নেই তো?

বিন্দুমাত্র না। প্রফেসান যখন, তখন যেতেই হবে।

থ্যাঙ্ক ইউ-চোখ টিপে হেসে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকো, আমি ফাঁসব না—

স্মার্ট ঝকঝকে মেয়ে লতিকা বিশ্বাস গ্রাম্য বালিকার মতো বলল, আচ্ছা–

.

০২.

সাড়ে পাঁচটায় আমাদের অফিস ছুটি হয়ে যায়। এখন পাঁচটা চল্লিশ।

সমরেশ, রীতেশ এবং মীনাক্ষী এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন আর পার্সোনালের ঘরে তালা লাগিয়ে চলে গেছে। ওদের তিন বেয়ারা রবীন, ভবতোষ আর শরদিন্দু নেই; ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও উধাও।

অবশ্য আমাদের এখানে কেউ আলাদা ভাবে অফিসার বা বেয়ারা নয়। এখানে সবার স্ট্যাটাস সমান। রবীন-শরদিন্দু-ভবতোষও ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট। আপাতত ওরা বেয়ারা হয়ে আছে; কদিন বাদেই অফিসার হবে। তখন সমরেশদের গায়ে বেয়ারার উর্দি চড়বে। আমাদের অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মোটামুটি এভাবেই চলছে। অর্থাৎ পালা করে এখানে সবাই অফিসার আর বেয়ারা সাজে।

যাই হোক, দুটো-আড়াইটার সময় এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনে সেই যে হীরাচন্দ আগরওয়াল এসেছিল তারপর আমাদের তিনটে কনসার্নের কোনওটাতেই একটা মাছি পর্যন্ত ঢোকেনি। বিজনেসের অবস্থা খুবই খারাপ।

ছুটির পর সবাই চলে গেলেও আমি কিন্তু এখনও আছি। সাড়ে ছটায় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সেই মহিলাটির কাছে যাবার কথা। ঠিক করে রেখেছি সোয়া ছটা নাগাদ এখান থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে চলে যাব। আগে বেরুলে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে সময়টা কাটাতে হবে। তাই অফিসেই আছি। আমি বেরুইনি বলে লতিকাও যায়নি; আমরা দুজন কাচের  দেয়ালের দুধারে যে যার চেম্বারে বসে আছি।

আমরা এলোমেলো গল্প করছিলাম। মাঝে মাঝে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। কথাবার্তার ফাঁকে একবার বললাম, এখনও আধ ঘণ্টার মতো আমাকে থাকতে হবে। তুমি শুধু শুধু আটকে আছ কেন? বাড়ি চলে যাও

লতিকা বলল, এখন বাড়ি যাব না।

কেন?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না লতিকা। আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তার টেবলের ওপর যে রঙিন পেপারওয়েটটা ছিল সেটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর বিস্বাদ গলায় বলল, বাবা ফিরে এসেছে।

খুবই চাপা ধরনের মেয়ে লতিকা। চার ঘন্টা আগে অফিসে এসেছি। এর মধ্যে একবারও বাবার কথাটা বলেনি। নেহাত বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলাম; তাই বলল। আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম, আবার!

হ্যাঁ।

কবে এল?

আজই সকালে।

লতিকার বাবার নাম যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস। এই লোকটা লতিকার জীবনে এক চিরস্থায়ী সমস্যা। মজা করে বললাম, খুবই আনন্দের খবর।

লতিকা বলতে লাগল, হা, আনন্দ আর ধরছে না। জানো, এবার একা আসেনি সে; সেই মেয়েছেলেটাকেও নিয়ে এসেছে। সঙ্গে দুটো বাচ্চা

ফার্স্ট ক্লাস। তোমাদের জনবল বেশ বেড়ে গেল।

লতিকা উত্তর দিল না; তার চোখে-মুখে ঘৃণা, রাগ, বিতৃষ্ণা–সব একাকার হয়ে যেতে লাগল।

একটা কথা মনে পড়তে বললাম, মাস তিনেক আগে তোমার বাবা তোমার কাছ থেকে না দুহাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিল? বলেছিল আর আসবে না?

বলেছিল তো। অনেকবার টাকা নিয়ে গেছে, অনেকবার ওই এক কথা বলে গেছে। বলতে বলতে লতিকা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, বাড়ির অবস্থাটা ভাবতে পারছ? আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, লতিকার বাবার কথা আমি পরে বলব। কেননা সামনের সুদৃশ্য ওয়াল-ক্লকটায় দেখতে পাচ্ছি এখন ছটা বেজে তেরো মিনিট। আর বসে থাকার উপায় নেই। এখনই উঠতে হবে।

লতিকা আবার বলল, আমি কী করব, বলতে পারো?

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, পরে ভেবে যা হয় করা যাবে। এখন চলো, বেরুনো যাক। আর দেরি করলে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সাড়ে ছটায় পৌঁছতে পারব না।

লতিকা আর কিছু বলল না।

তিন মিনিটের মধ্যে আমাদের চেম্বারে তালা লাগিয়ে দুজনে নীচে নেমে এলাম। নেমেই আমি একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। লতিকা আমার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠল না। ওরা থাকে বেলেঘাটায়। হাঁটতে হাঁটতে সে চৌরঙ্গীর দিকে চলে গেল; ওখান থেকে বাস-টাস ধরে বাড়ি চলে যাবে।

.

সেই মহিলাট টেলিফোনে যে ঠিকানা দিয়েছিলেন কাটায় কাটায় সাড়ে ছটায় সেখানে পৌঁছে গেলাম।

বিরাট কম্পাউন্ড-ওলা বাড়ি। আমি অবশ্য ট্যাক্সি নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম না। ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে রাস্তা থেকেই ট্যাক্সিওলাকে ছেড়ে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে প্রকাণ্ড গেটটার কাছে চলে এলাম। ঝকঝকে উর্দি-পরা নেপালি দারোয়ান সেখানে অ্যাটেনসানের ভঙ্গিতে মেরুদণ্ড টান করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে বন্দুক; গলা থেকে চামড়ার চওড়া বেল্টে টোটার মালা বুকের দিকে নেমে এসেছে।

আমি সামনে যেতেই দারোয়ান বলল, সাড়ে ছে বাজে আপকো আনেকা বাত থা?

মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ—

অন্দর যাইয়ে। বড়া মেমসাব আপকে লিয়ে ইন্তেজার করতী হ্যায়–

ভেতরে ঢুকলাম। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে কম্পাউন্ড; সেটা ঘিরে উঁচু দেয়াল। মাঝখানে অত্যন্ত মডার্ন আর্কিটেকচারের দোতলা বাড়ি। বাড়িটার সামনের দিকে একধারে টেনিস কোর্ট, আরেকধারে সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসের লন। লনে বড় বড় অনেকগুলো রঙিন গার্ডেন আমব্রেলা রয়েছে। সেগুলোর তলায় ফ্যাশনেবল বেতের চেয়ার। লনটাকে ঘিরে নানারকম অর্কিডের কেয়ারি। আরেকধারে ফুলের বাগান, বেঁটে পামগাছের জটলা। আমার বাঁদিকে খানিকটা দুরে কম্পাউন্ড ওয়াল ঘেঁষে তারের জালের ভেতর অগুণতি হরিণ আর খরগোস চোখে পড়ল। তার পাশে আরেকটা প্রকাণ্ড জালে ট্রপিক্যাল কান্ট্রির নানা ধরনের পাখি।

লন আর টেনিস কোর্টের মাঝখান দিয়ে সাদা নুড়ির পথ বাড়িটার দিকে চলে গেছে। আমি কী করব যখন ভাবছি, নুড়ির রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির দিকে যাব না এখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব–সেই সময় কোত্থেকে একটা সাদা উর্দি-পরা বেয়ারা প্রায় মাটি খুঁড়েই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। গেটের দারোয়ানটা যা জিগ্যেস করেছিল বেয়ারাটাও তাই জিগ্যেস করল। অর্থাৎ সাড়ে ছটায় আমার আসার কথা ছিল কিনা?

আমি মাথা হেলিয়ে দিলাম।

বেয়ারাটা বলল, আসুন আমার সঙ্গে

সে আমাকে লনের শেষ মাথায় নিয়ে গেল। কী আশ্চর্য, আগে লক্ষ্য করিনি, এখন দেখলাম, একটা রঙিন ছাতার তলায় সাদা বেতের চেয়ারে একটি মহিলা বলে আছেন।

কত বয়স হবে তার? দূর থেকে তিরিশ-বত্রিশের বেশি মনে হবে না। তবে কাছে এসে বোঝা যায় বয়সটা চল্লিশ পেরিয়েছে।

তার গায়ের রঙ ঝকঝকে রৌদ্র ঝলকের মতো। কপাল থেকে নাকটা নেমে এসেছে; তার দুধারে আঁকা আই-ব্রোর তলায় দীর্ঘ চোখ; মুখটা ডিম্বাকৃতি, সরু থুতনি, ভরাট মসৃণ গলার তলায় অনেকখানি অংশ অনাবৃত। তারপর ব্রা-টাইপের ছোট্ট ব্লাউজ; তার তলা থেকে সুভীর নাভির নীচে এক ইঞ্চি জায়গা পর্যন্ত শরীরের মধ্যভাগটা আবার উন্মুক্ত। মহিলার কোমরের তলায় বিশাল অববাহিকা। তার ঠোঁটে গাঢ় রঙ; নখ ম্যানিকিওর-করা; মুখে এনামেল। বাদামি চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এবং সযত্নে কার্ল-করা। তবে দু-চোখেরই নীচের দিকটা তার ফোলা ফোলা। পেটে এবং গালে কিঞ্চিৎ মেদও জমেছে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, চোখের এই ফোলা ফোলা ভাব, পেটের এই চবি–এগুলো কীসের লক্ষণ আমি জানি; এবং আপনারাও জানেন। শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখলেই আমি টের পেয়ে যাই। মহিলা অ্যালকোহলটি বেশ ভালোই চালান।

যাই হোক, তার পরনে এই মুহূর্তে দামি সিফন, গলায় বীভের হাড়, ডান হাতের কব্জিতে সোনার ব্যান্ডে ছোট্ট ওভাল সেপের এটা ঘড়ি। কোলে প্রচুর লোমওলা ধবধবে কুকুর। তাঁর লম্বা লম্বা সুন্দর আঙুল অলস ভঙ্গিতে কুকুরের লোমগুলোতে বিলি কেটে দিচ্ছিল।

বেয়ারা ডাকল, মেমসাব

মহিলা আমাদের দিকে ফিরলেন। বেয়ারা বলল, ইনি এসেছেন—

মহিলা আমাকে বললেন, পার্সোন্যালের অফিস থেকে আসছেন তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, নমস্কার

নমস্কার। বসুন—

একটা বেতের চেয়ারে মহিলার মুখোমুখি বসলাম।

আপনার নামটা তখন টেলিফোনে জেনে নেওয়া হয়নি। নাম জানলে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হয়।

নিজের আসল নামটা বলব কি বলব না, এক মুহূর্ত ভেবে নিলাম। তারপর নিজের অজান্তেই সেটা বলে ফেললাম।

মহিলা বললেন, আমার নাম মনোবীণা সান্যাল। আপনি আমাকে মিসেস সান্যাল বলতে পারেন।

এক পলক দ্রুত মনোবীণা সান্যালের সিঁথি এবং কপালটা দেখে নিলাম। মহিলা জানিয়েছেন তিনি মিসেস অর্থাৎ বিবাহিতা। কিন্তু সিঁদুর-টিদুর চোখে পড়ছে না। বাঙালি সুলভ রীতিনীতি সম্বন্ধে খুব সম্ভব এঁদের তেমন শ্রদ্ধা নেই। না থাক, আমার তাতে কী। আমি এসেছি আমার প্রফেসানের ব্যাপারে। বিবাহিত হয়েও কে সিঁদুর পরছে না, তা নিয়ে ভেবে ভেবে ব্লাড-প্রেসার চড়াবার কোনও মানে হয় না। বললাম, ধন্যবাদ। এখন বলুন, আমার ওপর কী দায়িত্ব দিতে চান

তার আগে আপনাদের সম্বন্ধে আমার কিছু জানবার আছে।

অত্যন্ত সতর্কভাবে মহিলাকে লক্ষ্য করতে করতে বললাম, কী জানতে চান?

আপনাকে ফোনে পাবার আগে আপনাদের অফিসের এক মহিলার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।

শুনেছি। ওই মহিলা আমার বিজনেস পার্টনার।

ও, আচ্ছা। আমি ওঁকে বলেছিলাম আমার কাজটা অত্যন্ত গোপনীয়। আপনাদের দায়িত্ব দিলে জানাজানি হয়ে যাবে না?

নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাডাম। আপনি যখন চাইছেন তখন কেউ জানতে পারবে না। গোপনীয়তা রক্ষা করা আমাদের প্রফেসানের একমাত্র ক্যাপিটাল। নইলে এই কনসার্ন কবে উঠে যেত।

আরেকটা কথা। আপনাদের বিশ্বাস করতে পারি তো?

সেটা আপনার ওপর নির্ভর করছে। এ ব্যাপারে নিজেদের সম্বন্ধে কোনও ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিতে পারব না। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমাদের কনসার্নটা পঁচিশ বছরের। কমাস আগে সিলভার জুবিলি হয়ে গেছে। মাননীয় ক্লায়েন্টদের খুশি করতে না পারলে এই কনসার্ন নিশ্চয়ই টিকত না। বলতে বলতে মনোবীণা সান্যালের দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলাম। মুখ-চোখ দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে ফাঁদটি আমি পেতেছি মহিলা তাতে পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ আমার কথা তিনি অবিশ্বাস করছেন না।

হে মহান জনগণ, ভদ্রমহিলাকে বললাম বটে আমাদের প্রতিষ্ঠানটা পঁচিশ বছরের, আসলে তিন মাস আগেও ওটার অস্তিত্ব ছিল না। আফটার অল এ একটা প্রফেসান; প্রফেসানের খাতিরে কত কিছুই তো বলতে হয়, যে প্রতিষ্ঠানের আয়ু মোট তিন মাস তার সিলভার জুবিলিও ঘটাতে হয়।

মনোবীণা সান্যাল বললেন, এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।

আমি নড়ে-চড়ে মেরুদণ্ড টান করে বললাম। মনোবীণা শুরু করলেন, আজে বাজে কথা না বলে আমি শুধু কাজের কথাটুকুই বলব।

উত্তর না দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম।

মনোবীণা বলতে লাগলেন, আমার একটি মেয়ে আছে; তার নাম শমিতা; ডাকনাম ডোরা। বয়েস চব্বিশ। প্রথমেই বলে রাখি শি ইজ এ প্রবলেম চাইল্ড। আমার ধারণা সে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড হুইস্কি খায়, শি ড্রিংকস লাইক ফিশ। যার তার সঙ্গে সে মেশে; একবার বেরুলে কখন কবে বাড়ি ফিরবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এভাবে চলতে পারে না। আপনি বলুন, পারে কি?

কেউ নিজের মেয়ের সম্বন্ধে এ রকম বলতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম। কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না।

মনোবীণা সান্যাল আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। একটু আগের প্রশ্নটা যদিও আমারই উদ্দেশ্যে, আসলে ওটা তিনি করেছিলেন নিজেকেই। মনোবীণা বলে যেতে লাগলেন, আমি চাই, ভোরা নর্মাল হোক। অন্য দশটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হোক ওর লাইফ।

গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, সব মা-ই তা চান!

আপনি তাহলে আমার সঙ্গে একমত?

নিশ্চয়ই।

মনোবীণা সান্যাল চিন্তিতভাবে এবার বললেন, বুঝতেই পারছেন, আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ানক সমস্যায় পড়ে গেছি। কিছুতেই ওকে কনট্রোল করতে পারছি না। এদিকে ওর বাবা চোদ্দো বছর পর কানাডা থেকে ফিরে আসছেন। হি ইজ এ ডিফারেন্ট টাইপ; তিনি ফিরে আসার আগে মেয়েকে আমি নর্মাল করে তুলতে চাই। আমার এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্যেই আমি আপনাকে ডেকেছি।

খুব শান্তভাবে বললাম, কী সাহায্য চান বলুন

ডোরা যেভাবে যেদিকে চলেছে সেটা খুবই বিপজ্জনক। যে কোনওদিন একটা ডিজাস্টার ঘটে যাবে। আমি চাই আপনি ওকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুন। যদি মেয়েটাকে নর্মাল করে দিতে পারেন, আই শ্যাল রিমেন এভার গ্রেটফুল। বলতে বলতে একটা থামলেন মনোবীণা। কী যেন চিন্তা করে একটু পর আবার বললেন, একটা কথা জিগ্যেস করতে ভুলে গেছি–এ জাতীয় কাজের অভিজ্ঞতা আপনাদের আছে কি?

নানা ধরনের মানুষ অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। কিন্তু এ রকম প্রবলেমের কথা আগে আর শুনিনি। পাছে এত বড় একটা ক্লায়েন্ট আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় তাই ব্যস্তভাবে বলে উঠলাম, এর চাইতে অনেক বড় সমস্যা ট্যাল করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন মিসেস সান্যাল।

মনোবীণা বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর অ্যাসুয়োরেন্স। এখন বলুন, এজন্য আপনাদের কী রেমুনারেসন দিতে হবে?

রেমুনারেসনের কথাটা পরে বলছি। আগে আপনার মেয়ে শমিতাদেবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন।

আলাপ করানো যাবে না।

বিমূঢ়ের মতো বললাম, কেন?

মনোবীণা বললেন, অসুবিধা আছে। ডোরা অদ্ভুত টাইপের মেয়ে। ও যদি টের পেয়ে যায়, আমি ওর পেছনের আপনাকে লাগিয়েছি, রেজাল্ট খুব খারাপ হবে।

তা হলে?

আমার মনোভাবটা বোধহয় বুঝতে পারলেন মনোবীণা। বললেন, ওকে যাতে চিনতে পারেন সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। এই দেখুন–পাশে একটা ফ্যাসনেবল লেডিজ হ্যান্ডব্যাগ পড়ে ছিল। সেটা খুলে দুটো পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোগ্রাফ সামনের টেবলটার ওপর রাখলেন মহিলা।

ফোটোদুটোর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। সে দুটো একই তরুণীর দুটি আলাদা আলাদা ভঙ্গির ছবি। ফোটোর চেহারার সঙ্গে মনোবীণা সান্যালের আশ্চর্য মিল। কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় মনোবীণার বয়সটা আচমকা কুড়ি-বাইশ বছর কমিয়ে ফেলতে পারলে এই রকমই দাঁড়াবে।

মনোবীণা আবার বললেন, দেখা হয়েছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম।

কেউ দেখে-টেখে ফেলতে পারে। ফোটো দুটো আপনি ব্রিফকেসে নিয়ে নিন। কথামতো ফোটো দুটো আমার ব্রিফকেসে পুরে ফেললাম।

মনোবাণী এবার বললেন, এর বেশি আমি আর কিছু দিতে পারব না। এখন কীভাবে ডোরার সঙ্গে আলাপ করবেন, কীভাবে ওকে নর্মাল লাইফে ফিরিয়ে আনবেন সেটা কমপ্লিটলি আপনার ব্যাপার।

ঘাড় কাত করে বললাম, তা তো বটেই।

এবার রেমুনারেসনটা ঠিক করে ফেলা যাক। কী পেলে আপনি হ্যাপি?

আমি জানি এই সব অদ্ভুত টাইপের মহিলাদের কাছে টাকা পয়সার কথা বলতে যাওয়া বোকামি। হয়তো আমি যা চাইব, মনে মনে উনি তার তিন গুণ দেবার কথা ভেবে রেখেছেন। ব্যাপারটা পুরোপুরি ওঁর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বললাম, আমি কী বলব; সব কিছু কনসিডার করে আপনি যা দেবেন আমি তাতেই খুশি।

মনোবীণা বললেন, এই তো বিপদে ফেললেন–বলে একটু থামলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইফ আই পে টেন থাউজেন্ড-খুব কম হবে কি?

দশ হাজার! ফিগারটা আমার পক্ষে প্রায় অভাবনীয়। খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠাই উচিত। কিন্তু কোথায় চেঁচাতে হয় আর কোথায় স্বরগ্রামকে নীচু ভাবে বেঁধে রাখা দরকার, আমি জানি। দশ হাজারের অঙ্কটা যেন কিছুই নয়, নেহাত দু-পাঁচ টাকার ব্যাপার, এই রকম মুখের চেহারা করে বললাম, ঠিক আছে, ওতেই হবে।

কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?

আপনার যা ইচ্ছে—

মনোবীণা খানিকক্ষণ ভেবে বলেন, এক হাজার দিই?

বললাম, তাই দিন

হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা বার করতে করতে মনোবীণা বললেন, না, দুহাজার দিচ্ছি। আমার মেয়েকে তো চিনি। ওর পেছনে আপনাকে অনেক পয়সায় দৌড়ুতে হবে। দুহাজারই রাখুন।

কুড়িখানা একশো টাকার নোট গুণে গুণে আমাকে দিলেন মনোবীণা। টাকাটা অবহেলার ভঙ্গিতে ব্রিফকেসে রেখে বললাম, ধন্যবাদ।

আমার কাজ আপাতত শেষ। মনোবীণা সান্যালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠতে যাব সেই সময় একটা দামি ইম্পোর্টেড গাড়ি সামনের বড় গেট দিয়ে ঢুকে টেনিস লনটার কাছে এস থামল। আর সেই গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সাড়ে ছফুটের ওপর হাইট, প্রকাণ্ড বুক, পালিশ করা ব্রোঞ্জের মতো রঙ। এত বয়সেও গায়ের চামড়া টান টান, মসৃণ। ছড়ানো কাধ তার, পাতলা ভুরুর তলায় মাঝারি ধরনের বাদামি চোখ, বিস্তৃত কপালের ওপর থেকে ব্যাক ব্রাস করা লালচে চুল। চৌকো মুখ, দৃঢ় চোয়াল, পরনে স্টিল গ্রে কালারের ট্রাউজার আর শার্ট। কোটটা গায়ে নেই, হাতে ঝুলছে। সব মিলিয়ে তাকে কেমন যেন অভারতীয় মনে হয়।

গাড়ি থেকে নেমে নুড়ির রাস্তার ওপর দিয়ে ভদ্রলোক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলেন। মনোবীণা সান্যাল তার দিকে চোখ রেখে চাপা নীচু গলায় বললেন, আপনি কী জন্যে এসেছেন, ওঁর কাছে বলবেন না।

আচ্ছা–আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম।

আর আমি যা বলে যাব তাতে সায় দিয়ে যাবেন।

ঠিক আছে।

আর কিছু বলার সময় পেলেন না মনোবীণা; ভদ্রলোক আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। দ্রুত এক পলকে আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, ইনি? মনোবীণা বললেন, ইনি একজন ইনটেরিয়র ডেকরেটর। আমাদের বাইরের ঘরটা ডেকরেসনের জন্য ওঁকে ডাকিয়েছি।

ভদ্রলোক বললেন, ও—

মনোবীণা এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, উনি আমার স্বামী–অরিন্দম সান্যাল।

আমি বিনীত ভাবে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতজোড় করলাম। অরন্দিম সান্যাল আমার দিকে আর ফিরেও তাকালেন না; একজন ইনটেরিয়র ডেকরেটর সম্বন্ধে তার কোনও কৌতূহল নেই। এমনকী সামান্য সৌজন্যও না। বড় বড় পা ফেলে ধবধবে সাদা নুড়ির রাস্তা দিয়ে তিনি বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

আর আচমকা বিদ্যুৎ চমকে যাবার মতো একটা কথা মনে পড়ে যেতে দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে মনোবীণার দিকে তাকালাম, কিন্তু

আমার গলায় হয়তো কিছু উত্তেজনা ছিল, হয়তো কিন্তু শব্দটা খানিকটা জোর দিয়েই বলে ফেলেছিলাম। মনোবীণা কী বুঝলেন তিনিই জানেন, তর্জনী তুলে বসলেন, আস্তে। কী জানতে চাইছেন?

আপনি তখন বললেন শমিতাদেবীর বাবা কানাডা থেকে আসছেন। কিন্তু আপনার স্বামী তো এখানেই আছেন–

মনোবীণা আরেকবার তর্জনী তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না। আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার বাইরে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ করেন–এটা আমি চাই না। আচ্ছা নমস্কার-সাদা সাদা ঝালরের মতো লোমলা সেই কুকুরটাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মনোবীণা। বললেন, আপনার কাজ কী রকম এগুচ্ছে মাঝে মাঝে খবর দেবেন। আই থিঙ্ক ইট উইল টেক সাম টাইম।

নমস্কার জানিয়ে যখন আমি গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম, তখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে। পাতলা অন্ধকার উলঙ্গবাহার শাড়ির মতো কলকাতাকে জড়িয়ে আছে।

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর নিরিবিলি। দেশভাগ, পপুলেশন এক্সপ্লোসান–এসব কোনও কিছুই কলকাতার এই অংশটাকে ছুঁতে পারেনি। তবে এ রাস্তায় পার্টিসনের পর ট্রাফিক বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বালিগঞ্জ, সাদার্ন অ্যাভেনিউ, যোধপুর পার্কের দিকে যারা থাকে এই রাস্তাটা শর্ট কাট করে তারা চলে যায়।

তখন সাতটার মতো বাজে। হুড় হুড় করে অগুনতি প্রাইভেট কার স্রোতের মতো নেমে আসছে। আমি রাস্তার ধার ঘেঁষে অন্যমনস্কর মতো লোয়ার সার্কুলার রোডের দিকে হাঁটছিলাম।

আমার ব্রিফকেসে নগদ দুটি হাজার টাকা রয়েছে। সাধারণত সব ব্যাপারেই অ্যাডভান্সের টাকাটা হাতিয়ে নিয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক চুকিয়ে দিই। অনেকগুলো ক্লায়েন্টের কাছ থেকে দু-এক হাজার টাকা করে অ্যাডভান্স নিতে পারলে মোটামুটি একটা ভালো অঙ্কই দাঁড়ায়। তখন আমরা করি কী, রাতারাতি কোম্পানির গণেশ উল্টে দিই। এবং সেই জায়গায় কলকাতার রাস্তায় নতুন নতুন শিবলিঙ্গর মতো আনকোরা নতুন একটা প্রতিষ্ঠানে গজিয়ে তুলি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আমাদের প্রফেসানের এই হল ট্রেড সিক্রেট।

মনোবীণা সান্যালের কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকাটা যখন পাওয়া হয়ে গেছে তখন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে আমি আর আসছি না। যেখান থেকে একবার কিছু আদায় হয়ে যায়, সেদিকে আমি আর তাকাই না।

নো লুকিং ব্যাক। কিন্তু আমার এই ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের লাইফে ওয়ার্ল্ডের অনেকটাই তো দেখা হল, বহু ঘাটের জলও খাওয়া হল, আমাদের প্রফেসানে সেই সূত্রে অদ্ভুত অদ্ভুত সব মানুষের কাছে এসেছি। যাদের অনায়াসেই রেয়ার হিউম্যান স্পেসিমেন বলা যেতে পারে। এতকাল যা-ই দেখে থাকি না কেন, মনোবীণা সান্যালকে আগে আর কখনও দেখিনি। যতই তাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করছি, তার ভাবনাটা টোকা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছি ততই তিনি, এক মিনিটের জন্যে দেখা তার স্বামী অরিন্দম সান্যাল, যাকে নর্মাল লাইফে পুনর্বাসন দেবার দায়িত্ব কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছি সেই শমিতা এবং এবং তার কানাডা প্রবাসী বাবা—সবাই তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে লাগল।

২. আমি থাকি এন্টালিতে

০৩.

আমি থাকি এন্টালিতে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মনোবাণী সান্যালের বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় খানিকক্ষণ এলোমেলো ঘুরলাম। তারপর সাড়ে দশটার সময় এন্টালিতে নিজের কোটরে ফিরে এলাম।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আপনাদের কেউ যদি আমার সঙ্গে এসে থাকেন অনুগ্রহ করে এই বাড়িটার অবস্থান লক্ষ্য করুন।

চারধারে টালি আর টিনের চালের ঘিঞ্জি বস্তি; মাঝখানে ধসে পড়া যে তিনতলা বাড়িটা কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খুব সম্ভব কলকাতার আদি পিতা জব চার্নক নিজের হাতে তার ভিত গেঁথেছিলেন। এটাই আমার হোম–সুইট হোম। এই বাড়িতেই একদা আমি জন্মেছিলাম। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি এ বাড়িতে কখনও হোয়াইট ওয়াশ করা হয়নি; সাঁইত্রিশ বছর ধরে বাড়িটা এই রকম বিপজ্জনক ভাবে হেলে রয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য কাণ্ড, বাড়িটা কিন্তু পড়ে না।

এটার আদি রঙ কী ছিল বুঝবার উপায় নেই। রোদে আর বৃষ্টিতে দেয়ালের আস্তর খসে গিয়ে কবেই ইট বেরিয়ে পড়েছে। এখন তার ওপর তিন ইঞ্চি পুরু কাঁচে শ্যাওলা জমে আছে। দেয়াল আর ভিতের ভেতর নানা আগাছা পঞ্চম বাহিনীর মতো শেকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ ক্রমাগত এগিয়ে রাখছে। এরই ছাদে অ্যাসবেস্টসের দু-খানা ঘর নিয়ে আমি বসবাস করি।

এ বাড়ির প্রত্যেক ফ্লোরে ছটা করে কামরা। তিনটে ফ্লোরে আঠারোখানা কামরায় মোট নটি ফ্যামিলি থাকে। ফ্যামিলি পিছু এখানে দুটো করে ঘর। এ বাড়ির একতলায় থাকে একটা চীনা ফ্যামিলি, একা বিহারি মুসলিম ফ্যামিলি, আর থাকে দুটো কাবলিওলা। কাবলিওয়ালাদের অবশ্য স্ত্রী ছেলেমেয়ে নেই। দোতলায় আছে একটা তেলেঙ্গী, একটা মারোয়াড়ি আর একটা বর্মিজ ফ্যামিলি। তিনতলায় থাকে একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, একটা নেপালি আর একটা শিখ ফ্যামিলি। আর এই বিশ্বসুদ্ধ জাতির মাথায় অর্থাৎ ছাদের ওপর থাকি আমি।

আমার যারা প্রতিবেশী তাদের সব আজব জীবিকা। কেউ সুদে টাকা খাটায়, কেউ রেসের বুকী, কেউ ড্রাইভার। কেউ সদর স্ট্রিটে মেয়েমানুষের দালাল, কেউ মাংসের দোকানদার, কেউ চামড়ার ব্যবসায়ী..ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এক জায়গায় সবার আশ্চর্য ছিল। বাংলা মদটি সকলেই নিয়মিত পান করে থাকে।

এমন একটি ইউনাইটেড নেশনের হেড কোয়ার্টার আমি কেমন করে খুঁজে পেলাম? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় এ কৃতিত্ব আমার নয়। আমার জন্মদাতা পিতা ঈশ্বর ভারতচন্দ্র সরকার এটি খুঁজে বার করেছিল এবং আজ থেকে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে মাত্র দশ টাকা ভাড়ায় এখানে এসে ম্যারেড লাইফ স্টার্ট করেছিল। তিন সাড়ে তিন যুগ আগের সেই দশ টাকা ভাড়া বেড়ে এখন পঁচিশ টাকায় উঠেছে। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ভাড়াটে বাড়ির দু-খানা অ্যাসবেস্টসের ঘর ছাড়া আর কিছুই পাইনি। মার পঁচিশ টাকায় ওয়ার্ল্ডের সেভেন্থ সিটি এই কলকাতার হার্টের কাছাকাছি তেতলা বাড়ির ছাদে যে থাকতে পারছি, একমাত্র এই কারণটার জন্যে আমি বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। যাক গে, বাবার কথা এখন নয়-পরে।

এখন এই রাত সাড়ে দশটায় বাড়িটার ভেতর ঢুকে দেখলাম একতলায় বিহারি মুসলমান আর কাবলীদের ঘরে এর মধ্যে আলো নিভে গেছে। তবে চীনেরা একটা খাঁটিয়ায় বসে সপরিবারে যুগপৎ রাতের খাবার আর বাংলা মাল খাচ্ছে। ওদের ফ্যামিলির কর্তা–নামটা কিছুতেই মন থাকে না; বাজারে ওদের জুতোর দোকান আছে-আমাকে দেখে রক্তাভ হলদে মুখে একটু হাসল। বলল, রিতারনিং? লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে; হিন্দিটা অবশ্য অনর্গলই বলে। তবে উচ্চারণ আধো-আধো; অনেকটা বাচ্চাদের মতো সব চীনারই উচ্চারণ বোধ হয় এইরকম।

যাই হোক আমিও একটু হাসলাম, ইয়েস। এভরিথিং অলরাইট?

ইয়েস। কাম অন, জয়েন আস।

ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আজ নয়–আরেকদিন ওদের সঙ্গে খাব। তারপর বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দোতলার বাঁকে এসে দেখলাম দোতলার বর্মিজ ফ্যামিলির বড় ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দোতলার বাঁকে এ ছেলেটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ থেখে ভক ভক করে দিশি মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে কম করে তিনশো ষাট দিন রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে ওই ছোকরাকে সিঁড়ির মুখে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ওর পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। এই মুহূর্তে এখানকার দুই পরিবার মারোয়াড়ি আর তেলেঙ্গীদের মধ্যে কোনও বিষয়ে তুমুল ঝগড়া চলছিল। এ বাড়িতে এই রকম ঝগড়া কোনও না কোনও ফ্লোরে সব সময়ই চলতে থাকে। আঠারোটা ঘরে বিশ্বসুদ্ধ জাতির সহাবস্থান ঘটলে এই রকম কাণ্ডই হয়। এটা আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওদের ভেতর দিয়ে আমি বর্মিজদের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে খুলে হেড অফ দি ফ্যামিলি, তার পিছনে তার গিন্নী এবং গিন্নীর পিছনে একগাদা কাচ্চাবাচ্চার মোঙ্গলীয় মুখ উঁকি মারল।

ফ্যামিলির কর্তা ভীতভাবে জিগ্যেস করল, ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া

লোকটা কী করে, সংসার কী ভাবে চালায়–সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরেও আমি জানতে পারিনি। কেউ বলে লোকটা চোরা চালানদার, কেউ বলে কোকেনের ব্যবসা করে। অসটেনসিল মিস অফ ইনকাম বলতে যে কথাটা আছে সেটা ওর নেই। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি লোকটা সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। বললাম, তোমার বড় ছেলে সিঁড়ির মুখে নেশার ঘোরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

লোকটা বলল, রহনে দেওয়া শালেকো। শালে হামারা জান বরবাদ কর দিয়া।

এক নিশ্বাসে লোকটা যখন নিজের ছেলে সম্বন্ধে দু-দুবার শালা শব্দটা উচ্চারণ করল তখন আমার আর বলবার কিছু নেই। সুতরাং আমি তেতলায় উঠে এলাম। এখানে কারোকেই দেখা গেল না। তবে তিন পরিবারের দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় কেউ ঘুমোয়নি। এই মুহূর্তে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঘরে প্রচণ্ড জোরে জ্যাজ বাজনার রেকর্ড বাজছে। জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম ওই ফ্যামিলির দুই মেয়ে বাজনার তালে তালে নেচে যাচ্ছে; তাদের প্রচণ্ড মোটা মা আর বাবা চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে মেয়েদের নাচ দেখছে। উল্টোদিকে শিখেদের ঘরে তারস্বরে বিবিধ ভারতী চলছে। এই দুটো ফ্যামিলি পাল্লা দিয়ে সারাদিন রেডিও আর জ্যাজ চালায়।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বড় মেয়েটা, নাম যার ডরোথি; কোন একটা ব্রিটিশ কোম্পানির টেলিফোন অপারেটর–আমাকে দেখলে এখনই মেয়েটা ছুটে আসবে; হাত ধরে টানাটানি শুরু করবে। মেয়েটা আমাকে ভীষণ লাইক করে। সবার সামনেই জড়িয়ে-উড়িয়ে ধরে এমন কাণ্ড করে বসে যাতে আমি যে আমি; আমার পর্যন্ত নাক-মুখ দিয়ে ঝুঁজ বেরুতে থাকে। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, ডরোথির কাছ থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই-এখনও পা টিপে টিপে তেতলার ছাদে উঠে এলাম।

এই গোটা ছাদটা দুখানা অ্যাসবেস্টসের ঘর সুন্দু পুরোপুরি আমার দখলে। এখান খেকে প্রকাণ্ড আকাশ আর গ্রেট ক্যালকাটা মেট্রোপলিসের অনেকখানি স্কাইলাইন চোখে পড়ে। যাই হোক, তালা খুলে আলো জ্বেলে ফেললাম। একটা ঘরে ঢুকলেই ভেতরের দরজা দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায়।

আমার এই ঘরটার একধারে পুরনো আমলের একটা ধবধবে বিছানা পাতা রয়েছে। আরেকধারে ছোট আলমারি, টেবল, বুক শেলফে কিছু বই-টই, দেয়ালে আয়না এবং একটা র‍্যাকে সেভিং বক্স, চিরুনি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার খাটের তলায় তেলচিটে আরেকটা বিছানা রয়েছে। সেটা চার্লির। ব্রিফকেসটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে জুতা খুলে ফেললাম। তারপর মাঝখানের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলাম। এটাকে মোটামুটি কিচেন-কাম-ডাইনিং রুম বলা যেতে পারে। চোখে পড়ল টেবলের ওপর আমার রাতের খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে। এ নিশ্চয়ই চার্লির কাজ। রোজই আমার জন্যে রাতের খাবার তৈরি করে বিছানা-টিছানা পেতে, ময়লা ট্রাউজার-ফাউজার থাকলে ধুয়ে ইস্তিরি করে রেখে যায় সে।

চার্লির সঙ্গে ক্বচিৎ কখনো আমার দেখা হয়। সে কখন আসে কখন যায় আমি জানি না। তবে একবার আসেই। এবং রান্না-বান্না থেকে ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্ম করে রেখে যায়। আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। চার্লি একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চোর! সারারাত কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় নিজের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায় সে। আর মওকা পেলেই সুরুত করে কোনও বাড়িতে ঢুকে কিছু হাতের কাজ করে ফেলে। মাঝে মাঝেই চার্লি ধরা পড়ে; তখন কিছুদিনের জন্যে জেলে গিয়ে মুখ বদল করে আসে। সেই সময়টা আমার ভীষণ অসুবিধা হয়।

আগেই বলেছি, চার্লির আসা-যাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই। আর সে আমার মতো সিঁড়ি বেয়েও আসে না। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, আমার এই ঘরের ডানদিকের জানালার দুটো শিক আলগা। ও দুটোর ওই অবস্থা চালিই করে রেখেছে। ওই জানালাটার ধার ঘেঁসে একটা ঢ্যাঙা চেহারার নারকেল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। চার্লি যখনই আসুক, নারকেল গাছ বেয়ে আলগা শিক দুটো খুলে ভেতরে ঢোকে। তারপর শিক দুটো আবার জায়গা মতো বসিয়ে দেয়। যায়ও সে ওইভাবেই। কাজেই, ছাদের দিক থেকে তালা লাগানো থাকলেও তার যাতায়াতের কোনও অসুবিধা ঘটে না। কিন্তু চার্লি কথাও এখন না।

থিয়েটার রোডে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা এক কাপ চা-ও খেতে বলেননি। অবশ্য ওঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনও রেস্তোরাঁ কি খাবারের দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু মনোবীণা সান্যাল যে কাজের দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়েছিলেন সেটা আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে খাওয়ার কথা মনে পড়েনি। এখন টের পাচ্ছি প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে।

কিচেন-কাম-ডাইনিং রুমে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না। বেড রুমে ফিরে দ্রুত একটা তোয়ালে কাঁধে চাপিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

দশ মিনিটের ভেতর হাত-মুখ ধোয়া এবং খাওয়ার পালা চুকিয়ে লাইট-টাইট নিভিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম।

ঘরের ভেতর অন্ধকার। কিন্তু খোলা জানালা দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত কলকাতার স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। আর চোখে পড়ছে নীচে রাস্তাঘাট, কর্পোরেশনের আলো। ট্রাম বাস এবং অন্যান্য গাড়ি চলার শব্দ ভেসে আসছে। সারাদিন আমার নানারকম ঝঞ্ঝাটের ভেতর দিয়ে কাটে। রাত্রে ফিরে এসে শোওয়ামাত্র আমার চোখ বুজে যায়। কিন্তু একেকদিন কী যে হয়, কিছুতেই ঘুমোতে পারি না আজ আমার ঘুম এল না।

ঘুম না এলে কেন না জানে, আমার ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের এই লাইফ, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে হুড়মুড় করে আমার চোখের সামনে এসে হাজির হয়। উজান টানে ভাসতে ভাসতে তখন আমি পিছন দিকে ফিরে যাই।

.

হে মহান জনগণ, আমার বাবা ভরতচন্দ্র সরকারকে দিয়েই শুরু করা যাক। বাবা ইংরেজ আমলে কোনওরকমে আপার প্রাইমারিটা পাশ করে মার্চেন্ট ফার্মে সাতাশ টাকার একটা লেজার-কিপারের চাকরি জোটাতে পেরেছিল। তখন টাকার দাম ছিল; সাতাশ টাকায় চলে যেত। সেই চাকরির ওপর ভরসা করে দুম করে একটা বিয়ে করে ফেলেছিল বাবা। তারপর? তখন তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছিল না, দো আউর তিন বাচ্চের স্লোগানও ওঠেনি। জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি–এই প্রোভাবখানা চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে পটাপট পাঁচটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে বসল।

এদিকে ওয়ার্ল্ডের হালচাল বদলে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার এসে গেল। ইনফ্লেসনের বাজারে হু-হুঁ করে চাল ডাল জামা কাপড়ের দর চড়তে লাগল। বাবার মাইনেও কিছু কিছু বাড়ল। কিন্তু দুই বাড়ার মাঝখানে অনেকখনি ফারাক। দুটো এজ মেলাতে বাবার নাক দিয়ে ফেনা উঠে যেতে লাগল।

তারপর ওয়ার্ল্ড ওয়ার থামল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম সেই যে চড়তে শুরু করেছিল, সেটা ক্রমাগত আকাশের দিকে উঠতেই লাগল, উঠতেই লাগল। এদিকে দেশ স্বাধীন হল, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পাকস্থলীর মাপও দিনকে দিন বাড়তে লাগল। লেট ভরতচন্দ্র সরকারের অবস্থাখানা বুঝে দেখুন। প্রকৃতির নিয়মে কিছুই নাকি ফাঁকা থাকার কথা না; সুতরাং আমাদের পাকস্থলিগুলো আর শূন্য থাকে কী করে? সেগুলো ভরাট করতে বাবার কণ্ঠার হাড় গজালের মতো ঠেলে বেরিয়ে পড়ল; বুকের মাপ ছইঞ্চি ছোট হয়ে গেল আর কঁচা চুলগুলো কবছরে পেকে সাদা ধবধবে হয়ে গেল।

তবু একটা কথা বলব, বাবার ওই রকম স্ট্রাগলের মধ্যেও একটু উচ্চাশা ছিল। সেটা তার ছেলেমেয়েদের ঘিরে। বাবা হয়তো ভেবেছিল নিজের জীবনটা কষ্টে-টষ্টে কাটল; ছেলেমেয়েগুলো যেন ভালো থাকে। তাই লোকটা করেছিল কী, নিজে অফিসে টিফিন না খেয়ে ট্রামে-বাসে না চড়ে সেই পয়সা বাঁচিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে মানুষ করে তুলতে চেয়েছে।

কিন্তু বিশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনও তো বিগড়ে যায়; এ তো মানুষের শরীর। ফলতঃ যা হবার তাই হল। টার্গেটে পৌঁছুবার ঢের আগেই বাবা মুখ থুবড়ে পড়ল। সেই যে পড়ল আর উঠল না।

ভরতচন্দ্র সরকার তো নামের আগে একখানা চন্দ্রবিন্দু যোগ করে বেঁচে গেল। কিন্তু আমরা? আমি তখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে পড়ি। আমার পর দুবছর বাদে একটা করে ভাই অথবা বোন। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। আমি ছাড়া বাদবাকিরা পড়াশোনা করছে।

মৃত্যুর আগে বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকাপয়সা তুলে একটা বোনের বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পর, যেহেতু আমি বড়, বাকি তিন ভাই-বোন এবং বিধবা মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ল আমার কাঁধে। অথচ একটি পয়সা রেখে যায়নি বাবা।

অতএব প্রথম ধাক্কাতেই আমাদের পড়াশোনা গেল বন্ধ হয়ে। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি। টিগ্রিগুলো পকেটে পুরে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ আর ডালহৌসিতে যত আফিস-টাফিস আছে সব জায়গায় ঢু মারতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও একটা দরজা খুলল না। যেখানেই যাই সেখানেই এক রেকর্ড বেজে যায়–নো ভ্যাকান্সি।

দেখতে দেখতে দু-তিনটে বছর কেটে গেল। এর মধ্যে ডিগ্রি-টিগ্রিগুলো পকেটে ঘুরে ঘুরে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে গেছে; আমার গাল বসে গেছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে।

হে মহান জনগণ, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন লোয়ার মিডিল ক্লাসের একেবারে নীচের স্তরের মানুষ আমরা। যার বাবা সামান্য একজন লেজার কিপার ছিল, যার কোনও জোরালো রকমের মামা বা মেসো নেই তার পক্ষে চাকরি জোটানো অসম্ভব। আমারও চাকরি-টাকরি হল না।

এর ফলে আরো অনেক ফ্যামিলিতে যা-যা ঘটেছে আমাদের বেলাতেও তাই তাই ঘটল। হে মহান জনগণ, আপনারা জানেনই কী ঘটতে পারে। তাই অংশটা খুব সংক্ষেপেই সেরে ফেলা যাক। আমার একটা বোন চাকরির খোঁজে রোজ দুপুরে বেরিয়ে যেত; ফিরত মাঝরাতে। ও কোথায় যায় আন্দাজ করলেও আমার মুখ বুজে থাকতাম। তারপর বলা নেই কওনা নেই, দুম করে মেয়েটা একদিন আত্মহত্যা করে বসল। আর তখনই জানা গেল, সে তিন মাসের প্রেগনান্ট ছিল। কী বোকা মেয়ে! আজকাল কত ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট বেরিয়েছে, তার কোনও খোঁজই রাখত না! হে মহান জনগণ, এই কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে ও সংসার বাঁচাবার জন্যে ঘরের বাইরে পা দিয়েছিল! যাকগে, আমার আরেকটা বোন একদিন একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। আর ছোট ভাইটা স্মাগলার না ওয়াগন-ব্রেকার কাদের দলে যেন ভিড়ে বাড়ি ছাড়ল। লস্ট জেনারেসন বলে একটা কথা আছে না, ও তাদেরই একজন হয়ে গেল। বাকি রইলাম মা আর আমি। মা খুবই নরম ধাতের মানুষ। এই সময়ের পক্ষে একবারেই অচল। এখন বেঁচে থাকতে হলে নার্ভগুলোকে স্টিল দিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। কিন্তু মায়ের নার্ভ ছিল মোমের তৈরি; একটুতেই গলে গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এতগুলো পারিবারিক বিপর্যয় দেখে দেখে ভদ্রমহিলার মাথাটা একেবারে গোলমাল হয়ে গেল। কিছুদিন বাড়িতে রেখে ট্রিটমেন্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত মাকে মেন্টাল হসপিটালেই পাঠাতে হল।

হে মহান জনগণ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। চাকরি-বাকরি না পেলেও অনেকগুলো টিউশনি পেয়েছিলাম। সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত হোল ক্যালকাটা ঘুরে তাই করে যেতাম। কিন্তু মেন্টাল হসপিটালে মাসে দুশো করে টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে হাতে কিছুই প্রায় থাকত না। ফলে কর্পোরেশনের কলের বিশুদ্ধ জল খেয়ে বেশির ভাগ দিন আমার কেটে যেত।

এদিকে টিউশানি-ফুইশানিগুলো একেবারে মরসুমী ব্যাপার। পরীক্ষার সীজনে আঁক বেঁধে যেমন আসত, আবার চলে যেত। তখন আমি দারুণ ঝামেলায় পড়ে যেতাম। বাড়িভাড়া বাকি পড়ত, ঠিক সময়ে মেন্টাল হসপিটালে টাকা দিতে পারতাম না। মোটামুটি এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল।

একবার হল কী, পরীক্ষার শেষে একটাও টিউশানি নেই। কী করব, ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুম আসছিল না। মাথার ভেতর থেকে নাক-মুখ দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসছিল। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে কিছুক্ষণ ছাদে ঘুরেছিলাম। তারপর নিজের অজান্তে কখন যে সিঁড়ি টপকে নীচে নেমে এসেছি, কখন এন্টালির আঁকাবাঁকা সরু গলি পিছনে রেখে লোয়ার সার্কুলার রোডে চলে গেছি, তারপর হাঁটতে হাঁটতে ল্যান্সডাউন রোডে–নিজেরই খেয়াল নেই। তখন অনেক রাত। রাস্তায় লোকজন চোখে পড়ছিল না। তবে দু-চারটে পুলিশ আর রাত-জাগা টলটলায়মান মাতালকে এখানে-ওখানে দেখা যাচ্ছিল। আর মাঝে মধ্যে ফাঁকা রাস্তায় ঝড় তুলে দু-একটা ট্যাক্সি কি প্রাইভেট কার উধাও হয়ে যাচ্ছিল।

ল্যান্সডাউন রোডের ফুটপাথ ধরে দূরমনস্কর মতো হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা অন্ধকার মোড়ের মাথায় আসতে চোখে পড়ল দশ-বারো বছরের একটা ছেলে দেয়ালে একটা পোস্টার মারছে।

পোস্টার-টোস্টারগুলো রাজনীতিক দলের ওয়ার্কাররাই বেশির ভাগ সময় মেরে থাকে। আর মারে সিনেমা-থিয়েটারওয়ালা কিংবা ছোটখাটো কোম্পানির লোকেরা। এতটুকু একটা বাচ্চাকে পোস্টার মারতে আগে আর দেখিনি। তা ছাড়া তার যা বয়েস, চেহারা এবং ময়লা ছেঁড়া খোঁড়া জামা-প্যান্ট–তাতে তাকে ভিখিরিদের ছেলে বলে সনাক্ত করা যায়।

কী পোস্টার মারছে ছেলেটা? কৌতূহলের বসে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম, সাদা কাগজের ওপর লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে : কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর ষাট বছরের পদার্পণ। এই উপলক্ষে বারো নম্বর গোলোক চাটুজ্যে রোডে জাতির পক্ষ থেকে এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দলে দলে যোগদান করুন।

বাংলা সাহিত্যের একটু-আধটু খবর আমি রাখি। বি-এ পর্যন্ত বাংলা ছিল আমার একটা সাবজেক্ট। তা ছাড়া গল্প-উপন্যাস কবিতা-টবিতা পড়ার ঝোঁক আছে। নিয়মিত একটা সাপ্তাহিক আরেকটা মাসিক আমি কিনে থাকি। কিন্তু সাতকড়ি পুততুণ্ড নামে কোনও কবির নাম আগে শুনেছি বলে মনে হয় না। ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম, এটা তোকে কে লাগাতে বলেছে?

খানিকটা দূরে একটা মোটর দেখিয়ে ছেলেটা বলল, একজন মোটা বাবু; ওই গাড়িতে বসে আছে। একটু থেমে আবার বলল, আমি রাস্তায় শুয়ে ছিলাম, বাবু আমাকে তুলে বলল, এ রকম দশটা কাগজ দেয়ালে সাঁটতে পারলে একটা টাকা দেবে। বলেই আবার পোস্টারটা লাগাতে শুরু করল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিন্তু ছোট ছোট হাতে অত বড় একটা কাগজ ঠিক সামলাতে পারছিল না ছেলেটা। বললাম, দে, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।

ছেলেটা সন্দিগ্ধ ভাবে তাকাল, তুমি আমার টাকাটা নিয়ে নেবে না তো?

আরে না। তোর টাকা তুই পাবি। পারছিস না তো, তাই লাগিয়ে দিচ্ছি।

ছেলেটা এবার তার হাতের পোস্টারটা আমাকে দিল। আমি সেটা চমৎকার করে দেয়ালে সেঁটে দিলাম।

ছেলেটা বলল, একটা যখন লাগিয়ে দিয়েছ, এগুলোও লাগিয়ে দাও

দেখলাম আরো নটা পোস্টার রয়েছে, এবং সবগুলোতে একই কথা লেখা আছে। খানিকটা দূরে দূরে ভালো জায়গা দেখে পোস্টারগুলো মেরে দিলাম। সেই সঙ্গে মোটরটার ওপর লক্ষ্যও রেখেছিলাম; সেটা নিঃশব্দে অনুসরণ করছিল।

সুচারুরূপে পোস্টার লাগানোর কাজটি শেষ হয়ে যাবার পর ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছিল, মোটরের দরজা খুলে গোলগাল থসথসে চেহারার একটা লোক বেরিয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম।

লোকটা আমার কাছাকাছি সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, ধন্যবাদ।

দশ ফুট হাঁটলেই যে লোক হাঁপিয়ে যায় তার ফুসফুসের জোর যে খুব বেশি নয়, বুঝতে পারছিলাম। যাই হোক, জিগ্যেস করেছিলাম, ধন্যবাদ কেন?

আমরা পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত দ্রুত এক পলক দেখে নিয়ে তুমি কি আপনি বলবে, খুব সম্ভব কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়েছে লোকটা। তারপর বলেছে, এই যে তুমি পোস্টারগুলো মেরে দিলে সেই জন্যে।

ধন্যবাদের দরকার নেই। আপনি এই টাকাটা দিয়ে দিন। আমি সেই ছেলেটাকে দেখিয়ে বলেছিলাম।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই-পকেট হাতড়ে এটা মোটা পার্স বার করেছিল লোকটা; তার থেকে একটি টাকা বার করে ছেলেটাকে দিয়েছিল।

টাকা পেয়েই চলে গিয়েছিল ছেলেটা। আমারও আর দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। তবু আচমকা প্রশ্ন করে বসেছিলাম, কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড কে?

আমি। কেন?

সেটাই আন্দাজ করেছিলাম। বলেছি, কিছু মন করবেন না, একটা কথা জিগ্যেস করব?

সাতকড়ি পুততুণ্ড বলেছে, অবশ্যই।

এভাবে পোস্টার লাগাচ্ছিলেন কেন?

সাতকড়ি পুততুণ্ড এর উত্তরে যা বলেছিল, তাতে আমার চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে। চল্লিশ বছর বয়স থেকেই সে নিজের জন্মদিন করে আসছে কিন্তু স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে এবং চাকর-বাকর ছাড়া কেউ নাকি সে উৎসবে ঘেঁষে না। তাই এবার পলিটিক্যাল মিটিং-এর পোস্টারের মতো দেয়ালে দেয়ালে নিজের জন্মদিনের বিজ্ঞাপ্তি লাগিয়ে লোক জড়ো করতে চেয়েছে।

এমন এক্সপিরিয়েন্স আগে আর কখনও হয়নি। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমার কী যেন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিলাম, আপনি চান, জন্মদিনে প্রচুর লোকজন আসুক, হই-চই হোক, আপনাকে নিয়ে সবাই মাতামাতি করুক–এই তো?

ঠিক ধরেছ। দেখো, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার কিছু পয়সা-টয়সা হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে পোয়েট্রি লিখছি কিন্তু ফেমটা তেমন হল না। আমার খুব ইচ্ছে ফেম হোক।

কিন্তু এভাবে পোস্টার মেরে কিছু লাভ হবে কি?

তবে?

দুসেকেন্ড চিন্তা করে বলেছিলাম, আপনি যদি বিশ্বাস করে আমার ওপর দায়িত্ব দেন ফেমের ব্যাপারটা দেখতে পারি। আপনার জন্মদিনের উৎসবটাও অর্গানাইজ করতে পারি।

সাতকড়ি পুততুণ্ড মধ্যরাতের ফাঁকা রাস্তায় প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল, মনে হচ্ছে তুমি পারবে। কাল একবার আমাদের বাড়ি এসো না।

কালই?

হ্যাঁ হ্যাঁ, কালই। সাতকড়ি পুততুণ্ডর আর তর সইছিল না, এই নাও ঠিকানা। পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে আমাকে দিয়েছিল সে।

তখন আমি পুরোপুরি বেকার, কোনও কাজকর্ম নেই। কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করছিল। মনে আছে, পরের দিনই তার ভবানীপুরের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

পুরনো আমলের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি সাতকড়ি পুততুণ্ডর। শ্বেতপাথরের মেঝে, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, খড়খড়ির জানালা, রঙিন কাচের  শার্সি, ঘরে ঘরে বার্মা টিকের ভারী ভারী খাট-আলমারি ইত্যাদি। সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে বড় বড় দাঁড়ে কাকাতুয়া, ময়না নতুবা টিয়া পা দিলেই টের পাওয় যায় পয়সাওলা লোকের বাড়ি।

সাতকড়ি পুততুণ্ড আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। প্রথমে রুপোর থালায় ডজনখানেক বিরাট-বিরাট সাইজের সন্দেশ খাইয়ে নিজের লাইফ-হিস্ট্রিটা এক নিশ্বাসে মুখস্থ বলার মতো বলে গিয়েছিল। চার জেনারেসন ধরে তাদের বিলিতি মদের বিজনেস; লিসে স্ট্রিটে প্রকাণ্ড দোকান রয়েছে। সেখান থেকে বছরে কম করে তিন লাখ টাকা ইনকাম তবে মদটা ছোঁয় না সাতকড়ি পুততুণ্ড। তার একমাত্র নেশা কবিতা লেখা এবং এ-ব্যাপারে কিঞ্চিৎ নাম করা। কিন্তু নামটা কিছুতেই হয়ে উঠছে না। পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকে লিখছে সে; মোট ছহাজার কবিতা এর মধ্যে লিখে ফেলেছে। তবে তিরিশ পঁয়তিরিশটার বেশি এ পর্যন্ত ছাপা হয়নি। সবশুন্ধু তিনটি সন্তানের জনক সাতকড়ি পুততুণ্ড। দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি মদের দোকানে বসে। সুতরাং নির্বিঘ্নে কবিতার চাষ করে যেতে পারে সাতকড়ি পুততুণ্ড।

সংক্ষেপে অটোবায়োগ্রাফি শেষ করে সাতকড়ি পুততুণ্ড চাকরকে দিয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশখানা চামড়া বাঁধানো মোটা মোটা কবিতার খাতা এনে আমার সামনে ডাঁই করে রেখেছিল। খাতাগুলোর, কোনওটার গায়ে সোনার জলে লেখা রয়েছে কবিতার ফুলবাগান, কোনওটার গায়ে কাব্য কুসুম, সৌরভ ইত্যাদি। তার তলায় লেখা আছে–কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড।

পাতা উল্টে দু-একটা কবিতার নমুনা দেখতেই টের পাওয়া গিয়েছিল সম্পাদকার অন্ধ আর কালা না হলে এসব কোনওদিনই ছাপা হবে না। কিন্তু আমার পাকস্থলীতে তখন এক ডজন দামি সন্দেশ রয়েছে, তা ছাড়া জন্মদিন অর্গানাইজ করার দায়িত্ব নিয়েছি; সুতরাং মাথা ঝাঁকিয়ে কবিতাগুলোর তারিফ করেছি। সাতকড়ি পুততুণ্ড সেই বোধহয় প্রথম তার লেখার একজন সমঝদার পেয়েছিল। প্রায় হাতে চাঁদ পাবার মতো ব্যাপার। বিগলিত হেসে সে বলেছিল, তা হলে ভাই জন্মদিনের ব্যাপারে লেগে যাও। টাকা-পয়সা যা লাগে চেয়ে নেবে। মোটে লজ্জা করবে না।

সত্যি সত্যি কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর ষাট বছরের জন্মদিনটা দারুণভাবে অর্গানাইজ করেছিলাম। ডেকরেটরকে দিয়ে চমৎকার একখানা প্যাণ্ডেল বানিয়ে নাম করা নার্সারীর লোকদের দিয়ে পাতার ওপর সাদা ফুল গেঁথে লিখিয়ে নিয়েছিলাম কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর শুভ জন্মদিনে সবার নিমন্ত্রণ। সেই ফুলের লেখাটা প্যান্ডেলের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের এন্টালিতে যে-সব ক্লাব আছে তাদের খাবার-দাবারের লোভ দেখিয়ে লরি বোঝাই করে জন্মদিনের সভায় নিয়ে এসেছিলাম। উঁচু একটা ডায়াসের ওপর নতুন ধুতি আর নতুন গরদের পাঞ্জাবি পরিয়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় জুইয়ের মালা দিয়ে সাতকড়ি পুততুণ্ডকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল সভার কাজ।

আমি যে কলেজে পড়তাম সেখানকার এক রিটায়ার্ড বাংলার প্রফেসারকে সভাপতি করে নিয়ে এসেছিলাম। ভদ্রলোক খুবই নিরীহ আর ভালোমানুষ। তাকে দিয়ে সাতকড়ি পুততুণ্ডর প্রতিভা সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক বক্তৃতা দিইয়ে ছিলাম। তাছাড়া সাতকড়ির কিছু কবিতার আবৃত্তি এবং কিছু কবিতায় সুর দিয়ে গানও গাওয়ানো হয়েছিল। ফোটোগ্রাফারকে দিয়ে সভার নানা অ্যাঙ্গেল থেকে অনেক ছবিও তুলিয়েছিলাম। পরের দিন প্রায়-অচল এক খবরের কাগজের অ্যাসিস্টান্ট নিউজ-এডিটরের হাতে-পায়ে ধরে সভার বিবরণ আর সাতকড়ি পুততুণ্ডর একখানা ছবি ছেপে দিয়েছিলাম।

এই জন্মদিনের ব্যাপারে প্রচুর খরচ করেছিল সাতকড়ি পুততুণ্ড। কোনও কারণে একশো টাকা চাইলে লোকটা তিনশো বার করে দিয়েছে। হে মহান জনগণ, অকপটে স্বীকার করছি, এই জন্মদিনের ব্যাপারে নিট পাঁচশোটি টাকা আমার লাভ হয়েছিল।

যাই হোক, ওই দিনটার পর সাতকড়ি পুততুণ্ড আমাকে আর ছাড়ে না। তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল ইচ্ছা করলে আমি তাকে নোবেল প্রাইজও পাইয়ে দিতে পারি। সে যেমন আমাকে ছাড়েনি, আমিও চিটেগুড়ের গায়ে মাছির মতো তার গায়ে আটকে ছিলাম। প্রায়ই সাতকড়ি পুততুণ্ডর বাড়িতে কাব্য পাঠের আসর বসাতাম, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের ধরে মাঝে-মধ্যে তার দু-একটা কবিতা ছাপিয়ে দিতাম। অবশ্য নানা খরচের নাম করে সাতকড়ির কাছ থেকে টাকা বার করে টু পাইস নিজের পকেটে পুরে ফেলতাম।

এই ভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন সাতকড়ি পুততুণ্ড দারুণ আবেগের গলায় বলেছিল, তুমি আমার জন্যে এত করছ, কই কখনও তো কিছু চাও না

মনে মনে এই দিনটার জন্যে যেন অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম, সাতকড়ি পুততুণ্ডের মুখ থেকে একদিন এই রকম একটা কথা বেরুবেই। কিন্তু আমি কোনও আগ্রহ দেখালাম না। অত্যন্ত নিরাসক্তভাবে বললাম, কী চাইব।

তোমার যা ইচ্ছা।

সাতকড়ি পুততুণ্ডকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয়েছিল কিছু কিছু পয়সাওলা লোকের মধ্যে দু-একটা উইক স্পট মানে দুর্বল জায়গা থাকে। এদের কেউ চায় দারুণ নাম করতে, কেউ চায় প্রতিষ্ঠা, কেউ রাজনীতিক ক্ষমতা। এই উইকনেসগুলো কাজে লাগাতে পারলে কাজ গুছিয়ে নেওয়া যায়।

মনে মনে ভেবেও রেখেছি, আমার তো চাকরি-বাকরি হবে না, সার্ভিসের বয়স পারও হয়ে যাচ্ছে, যদি কিছু ক্যাপিটাল পাই বড়লোকদের দুর্বলতার ওপর বড় আকারে কাল্টিভেসন চালিয়ে যাব। এই ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডিস্ট্রিক্টে কম করে এক কোটি লোক থাকে। তার ফাইভ পারসেন্ট যদি বড়লোক হয় তাহলে অঙ্কটা দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষে। পাঁচ লক্ষের শতকরা বিশজনেরও যদি নানারকম দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে এক লক্ষ লোককে আলাদা করে নেওয়া যায়। আর এই লাখ লোকের টেন পারসেন্টকেও যদি ফঁদে ফেলতে পারি আমার লাইফ কেটে যাবে। আমি প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলাম, মানুষের দুর্বলতাগুলো নিয়ে একটা লার্জ স্কেল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলব। কিন্তু ক্যাপিট্যালটা পাওয়া যাচ্ছিল না। বললাম, আমার একটা বিজনেস স্টার্ট করার ইচ্ছে; কিন্তু টাকার জন্যে ওটা আটকে আছে।

কত টাকা হলে তোমার চলবে?

হাজার দশেক।

আমি এতটা আশা করিনি, কিন্তু পরের দিনই পুরো দশ হাজার টাকাই আমাকে দিয়েছিল সাতকড়ি পুততুণ্ড। এবং খুবই আশ্চর্যের ঘটনা, টাকাটা দেবার দুদিন বাদে চার ঘণ্টায় দু-দুবার করোনারি অ্যাটাক হয়ে লোকটা মারা গেল।

সাতকড়ি পুততুণ্ড মারা যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলাম। লোকটার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। কেননা সে-ই আমাকে মানুষের দুর্বলতার সন্ধান দিয়েছিল।

যাই হোক, সাতকড়ি পুততুণ্ডর সেই দশ হাজার টাকায় থিয়েটার রোডে প্রথমে একখানা ঘর নিয়ে বিজনেস স্টার্ট করেছিলাম। তারপর দ্রুত এক্সপ্যানসন করতে হয়েছে। এখন একটার জায়গায় চারখানা ঘর নিয়ে আমাদের অফিস। এক্সপ্যানসানের জন্যে লোকজনও নিতে হয়েছে। কলকাতা শহরে অফিস খুললেই চাকরির জন্যে ছেলেমেয়েরা কিউ লাগায়। গ্র্যাজুয়েট হলেই হল, আমার অফিসে কিছু কাজ তার জন্যে বরাদ্দ। তবে সারা বছরের জন্যে হয়তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে পারি না। পালা করে বছরে একমাস, দু-মাস কি ম্যাক্সিমাম তিন মাসের জন্যে ওদের কাজ দিয়ে থাকি। তিন মাস পর আবার নতুন ছেলে কি মেয়ে আসে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একটা চমৎকার বোঝাপড়া আছে। চাকরি-বাকরির যা বাজার তাতে এই রকম ভাগাভাগি করে না নিলে কী করে চলবে। মোদ্দা কথা হল, আমরা মোটামুটি ভালোই আছি, সুখেই আছি। আমাদের পরিবার সুখী পরিবার। আওয়ার্স ইজ এ হ্যাপি ফ্যামিলি।

হে মহান জনগণ, মানুষের দুর্বলতা নিয়েই আমাদের কাজ-কারবার। এই বিজনেসটা শুরু করার আগে ধারণা ছিল না, মানুষের কত রকমের উইকনেস থাকতে পারে। মনুষ্যজাতির দুর্বলতার ওপর ফসল ফলাতে গিয়ে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আরো নতুন নতুন রাস্তা খুলে গেছে। এখন রোজই দেখি, শুধু দুর্বলতা নয়–মানুষের নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত হবি আর সাধ আছে, আছে অদ্ভুত ধরনের সব ক্ষ্যাপামি আর মানসিক বিকার। এগুলো আছে বলেই আমরা মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছি।

রোজই দেখি নানারকমের লোকজন আশে। এক কালের নামকরা কোনও অভিনেতা বা নৃত্যশিল্পী এখন তাকে লোকে ভুলে গেছে–এসে হয়তো বলেন তার জন্যে সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্যে যত টাকা দরকার তিনি দেবেন। মোট কথা, সময় তাঁকে অচল পয়সার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তিনি পিপলের চোখের সামনে থাকতে চান। কোনও পয়সাওলা বাপ এসে ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখবার জন্যে আমাদের সাহায্য চায়। কোনও ভাগ্নে আসে আমাদের দিয়ে তার মালদার শাঁসালো মামাকে ব্ল্যাকমেল করতে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজনেস স্টার্ট করার পর প্রথম কিছুদিন ক্লায়েন্টদের মনোরঞ্জনের জন্যে আমরা কিছু কিছু কাজ করেছি। তবে এখন কিছুই করি না। আজকাল শুধু অ্যাডভান্সের টাকা নিই। অনেকের কাছ থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতে এসে গেলে কোম্পানির লালবাতি জ্বালিয়ে আবার নতুন কোম্পানি ফেঁদে বসি।

হে মহান জনগণ, আমার সব কথাই বলেছি। শুধু লতিকার প্রসঙ্গ ছাড়া।

লতিকা যদিও আমার চাইতে বছর দুয়েকের ঘোট, একসঙ্গে এম-এ পড়তাম। তারপর আমার বাবা ভরতচন্দ্র সরকার টুক করে মারা গেলে আমাকে ইউনিভার্সিটি ছাড়তে হয়েছিল। তারপর বেশ কয়েক বছর লতিকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় লতিকার সঙ্গে তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা আমার হয়নি। তবে এক ধরনের বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে অন্য বন্ধুতের মতো লতিকার সঙ্গেও কফি হাউসে আড্ডা-টাড্ডা দিতাম। মাঝে মধ্যে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যখন কঁক বেঁধে সিনেমা দেখতে যেতাম সেই দলে লতিকাও থাকত। ব্যস, ওই পর্যন্ত। অনেক কাল বাদে দারুণ নাটকীয়ভাবে আবার লতিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।

মনে আছে থিয়েটার রোডে আমার বিজনেস স্টার্ট করার তিন-চার বছর পর একদিন সন্ধেবেলা এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে লেকের দক্ষিণের নতুন স্যাটেলিট টাউনশিপ লেক গার্ডেনসে গিয়েছিলাম। কথাবার্তা সেরে অনেক রাত্রে রেললাইন পেরিয়ে লেকের দিকে আসতে আসতে হঠাৎ চোখে পড়েছিল অনেক দুরে-সেই গড়িয়াহাটা ওভারব্রিজের তলা থেকে বজবজ লাইনের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দুর্দান্ত স্পিডে ছুটে আসছে। গাড়িটার সামনের দিকে যে হেডলাইট জুলছিল তার আলোয় দেখতে পেয়েছিলাম, একটি মেয়ে রেললাইন ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো ট্রেনটার দিকে ছুটছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটার উদ্দেশ্য কী। সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে আগুনের হলকা বইতে শুরু করেছিল। কী করব, ভাবতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন পেরেক ঠুকে আমার পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে।

ওদিকে ট্রেনটা ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে; মেয়েটাও উল্টোদিক থেকে ছুটে যাচ্ছে। দু-চার মিনিটের মধ্যে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যাবে।

আচমকা আমার শরীরে কোত্থেকে যেন দশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনের মতো শক্তি নেমে এসেছিল। মাটি থেকে পা দুটো টেনে তুলে শ্বাসরুদ্ধের মতো সামনের দিকে ছুটেছিলাম। তারপর ট্রেনটা যখন মাত্র পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে সেই সময় মেয়েটাকে পিছন দিক থেকে জাপ্টে ধরে টানতে টানতে রেললাইনের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা আমাদে গা ঘেঁষে ক্ষ্যাপা জানোনায়ারের মতো গাঁক গাঁক করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

ট্রেনটা চলে যাবার পর মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চাবুকের মতো তীব্র গলায় সে বলেছিল, কেন, কেন আপনি আমাকে বাঁচালেন?

আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই মেয়েটার মুখ চোখে পড়ে গিয়েছিল। কেননা রেললাইনের ধারে ধারে যে রিফিউজি কলোনি গজিয়ে উঠেছে সেখান থেকে আলো এসে পড়েছিল তার ওপর। যাই হোক দেখা মাত্র চমকে উঠেছিলাম। বলেছিলাম, এ কী লতিকা-তুমি!

লতিকাও ততক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছে। সেও খানিকটা অবাক। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুহাতে মুখ ঢেকেছিল লতিকা। এবার খুব ক্লান্ত স্বরে বলেছিল, আমাকে না বাঁচালেই পারতে।

একটু মজা করে বলেছিলাম, তোমার শরীরটা হল ন্যাশনাল প্রপার্টি; এটাকে ধ্বংস করার কোনও রাইট নেই তোমার। একজন অনেস্ট নাগরিক হিসেবে তোমাকে বাঁচাতে আমি বাধ্য হয়েছি।

লতিকা কী বলতে যাচ্ছিল; তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, এখানে দাঁড়িয়ে কোনও কথা নয়। চলো, কোথাও গিয়ে একটু বসি।

তাকে নিয়ে রেললাইন পেরিয়ে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে চলে এসেছিলাম। তারপর বিশাল রাস্তার মাঝখানে যে সারি সারি সবুজ ঘাসের আইল্যান্ড রয়েছে তার একটাতে দুজনে পাশাপাশি বসেছিলাম। লতিকার বসবার ভঙ্গিটা অত্যন্ত ক্লান্ত, ভেঙেপড়া। রেললাইন ধরে ট্রেনের দিকে ছুটবার সময় তার মধ্যে যে ক্ষ্যাপা উদ্ভ্রান্ত মরিয়া ভাবটা কাজ করছিল, তখন আর তা নেই। হাত-পায়ের জোড় তখন আলগা হয়ে গিয়েছিল; দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে ভাঙাচোরা কোনও মূর্তির মতো সে বসে ছিল।

অত রাতে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে তেমন লোকজন ছিল না। যা দু-চারজন ছিল, চোখ কুঁচকে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছিল। কেউ কেউ যাবার সময় দু-একটা রগরগে টিপ্পনিও ছুঁড়ে দিচ্ছিল। ওদের আর দোষ কী, মাঝরাতে লেকের কাছে এক জোড়া যুবক-যুবতাঁকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখলে গলা খুসখুস তো করবেই, গ্ল্যান্ডগুলোও অশ্লীল হয়ে উঠবে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বলেছিলাম, এবার বলো, আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে কেন?

লতিকা নিজবি গলায় বলেছিল, আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তুমি তো দারুণ ঝকঝকে মেয়ে ছিলে। হঠাৎ এত পেসিমিস্ট হয়ে উঠলে কেন?

তুমি আমার ফ্যামিলির কথা কিছুই জানে না রাজীব। জানলে বুঝতে কেন পেসিমিস্ট হয়েছি, কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।

আমি শব্দ করে বেশ জোরেই হেসে উঠেছিলাম।

চমকে হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলছেল লতিকা, কী হল, হাসছ যে!

বলেছিলাম, তোমার ফ্যামিলির কথা না জেনেও বুঝতে পারছি তোমার দুঃখ। কিন্তু আমার ফ্যামিলির কথা যদি জানতে তাহলে বলতে, আমার একবার না, বারদশেক আত্মহত্যা করা উচিত। কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারটা ভাবতেই পারি না। তোকা হেসে হেসেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। একটু থেমে আবার বলেছিলাম, আচ্ছা বলো, তোমার ফ্যামিলির কথা শুনি–

লতিকা যা বলেছিল, সংক্ষেপে এই রকম–টালিগঞ্জের এক ভাড়া বাড়ির একতলার দুটো ঘর নিয়ে ওরা থাকত (এখনও থাকে)। মা-বাবা আর চার ভাইবোন নিয়ে ওদের মাঝারি মাপের সংসার। বাবা যোশেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস একসময় ভালোই চাকরি-বাকরি করত। কিন্তু লোকটার ক্যারেক্টার বলতে কোনও ব্যাপারই নেই। জুয়াড়ি, মাতাল এবং প্রথম শ্রেণির ফেরেব্বাজ সে। ওয়ার্ল্ডে যত রকম জুয়ো আছে–রেস, রামি, সাট্টা, মাটিকা–কোনও কিছুতেই তার অরুচি নেই। এছাড়া মেয়েমানুষের দোষও ছিল। এত বিভিন্ন দিকে নিজের প্রতিভাকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ঠিক সময় অফিসে হাজিরা দিতে পারত না লোকটা, ফলে তার চাকরি যায়। একটা চাকরি যাবার পর অবশ্য আবার নতুন চাকরি সে জুটিয়ে নেয়। কিন্তু দু-চার মাসের মধ্যে সেটাও থাকে না। এইভাবে যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস প্রায় ডজন দেড়েক অফিসের অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে অটোগ্রাফ রেখে গেছে। দশ-পনেরো দিন কামাই করার পরও অফিস থেকে সে যা মাইনে পেত সেটা আর বাড়িতে আসত না। রেসের মাঠে, মদের দোকানে কিংবা জুয়োর আড্ডায় সেটা জমা দিয়ে আসতে হত। যাই হোক, এই করে করে, অর্থাৎ অফিসে না গিয়ে গিয়ে শেষ চাকরিটাও সে খুইয়েছিল।

হেড অফ দি ফ্যামিলি যদি এই হয়, সংসারের হাল কী দাঁড়াতে পারে সহজেই আন্দাজ করা যায়। লতিকার মা লোকের বাড়ি থেকে অর্ডার-টর্ডার এনে জামা-প্যান্ট সেলাই করে সংসারটাকে জোড়াতালি দিয়ে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কি সংসার বাঁচে। রোজ দুবেলা খাওয়াই জুটত না। লতিকার ঠিক পরের ভাইটার ছিল ক্যান্সার। ডাক্তাররা তার সম্পর্কে সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের ধারণা, ম্যাক্সিমাম আর এক বছর সে বাঁচবে।

যার ফ্যামিলির রেখাচিত্র এই, সেই যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস কিন্তু পরম নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিল। স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের দিকে সে ফিরেও তাকাত না। বরং নেশা আর জুয়োর পয়সায় টান পড়লে লতিকার মাকে মেরে ধরে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে যেত। এ নিয়ে সংসারে খিটিমিটি লেগেই থাকত।

তবু এরই মধ্যে দুবেলা দুটো টিউশানি করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে লতিকা। তার আশা ছিল ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা নিয়ে বেরোতে পারলে একটা কিছু হয়ে যাবে। শ চারেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে এক আঁকে এম-এ-টা পাশ করে বেরিয়েও ছিল সে। একে বাংলায় এম-এ তার ওপর খুব নীচের দিকের একটা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল। এতে চাকরি হয় না। বছর তিনেক নানা স্কুল, সরকারি আর মার্চেন্ট অফিসে ঘোরাঘুরির পর সেই আত্মহত্যার দিন দুপুরে ক্যামাক স্ট্রিটের এক প্রাইভেট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কনসানে গিয়ে সোজা ডিরেক্টরের চেম্বারে ঢুকে পড়েছিল।

ডিরেক্টর মিস্টার সোনি–পঞ্চান্নর মতো বয়স, টকটকে গায়ের রঙ, চওড়া হাড়ের ফ্রেমে মজবুত শরীর, কাঁচা পাকা চুল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, বেশ সুপুরুষই বলা যায় তাকে-সহানুভূতির সঙ্গে লতিকার সব কথা শুনেছেন, সুন্দর সহৃদয় ব্যবহার করেছেন, কফি খাইয়েছেন, বলেছেন চাকরি নিশ্চয়ই দেবেন এবং সেটা তখনই।

কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গিয়েছিল লতিকার। রুক্ষ কর্কশ ওয়ার্ল্ডে সেই প্রথম একজন হৃদয়বান মানুষের দেখা পেয়েছিল সে। কিন্তু কী ধরনের কাজ তাকে করতে হবে, জানতে গিয়েই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছিল।

মিস্টার সোনি জানিয়েছিলেন, কাজটা তেমন কিছু নয়। তিনি বিপত্নীক এবং একেবারেই নিঃসঙ্গ। ছেলেমেয়েরা বিয়ে-টিয়ে করে এবং কাজের সূত্রে দূরে দূরে থাকে। এদিকে অফিসের কাজটুকু বাদ দিলে বাকি সময়টা তিনি বড় একা হয়ে যান। এই সময়টার জন্যে তার একজন সঙ্গিনী দরকার। স্নিগ্ধ, মধুর, সফট টাইপের একটি মেয়ে চাই-ঠিক যেমনটি লতিকা। মিস বিশ্বাস যেন ঈশ্বর-প্রেরিত হয়েই তার কাছে এসেছে।

মিস্টার সোনি আরও বলেছিলেন, কাজটা হোল-টাইমের। লাউডন স্ট্রিটে তাঁর তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের প্রকাণ্ড ফ্ল্যাট আছে। লতিকাকে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে ভাই-বোন মা-বাবাকে সে দেখে আসতে পারে। তা ছাড়া বছরে দু-তিনবার মিস্টার সানিকে ইওরোপ-আমেরিকা যেতে হয়, লতিকাকেও তখন তার সঙ্গে যেতে হবে।

লতিকা বুঝতে পারছিল, এই মধ্যবয়সি নোকটা মহানুভবতার মুখোস এঁটে তাকে তার মিস্ট্রেস হয়ে থাকতে বলছে। ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা হাতে নিয়ে আসার পরও কেউ যে এমন একটা চাকরির কথা বলতে পারে–এটা ভাবতে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল লতিকার; মাথার ভেতর কোথায় যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল, গলগল করে ঘামতে শুরু করেছিল সে। একটা কথাও আর না বলে মিস্টার সোনির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল লতিকা। তারপর অন্ধের মতো রাস্তায় নেমে একটা বাস ধরে বাড়ি ফিরেছিল। ফিরেই দ্যাখে ক্যান্সারের রুগী ভাইটার অবস্থা খুব খারাপ; অসহ্য যন্ত্রণায় তার শরীর বেঁকে যাচ্ছে। মা এবং অন্য ভাইবোনরা তাকে ঘিরে বসে সমানে কাঁদছে।

দুপুরে যখন লতিকা ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অফিসে চাকরির খোঁজে যায় তখন ভাইটার অবস্থা এ রকম ছিল না। যাই হোক, যন্ত্রণা বাড়লে ওকে পেইনকিলার ট্যাবলেট দেওয়া হয়। তাড়াতাড়ি একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল লতিকা; কিন্তু কষ্ট কমেনি। তখন পর পর আরো দুটো ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল লতিকা। কিন্তু তাতেও যখন কিছু হল না তখন তার বুকের ভিতরকার শিরা-টিরা মুচড়ে-টুচড়ে কী রকম যেন হয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক এই সময় বাবা যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস বাড়ি এসে ঢুকেছিল। সঙ্গে কালো গাবদা গাবদা রক্ষাকালীর মতো চেহারা এক মহিলা আর দুটো বাচ্চা। যোসেফ গঙ্গাপদ আনুষ্ঠানিকভাবে মহিলা এবং বাচ্চা দুটির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লতিকাকে বললেও, কথাটা সবারই উদ্দেশ্য। ওই মহিলাটি গঙ্গাপদর দ্বিতীয় স্ত্রী, অর্থাৎ লতিকার ছোট মা এবং ছেলে দুটো তার ভাই। এতদিন বেহালার ওদিকে ভাড়া বাড়িতে ওরা থাকত। এখন যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস সিদ্ধান্ত করেছে, ওদের আর দূরে থাকার মানে হয় না। সে বলেছিল, সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবি-বুঝলি লতু! তোর ফাস্ট মাদার, সেকেন্ড মাদার, আমি, তোরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে আমরা একটা হ্যাপি ফ্যামিলি; সুখী পরিবার।

বাবা যে লুকিয়ে লুকিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছে এবং সন্তান-সন্ততি উৎপাদন করে বসে আছে, এ খবরটা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। প্রসেসান করে দ্বিতীয় পক্ষের সংসারটিকে নিয়ে আসায় এই ব্যাপারটা আচমকা বাজ পড়ার মতো ঘটনা। বাবার কথা শেষ হতে না হতেই লতিকার আসল মা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আর তখন লতিকার মাথার ঠিক ছিল না; বাড়ি থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো সে বেরিয়ে পড়েছিল। সারাদিনে যা ঘটনা ঘটে গেছে সবগুলো মেন্টাল ব্যালান্স অর্থাৎ মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। অনেকক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে স্থির করে ফেলেছিল আত্মহত্যা করবে।

নিজের কথা শেষ করে লতিকা আমার দিকে তাকিয়েছিল। এবার তুমিই বলো–আমার আত্মহত্যার অধিকার আছে কিনা।

বলেছিলাম, তখনও বলেছি, এখনও বলছি-নেই। এখন বাড়ি চলো। অনেক রাত হয়ে গেছে।

না। তুমি চলে যাও।

আমি গেলে আরেকটা সুইসাইডের অ্যাটেম্পট নেবে বুঝি! কিন্তু ও প্রচেষ্টা তোমাকে চালাতে দেব না। শোনো লতিকা, লাইফের একটা সাইড তো দেখলে। এটুকুই কিন্তু শেষ নয়। বেঁচে থাকার অনেক মজা আছে, সেটা দেখবে না?

বেঁচে থাকার যে মজা আছে–সে কথা শুনেছি কিন্তু কখনও দেখিনি।

তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও; সেই মজাটা তোমার হাতে তুলে দেব। যদি না পারি, তোমার যা ইচ্ছে কোরো। চলো এখন, তোমাদের বাড়ি চলো।

একটা ট্যাক্সি ডেকে লতিকাকে তুলে নিয়েছিলাম। পাশাপাশি বসে যেতে যেতে থিয়েটার রোডে আমার অফিসের ঠিকানাটা দিয়ে বলেছিলাম, কাল নিশ্চয়ই আমার অফিসে আসবে।

পরের দিন আমার অফিসে লতিকা আসতেই প্রথমে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমার পিতৃদেব, দ্বিতীয় মাতৃদেবী এবং তস্য ছানাপোনাদের খবর কী?

লতিকা বলেছিল, মা অজ্ঞান হয়ে যাবার পর ওরা পালিয়ে গেছে।

ভেরি গুড। ওদের ভাগাবার একটা অস্ত্র হাতে পাওয়া গেল। মাকে বলবে ওরা এলেই যেন অজ্ঞান হয়ে যায়।

লতিকা হেসে ফেলেছিল।

আমি বলেছিলাম, এবার কাজের কথায় আসা যাক। তুমি আমার কনসার্নে জয়েন করো। মাসে আপাতত হাজারটাকা করে পাবে।

সেই থেকে লতিকা আমার বিজনেস পার্টনার। সুখে-দুঃখে এবং মজাসে আমরা দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। তবে একটু ঝামেলা দুজনেরই আছে। আমার মা মেন্টাল পেসেন্ট, আর লতিকার বাবা মাঝে মাঝেই এসে মেয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। লতিকা বাবার ওপর ক্ষেপে যায়, একটা মাতাল জুয়াড়িকে টাকা দিতে চায় না। আমি হেসে হেসে বোঝাই, আরে বাবা, আফটার অল লোকটা তোমার জন্মদাতা পিতা। জন্মটা যখন ওর জন্যেই হয়েছে এখন ওল্ড-এজ পেনসানটা দিয়ে যাও।

লতিকার আরেকটা সমস্যা অবশ্য মিটে গেছে। ওই ক্যান্সারের পেসেন্ট ভাইটা মারা গেছে। এর মধ্যে দুটো বোনের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে সে, মাকে আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলাইয়ের অর্ডার আনতে দেয় না। মোট কথা, এ লাইফে এই প্রথম একটু সুখ-সচ্ছলতার মুখ দেখতে পেয়েছে সে। এ জন্যে আমার কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। প্রায়ই বলে, তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমি কিছু বলি না, হাসি।

লতিকা আবার বলে, আর যে প্রফেসানে এনে ঢুকিয়েছ তাতে যে কত রকমের মানুষ, কত রকমের মজা!

এবার বলি, তাহলে লাইফের একটু আধটু মজা দেখতে পাচ্ছ!

শুধু কৃতজ্ঞতাই না, কিছুদিন ধরে আমার নার্ভে কিছু কিছু গোলমেলে ব্যাপার ধরা পড়েছে। অফিসে কাচের  দেয়ালের এধারে বসে থাকতে থাকতে আচমকা হয়তো চোখে পড়ে যায়, গভীর দৃষ্টিতে লতিকা আমাকে লক্ষ্য করছে। কখনও-সখনও আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কিংবা ময়দানের সবুজ ঘাসে গিয়ে বসি। তখন লতিকা আমার একটা হাত নিয়ে খেলা করতে থাকে। দুম করে কোনও কোনও দিন সে আমার এন্টালির বাড়িতে চলে আসে; কোমর বেঁধে রান্না করে ঘর গুছিয়ে দেয়; তারপর চলে যায়। একেকদিন গাঢ় গলায় সে বলে, আমার আর ভালো লাগে না।

আমি জিগ্যেস করি, কেন?

জানি না।

ব্যাপারটা বোধহয় সংক্রামক। আর আমিও একটা মানুষ। মানুষের সব প্রপার্টি যখন আমার আছে তখন লতিকা কাছে এলে, শুদ্ধ ভাষায় কী যেন বলে-হৃদয়ের শব্দ, হ্যাঁ তাই আমি শুনতে পাই। সে-ও কি আমার হৃদয়ের শব্দ শোনে? বুকের ভেতরকার এই শব্দটা তো ব্যান্ড পার্টির আওয়াজ নয়। কাজেই জোর করে কিছু বলতে পারি না। তবে আমার মনে হয় ও একদিন কিছু বলে ফেলবে। কিংবা গ্ল্যান্ডগুলো ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লে আমিও দুম করে কিছু বলে ফেলতে পারি। দেখা যাক, কে আগে বরফ গলায়? মোটামুটি এই লতিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক।

.

হে মহান জনগণ, এখন অনেক রাত। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কলকাতায় স্নায়ু একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে।

এতক্ষণ নিজের লাইফ হিস্ট্রি, লতিকার লাইফ হিস্ট্রি, প্রফেসান–সব আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু এখন সমস্ত সরিয়ে সেই মহিলাটি, যার নাম মনোবীণা সান্যাল, তাঁর মেয়ে শমিতা, তার স্বামী এবং শমিতার কানাড়াবাসী বাবা–এরা আবার পুরনো রেকর্ড নতুন করে বাজার মতো স্নায়ুর ভেতর ফিরে আসতে লাগল। এদের কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ আমার চোখ জুড়ে আসতে লাগল।

.

০৪.

ঘুম ভাঙতে প্রথমেই যাঁদের কথা মনে পড়ল তাঁরা হলেন মনোবাণী সান্যাল, তার স্বামী অরবিন্দ সান্যাল, তার মেয়ে শমিতা এবং শমিতার কানাডায় থাকা বাবা। কাল রত্তিরে এদের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

এখনও ভালো করে সকাল হয়নি। জানালার বাইরে আবছা আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটা ট্রাম কি হরিণঘাটার দুধের গাড়ি কিংবা খবর কাগজের ভ্যান চলার শব্দ আসছিল।

ওই সব শব্দ-টব্দ আমার কানে ঢুকছিল না। জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঝাপসা অন্ধকার, ভোরের আকাশ কিংবা অন্য দৃশ্যাবলী, কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনোবীণা সান্যালদের চিন্তাটা আমাকে পেয়ে বসেছে।

অথচ মহিলার কাছ থেকে দুহাজার টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছি। অ্যাডভান্স নেওয়া হয়ে গেলেই আমার কাজ শেষ। তখন পিছন দিকে ফিরেও তাকাই না। কিন্তু ওই মহিলা–মনোবীণা সান্যাল ফিক্সেসানের মতো আমার মাথার ভেতর আটকে গেছে।

আস্তে আস্তে পাতলা অন্ধকার কেটে গিয়ে রোদ দেখা দিল। শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে নীচের রাস্তায় এখন প্রচুর লোকজন দেখতে পাচ্ছি; অজস্র গাড়ি-টাড়ি চোখে পড়ছে। হঠাৎ আমি ঠিক করে ফেললাম, মনোবীণা সান্যালের মেয়ে শমিতার দায়িত্ব নেব। ডাইনির মতো মন্ত্র পড়ে ওরা যেন আমাকে টানছিল। ব্যাপারটা মনে মনে স্থির করে বিছানা থেকে নামতে গিয়েই চোখে পড়ল মেঝেতে চিটচিটে নোংরা বিছানায় কুকুরে মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে চার্লি। কাল রাত্তিরে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর নারকেল গাছ বেয়ে জানালার শিক সরিয়ে কখন ও ঘরে ঢুকেছে, টের পাইনি।

চার্লির বয়স বাহান্ন-তিপান্ন। লোকটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। পোড়া ব্রোঞ্জের মতো গায়ের রঙ। শরীরে মাংসের চাইতে হাড় বেশি। এবড়ো-খেবড়ো লম্বাটে মুখ; চোখ দুটো ইঞ্চিখানেক ভেতরে ঢোকানো; গালে খাপচা খাপচা দাড়ি। তামাটে রঙের পাতলা চুল অযত্নে সব সময় এলোমেলো হয়ে থাকে। পরনে তাল-মারা ঠেটি ট্রাউজার আর চক্কর-বক্কর লাগানো স্পোর্টস গেঞ্জি।

চার্লি আমাদের এই এলাকার নামকরা ছিঁচকে চোর। তবে ওর লোভ কম, হয়তো সাহসও। কোনও জিনিসের দাম পঞ্চাশ টাকার বেশি হলে ও তা ছোঁয় না।

চার্লি জেলখানার পোষা পাখি; ইংরেজিতে যাকে জেল-বার্ড বলে ঠিক তাই। বাহান্ন-তিপন্ন বছরের মধ্যে কম করে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর তার জেলেই কেটেছে। আমাদের এই অঞ্চলে ছোটখাটো কিছু চুরি হলে পুলিশ চার্লিকে ধরে হাজতে চালান করে দেয়।

মা বাবা-ভাই-বোন বউ-বাচ্চা, কেউ নেই চার্লির। ওর থাকারও কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে জেলখানার বাইরে যে কটা দিন সে থাকত সে দিন কটা এর-ওর বারান্দায় শুত। ট্রাম রাস্তার ধারে দুটো আস্তাবল আছে। কখনও-সখনও সেখানে গিয়েও পড়ে থাকত।

আমার সঙ্গে চার্লির আলাপ হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। আমাদের এই এলাকার থানায় আগে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে যেতাম। আমার এক বন্ধু সমীর ছিল ওখানে সাব-ইন্সপেক্টার।

সেবার কলকাতায় দারুণ শীত পড়েছে। মাসটা ছিল জানুয়ারি। রাত নটার সময় কফি খেতে খেতে সমীরের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ চার্লি এসে হাজির। লম্বা স্যালুট সে সমীরকে বলেছিল, স্যার, বড় বিপদে পড়ে গেছি। প্লিজ সেভ মি। ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে কথা বলে সে।

এই থানার সবাই চার্লিকে চেনে। ভুরু কুঁচকে সমীর জিগ্যেস করেছিল, কী ব্যাপার?

চার্লি বলেছিল, স্যার, এবার দারুণ শীত পড়েছে–ট্রিমেণ্ডাস কোল্ড। বাইরে পড়ে থাকতে থাকতে হিমে জমে যাচ্ছি। প্লিজ এই উইন্টারটা আমাকে জেলখানায় পুরে রাখুন। নইলে স্রেফ মরে যাব–আই উইল ডাই।

ভাগ

আমি আপনাদের বাঁধা ক্লায়েন্ট। মরে যাব, এটা কি ভালো হবে। আমার কেসটা কনসিডার করুন।

তুই কি চুরি করেছিস যে জেলে পুরব! খারাপ কাজ না করলে জেলে পোরা যায়?

যাই, তাহলে একটা চুরি-ফুরিই করে আসি। চার্লি চলে গিয়েছিল।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম; আবার মজাও লাগছিল খুব। এমন ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার আগে আর কখনও দেখিনি।

যাই হোক, কিছুক্ষণ বাদে সমীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সার্কুলার রোডের কাছাকাছি আসতেই চার্লির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজে ডেকে ওর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। দারুণ মজার লোক চার্লি। ওর জীবন এবং কথা বলার ভঙ্গি আমাকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করেছিল। ফলে রাস্তা থেকে ওকে সোজা আমার ডেরায় নিয়ে এসেছিলাম। হে মহান জনগণ, একটা লোক জেলে যেতে পারবে না বলে শীতে কষ্ট পাবে, তা তো আর হতে পারে না। বিশাল ছাদে দু-দুটো ঘর নিয়ে আমি একা থাকি; এখানে আরেকটা লোকের জায়গা সহজেই হয়ে যেতে পারে। চার্লিকে বলেছিলাম, এখন থেকে তুমি আমার এখানেই থাকবে।

চার্লি গভীর কৃতজ্ঞতায় আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলেছিল, ইউ আর মাই সেভিয়র; মাই লর্ড। মনে হচ্ছে তোমার জন্যে এই শীতটা টিকে গেলাম।

সেই থেকে চার্লি আমার কাছেই আছে। মাঝে মাঝে অবশ্য হাওয়া বদলাবার জন্যে জেলে চলে যায়। তখন আমি একাই থাকি। ও আমাকে লর্ড বলে ডাকে।…

…কয়েক পলক ঘুমন্ত চার্লির দিকে তাকিয়ে থেকে আমি বাথরুমে চলে গেলাম। আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখি চার্লির ঘুম ভেঙে গেছে। শুধু তাই না, নিজের তেলচিটে বিছানাটা খাটের তলায় চালান করে ঘর-টর সাফ করে ফেলেছে। তারপর চা বানিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমাকে দেখেই চার্লি বলে উঠল, গুড মর্নিং লর্ড

আমিও বললাম, গুড মর্নিং

আমার হাতে একটা চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে চার্লি বলল, অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হল লর্ড।

হে মহান জনগণ, আপনাদের আগেই জানিয়েছি আমরা একই ঘরের বাসিন্দা হলেও দেখা-টেখা আমাদের খুব কমই হয়ে থাকে। কেননা আমি যখন ঘরে থাকি; চার্লি তখন বাইরে। আবার চার্লি যখন ঘরে ঢোকে আমি তখন বাইরে ঘুরে বেড়াই।

হেসে বললাম, হ্যাঁ, তা তোমার হাতের কাজ কী রকম চলছে?

হাতের কাজ বলতে চুরি-চামারি। হতাশ এটা ভঙ্গি করে চার্লি দু-হাত উল্টে দিল। বলল, ভেরি ব্যাড লর্ড।

কেন?

লোকজন খুব কেয়ারফুল হয়ে গেছে। মাল-টাল আর সরানো যাচ্ছে না। ভাবছি হ্যাঁন্ডিক্র্যাফটের কাজটা ছেড়েই দেব। তার ওপর কাল যা একখানা এক্সপিরিয়েন্স হল নাকী বলব!

কী এক্সপিরিয়েন্স? আমার রীতিমতো কৌতূহলই হল।

রাত বারোটায় আমাদের এই এন্টালিতেই একটা গলিতে ঢুকলাম। মনে হল কেউ জেগে নেই। সামনের একটা তেতলা বাড়ির তিনতলার বারান্দায় দেখলাম একটা ওয়াল-ক্লক রয়েছে। ওটা সরাবার জন্যে রেন-ওয়াটার পাইপ বেয়ে যেই উঠতে যাব অমনি একটা ট্যাক্সির হেডলাইট এসে পড়ল আমার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সিটা থেমে গেল আর দরজা খুলে এক বাবু বেরিয়ে এল। মাল খেয়ে বাবুটি চুর হয়ে আছে। টলতে টলতে আমার কাছে এসে সে বলল, এই ব্যাটা, তুই নির্ঘাত চোর। আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেলাম। বুঝলাম কট যখন হয়েই গেছি তখন স্বীকার করাই ভালো। বললাম, স্রেফ পেটের দায়ে এই প্রফেসানটা নিতে হয়েছে স্যার। আর কখনো চুরি করব না। দারুণ টলছিল লোকটা। সেই অবস্থায় আমাকে দেখতে দেখতে বলল, তুই বুঝি এ পাড়ায় আজই প্রথম চুরি করতে এসেছিস? ভয়ে ভয়ে বললাম, হ্যাঁ স্যার। বাবুটি বলল, তাই জানিস না, রাত বারোটায় এ পাড়ায় কোনও চোর ঢোকে না। কারণ এ-সময় আমি মানে নিশিকান্ত সেনগুপ্ত মলে খেয়ে ফিরি। তা তোর নাম কী বল? বললাম, চার্লি। বাবুটি বেশ ফানি। বলল, চার্লি চ্যাপলিন নাকি? বললাম, না চার্লি হেণ্ডারসন। বাবুটি বলল, তার মানে খ্রিশ্চান! তোকে পেয়ে খুব ভালো হল। কদিন ধরেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের ব্যাপারটা বুঝবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। বুঝিয়ে দে তো ব্যাপারটা। লাইফে কোনওদিন চার্চে যাইনি, বাইবেল চোখে দেখিনি। আমার গা দিয়ে ঘাম ছুটল। বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার, আর কক্ষনো এখানে আসব না। বাবুটি ঢুলুঢুলু চোখে আমাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘাড়ে এক রদ্দা কষিয়ে বলল, যাও শালা, গেট আউট–। আমি এক দৌড়ে গলিটা ক্রস করে ট্রাম রাস্তায় চলে এলাম।

চার্লির কথা শুনতে শুনতে দারুণ মজা লাগছিল। হাসতে হাসতে বললাম, দারুণ এক্সপিরিয়েন্স তো

চার্লি বলল, সবটা আগে শুনে নাও

এখনও বাকি আছে নাকি?

ইয়েস লর্ড। বলে চার্লি আবার শুরু করল, গলি থেকে বেরিয়ে এলেও ব্লাডি ঘড়িটা আমার মাথায় আটকে ছিল। এদিক ওদিক ঘুরে রাত দুটোয় আবার ওখানে গেলাম। রেন-ওয়াটার পাইপে উঠতে গিয়ে এবার সান অফ এ বিচ একটা প্রাইভেট কারের হেডলাইট এসে পড়ল আমার ওপর। গাড়ি থামিয়ে ঢ্যাঙা ল্যাস্কি চেহারার আরেক মাতাল নেমে এল। আমার ঘাড়ে আস্তে টোকা মেরে বলল, তোর সাহস তো কম না! রাত দুটোয় আমি এই ভূতনাথ চাকলাদার নেশা করে ফিরি, আর তুই কিনা এ সময় চুরি করতে ঢুকেছিস! নাম বল-ভয়ে ভয়ে নামটা বললাম। চাকলাদার সাহেব জিগ্যেস করল, তুই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল? ইয়েস স্যার, আমার জন্ম-কর্ম সব এখানে। চাকলাদার বলল, ভেরি গুড! এবার ন্যাশনাল অ্যানথেম মানে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ বলে যা তো দেখি। আরেকবার আমার ঘাম ছুটল। দু-চারটে লাইন বলবার পর সব গোলমাল হয়ে গেল। চাকলাদার সাহেব ভয়ানক রেগে গেলেন, শালা, ভারতীয় নাগরিক হয়ে তুমি জাতীয় সঙ্গীত পুরো বলতে পারছ না! অ্যাবাউট টার্ন-ভয়ে ভয়ে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। চাকলাদার সাহেব তখন তার লম্বা পা দিয়ে আমার পাছায় টেনে একটি কিক হাঁকালেন। আমি উড়ে গলির মুখে সে পড়লাম।

শুনে হাসতে হাসতে আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বললাম, চার্লি, আমি মরে যাব। আই শ্যাল ডাই সিম্পলি। |||||

||||| চার্লি বলল, শেষটুকু শুনে নাও। তারপর মরো। চাকলাদারের লাথি খেয়ে তো পালিয়ে এলাম। কিন্তু ঘড়িটাকে কিছুতেই মাথার ভেতর থেকে আউট করে দিতে পারছিলাম না। সাড়ে চারটের সময় গুটি গুটি আবার গলিতে ঢুকলাম। রেন-ওয়াটার পাইপ বেয়ে থার্ড টাইম উঠতে যাব, ঠুং টুং করে রিশার শব্দ কানে এল। কিছু বুঝবার আগেই রিকশা থেকে কে যেন আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। দেখলাম ছাই-টাই মাখা এক ইয়োগী (যোগী) চোখ দুটো তার টেরিফিক রেড। আমার গলাটা চেপে ধরে সে বলল, পাপী, জানিস না, আমি ভীমভৈরব অবধূত এ সময় শ্মশান থেকে মহাদেবের প্রসাদ চড়িয়ে ফিরি! বললাম, সাধু মহারাজ, আমি আর কখনও এখানে আসব না। ইয়োগী বলল, না, আসবি না। এসে সুবিধে হবে না। এ পাড়ায় রাত বারোটায় মাল খেয়ে নিশিকান্ত ফেরে, ভূতনাথ ফেরে রাত দুটোয়, আর আমি ফিরি সাড়ে চারটেয়। সারা রাতে ফঁকটা কোথায় যে চুরি করতে ঢুকবি! বলেই রিকশা থেকে একটা ত্রিশূল নামিয়ে তার বাঁটটা দিয়ে কোমরে মারলে এক খোঁচা, আমি ছিটকে আবার গলির বাইরে এসে পড়লাম। বলে একটু থামল চার্লি। পরক্ষণে আবার শুরু করল, তুমিই বলো লর্ড, এরপর আর এই প্রফেসান কি চালানো যায়? ভাবছি এটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু করব। উইল ডু সামথিং এ

পাদ্রি বাবা হয়ে যাবে নাকি?

চার্লি আবার কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আচমকা মনোবীণা সান্যাল আর শমিতার মুখ আবার আমার মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা প্ল্যান এসে গেল। চার্লিকে সেই প্ল্যানটায় লাগিয়ে দেওয়া যায়। বললাম, তোমাকে একটা কাজ দিতে পারি চার্লি। করবে?

চার্লি বলল, জেন্টলম্যানের কাজ দিলে কিন্তু পারব না লর্ড।

আমাকে কি জেন্টলম্যান মনে হয় যে তোমাকে ভদ্রলোকের কাজ দেব!

তা হলে কী করতে হবে বলে ফেললো।

আমি আমার সেই ব্রিফকেসটা এনে তার থেকে শমিতার ফোটো বার করে বললাম, এটা দেখো

ছবিটা দেখতে দেখতে চার্লি বলল, ওহ গড়, এ যেন এলিজাবেথ টেলর! একে তুমি কোথায় পেলে?

চার্লি এলিজাবেথ টেলরের দুর্দান্ত ফ্যান। এলিজাবেথের যে-কোনও ছবি আসুক, সে দেখবেই।

যেখানেই পাই, তোমার কাজটা হল এর ওপর নজর রাখা। পারবে?

গ্ল্যাডলি। চুরি-ফুরির চাইতে বিউটিফুল মেয়েদের পেছনে ঘোরা অনেক ভালো প্রফেসান। আহ হেভেন! অনবরত সুন্দরী মেয়ে দেখলে চোখ ভালো হয়ে যায়, না কী বলো!

হাসলাম। তারপর মনোবীণা সান্যালের ঠিকানাটা দিয়ে বললাম, এখনই তুমি ওখানে চলে যাও। বাড়ির ভেতরে ঢুকবে না; বাইরে ট্যাক্সি নিয়ে ওয়েট করবে। মেয়েটা কোথায় যায় লক্ষ্য রাখবে। যদি দেখো কোথাও বেশিক্ষণ থাকছে আমার অফিসে একটা ফোন করে দেবে। আমি এগারোটার পর অফিসে থাকব।

ঠিক আছে লর্ড। কিছু ক্যাশ দেবে না? ট্যাক্সি-ফ্যাক্সির খরচ আছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মনোবীণা সান্যাল যে টাকাটা অ্যাডভান্স করেছিল তার থেকে পঞ্চাশটা টাকা চার্লিকে দিলাম।

টাকাটা এবং সেই সঙ্গে শমিতার ফোটোটা পকেটে পুরতে পুরতে চার্লি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। তারপর জানালা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। গলা নামিয়ে বলল, ব্যাপারটা কী লর্ড?

কী জানতে চাইছ?

শমিতার ফোটোটা দেখিয়ে চার্লি বলল, ইঁদুরকলে পা ঢুকিয়ে দাওনি তো? মেয়ে-ঘটিত বিষয়গুলোকে চার্লি ইঁদুর-কল বলে থাকে।

আমি হাসাম, বুঝতে পারছি না। তুমি এখন যাও।

চার্লি জানালার শিক সরিয়ে নারকেল গাছ বেয়ে নীচে নেমে গেল।

৩. অফিসে চলে এলাম

০৫.

এগারোটার কিছু আগেই অফিসে চলে এলাম। চার্লি আজ আর রান্না-টান্না করবার সময় পায়নি; তাই একটা হোটেল থেকেই খেয়ে আসতে হয়েছে।

নিজের চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম কাচের  পার্টিসান ওয়ালের ওধারে লতিকা বসে আছে। ফোন-লাগানো রিভলভিং চেয়ারটায় বসতে বসতে লতিকার বাবা, দু-নম্বর মা এবং তার ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়ে গেল। বললাম, বাড়ির খবর কী?

লতিকা বিস্বাদ গলায় বলল, কী আর। কালই তো তোমাকে বললাম, বাবা আর সেই মেয়েমানুষটা এসে গেছে।

তোমার মা অজ্ঞান হয়ে যায়নি?

অজ্ঞান হোক আর মরে যাক, এবারআর ওদের তাড়ানো যাবে না। পার্মানেন্টলিই ওরা এসে বসল। যাক গে–তারপর খুব সংক্ষেপে পারিবারিক ঝঞ্জটের কথা শেষ করে লতিকা বলল, তারপর বলো, কাল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সেই মহিলার কাছে গিয়ে কী করলে?

লক্ষ্য করলাম, লতিকার চোখ-মুখ আগ্রহে চকচক করছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার খেয়াল হল, আরে, অন্য দিন বারোটার আগে অফিসে আসে না সে; আজ এগারোটা বাজতে না বাজতেই এসে বসে আছে। নিশ্চয়ই সেই মহিলাটির বিষয়ে জানবার জন্যে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে। আমার দারুণ মজা লাগছিল। বললাম, প্রথমেই বলে রাখি মহিলাটি বেশ এজেড।

মহিলার বয়স সম্পর্কে আমার মাথা ব্যথা নেই। ওখানে কী হল সেটাই জানতে চাইছি।

বলছি, তার আগে আরেকটা খবর দিয়ে নিই। মহিলা এজেড হলেও তার মেয়েটি তরুণী–তার বয়স ম্যাক্সিমাম টোয়েন্টি থ্রি-টোয়েন্টি ফোর। আমার কাছে তার একটা ফোটো আছে। দেখবে নাকি?

কথা বলতে গেলে মহিলার সঙ্গে; ফোটো নিয়ে এলে তার মেয়ের ব্যাপারটা–এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেল লতিকা।

বুঝতে পারছি ফোটোটা দেখবার খুবই ইচ্ছা লতিকার, কিন্তু তার আত্মমর্যাদা এবং শোভনতাবোধ তাকে বাধা দিচ্ছে। ব্রিফকেস থেকে শমিতার ফোটোটা বের করে কাচের  দেয়ালের গোল ফোকর দিয়ে লতিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, বেশ সুন্দর, না?

ফোটোটা এক পলক দেখেই আমাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে লতিকা বলল, হ্যাঁ। এবার বলো–

মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে আমার যা-যা কথা হয়েছে, সব বলে গেলাম। এমনকী অ্যাডভান্সের কথাটাও বাদ দিলাম না। তবে চার্লিকে যে শমিতার ওপর নজর রাখার জন্য লাগিয়েছি, সেটাই শুধু বললাম না।

সব শুনে লতিকা বলল, অ্যাডভান্স নিয়ে এসেছ। ওই চ্যাপ্টার তো তাহলে ক্লোজড।

আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

ওই মেয়েটাকে শোধরাবার দায়িত্ব নেবে, এই তো?

একজ্যাক্টলি। তুম একেবারে অন্তর্যামী। নাকি থট রিডিং জানো?

আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে লতিকা এবার বলল, মেয়েটা সুন্দর বলে বুঝি এত ইন্টারেস্ট?

তার চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেস্ট আরেকজন সম্পর্কে।

কে সে?

কাচের  দেয়ালের ওপারে এখন সে বসে আছে।

ফ্ল্যাটারি।

তোমার কি তাই মনে হয়?

লতিকা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। একটু পরে সে বলল, এটা কিন্তু আমাদের প্রফেসান নয়। অ্যাডভান্স নেবার পরই আমরা কিন্তু ক্লায়েন্টের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক কাট অফ করে দিই।

কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে বললাম, কিন্তু ব্যাপারটা কী জানো, আমার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা মানে শমিতাকে ফলো করলে একটা অদ্ভুত সোসাল অ্যাটমসফিয়ারকে ধরতে পারব।

সোসিওলজির ওপর তুমি কোনও বই লিখবে নাকি?

না, মানে সিম্পলি কৌতূহল।

লতিকা আর কিছু বলল না। শমিতার ব্যাপারে তার মনোভাবটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। হে মহান জনগণ, মেয়েটা দারুণ চাপা ধরনের। মেরুপ্রদেশের নদীতে বরফের পাহাড়ের মতো তার খানিকটা দেখা যায়, বাদবাকি সবটাই গোপন। যাই হোক, একটু ভেবে বললাম, আজ বিজনেসের খবর কী?

খুব ভালো। তুমি আসার আগে এক ঘণ্টায় এই-ইলেকসান কর্পোরেশনে পাঁচজন নাম লিখিয়ে গেছে। এর মধ্যে তিনজন এম-এল-এ হতে চায়, দুজন মিউনিসিপ্যাল কমিশনার। অ্যাডভান্স পেয়েছি বারো হাজার টাকা।

ফাইন। আর ডেটেকটিভ কনসার্ন?

দুজন এসেছিল। এক হাজার টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছি। আর পার্সোনালে তিনজন আড়াই হাজার অ্যাডভান্স দিয়েছে।

ফার্স্ট ক্লাস।

আমাদের কথার মধ্যে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন থেকে সমরেশের ফোন এল। আমাকে তার ঘরে যেতে বলছে।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের পিছন দিকের দেয়ালে যে কাঁচ বসানো আছে সেটা দিয়ে দেখলাম একটা লোক সমরেশের মুখোমুখি বসে আছে। খুব সম্ভব তাকে ম্যানেজ করতে পারছে না সমরেশ। লতিকার দিকে ফিরে বললাম, যাই, নতুন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসি।

এইড-ইলেকসানের ঘরে এসে দেখলাম, সমরেশের সামনে যে বসে আছে তার বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন, জিরাফের মতো গলা, মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি, মুখটা বোতলের মতো লম্বা, কপালে গালে বসন্তর দাগ, পরনে ফিনফিনে ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি, হীরের বোম, হীরের আংটি, চকচকে পাম্প–

লোকটার সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা গেল তার নাম ভগবতী চরণ পোদ্দার। ইলেকসানে কনটেস্ট করতে চায়। তার বায়োডাটা প্রভৃতি টুকে নিয়ে আড়াই হাজার টাকা অ্যাডভান্স নিলাম।

বিদায় নেবার মুখে ভগবতী পোদ্দার জানাল, তার কনস্টিটিউয়েন্সি হুগলী জেলার এক ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনে এবং তার সবচাইতে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম হীরাচন্দ আগরওয়াল।

আমার দারুণ মজা লাগল। কালই ময়দার বস্তার মতো বিশাল শরীরের মালিক হীরাচন্দ এসেছিল। আজ এসেছে তারই রাইভ্যাল অস্বাভাবিক লম্বা আর রোগা ভগবতী পোদ্দার।

ভগবতী বলল, ও হীরাচন্দ শালেকে এমন হারান হারাতে হবে যে শালে গিধর একেবারে শুয়ে পড়ে।

বললাম, চিন্তা করবেন না ভগবতীবাবু, শালাকে একেবারে শুইয়েই দেব।

পরে আপনাকে হীরাচন্দের অনেক স্ক্যান্ডাল সাপ্লাই করব। সেগুলোকে কীভাবে কাজ লাগানো যায়, দেখবেন।

নিশ্চয়ই দেখব, স্ক্যান্ডাল খুব কাজে লাগবে। আচ্ছা নমস্কার।

নমস্কার। ভগবতী চলে গেল। আমার পাকস্থলীতে দারুণ একটা হাসি বগবগিয়ে উঠছিল। এতক্ষণে সেটা তোড়ে বেরিয়ে এল। আমার দেখাদেখি সমরেশও হাসছিল। হাসতে হাসতে আমি চেম্বারে ফিরে এলাম।

.

০৬.

ভগবতী চলে যাবার পর তেমন কোনও ঘটনা আর রইল না। ঘণ্টায় একবার করে চা খেতে লাগলাম। সেই সঙ্গে লতিকার সঙ্গে এলোমেলো গল্পও চলছে। এইড-ইলেকসানে আজ যে-রকম অ্যাডভান্স পাওয়া গেছে সেই রকম দিন পনেরো-কুড়ি যদি পাওয়া যায় তাহলেই ওটার গণেশ উল্টে দেওয়া যেতে পারে। তখন ওখানে কী বিজনেস ফাঁদা যাবে তারই নানারকম পরিকল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনওটাই মনে ধরল না। ঠিক করলাম পরে এ সম্বন্ধে ভালো করে ভাবা যাবে।

লতিকার সঙ্গে কথা বলছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার কান ছিল টেলিফোনের দিকে। সেই সকালে চার্লি বেরিয়েছে। এখন সাড়ে চারটে বাজতে চলল অথচ তার কোনও পাত্তাই নেই। একটা ফোন করেও সে শমিতার ব্যাপারটা জানাতে পারত। কোনও কারণে তার সঙ্গে দেখা না হলে কিংবা অন্য কোনও ঝামেলা হলে, সেই খবরটা দিতে কী অসুবিধা ছিল? চার্লির ওপর ক্রমশ আমি বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম। ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় আমি তার আশায় বসে আছি। এভাবে কারোকে ঝুলিয়ে রাখার মানে হয়? ওকে না পাঠিয়ে আমি গেলেই বোধহয় ভালো হত।

হে মহান জনগণ, আরো এক ঘণ্টা পর চার্লির আশা যখন পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছি তখন তার ফোন এল।

বললাম, কী ব্যাপার চার্লি, কখন তোমার ফোন করার কথা ছিল?

ওধার থেকে চার্লির গলায় ভেসে এল, ফোন করার চান্স পেলে তো করব! পাঁচ ঘণ্টা পর এই তো ফাস্ট চান্স পেলাম। ওহ গড, এ তুমি কার পেছনে আমাকে লাগিয়েছ!

কেন, সে কী করেছে?

কী আর, হোল ক্যালকাটা চরকির মতো আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অলরেডি সাঁইত্রিশ টাকা ট্যাক্সি ফেয়ার দিয়ে ফেলেছি।

তাই নাকি!

ইয়েস লর্ড। এর মধ্যে লাঞ্চ করারও চান্স পাইনি। এর ফাঁকে রাস্তা থেকে দুটো চারশো গ্রামের পাঁউরুটি কিনে নিয়েছিলাম। তোমার এলিজাবেথ টেলরের পেছন ছুটতে ছুটতে ওনলি সে দুটো খেয়েছি।

আমি শব্দ করে হাসলুম, তাহলে বলো বেশ ভালোই এক্সপিরিয়েন্স হচ্ছে।

তা হচ্ছে–চার্লি বলতে লাগল, আর সেই এক্সপিরিয়েন্সের ঠ্যালায় আমার ফ্লেশ আর বোন লুজ হয়ে যাচ্ছে।

তুমি এখন কোথায়?

আলিপুরের এক পেট্রোল পাম্পে। সেখান থেকে ফোন করতে করতে রাস্তার উল্টোদিকের ক্লাবটার ওপর ওয়াচ রাখছি।

ওয়াচ রাখছ! কেন?

তোমার এলিজাবেথ টেলর ওখানে ঢুকেছেন যে। বলতে বলতেই চার্লি ব্যস্ত হয়ে উঠল, তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। এখন লাইন ডিসকানেক্ট করে দিচ্ছি। তুমি অফিসেই থেকো, আমি আবার ফোন করব।

আমি কিছু বলবার আগেই লাইন কেটে গেল। চার্লি মহা ঝামেলায় ফেলে দিল তো; কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে কে জানে।

সাড়ে পাঁচটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনটে কনসানেই ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সমরেশ, রীতেশ-টীতেশরা চলে গেছে। শুধু লতিকা আর আমিই আছি। লতিকাকে বললাম, আমার বেরুতে দেরি হবে। চার্লিকে একটা কাজে পাঠিয়েছে। ও আমাকে ফোন করে ওয়েট করতে বলল। তুমি বসে থেকে কী করবে; বাড়ি চলে যাও।

লতিকা এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটা কথাও না বলে চলে গেল।

লতিকা চলে যাবার পর দুঘণ্টায় আরো বার দুই ফোন করল চার্লি। একবার ডায়মণ্ড হারবার রোড থেকে, আরেকবার টালিগঞ্জ থেকে। দুবারই আরো কিছুক্ষণ আমাকে অপেক্ষা করতে বলে লাইন কেটে দিয়েছে। আমার নাকে বঁড়শি আটকানো। না পারছি এখান থেকে বেরুতে, না ভালো লাগছে এখানে বসে থাকতে। দমবন্ধ মানুষের মতো আমি চেম্বারে আটকে আছি।

রাত সাড়ে আটটার সময় চার্লির শেষ ফোন এল। সে বলল, আর তোমাকে আটকে রাখছি না লর্ড; চলে এসো।

জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাব?

চৌরঙ্গীর একটা বড় হোটেলের নাম করে চার্লি বলল, আমি তার তলায় মেইন এনট্রান্সের কাছে ওয়েট করছি; ওখানে এলেই দেখা হবে।

তিনি কোথায়?

হোটেলের ভিতর।

পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে আমি বিশাল হোটেলটার সামনে চলে এলাম। মেইন এনট্রান্সের কাছে চার্লি অপেক্ষা করছিল। ট্যাক্সি থেকে নামতেই সে দৌড়ে এল।

চার্লির চেহারা দেখে মনে হল সারাদিনে তার ওপর দিয়ে একটা টাইফুন বয়ে গেছে। মুখ আরো ভেঙে গেছে; সারাদিন স্নান হয়নি; চুল উস্কোখুস্কো; চোখ লালচে। নেশা না করেও সে প্রায় উলছিল।

বললাম, সকাল থেকে কী করলে ডিটেলে এবার বলো দেখি।

চার্লি যা বলল, সংক্ষেপে এই রকম। সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে সোজা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে চলে যায়। রাস্তায় ঝাড়া দেড়টা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সে দেখতে পায় শমিতা একটা ফিয়েট গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তখনই একটা ট্যাক্সি ডেকে তাকে ফলো করতে থাকে। তারপর প্রায় গোটা কলকাতা ঘুরে বাইশটা প্রাইভেট ক্লাব, সতেরোটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে গেছে শমিতা। কিন্তু কোথাও দশ-পনেরো মিনিটের বেশি থাকেনি। তার ওপর চোখ রেখে অত কম সময়ে ফোন করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া সব জায়গায় টেলিফোন বুথ বা ফোন করার সুবিধা ছিল না। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে যখনই সময় পাওয়া গেছে তখনই ফোন করে জানিয়েছে চার্লি। আপাতত শমিতা সামনের এই হোটেলটায় ঢুকেছে। চার্লির ধারণা, এখন বেশ কিছুক্ষণ সে এখানে থাকবে।

চার্লির একটা হাত ধরে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমার জন্যে তোমার খুবই কষ্ট হল।

নাথিং। চার্লি মাথা নাড়ল, তোমার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি।

আমি আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, অতটা দরকার নেই।

চার্লি বলল, আমার ডিউটি শেষ। তুমি চার্জ বুঝে নাও লর্ড। আমি যাব।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মেয়েটা এই হোটেলের কোথায় আছে জানো?

না। আমার এই চেহারা আর ড্রেস নিয়ে এত বড় হোটেলে ঢুকতে সাহস হয়নি। আমি যা, মানে চোর বলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে তুলে দেবে। তুমি লর্ড ভেতরে ঢুকে তোমার জিনিসটি ডিসকভার করে নাও।

চার্লি চলে যাচ্ছিল; তাকে থামিয়ে বললাম, সেই পঞ্চাশ টাকা থেকে কিছু বেঁচেছে?

পকেট থেকে এক খামচা রেজগি বার করে দ্রুত গুণে ফেলল চার্লি। তারপর বলল, সেভেন্টি টু পয়সে ওনলি।

এখন সোজা বাড়ি ফিরবে তো?

সিওর, অফুলি টায়ার্ড, এখন গিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচি।

চার্লিকে পাঁচটা টাকা দিয়ে বললাম, যাবার আগে কোনও হোটেলে-টোটেলে খেয়ে নিও। আর আমার জন্যে কিছু রাঁধতে হবে না।

ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে পাঁচ টাকার নোটটা তুলে নিয়ে চুক করে একটু চুমু খেল চার্লি, বলল, থ্যাঙ্ক ইউ লর্ড, থ্যাঙ্ক ইউ। লাইফে কখনও পাঁচ টাকার ডিনার খাইনি। কিন্তু

কী?

এত দামি ডিনার খাব। সেটা জম কতে মেডিসিন লাগবে না?

চার্লির মেডিসিন মানে কালী মার্কা বাংলা মদ। হাসতে হাসতে আরো পাঁচটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

চার্লি বলল হা যাও। হোল ডে আমি ডিউটি দিয়েছি; এবার হোল নাইট তুমি ডিউটি লাগাও।

চার্লি চলে গেল। আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে হোটেলটায় ঢুকে পড়লাম।

.

০৭.

এই হোটেলে আগেও অনেকবার এসেছি এখানকার সব কিছুই আমার চেনা। তবু মেইন এনট্রান্স থেকে কার্পেট মোড়া লম্বা প্যাসেজের ওপর দিয়ে চিন্তা-গ্রস্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, এই চোদ্দতলা এয়ার কন্ডিশন্ড হোটেলের চারশো সুইট, দশ-বারোটা বার, ক্যাজিনো, সাত-আটটা রেস্তোরাঁ, কফি শপ, সুইমিং পুল, ডিনার ক্লাব, বিউটি পার্লার ইত্যাদি ইত্যাদি মিলিয়ে যে বিশাল ব্যাপার–তার মধ্যে শমিতাকে কোথায় খুঁজব? তা ছাড়া শমিতাকে আগে কখনও দেখিনি; ফোটো দেখে তাকে সনাক্ত করতে হবে।

চওড়া প্যাসেজের দুধারে নানা রকম কিউরিও শপ, শাড়ির দোকান, ইন্ডিয়ান হ্যাঁন্ডিক্র্যাফট আর জুয়েলারির দোকান, অসংখ্য শো-উইন্ডোতে বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের বিজ্ঞাপন। আমার দুপাশ দিয়ে বিচিত্র বিচিত্র সাজ-পোশাক পরা পুরুষ এবং মহিলারা ফ্যাসন প্যারেডের মতো ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। এদের বেশির ভাগই বিদেশি ট্যুরিস্ট।

আমি দুধারের দোকান-টোকান দেখছিলাম না। তবে চারপাশের মহিলাদের মুখ লক্ষ্য করছিলাম আর মাঝে মাঝে পকেট থেকে শমিতার ফোটোটা বার করে দেখে নিচ্ছিলাম। ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় রিসেপসান কাউন্টারের কাছে চলে এসেছিলাম। হঠাৎ একটি মেয়ের গলা কানে এল, আমার নাম ধরেই ডাকছে।

ঘাড় ফেরাতেই রিশেপসান কাউন্টারে শিরিনকে দেখতে পেলাম। শিরিন—পুরো নাম শিরিন মার্চেন্ট, বয়স সাতাশ-আটাশ, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স ৩৬-২৫-৩৬ (এটা আমার অনুমান), জাতে পারসি, নিশ্বাস বন্ধ করে দেবার মতো সুন্দরী–এই হোটেলের সে একজন রিসেপসনিস্ট। অনেকবার আসার ফলে ওর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে।

পায়ে পায়ে শিরিনের কাছে চলে এলাম। হঠাৎ মনে হল, এই মেয়েটা শমিতার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারে।

শিরিন বলল, গুড ইভনিং মিস্টার সরকার। বলে দারুণ মিষ্টি করে হাসল।

আমিও হাসলাম, গুড ইভনিং

অনেকদিন পর আপনাকে আমাদর হোটেলে দেখলাম।

হ্যাঁ। নানা কাজে আটকে গিয়েছিলাম, আসা হচ্ছিল না। বলে একটু থামলাম। তারপর সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললাম, একটা ব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারেন মিস মার্চেন্ট?

গ্ল্যাডলি। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সারভিস। বলুন কী রকম

ব্যাপারটা স্লাইট ঝামেলার

কী রকম?

আমি এখানে একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছি, এত বড় হোটেলে তাকে কোথায় পাব, বুঝতে পারছি না। এ জন্যে আপনার হেল্প চাই।

শিরিন হেসে ফেলল, এখানে এই মুহূর্তে কয়েক শশা মেয়ে আছে। বোর্ডার ছাড়া তাদের অনেক গেস্টও আছে। তার মধে থেকে কোনও একজনকে খুঁজে বার করা বেশ ডিফিকাল্ট। তবু নামটা বলুন–দেখি চেষ্টা করে।

বললাম, শমিতা সান্যাল। আধঘণ্টা আগে এখানে এসেছে।

আই-ব্রো পেন্সিলে আঁকা সরু ভুরু কুঁচকে গেল শিরিনের, একটু ভেবে সে প্রতিধ্বনি করল, শমিতা সান্যাল!

হ্যাঁ হ্যাঁ-আমার গলায় আগ্রহ ঝকমকিয়ে উঠল।

আধঘণ্টা আগে এক শমিতাকে আমি ভেতরে যেতে দেখেছি, মনে হচ্ছে। তবে সে তো সান্যাল নয়–শি ইজ বোস। এই শমিতা রেগুলার আমাদের হোটেলে আসে।

আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই শিরিন আবার বলে উঠল, আপনি কি সিওর—যাকে খুঁজছেন সে শমিতা সান্যাল?

এক পলক চিন্তা করে নিলাম। মায়ের অর্থাৎ মনোবীণার পদবি যদি সান্যাল হয় মেয়ের পদবিও তাই হওয়া উচিত। আমার কোথায় যেন একটা খটকা লাগল। পরক্ষণে মনে পড়ে গেল, আরে কী আশ্চর্য, শমিতার একটা ফোটোই তো য়েছে আমার পকেটে। শিরিনকে সেটা দেখলেই তো বোস আর সান্যালের জটটা ছাড়িয়ে নেওয়া যায়। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি ফোটোটা বার করে শিরিনের সামনে রাখতেই সে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, আরে এ-ই তো শমিতা বোস। কিন্তু ব্যাপারটা কী মিস্টার সরকার, যাকে খুঁজতে এসেছেন তার সারনেমটাও জানেন না!

যার মা সান্যাল সে কী করে বোস হয়, ওটা আমার মাথায় আসছিল না। যাই হোক, শিরিনের কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, কাইন্ডলি একটু দেখবেন শমিতা কোথায় আছে–

দেখতে হবে না। ও এখানে রোজ আসে; আমরা ওকে খুব ভালো করেই চিনি। আপনি এক কাজ করুন। ফিফথ ফ্লোরে যে বারটা আছে সেখানে চলে যান। সেখানে ওকে না পেলে সেভেন্থ ফ্লোরে বল রুমে চলে যাবেন। যে-কোনও এক জায়গায় পেয়ে যাবেন। এই হোটেলে ওই দুটো হল ওর ফেভারিট স্পট।

থ্যাঙ্ক ইউ মিস মার্চেন্ট, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আচ্ছা, চলি—

পা বাড়াতে যাব, শিরিন হঠাৎ ডাকল, মিস্টার সরকার—

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, কিছু বলবেন?

ওই মেয়েটার পেছনে ঘুরছেন-ব্যাপারটা কি খুবই গভীর? বলে ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে হাসল শিরিন।

কোনও রিশেপসানিস্ট ঠিক এভাবে সম্মানিত কাস্টমারের (সব কাস্টমারই সম্মানিত) সঙ্গে কথা বলে না। কিন্তু শিরিনের সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ, এক ধরনের হৃদ্যতাই হয়েছে তার সঙ্গে, আমি তাকে খানিকটা প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকি। শিরিন সেই প্রশ্রয়ের কিছুটা সুযোগ নেয়, তবে কখনওই শোভনতার সীমা ছাড়ায় না। যাই হোক, বললাম, বুঝতে পারছি না। তবে আজ থেকে ওয়াইল্ড গুজ চেজ করা শুরু করেছি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে লিস্টে আরেকটা নাম যোগ হল। অ্যান্ড দ্যাট নেম ইজ রাজীব সরকার।

মানে?

মানে এই ওয়াইল্ড গুজটির পেছনে আপনার আগে থেকেই কয়েক ডজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি ইনফরমেসন। আচ্ছা, বাই

বাই। বেস্ট অফ লাক। শিরিন হাত নেড়ে হাসল।

.

শিরিনের কথামতো লিফটে করে ফিফথ ফ্লোরের বারে এসে শমিতাকে দেখতে পেলাম না। অতএব সেভেন্থ ফ্লোরের বলরুমে চলে এলাম।

এই হোটেলে আগে এলেও বলরুমে কখনও ঢুকিনি। তবে শুনেছি, বলরুমে এসে নাচের জন্য পার্টনার পাওয়া যায়। অবশ্য সঙ্গী নির্বাচন একতরফা হয় না; একজন আরেকজনকে পছন্দ করা চাই।

বল-রুমটা প্রকাণ্ড–প্রায় তিন সাড়ে তিন হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে। এখানেও একধারে বার রয়েছে; আরেক ধারে আয়নার মতো পালিশ করা ঝকঝকে মেঝেতে নাচের ব্যবস্থা।

হে মহান জনগণ, স্বৰ্গত লেজার-কিপার ভরতচন্দ্র সরকারের ছেলে আপনাদের রাজীব সরকার সুড়ুৎ করে সেখানে ঢুকে পড়ল।

এক ধারে জমজমাট, মাতালদের আড্ডা। বার-বয়রা ছোটাছুটি করে তাদের ইউস্কি-টুইস্কি সার্ভ করে যাচ্ছিল। আরেক ধারে নাচের জন্যে নির্দিষ্ট ফ্লোরে বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু মত্ত পুরুষ আর মহিলা নেচে যাচ্ছে। উঁচু একটা ডায়াসে মিউজিক হ্যান্ডরা কখনও দ্রুত লয়ে কখনও বা ধীরে ধীরে বাজিয়ে চলেছে। আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে চারদিকের মহিলাদের লক্ষ্য করতে লাগলাম। কিন্তু এত বড় বার-কাম-বল রুমে প্রতিটি মহিলার মুখ দেখা সম্ভব না। টেবলে টেবলে ঘুরে বা নৃত্যরত জোড়া জোড়া নারী পুরুষের কাছে গিয়ে শমিতাকে খুঁজে বার করাও অসম্ভব ব্যাপার।

কী করব যখন ভাবছি সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল বার-এর শেষ মাথায় একটা টেবল থেকে সে-হা সে-ই তো, অর্থাৎ যার ফোটো বুকের ভেতর পুরে নিশি-পাওয়া মানুষের মতো ছুটে বেড়াচ্ছি সেই শমিতা উঠে দাঁড়িয়েছে।

আগুনের একটা হলকার মতো দেখাচ্ছে তাকে। পরনে নাভির নীচে একটা বেলবটুস আর ব্রা। ব্রা-র ওপর কাচের  মতো স্বচ্ছ একটা জামা।

সে উঠে দাঁড়াতেই, হে মহান জনগণগোটা বল রুমটায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কিছু একটা ঘটে গেল যেন। নানা টেবল থেকে কয়েক ডজন হাত তার দিকে উঠে আসতে লাগল সেই সঙ্গে অসংখ্য মাতালের জড়ানো কণ্ঠস্বর আমার কানের পর্দায় ধাক্কা দিতে লাগল। ওরা সবাই বলছিল, আমাকে আজ তোমার পার্টনার করে নাও।

শমিতা আগুনের ফুলকির মতো সব হাত ঠেলে ঠেলে নানা টেবলির মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে টলতে টলতে বলছিল, নো-নো-নো-নট ইউ, ডগস।

প্রথম দেখাটা এভাবে হবে, ভাবতে পারা যায়নি। স্থির পলকহীন আমি তাকিয়েই আছি। আমার চোখে পাতা পড়ছে না।

কিন্তু কে জানত, আমার জন্যে দারুণ রকমের আরো একটা চমক অপেক্ষা করছিল। প্রায় উড়তে উড়তে আর টলতে টলতে শমিতা এক সময় আমার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়াল ঠিকই, তবে স্থিরভাবে নয়। তার পা-মাথা এবং গোটা শরীরটা টলছিল; চোখ আরক্ত; মুখ থেকে হুইস্কির গন্ধ বেরিয়ে আসছে। শমিতা ঢুলু ঢুলু চোখে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, হু ইউ? নেভার সিন বিফোর।

হে মহান ভারতীয় জনগণ, আমার মতো একটি লোক, যে মনুষ্যজাতির যাবতীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে সে পর্যন্ত হকচকিয়ে গেল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে অবশ্য আমি আমার মধ্যে ফিরে এলাম। বললাম, এ স্ট্রেঞ্জার

তাই মনে হচ্ছে। বলেই একুট চুপ করে থাকল শমিতা। তারপর আচমকা আমার একটা হাত ধরে বলল, কাম অন–

অবাক হয়েই জিগ্যেস করলাম, কোথায়?

যেখানে ফ্লোর-ডান্স চলছিল সেই জায়গাটা দেখিয়ে শমিতা বলল, ওখানে। তার পরেই বার-এর সামনে যে সব মাতালেরা বসে ছিল তাদের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই কুকুরগুলোর সঙ্গে রোজ নেচে নেচে ডিসগাস্টেড হয়ে গেছি। আই ওয়ান্ট এ নিউ পার্টনার। উড ইউ জয়েন মি

হে মহান জনগণ, আমি এবার সত্যি সত্যি কাঁচাকলে পড়লাম। স্বীকারোক্তি করতে বাধা নেই, এই সব বিদেশি নাচ-ফাচ, বিদেশি কেন–কোনও রকম নৃত্য-কলাই আমি জানি না। কিন্তু শমিতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে এই সুযোগটা ছাড়া উচিত হবে না। আমার নিয়তি যেন আমাকে বলিয়ে দিল, মোস্ট গ্ল্যাডলি-

শমিতা আমার হাত ধরেই ছিল। জোরে টান দিয়ে আরেকবার বলল, কাম অন

নিশির ডাকের মতো অদৃশ্য কোনও আকর্ষণ ধাক্কা মারতে মারতে আমাকে শমিতার পিছু পিছু ডান্সিং ফ্লোরে ঠেলে নিয়ে চলল।

পিছন থেকে অনেকগুলো মাতালের জড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। তারা আমারই উদ্দেশ্যে চেঁচাচ্ছে, চিয়ার ইউ লাকি সোয়াইন! অর্থাৎ শমিতা আমাকে নাচের পার্টনার নির্বাচন করায় ওরা অভিনন্দন জানাচ্ছে।

যাই হোক, নাচের জায়গায় এসে আমার গা দিয়ে গলগল করে ঘাম ছুটতে লাগল। বুঝতে পারছি অনভ্যস্ত পা নাচের তালে তালে সঠিক স্টেপ ফেলতে পারছে না। একমাত্র বাঁচোয়া, এখানে কেউ সাদা চোখে নেই। আমার ভুল কেউ ধরতে পারবে না। আশেপাশে যারা নাচছে, ফ্লোর ডান্সে নেহাত আনাড়ি হলেও, বুঝতে পারছি তাদের স্টেপিংও ঠিক হচ্ছে না। এমনকী আমার পার্টনারও এলোমেলো পা ফেলে যাচ্ছে। আসলে নাচবার মতো অবস্থাই নয় শমিতার। এক হাত দিয়ে আমার এটা হাত ধরে, আরেকটা হাতে আমার পিঠটা সাপের মতো বেষ্টন করে সে দুলছিল। ফ্লোর ডান্সের নিয়ম অনুযায়ী আমার একটা হাতও শমিতার কোমরের পাশ দিয়ে শমিতার পিঠটাকে বেড় দিয়ে রেখেছে।

হে মহান জনগণ, এবার আপনাদের কাছে আমার দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিটি করব। নাচের তালে তালে মাখনের স্তূপের মতো শমিতার বিশাল উরু আমার উরুতে বার বার ঠেকে যাচ্ছে। তার ব্রা-টাইপের পাতলা ব্লাউজের ভেতর দিয়ে রুপোর বাটির মতো গোল উদ্ধত বুক দেখতে পাচ্ছিলাম। পৃথিবীর দুর্লভতম, ফলের মতো সে-দুটো আমার বুকে চেপে বসে আছে। শমিতার শরীর থেকে, চুল থেকে অত্যন্ত উগ্র একটা গন্ধ উঠে এসে আমার নাকের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।

হে মহান জনগণ, আমি মদ্যপান করি, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লোক ঠকাই। তবু একটা ব্যাপারে গ্যারান্টি দিতে পারি–আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট ব্রহ্মচারী; মেয়েমানুষের ব্যাপারে আমার ঝামেলা নেই। তামা-তুলসী ছুঁয়ে ও বিষয়ে আমি শপথবাক্য উচ্চারণ করতে পারি।

ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের লাইফে আগে আর কোনও মেয়ে এভাবে উরুতে উরু ঠেকিয়ে কিংবা বুকে বুক চেপে ধরে আমাকে নাচায়নি। কোনও মেয়েকে আমি এভাবে কখনও জড়িয়ে থাকিনি। অবশ্য লতিকা যেদিন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল সেদিন তাকে জাপ্টে ধরে রেললাইনের বাইরে টেনে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা ছিল আলাদা ব্যাপার। তখন বাঁচানোটাই ছিল বড় কথা, একমাত্র উদ্দেশ্য। কোনও যুবতীর দারুণ লোভনীয় শরীর যে বুকের মধ্যে ধরে আছি–এ কথাটা একবারও মনে হয়নি।

কিন্তু এই মুহূর্তে শমিতার দৃঢ় অথচ কোমল বুকে যখন আমার পাঁজরাকে বিদ্ধ করছে সেই সময় মনে হতে লাগল আমি শালা আর বাঁচব না। হে মহান জনগণ, আজ একটি ফোঁটাও মদ্যপান করিনি তবু মনে হচ্ছে তিন বোতল র হুইস্কি টেনেছি। আমার দম আটকে আসছে। আমি মরে যাব, নির্ঘাৎ মরে যাব।

কতক্ষণ নেচেছিলাম, মনে নেই। এক সময় ক্লান্ত নেশাগ্রস্ত শমিতা ওধারের একটা চেয়ারে গিয়ে নিজের শরীরটাকে ছুঁড়ে দিল। আমিও খুব হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কী করব, বুঝতে পারছি না। আমি কি শমিতার কাছে গিয়ে বসব, না এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওকে লক্ষ্য করতে থাকব?

হঠাৎ জড়ানো গলায় শমিতা ডেকে উঠল, ইউকাম হিয়া–

আবার যখন সুযোগ পাওয়া গেছে, দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। আমি তক্ষুনি শমিতার মুখোমুখি অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।

শমিতা এবার বলল, ইউ হ্যাভ ডান্সড ওয়েল। কনগ্রাচুলেসন্স

থ্যাঙ্কস্।

ড্রিংক চলবে?

আমি মদ্য পান করব, আর শমিতা চুপচাপ শান্তশিষ্ট সুবোধ বালিকাটি হয়ে তাই দেখে যাবে–এটা নিশ্চয়ই হবে না। দুজনের জন্যেই নির্ঘাত ও ড্রিংকের অর্ডার দেবে। কিন্তু আগেই ও বেশ কয়েক পেগ পাকস্থলীতে চালান করে বসে আছে। শমিতার যা অবস্থা তাতে আর ড্রিংক করা ঠিক নয়। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই একটা বয়কে ডেকে সে দুজনের মতো হুইস্কি দিতে বলল।

দুমিনিটের মধ্যে ড্রিংক এসে গেল। আলুতো করে একটা চুমুক দিয়ে শমিতা বলল, বললেন না তো, আমার কম্প্যানি কী রকম লাগল

বললাম, হেভেনলি—

ফ্ল্যাটারি।

নো। ইটস ট্রু।

থ্যাঙ্কস। তখন বলেছিলেন আপনি এখানে স্ট্রেঞ্জার

আপনার মনে আছে?

আট পেগ হুইস্কি খাবার পর আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বারো পেগের আগে আমার মেমারি বিট্রে করে না। আপনার সঙ্গে যা-যা কথা হয়েছে, সব আমার মনে আছে। শমিতা হাসল।

প্রত্যুত্তরে আমিও হাসলাম। কিন্তু কিছু বললাম না।

শমিতা এবার বলল, ইন ফ্যাক্ট, আপনাকে আজই প্রথম দেখলাম। আপনার সঙ্গে আের দেখা হবে কি

আপনি চাইলেই হবে।

ঢুলু ঢুলু আরক্ত চোখে আমাকে দেখতে দেখতে শমিতা বলল, আমি চাইলে অনেক কিছু হয়, তাই না?

শমিতা ঠিক কী ইঙ্গিত করল বুঝতে পারছি না। খুব সতর্কভাবে বললাম, আমার সেই রকম ধারণা।

তাহলে কাল আবার এখানে আসবেন?

আসব।

যদি পরশু আসতে বলি?

পরশুও আসব।

যদি রোজ আসতে বলি?

রোজই আসব।

আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল শমিতা। হাসতে হাসতে টেবলের ওপর দিয়ে অনেকখানি ঝুঁকে চাপা জড়ানো গলায় বলেছিল, ইউ আর ফিনি; আপনি মরেছেন–

শমিতার এবারের ইঙ্গিতটা বুঝলাম। বললাম, আপনার হাতে মরাটাও প্লেজার।

চোখের পাতা নেশায় প্রায় জুড়ে যাচ্ছিল শমিতার। প্রাণপণে চোখ দুটো মেলে রেখে সে বলল, রিয়ালি!

রিয়ালি।

আপনি তো ফাইন কথা বলেন।

এতে আমার কোনও কৃত্বি নেই। আপনার কম্প্যানিতে যে ম্যাজিক আছে তারই গুণে–

দুজনেরই গেলাস ফাঁকা হয়ে এসেছিল। শমিতা আবার হুইস্কির অর্ডার দিয়ে বলল, আমার দুটো রিকোয়েস্ট রাখবেন

বললাম, গ্ল্যাডলি।

হাতের গেলাসটা দেখিয়ে শমিতা বলল, দিস ইজ নাইন্থ পেগ। টুয়েলথ পেগের পর আমি কমপ্লিটলি আউট হয়ে যাব। তখন এখানকার বার-বয় খাতা সই করাতে আসবে। আমার বারো পেগের সময় আপনার হবে ফোর্থ পেগ। দ্যাট মিনস সব মিলিয়ে হবে ষোল পেগ। আউট হয়ে গেলে তো বুঝতে পারব না; আপনি কাইন্ডলি দেখবেন ওরা বেশি লিখিয়ে নেয় কিনা

দেখব।

বুঝতে পারছিলাম, শমিতা এখানকার নিয়মিত কাস্টমার, নগদ পয়সা দিয়ে সে মদ্যপান করে না। তার হিসেবে খাতা আছে; প্রতিদিন ড্রিংকের পর তাকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়। উইক-এন্ডে বা মাসের শেষে শমিতা পেমেন্ট করে দেয়।

শমিতা আবার বলল, আউট হবার পর আমি যেখানে সেখানে পড়ে থাকি। তখন আমায় বাড়িতে যে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারে; মাঝে-মধ্যে নিয়ে যায়ও। আই ডোন্ট মাইন্ড স্লিপিং উইথ এ ম্যান। আমার থার্ড ক্লাস প্যানপেনে মরালিটি নেই। বাট আই কান্ট স্লীপ উইথ ডগস। বার-এর ওদিকটা দেখিয়ে সে বলল, ওই যে ওখানে যারা বসে আছে-মোস্ট অফ দেম আর ডগস। এনি ওয়ে, আমি আউট হয়ে গেলে প্লিজ আমাকে আমার বাড়ি একটু পৌঁছে দেবেন। বাইরে পার্কিং জোনে আমার একটা ফিয়েট গাড়ি আছে। তার নাম্বার হল ডকু-বি এম থ্রি ফোর ফাইভ সিক্স। অ্যাড্রেস বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। বলেই রাস্তার নম্বরটা জানিয়ে দিল।

এসবের কিছুই দরকার ছিল না। গাড়ির নম্বরটা চার্লি আগেই আমাকে জানিয়ে দিয়েছে; আর ওদের বাড়িতে তো আমি নিজেই গেছি। চুপচাপ সব শুনে বললাম, নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব।

থ্যাঙ্কস। ইউ আর রিয়ালি এ জেন্টলম্যান।

বারো পেগ খাবার পর সত্যি সত্যি আউট হয়ে গেল শমিতা। তার চোখ নেশায় পুরোপুরি বুজে গেছে। ঘাড় এলিয়ে পড়েছে; হাত দুটো চেয়ারের হাতার ওপর দিয়ে ঝুলছে ঠিক এই সময় একটা বার-বয় অ্যাকাউন্টের খাতা সই করাতে এল। চট করে খাতাটা চেক করে নিলাম। নাঃ, সঠিক হিসাব অর্থাৎ সোল পেগই লেখা আছে। বয়টা বারকয়েক ডাকাডাকি করার পর চোখ বুজেই আঁকাবাঁকা জড়ানো অক্ষরে সই বসিয়ে দিল শমিতা।

এদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বারটা ফাঁকা হয়ে এসেছিল। ওধারে ফ্লোর ডান্সও থেমে গেছে। যে কটি মাতাল এধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, হঠাৎ তাদের মধ্যে থেকে তিন-চারজন উঠে এল। তারা প্রায় একই সঙ্গে শমিতার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে বলল, অ্যাই শমিতা, ওঠো, তোমাকে পৌঁছে দিই।

আমি তাদের একধারে ঠেলে দিয়ে বললাম, নো

হোয়াট ডু ইউ মিন? চার-পাঁচটা মাতাল প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।

এই অ্যাসাইনমেন্টটা আজ আমি পেয়েছি। আমিই পৌঁছে দেব।

শমিতা ওদের বাদ দিয়ে আজ আমার সঙ্গে নেচেছে, আমাকে হুইস্কি খাইয়েছে–এতে ওরা আদৌ খুশি না। ক্রুদ্ধ বিরক্ত চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে ওরা চলে গেল। আজ ওরা কিছু বলল না কিন্তু ওদের চাউনি-টাউনি বা অ্যাটিচুড আমার ভালো লাগল না। মনে হল পরে ওদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আছে।

পরের কথা পরে। আমি শমিতাকে টেনে দাঁড় করালাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথাটা আলগা হয়ে আমার কাঁধে ঝুলে পড়ল আর শরীরের সমস্ত ভার এসে পড়ল আমার বুকের ওপর। সেই অবস্থাতেই শমিতার গোটা শরীরটাকে নিজের শরীরের মধ্যে প্রায় লেপ্টে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। রিসেপসান কাউন্টারের কাছে আসতেই শিরিন চোখ দুটো ছুঁচলো করে হাসল। এক পলক চারদিক দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, কনগ্রাচুলেসন্স। একদিনের পক্ষে প্রগ্রেসটা বেশ ভালোই।

আমিও হাসলাম। হাসতে হাসতেই দ্রুত একবার শিরিনকে চোখ মেরে এগিয়ে গেলাম। তারপর পার্কিং জোন থেকে শমিতার গাড়িটা বার করে চৌরঙ্গীতে চলে এলাম। এখন আমিই ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। আর শমিতা আমার পাশে লক করা দরজায় হেলান দিয়ে পড়ে আছে। তার মাথাটা সামনের দিকে আলগা হয়ে ঝুলছে যেন।

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে শমিতাদের বাড়ির সামনে এসে হর্ন বাজাতেই নেপালি দারোয়ান গেট খুলে দিল। গাড়িটা ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাঁদিকের লন আর ডানদিকের টেনিস কোর্টের মাঝামাঝি নুড়ির রাস্তাটায় পার্ক করলাম।

দারোয়ানটা গেট বন্ধ করে ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে চলে এল। তাকে চিনতে পারলাম। কেননা কাল যখন মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে এসছিলাম সে-ই গেট খুলে দিয়েছিল। দারোয়ানটা বোধহয় আমাকে চিনতে পারেনি। চাপা মঙ্গোলিয়ান চোখে একপলক আমাকে দেখে নিয়ে সে বলল, আজ ভি এক নয়া আদমি–

আমি উত্তর দেবার আগে দারোয়ানটা আপন মনে বিড় বিড় করে বলে উঠল, হর রোজ রাতমে এক এক নয়া আদমি ছোটা মেমসবকে লেকে আতা।

ছোট মেমসাব নিশ্চয়ই শমিতা। বুঝতে পারছি নেশায় চুরচুর শমিতাকে প্রতি রাত্রে নতুন নতুন লোক এখানে পৌঁছে দিয়ে যায়। যাই হোক, শমিতার মা মনোবীণা সান্যালের কথা আমার মনে পড়ে গেল। এখানে যখন এসেই পড়েছি মনোবীণার সঙ্গে একবার দেখা করা যেতে পারে। ভদ্রমহিলা তাতে বুঝতে পারবেন ওঁর কাজটা সত্যি সত্যি শুরু করে দিয়েছি। দারোয়ানটাকে জিগ্যেস করলাম, বড়া মেমসাব কোঠিমে হ্যায়?

দারোয়ানটা বলল, বড়া মেমসাব, সাব কোই নেহি হ্যায়, পার্টিমে গিয়া

কখন ফিরবেন? হিন্দিতেই জিগ্যেস করলাম।

মালুম নেহি। দারোয়ানটা ডাইনে-বাঁয়ে দুধারের মাথা নাড়ল।

এবার শমিতাকে দেখিয়ে বললাম, তাহলে একে

দারোয়ানটা আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। সে বুঝিয়ে দিল দুশ্চিন্তার কিছু নেই; রোজ রাতেই শমিতা এই রকম বেহুশ অবস্থায় ফেরে; বাড়িতে বেশির ভাগ দিনই সাহেব বা মেমসাহেব থাকেন না; তাকেই ছোটা মেমহেবকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার ঘরে রেখে আসতে হয়। তবে একা তার পক্ষে এত বড় জোয়ান আওরতকে নামিয়ে তেতলায় টেনে তোলা খুবই কষ্টকর। তাই যারা শমিতাকে নিয়ে আসে সে তাদের সাহায্য চায়। তার আশা নতুন সাব অর্থাৎ আমিও মেহেরবানী করে সহায়তা করব।

বললাম, জরুর–

দুজনে ধরাধরি করে শমিতাকে তার ঘরে শুইয়ে যখন আবার নীচে লনের কাছে চলে এসেছি। সেই সময় গেটের বাইরে হর্নের শব্দ শোনা গেল। দারোয়ানটা দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিতেই একটা প্রকাণ্ড ঝকঝকে ইমপোর্টেড গাড়ি ভেতরে ঢুকে টেনিস কোর্টের ওধারে পার্ক করল।

এখানে নুড়ির রাস্তায়, টেনিস কোর্টে, সবুজ লনে–মানে চারদিকেই সুদৃশ্য পোস্টের মাথায় মার্কারি ল্যাম্প জ্বলছে। সবকিছুই সূর্যালোকের মতো উজ্জ্বল। আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। চোখে পড়ল দরজা খুলে মনোবীণা সান্যাল আর অরিন্দম সান্যাল গাড়ি থেকে নামছেন। অর্থাৎ পার্টি থেকে ফিরে এলেন। অরিন্দমের গায়ে নিখুঁত ডিনার স্যুট। তার পাশে মনোবীণাকে একটা রঙিন প্রজাপতির মতো দেখাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা আজ দারুণ সেজেছেন।

একটু পরে ওঁরা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। কেননা আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দিয়েই ওঁদের বাড়ির দিকে যেতে হবে।

অরিন্দম এবং মনোবীণা দুজনকেই বেশ টিপসি দেখাচ্ছে। দুজনেরই চোখ ফোলা ফোলা এবং ঈষৎ আরক্ত। দুজনেই অল্প অল্প টলছিলেন। অর্থাৎ হে মহান জনগণ, এঁরা যুগলে পার্টি থেকে ভালোরকম নেশাটি করে এসেছেন।

দারোয়ান আমাকে চিনতে পারেনি, কিন্তু অরিন্দম পারলেন। নেশা-জড়ানো লাচে চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, সেই ইনটেরিয়র ডেকরেটর না?

নার্ভগুলোকে বেশ স্টেডি রেখেই বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার–

এত রাত্রে কী মনে করে? ইনটেরিয়রের কিছু খোঁজখবর নিতে নাকি?

দারোয়ানটা কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি উত্তর দেবার আগেই সে জানিয়ে দিল, এ সাব ছোটা মেমসাবকো লেকে আয়া

ও, আচ্ছা। তাহলে পরোপকারের জন্যে আসা। ভেরি গুড-অরিন্দম সান্যাল আমার মুখের কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করলেন, ওয়াজ শি ড্রাংক?

কী উত্তর দিলে ভদ্রলোক খুশি হবেন বুঝতে না পেরে চোখের কোণ দিয়ে দ্রুত মনোবীণার দিকে তাকালাম। মনোবীণা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই তিনি চোখ টিপলেন। অর্থাৎ যা সত্যি তাই যেন বলি। বললামও। অরিন্দম এবার স্ত্রীর দিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে বিরক্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, প্রতিদিন তোমার মেয়ে ড্রিংক করে একেকটা লোকের ঘাড়ে চেপে বাড়ি ফিরছে। চারদিকে কীরকম স্ক্যান্ডাল রটছে জানো—

মনোবীণা খুব আস্তে আস্তে বললেন, স্ক্যান্ডালাররাও ও-রকম রটায়ই তবে

আমার মেয়ের স্ক্যান্ডাল নিয়ে তো খুব চেঁচাচ্ছ। তোমার স্ক্যান্ডলে যে ক্যালকাটার বাতাস পয়জন্ড হয়ে গেছে–সে খবরটা রাখো কি?

তোমার স্ক্যান্ডালও কম নেই।

তার জন্যে ইউইউ আর রেসপন্সিল।

স্পট ইট।

আমি চুপ করেই থাকি, কিন্তু তুমি আমাকে ঘাঁটিও না।

একটু থতিয়ে রইলেন অরিন্দম। তারপর গলার স্বর সামান্য নামিয়ে বললেন, প্রত্যেক মাসে তোমার মেয়ের জন্যে পাঁচ-ছহাজার টাকা মদের বিল দিতে হয়। আই ওন্ট পে ইট এনি মোর

রুক্ষ কর্কশ গলায় অস্বাভাবিক জোর দিয়ে মনোবীণা বললেন, ইউ মাস্ট পে। তোমার সঙ্গে সেই রকম কন্ডিসানই আছে।

আরক্ত চোখে স্ত্রীকে একবারে দেখে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন অরিন্দম।

হে মহান জনগণ, ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি মনোবীণা আর অরিন্দমের সম্পর্কটা দারুণ খারাপ। দুজনের মাঝখানে ঘৃণা-টুণা ছাড়া আর কোনও বস্তু নেই। বিবাহিত নারী-পুরুষ সম্বন্ধে আমার বলার কোনও রাইট নেই; এ বিষয়ে আমি খুবই আনাড়ি এবং অনভিজ্ঞ। তবু এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন ঘৃণা অবিশ্বাস ইত্যাদির ওপর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

মনোবীণা সান্যাল বললেন, ডোরাকে কোথায় পেলেন?

আমার মনে পড়ল শমিতার ডাকনাম ডোরা। লক্ষ্য করলাম মনোবীণার কণ্ঠস্বরে একটু আগের সেই উত্তেজনা বা রুক্ষতা নেই। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন। যাই হোক শমিতাকে কোথায় পেয়েছি জানালাম।

মনোবীণা জিগ্যেস করলেন, কী রকম মনে হচ্ছে?

বললাম, আজই তো শুরু করলাম। তবে আমি আশাবাদী।

ধন্যবাদ। মনোবীণা আর দাঁড়ালেন না; আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

এ বাড়ির তিনটি মানুষ–স্বামী, স্ত্রী এবং মেয়ে–তিনজনেই মধ্যরাতে মদ্যপান করে ফেরে। এদের ফ্যামিলি প্যাটার্নটা কেমন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবতে চেষ্টা করলাম। তারপর গেটের বাইরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে চলে গেলাম।

এখন আমার ঘড়িতে রাত দেড়টা। হঠাৎ খেয়াল হল চার পেগ হুইস্কি ছাড়া কিছুই পাকস্থলীতে পড়েনি। এত রাতে দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ সব বন্ধ হয়ে গেছে। ওদিকে চার্লিকে রান্না-বান্না করতে বারণ করে দিয়েছি। তার মানে আজকের রাতটা উপোষ দিয়েই কাটাতে হবে। হে মহান জনগণ, এ জন্যে আমার দুঃখ নেই। আপাতত সবচাইতে যা বেশি দরকার তা হল একটা ট্যাক্সি। ওটা না পেলে, এত রাত্রে যখন বাস-ট্রাম-মিনিবাস সবই বন্ধ হয়ে গেছে তখন খালি পেটে এন্টালি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে।

মিনিট তিন-চারেক হাঁটবার পর একটা ট্যাক্সি পেয়েও গেলাম।

.

এন্টালিতে আমার তেতলার সেই ছাদে পৌঁছে দেখলাম চার্লি ঘুমোয়নি। বিছানায় বসে বিড়ি ফুকছে। আমি ঢুকতেই বলল, ডিউটি শেষ হল?

বললাম, আজকের মতো।

খাওয়া হয়েছে?

না। খাবার চান্স পাইনি। বলেই তোয়ালে-ফোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। দশ বারো মিনিট বাদে ফিরে এসে দেখি আমার বিছানার একধারে ছোট টেবলের ওপর প্লেটে করে রুটি আর মাংস সাজানো রয়েছে। এ নিশ্চয়ই চার্লির কাজ। অবাক এবং খুশি হয়ে বললাম, এ সব পেলে কোথায়? রাঁধার কথা তো ছিল না।

চার্লি বলল, তোমার জন্যে কিনে এনে রেখেছি লর্ড। জানতাম যে পাল্লায় পড়েছ আজ আর খাওয়া-টাওয়া জুটবে না।

থ্যাঙ্ক ইউ চার্লি, থ্যাঙ্ক ইউ–আমি রুটি-মাংসের প্লেটটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

.

০৮.

সকালে উঠে আগের দিনের মতোই চার্লিকে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে শমিতার ওপর নজর রাখবার জন্যে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পাঠিয়ে দিলাম এবং তার গতিবিধি লক্ষ্য করে দশটার পর অফিসে ফোন করতে বললাম।

চার্লি চলে গেলে খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো দ্রুত একবার দেখে শেভ-টেভ করে নিলাম। হে মহান জনগণ, গোটা খবর কাগজটা আমার পড়তে ইচ্ছা করে না; আসলে অত ধৈর্যই নেই। মোটামুটি দু-চারটে নিউজ যা আমার প্রফেসানে কাজে লাগতে পারে জানতে পারলেই আমি খুশি। যাই হোক তারপর স্নান-টান সেরে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে নীচে নামতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল তেতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে ডরোথি দাঁড়িয়ে আছে। তক্ষুনি আমি ঘুরে দাঁড়লাম; ওর পাল্লায় পড়লে আর দেখতে হবে না; এই দিনের বেলাতেই এমন সব কাণ্ড করে বসবে যাতে আমার একটা বড় রকমের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু কপালটা খারাপ; ডরোথি আমাকে ঠিক দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, হেয় রাজীব। তারপরেই একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে টপকে আমার কাছে চলে এল। অগত্যা আমাকে দাঁড়াতেই হল। মনে মনে ভাবলাম আজ আমার বারোটা বাজল।

ডরোথি একটা দারুণ ভলাপচুয়াস সেক্সি মেয়ে। সে বলল, এ কী, আমাকে দেখে তুমি পালাচ্ছ যে!

থতমত খেয়ে বললাম, না না, পালাব কেন?

পালাচ্ছ আর বলছ পালাব কেন?

বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি দেখতে পাইনি।

ডরোথি বলল, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। একটু থেমে বলল, অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হল। যখনই ছাদে যাই দেখি তোমার ঘরের তালা বন্ধ। খুব বিজি নাকি?

এক্সট্রিমলি–আমি তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করলাম।

গুড লাক। তোমাকে পেয়ে ভালোই হল। অফিস থেকে আজ ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছি। হোল ডে তোমাকে আর ছাড়ছি না ডার্লিং

আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। বললাম, ডরোথি, আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে। সেটা করতেই হবে।

ডরোথি আমার কাঁধে একটা হাত তুলে দিল। টের পাচ্ছি তার বুকের তীক্ষ্ণ ছুঁচলো অংশটা ছুরির ফলার মতো আমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে যাচ্ছে।

ঘাড় বাঁকিয়ে চোখের তারা নাচাতে নাচাতে সে বলল, কোনও কথাই শুনছি না। তোমাকে নিয়ে আজ হোল ডে প্রোগ্রাম করব।

ডরোথির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে বললাম, এক কাজ করো; প্লিজ এখন আমাকে ছেড়ে দাও। সাড়ে তিনটের সময় চৌরঙ্গীর ইন্ডিয়ান কাফেতে ফার্স্ট কেবিনটার ওয়েট কোরো; ওখানে তোমার সঙ্গে মিট করব।

প্রমিস?

প্রমিস।

আমি কিছু বুঝবার আগেই প্রকাশ্য দিবালোকে এই খোলা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ আমাকে জড়িয়ে ধরে গোলে এবং ঠোঁটে একসঙ্গে আট দশটা চুমু খেল ডরোথি। তারপর ছেড়ে দিয়ে নাকের ডগায় আলতো টোকা মেরে বলল, মুখটা মুছে নিও, লিপস্টিকের দাগ লেগে গেছে।

ডরোথির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে অফিসে যখন পৌঁছুলাম দশটা বেজে গেছে। আমার আগেই লতিকা এসে গিয়েছিল। সে কাচের  দেয়ালের ওপারে বসে আছে।

এয়ার কুলারটা চালানোই ছিল; নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসতে বসতে লতিকাকে লক্ষ্য করলাম। সে ঠিক হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে নেই; মোটা খাতার ওপর ঝুঁকে কী হিসেব-টিসেব দেখছে। ডাকলাম, অ্যাই লতিকা-লতিকা বলল, প্লিজ দুমিনিট-ঠিক দুমিনিট পরেই মুখ তুলে বলো, বলো–আজ বিজনেসের খবর কী?

এই তো সবে অফিস খুলল; কোনও খবর নেই।

একটু চুপচাপ। লতিকা আবার হিসেবের খাতায় ঝুঁকল। আমি এবার বললাম, কী হল? আবার হিসেব নিয়ে পড়লে যে?

কী করব?

কই জিগ্যেস করলে না তো কাল অফিস ছুটির পর আমি কোথায় গিয়েছিলাম?

জিগ্যেস করে কী করব। জানি তুমি নিজেই বলবে।

আমার ওপর দারুণ বিশ্বাস দেখছি।

খাতাটা বন্ধ করে এবার সোজা আমার দিকে তাকাল লতিকা। বলল, বিশ্বাস করব না বলছ?

বললাম, আমি তো অনেক কিছু লুকিয়ে রাখতে পারি।

লতিকা একটু হাসল। তারপর বলল, কোথায় গিয়েছিলে বলো

কাল হোটেলে গিয়ে শমিতার সঙ্গে দেখা করার পর থেকে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সব বলে গেলাম; একটা কথাও গোপন করলাম না।

সমস্ত শুনে পলকের জন্যে লতিকার মুখে ছায়া পড়ল। পরক্ষণেই হেসে হেসে সে বলল, কাল রাতটা তাহলে বেশ মজাতেই কাটিয়েছ।

বলছ!

লতিকা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই পার্সোনাল ডিপার্টমেন্ট থেকে রীতেশ আমার চেম্বারে এল। জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার?

রীতেশ বলল, দাদা, বাইরের এটা লাইন আছে। এক ভদ্রলোক আমাদের হেল্প চান। কিন্তু তার কিছু কন্ডিসান আছে। কী উত্তর দেব, বুঝতে পারছি না। লাইনটা আপনি ধরবেন?

দাও।

রীতেশ ফিরে গিয়ে আমাকে কানেকসান দিয়ে দিল। ফোনটা কানে লাগিয়ে বললাম, কে বলছেন?

ওধার থেকে ভারী মোটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার নাম মণিমোহন মল্লিক আপনাদের ওপর আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজের দায়িত্ব দিতে চাই।

ধন্যবাদ স্যার। বলুন আমাদের কী করতে হবে।

কাজটা গোপনীয়; খুব সাবধানে করতে হবে। আপনাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি কি?

পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে ফোন করে লোকে প্রথমে এই প্রশ্নটাই করে থাকে এবং এক্ষেত্রে আমরা যা-যা বলে থাকি অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষা করাই আমাদের প্রফেসানের একমাত্র ক্যাপিটাল–ঠিক তাই বললাম।

মণিমোহন মল্লিক বললেন, ভেরি গুড। আমি ঠিক এরকমটাই চাইছিলাম। যাই হোক কাজটার জন্যে আপনার কী রকম রেমুনারেসন নেবেন?

কাজটা কী, না জেনে কী করে বলি–

তা অবশ্য ঠিক। আপনি এক কাজ করুন, আমার এখানে চলে আসুন। ফোনে তো সব কথা হয় না। সামনা-সামনি বসে কাজের ব্যাপারটা আলোচনা করে নেওয়া যাবে, সেই সঙ্গে রেমুনারেসনটাও।

কিন্তু আমরা তো কোথাও যাই না মিস্টার মল্লিক। ক্লায়েন্টনরা আমাদের অফিসে এসেই তাদের কাজ-টাজ বুঝিয়ে দিয়ে যান।

আমার যেতে কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু কাল থেকে ব্লাড প্রেসারটা গোলমাল করছে। ডাক্তার কদিনের রেস্ট নিতে বলেছে। প্লিজ চলে আসুন

যাওয়াটা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। কারণ আমাদের যা প্রফেসান তাতে প্রতি মুহূর্তে ফাঁদে পড়ার ভয়। আমি আবার বললাম, কিন্তু

কিন্তু-টিন্তু নয়, আমি আপনাকে আধ ঘণ্টার মধ্যে এক্সপেক্ট করে রইলাম। আমার ঠিকানা পার্ক অ্যাভেনিউতে-মণিমোহন তাদরে রাস্তার একটা নম্বর বললেন এবং সেইসঙ্গে তাঁর সুইট নম্বরটাও।

হে মহান জনগণ, মহা ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি। একটু চুপ করে থেকে বললাম, কোনওভাবেই কি ফোনে আপনার কাজের বিষয়টা বুঝিয়ে দিতে পারেন না?

না। কারণ আপনাকে কিছু মেটিরিয়াল দিতে হবে। সেগুলো হাতে না পেলে কিছুতেই কাজটা শুরু করতে পারবেন না। প্লিজ আর না বলবেন না; আমি ধরেই নিলাম আপনি আসছেন। মণিমোহন লাইনটা কেটে দিলেন।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে লতিকার দিকে ফিরতেই দেখি উৎসুকভাবে সে তাকিয়ে আছে। বলল, কী ব্যাপার?

মণিমোহনের কথা বলে জিগ্যেস করলাম, কী করা যায় বলো তো। যাব?

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। যা করবার ভেবে-চিন্তে করবে।

খানিকটা সময় দারুণ এক অস্থিরতার মধ্যে কেটে গেল। তারপর কখন যে আমাদের অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরেছি, আর কখন পার্ক অ্যাভেনিউতে চলে এসেছি, মনে নেই।

মণিমোহনের দেওয়া নম্বরটা খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগল না। এটা একটা নতুন মাল্টি-স্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে লিফটে করে টেন্থ ফ্লোরের নির্দিষ্ট স্যুইটের সামনে এসে কলিংবেল টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে ভেসে এল, দরজা ভেজানো আছে; ঠেললেই খুলে যাবে। চেনা গলা। কিছুক্ষণ আগে টেলিফোনে এই কণ্ঠস্বরটিই আমি শুনেছি। দরজা ঠেলে ভেতের ঢুকতেই সেই মণিমোহনের গলা আবার শোনা গেল, কাইন্ডলি সামনের প্যাসেজটা দিয়ে রাইট টার্ন নিন, তারপর লেট, দেন এগেন রাইট–তারপর যে ঘরটা পাবেন সেখানকার পর্দা সরালেই আমাকে দেখতে পাবেন।

হে মহান জনগণ, গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময়–টেরিফিক রকমের মিস্টিরিয়াস।

যাই হোক লেফট-রাইট করতে করতে এগুতে লাগলাম। যেতে যেতে দুধারে মোট তিনখানা ঘর পড়ল। একটা ঘর দেখে মন হল ফোটো ডেভলপ করার ডার্ক রুম। বাকি দুটোতে খোলা দরজা দিয়ে উঁচু অনেকগুলো স্টিলের ব্ল্যাক দেখতে পেলাম। র‍্যাকগুলোতে অগণিত ফাইল সাজানো রয়েছে। শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ঘরখানার কাছে এসে পর্দা সরাতেই ঘরের মাঝখানের উঁচু টেবলটায় ক্রস করা দুটো পা চোখে পড়ল। আর সেই পায়ের ফাঁক দিয়ে টেবলটার পিছনে ইজিচেয়ারে মধ্যবয়সি একটি লোককে আধশোয়া অবস্থায় দেখতে পেলাম। নিশ্চয়ই ইনি মণিমোহন মল্লিক।

মণিমোহন আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন। আস্তে আস্তে পা দুটো নামিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, পার্সোনাল অফিস থেকে আসছেন নিশ্চয়ই?

আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় কাত করলাম।

আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমিই মণিমোহন, বসুন–

মণিমোহনের ইজিচেয়ারটার ডানপাশেই সোফা-টোফা সাজানো রয়েছে। আমি একটা সোফায় বসে দ্রুত এক পলক তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলাম। চুয়ান্ন-পঞ্চান্নর মতো বয়স। গোল মুখে শক্ত চোয়াল, থ্যাবড়া থুতনি, মোটা নাক। রোমশ ভুরুর তলায় মাঝারি চোখ। সাধারণ বাঙালিদের মতো হাইট, ব্যাকব্রাশ করা চুল। তবে শরীরে যথেষ্ট অনাবশ্যক মেদ রয়েছে। এটা প্রচুর মদ্যপানজনিত।

মণিমোহনের দিকে তাকালে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হল তার মুখের অস্বাভাবিক লাল রঙ। মনে হয় শরীরের সব রক্ত সেখানে উঠে এসেছে। হয়তো সত্যিই তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।

ইজিচেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন মণিমোহন। তারপর বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম। কিছু মনে করবেন না।

না না, মনে করব কেন? আমি হাসলাম।

আপনাকে দশ মিনিটের বেশি আটকাব না। কাজের কথা শুরু করা যাক–হে মহান জনগণ, কাজ যা করব তা তো আমি জানিই, তবু অ্যাডভান্সের টাকাটা বাগাতে হলে কিছু ভড়ং-টংও তো করতে হয়; নইলে পার্টিকে ফাসাব কী করে? মুখের ভাবখানা দারুণ সিরিয়াস করে তাকিয়ে রইলাম।

মণিমোহন মল্লিক বলতে লাগলেন, কাজটা হল একটি মেয়েকে সর্বক্ষণ আপনাকে ফলো করতে হবে। আর

তার কথার মাঝখানেই বলে উঠলাম, মেয়েটা কে?

কলকাতা শহরে কয়েক লক্ষ মেয়ে আছে। নাম বললেই কি চিনতে পারবেন? কথাটা ঠিকই বলেছেন মণিমোহন। সুতরাং আমাকে চুপ করে থাকতে হল। মণিমোহন আবার বললেন, আপনাকে সব ডাটা দিয়ে দেব। তার আগে আপনার কাছে কী কাজ চাই শুনে নিন।

ঠিক আছে। বলুন

মেয়েটা একটা দুর্দান্ত ড্রাঙ্কার্ড। এ ব্যাপারে পুরুষদের সে কান কেটে দিতে পারে। হোটেলে, ক্লাবে সব জায়গায় সে ঘুরে বেড়ায়। মাতাল অবস্থায় ওর জামা কাপড়ের ঠিক থাকে না; এর কিছু নুড ছবি আমাকে তুলে দিতে হবে। এছাড়া অনেকে তার এই মাতলামির সুযোগ নেয়; বাড়িতে পৌঁছে দেবার নাম করে নিজের বেডরুমে নিয়ে আসে। এই বেডরুমের কিছু হট ছবিও আমার দরকার।

আমি আপনাদের এই রাজীব সরকার মনুষ্য জাতির যাবতীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকি। নানা টাইপের লোক অদ্ভুত অদ্ভুত অনুরোধ নিয়ে আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ন্যুড ছবি কিংবা বেডরুমের রগরগে ঝাঝালো দৃশ্যের শট নেবার দায়িত্ব কেউ আমাকে দেয়নি। আমি ঘামতে লাগলাম। টের পাচ্ছি আমার জামা, গেঞ্জি এবং কোমরের ট্রাউজারটা ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছে।

মণিমোহন মল্লিকের গলা আবার শোনা গেল, এর জন্যে আপনাকে পনেরো হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। এবং পাঁচ হাজার অ্যাডভান্স। এ সম্বন্ধে আপনার কিছু বলবার আছে?

হঠাৎ আমি আমার নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। আরে এত ঘামছি কেন? এত নার্ভাসই বা কেন হচ্ছি? আমার কাজ তো অ্যাডভান্স নেওয়া পর্যন্ত। মন থেকে নার্ভাসনেসটাকে ঝেড়ে ফেলে বললাম, না না, ঠিক আছে।

জানতাম, টাকার এই ফিগারটা আপনার অপছন্দ হবে না। সে যাক, আপনার ক্যামেরা আছে?

না।

আমি আপনাকে ক্যামেরা দেব। আর একটা কথা–এই ফোটোগুলো দুমাসের মধ্যে চাই।

ফোটো যখন তুলবই না; দুমাসই বা কী, আর দুঘন্টাই বা কী। আমার কাছে সব সমান। বললাম, তাই পাবেন।

মণিমোহন বললেন, এবার তাহলে কাজটা সারা যাক। যে মেয়েটির ফোটো আপনাকে তুলতে হবে তার সঙ্গে কিন্তু আলাপ করিয়ে দিতে পারব না।

তাকে চিনব কী কবে?

তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

উঁচু টেবলটার ড্রয়ার খুলে একটা ফোটো বার করে টেবলের ওপর রাখলেন মণিমোহন। সেটার দিকে চোখ পড়তেই ফোর ফর্টি ভোল্টের ইলেকট্রিসিটি আমার নার্ভের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। ফোটোটা শমিতার।

মণিমোহনের গলা আবার শোনা গেল, এরা থাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। তবে একে ধরবার জন্যে সেখানে যাবার দরকার নেই। কলকাতার পশ হোটেল আর বড় বড় ক্লাবগুলোতেই ঘুরলেই এর দেখা পাওয়া যাবে। আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।

মণিমোহন মল্লিক উঠে ভেতরের অন্য একটা ঘরে চলে গেলেন। এক মিনিটের মধ্যেই হাতে একটা ক্যামেরা ঝুলিয়ে আবার ফিরে এলেন। ক্যামেরাটা টেবিলের ওপর রেখে সেই ইজিচেয়ারটায় বসতে বসতে বললেন, তাহলে আজ থেকেই কাজটা শুরু করে দিন। ক্যামেরা আর ফোটোটা নিয়ে যান। ও হ্যাঁ, অ্যাডভান্সের টাকাটাই তো দেওয়া হয়নি। সামনের বড় টেবলটার ড্রয়ার খুলে একগাদা একশো টাকার নোট বার করে গুণে গুণে পঞ্চাশটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, এই যে

টাকা, ক্যামেরা এবং ফোটো নিয়ে আমি উঠে পড়লাম।

মণিমোহন আরেকবার আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, সময়ের কথাটা খেয়াল আছে তো? দুমাসের মধ্যে কিন্তু ফোটোগুলো আমার চাই।

বললাম, আমার মনে আছে। একটা কথা জিগ্যেস করব?

অবশ্যই।

ওইসব ফোটো দিয়ে আপনি কী করবেন?

এর উত্তর আমি দেব না। আশা করি আপনার আর কোনও প্রশ্নই নেই। উইশ ইউ এভরি সাকসেস।

লোকটা আমাকে ভদ্রভাবে চলেই যেতে বলছে। বললাম, ধন্যবাদ।

হে মহান জনগণ, রাস্তায় বেরিয়ে দুরমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? মনোবীণা সান্যাল তার মেয়ে অর্থাৎ শমিতাকে শোধরাবার দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন আমার হাতে। এদিকে মল্লিক মশাই আমাকে দিয়েই শমিতার নুড পিকচার আর কিছু বেডরুম সিন তোলাতে চান। হে মহান জনগণ, বুঝতে পারছেন আমি একটা সাঙ্ঘাতিক কাঁচাকলে পড়ে গেছি।

.

০৯.

লতিকা উদ্গ্রীব হয়ে বলে ছিল। আমি অফিসে ফিরতেই জিগ্যেস করল, যেখানে গিয়েছিলে কী হল সেখানে?

মণিমোহনের ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে বসতে বসতে বললাম, টেরিফিক ঝামেলার ব্যাপার–

মানে?

আগে অ্যাডভান্সের টাকাটা ধরো। তারপর বলছি। পকেট থেকে সেই পাঁচ হাজার টাকা বার করে লতিকাকে দিতে দিতে বললাম, আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা এবার ক্লোজ করে দিতে হবে।

এত তাড়াতাড়ি। ছমাসও তো হয়নি ওটা খোলা হয়েছে। বলতে বলতে ক্যামেরাটার দিকে চোখ পড়ল শমিতার, আরে এটা কোথায় পেলে।

যার কাছে গিয়েছিলাম সে দিয়েছে।

অ্যাডভান্সের টাকা দিয়েছে; তার ওপর ক্যামেরাটাও দিল!

আরো একটা জিনিস দিয়েছে।

কী?

একটা ফোটো-পকেট থেকে শমিতার ফোটোটা বের করে কাচের  দেয়ালের সেই গোল ফুটোর ভেতর দিয়ে লতিকার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।

ফোটোটা দেখে খানিকক্ষণ আগে আমার মতোই চমকে উঠল লতিকা। তার গলার ভেতর থেকে আধফোঁটা গোঙানির মতো শব্দ বেরিয়ে এল, সেই মেয়েটা না, মানে শমিতা?

মনোবীণা সান্যাল শমিতার যে ফোটোটা দিয়েছিলে সেটা আগেই তাকে দেখিয়েছিলাম। আমি ঘাড় হেলিয়ে দিয়ে বললাম, ইয়েস ম্যাডাম।

লতিকা বলল, তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখান থেকেই ওর ফোটো নিয়ে আসছ। ব্যাপারটা কী বলো তো?

এ বোধহয় হোল ওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে আছে। সে যাক গে, যে কাজের জন্যে গিয়েছিলাম এবার সেটা শোনো।

বলো–লতিকা উৎসুক মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

মণিমোহন মল্লিক আমাকে কী কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, বলে গেলাম। শুনে লতিকার চোখের তারা কপালে উঠে গেল। বলল, এ সব তুমি করবে।

একটি সুন্দর যুবতী মেয়ের নুড ছবি তোলা–কাজটা যাই বলো দারুণ এক্সাইটিং। আমার খুব একটা ইচ্ছে নেই। তবে তুমি যদি পারমিসান দাও–মানে অনেক দিন এক ধরনের কাজ করে যাচ্ছি। মনোটনি লাগছে; এটা করলে একটু ডাইভার্সিফিকেশন হত। বলে হাসতে লাগলাম।

অসভ্যতা করবে না। দিস ইজ অফুলি ব্যাড। ওই মণিমোহন লোকটার উদ্দেশ্য কী বলো তো?

নিশ্চয়ই মহৎ কিছু নয়। তাহলে এই কাজটায় তোমার আপত্তি আছে?

হ্যাঁ।

জানতাম। সেই জন্যই পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টের গণেশ ওল্টাবার কথাটা আগেই বলেছিলাম। পাঁচ হাজার টাকা অ্যাডভান্স, তার ওপর একটা ক্যামেরা ফাউ। ব্যাপারটা মন্দ হল না, কী বলো?

আমার কথা শেষ হল কি হল না, আচমকা টেলিফোনটা বেজে উঠল। ওটা তুলে নিয়ে কানে লাগাতেই চার্লির গলা ভেসে এল, লর্ড, আমি বলছি

মাঝখানে খানিকটা সময় এমন এক্সাইটমেন্টের মধ্যে কেটেছে যে চার্লির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। যাই হোক জিগ্যেস করলাম, তুমি এখন কোথায়?

সাদার্ন অ্যাভেনিউতে। একটা প্রাইভেট ক্লাবের সামনে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার সেই তিনি পনেরো মিনিট আগে ক্লাবটার ভেতর ঢুকেছেন। মনে হচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন। চট করে চলে এসো–চার্লি জায়গাটা বলে দিল।

ফোনটা ক্রেডেলে নামিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নাঃ, শমিতার হাত থেকে বোধহয় মুক্তি নেই। অলৌকিক কোনও শক্তি প্রচণ্ড নিয়তির মতো যেন চারদিক থেকে আমাকে টানতে শুরু করেছে।

লতিকা অবাক হয়ে গেল। বলল, এ কী! উঠলে যে! কোথায় যাচ্ছ?

একটা প্রাইভেট ক্লাবে। শমিতা সেখানে রয়েছে।

শমিতা!

হ্যাঁ-আমি কাচের  দেয়ালটার দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বললাম, ভয় নেই; ওইসব ফোটো তুলব না।

তবে যাচ্ছ কেন?

ওর ব্যাপারটা একটু জানতে চাই। মেয়েটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। এ রকম ক্যারেক্টার আগে কখনও দেখিনি।

লক্ষ্য করলাম লতিকার মুখের ওপর একটা ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, তোমাকে ফোন করে কে শমিতার খবর দিল?

চার্লি—

লতিকা চার্লিকে চেনে। সে জিগ্যেস করল, ওকে বুঝি শমিতার পেছনে লাগিয়ে রেখেছ?

শমিতার সঙ্গে চার্লিকে যে জুড়ে দিয়েছি–এ কথাটা লতিকাকে বলা হয়নি। তার মানে এই নয় যে ওটা গোপন করতে চেয়েছি। লতিকার কাছে ঢাকা-ঢাকির কোনও ব্যাপারই নেই আমার। একটু থতিয়ে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ। শমিতাকে স্টাডি করতে হলে অলওয়েজ ওর পিছনে লেগে থাকতে হয়।

আমার সেই সময় কোথায়? তাই চার্লিকে লাগিয়ে দিয়েছি। একটু থেমে আবার বলাম, এ ব্যাপারটা তোমাকে জানানো হয়নি, প্লিজ কিছু মনে কোরো না।

লতিকা হাসল, তোমার কাছে আমি এমনই গ্রেটফুল যে কখনও কোনও কারণেই কিছু মনে করব না।

দেখো ওসব কৃতজ্ঞতার-টুতজ্ঞতার কথা বললে আমি ভীষণ ঘাবড়ে যাই।

ঠিক আছে, তুমি আর দেরি কোরো না; বেরিয়ে পড়ো।

 ৪. প্রাইভেট ক্লাব

১০.

সাদার্ন অ্যাভেনিউর সেই প্রাইভেট ক্লাবটা খুঁজে বার করতে অসুবিধা হল না। চার্লি রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ট্যাক্সি থেকে নামতেই দৌড়ে এল। ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে তাকে জিগ্যেস করলাম, আজকের এক্সপিরিয়েন্স কী?

চার্লি যা জানাল তা এইরকম। কালকের মতো আজ আর তাকে চরকি কলে ঘুরতে হয়নি। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে সোজা এখানেই চলে এসেছে শমিতা। চার্লিও তার ছায়া হয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। কাল খাওয়া-দাওয়া কিছু হয়নি; আজ ফাঁক বুঝে ফুটপাতের একটা ছাতুওয়ালার কাছ থেকে ছাতু-ফাতু কিনে খেয়েছে। তবে স্নানটা হয়নি; সেই কারণে চোখ-টোখ এবং মাথার চাঁদি জ্বালা করছে। এক দমে কথাগুলো বলে হিপ পকেট থেকে একগাদা নোট আর রেজগি বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, নাও। তুমি যে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিল তার এই ব্যালান্স–বললাম, ওটা ফেরত দিতে হবে না; তোমার কাছেই রাখো।

অল রাইট-নোট-টোট আবার হিপ পকেটে পুরতে পুরতে চার্লি বলল, ডিউটি হ্যান্ডওভার করে দিচ্ছি। তুমি ক্লাবে ঢুকে যাও লর্ড; আমি ওফ হয়ে যাচ্ছি।

ঠিক আছে বলতে বলতেই ডরোথির কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটা আমার জন্যে চৌরঙ্গীর একটা রেস্তোরাঁয় বিকেলে বসে থাকবে। আচমকা আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসে গেল। চার্লিকে বললাম, তোমাকে আরেকটা ডিউটি দিয়ে দিচ্ছি। অ্যান্ড ইটস এ ড্যাম গুড থিং

কীসের ডিউটি?

আমার হয়ে তোমাকে এক জায়গায় প্রক্সি মারতে হবে। ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে বলো তো

চৌরঙ্গীর যে রেস্তোরাঁয় ডরোথির অপেক্ষা করার কথা তার নাম, কেবিনের নম্বর এবং সময়টা জানিয়ে বললাম, একজন আমার জন্যে ওখানে ওয়েট করবে। তুমি গিয়ে ওকে একটু ম্যানেজ করে নিও-ইচ্ছা করেই ডরোথির নামটা আর বললাম না।

চার্লি জিগ্যেস করল, খাওয়াবে-টাওয়াবে তো?

তুমি যা খেতে চাও

চার্লি দারুণ খুশি হয়ে চলে গেল। আর আমি পায়ে পায়ে ক্লাবটার গেটের দিকে চলে এলাম। ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছি, ঝকঝকে উর্দি পরা দারোয়ান দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। বলল, সাব, ইয়ে প্রাইভেট ক্লাব। আপ কেয়া মেম্বার হ্যায়?

বুঝলাম ক্লাবের মেম্বারশিপ না পেলে এখানে প্রবেশ নিষেধ। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসে গেল, চোখ-কান বুজে তাকে জানালাম, আমার এখানে আসার কথা; ক্লাবের একজন মেম্বার আসতে বলেছে। আমি তার গেস্ট।

দারোয়ানটা এক পলক আমার পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত জরিপ করে নিল। তারপর জিগ্যেস করল, আপ কিসকা গেস্ট?

শমিতা বোস মেমসাবকে। বলেই টের পেলাম, ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছি। কেননা দারোয়ানটা যদি আমাকে শমিতার কাছে নিয়ে যায় আর শমিতা যদি আমাকে চিনতে না পারে, অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? গোটা ব্যাপারটা ভেবে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। ম্যাক্সিমাম আমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে।

দারোয়ানটা আমার সঙ্গে গেল না। দারুণ উদারভাবে বলল, আন্দার যাইয়ে? মেমসাব সুইমিং পুলকা পাশ হ্যায়–

ভেতরে ঢুকেই নুড়ির রাস্তা। তার দুধারে সবুজ লন। লনের পর তিনতলা বিশাল ক্লাব বিল্ডিং। বিল্ডিং-এ ঢুকতেই বাঁদিকে সুইমিং পুল চোখে পড়ল। কাচের  মতো স্বচ্ছ জলে ক’টি মেয়ে সাঁতার কাটছিল। মনে হচ্ছিল যেন কটা লাল-নীল মাছ। পুলটার পারে চারদিক ঘিরে মোজেক করা চত্বর। সেখানে নানারকম ফ্যাশানেবল চেয়ারে বা সোফায় ইন্ডিয়ান এবং নন-ইন্ডিয়ান বেশ কিছু মহিলা আর পুরুষ বসে আছে।

আমি জলের ধারে নীচু ডাইভিং বোর্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পুলের মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, হ্যাল্লো

আমি তাকাতেই শমিতাকে দেখতে পেলাম। জলের ওপরে একটা হাত তুলে সে আবার বলল, ওয়েট-বলেই জল কেটে-কেটে পুলটার ধারে এসে অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্যান্ড বেয়ে ওপরে উঠে এল।

হে মহান জনগণ, শমিতার দিকে তাকিয়ে আমার নাক দিয়ে ধোঁয়া ছুটতে লাগল। তার পরনে যে সুইমিং কস্টিউমটা রয়েছে, সেটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নাভির ছইঞ্চির নীচে বিকিনি ধরনের একটা জাঙ্গিয়া; বুকে কালো ব্রা। একটা কালো ফিতে দিয়ে ব্রা আর জাঙ্গিয়াটা সামনের দিকে আটকানো।

একটা চেয়ার দেখিয়ে শমিতা বলল, প্লিজ, দশ মিনিট বসুন; আমি আসছি। দশ মিনিট লাগল না; তার আগেই শমিতা ফিরে এল। এখন তার পরণে হট প্যান্ট আর শার্ট; পায়ে স্ট্রাপে-বাঁধা জুতো।

হে মহান জনগণ, আগেও বলেছি মেয়ে-টেয়ে নিয়ে এ পর্যন্ত অর্থাৎ লাইফের ছত্রিশ-পঁইত্রিশটা বছর মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এই মেয়েটা অর্থাৎ শমিতাকে দু-বার মোটে দেখলাম। আমি বলতে পারি এ রকম প্রচণ্ড আকর্ষণীয় ফিগার আগে আর কখনও দেখিনি। এটা আমার ফ্র্যাঙ্ক কনফেসান-অকপট স্বীকারোক্তি। ওকে দেখলেই নার্ভের ভেতর কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। শমিতা আমার মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসল। বলল, আপনাকে এখানে দেখব, ভাবতেই পারিনি; ইটস এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ।

শমিতা এখন ড্রিংক করে টিপসি বা বেঁহুশ মাতাল হয়ে নেই। এখন সে আশ্চর্য স্বাভাবিক আর স্বচ্ছন্দ। তাকে দারুণ ভালো লাগছিল। যাই হোক তারই নাম করে যে এখানে ঢুকতে পেরেছি সেটা আর বলালম না। যা বললাম তা এই রকম, এখানে একজনের খোঁজে এসেছিলাম। তার সঙ্গে দেখা হল না। তার বদলে পেয়ে গেলাম আপনাকে। সারপ্রাইজটা আমার কাছেও কম প্লেজান্ট না। একটু চুপ করে থেকে আবার বললাম, জানেন, আজ সকালবেলা উঠবার পর আপনার কথাই ফাস্ট মনে পড়ে গিয়েছিল।

রিয়ালি?

সুয়্যার

ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। শমিতা হাসল, নিশ্চয়ই ভেবেছিলাম এ রকম থার্ড ক্লাস মেয়ে আগে আর কখনও দ্যাখেননি।

নো–আমি মাথা নাড়লাম, ভেবেছি আপনার সঙ্গে আবার কখন দেখা হবে, দেখা হলে চিনতে পারবেন কিনা–

কাল বারো পেগ খাবার আগেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বারো পেগের পর দেখা হলে ডেফিনিটলি চিনতে পারতাম না। এখন বলুন কী খাবেন? হুইস্কি, রাম, জিন-এনিথিং ইজ অ্যাভেলেল হিয়ার। বলতে বলতে আচমকা উঠে পড়ল, না, এখানে নয়।

আমি একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম। শমিতা আবার বলল, অ্যাবাউট থ্রি আওয়ার্স আমি এখানে আছি। বোরিং লাগছে। চলুন, অন্য কোথাও গিয়ে ড্রিংক করব।

আমাকে সঙ্গে করে ক্লাব বিল্ডিং-এর বাইরে লনের পাশের পার্কিং জোনে চলে এল শমিতা। এখানে তার ফিয়েট গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। চাবি ঘুরিয়ে ডানদিকের দরজাটা খুলে ড্রাইভারের সিটে বসতে বসতে বাঁদিকের দরজা খুলে দিল সে। বলল, উঠে পড়ুন

আমি উঠতেই শমিতা স্টার্ট দিল। একটু পর আমরা সাদার্ন অ্যাভেনিউতে চলে এলাম। উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে শমিতা বলল, আপনার সঙ্গে কাল আলাপ হয়েছে, রাত্রে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন–অথচ আপনার নামটাই জানি না।

আমার যা প্রফেসান তাতে নিজের নাম বলার অসুবিধা আছে। কেউ জিগ্যেস করলে যা হোক একটা কিছু বলে দিই। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের অজান্তে দুম করে আমার আসল নামটাই বলে ফেললাম।

শমিতা বলল, আমার নাম শমিতা বসু।

ওর নাম বলার দরকার ছিল না। কিন্তু শমিতা কী করে জানবে তার নামটা আমি আগেই জেনে গেছি।

এবার বলল, আপনার এখন কোনও জরুরি কাজ-টাজ নেই তো?

মনে মনে বললাম, তোমার পিছনে লেগে থাকাটাই আমার একমাত্র জরুরি কাজ। মুখে অবশ্য বললাম, না। আই অ্যাম টোটালি ফ্রি।

শমিতার মুখ দেখে মনে হল সে খুশি হয়েছে। বলল, ফাইন! তাহলে অনেকক্ষণ আপনার সঙ্গ পাওয়া যাবে।

উইথ প্লেজার।

নানা রাস্তা ঘুরে ঘুরে কখন যে আমরা পার্ক সার্কাসে চলে এসেছিলাম, খেয়াল নেই। আচমকা একটা বিরাট অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিল শমিতা। বলল, ড্রিংকের আগে চলুন একটু আড্ডা দিয়ে যাই। সুতরাং, হে মহান জনগণ, আমাকে নামতেই হল। শমিতাও নেমে পড়েছিল। গাড়িটা লক করে আমাকে নিয়ে সে লিফট বক্সে পুরে ফেলল। দুমিনিটের মধ্যে হাউইয়ের মতো ফিফটিন্থ ফ্লোরে উঠে এসে একটা সুইটের সামনে আমরা দাঁড়ালাম। শমিতা কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিল একটা নন বেঙ্গলি যুবক। চেহারা দেখে গুজরাটিই মনে হয়-উচ্ছ্বাসের গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাল্লো

শমিতাও বলল, হ্যাল্লো

এবার ছোকরা এক কাণ্ডই করে বসল। এক হাতে শমিতার মসৃণ সুগোল গ্রীবা বেষ্টন করে হে মহান জনগণ, এই প্রকাশ্য দিবালোকে এবং আমারই চোখের সামনে চকাত করে তার কাঁধে একটা চুমু খেয়ে বলল, আফটার এ লং টাইম ডার্লিং

চোকরার আদরে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করল না শমিতা। এটা যেন খুবই একটা নর্মাল ব্যাপার। আস্তে আস্তে গলার থেকে ছোকরার হাতটা নামিয়ে দিয়ে সে বলল, অনেকদিন কোথায়? লাস্ট উইকেও তো এসেছিলাম।

তোমাকে এক দিন না দেখলে মনে হয় এক বছর দেখিনি।

ইউ সোয়াইন, প্লিজ স্টপ ইওর ফ্ল্যাটারি।

এবার আমার দিকে চোখ পড়ল ছোকরার। জিগ্যেস করল, ইনি?

শমিতা বলল, রাজীব সরকার-আমার নতুন বন্ধু। ছোকরাকে দেখিয়ে আমাকে বলল, আর এ হল হরিশ দেশাই-ওল্ড ফ্রেন্ড।

হরিশ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল; কাজেই আমাকেও বাড়াতে হল।

তারপর একই সঙ্গে দুজনে বলে উঠলাম, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।

শমিতা এবার হরিশকে বলল, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?

হরিশ ব্যস্তভাবে বলল, সরি! এসো

ভেতরে যেতে যেতে শমিতা জিগ্যেস করল, তুমি ছাড়া আর কে কে আছে?

সুধাময়, অমিত আর রবিন্দর সিং

ওনলি?

এই বিকেলে এর বেশি লোক হয় নাকি। ভিড় বাড়বে সন্ধের পর।

ওদের সঙ্গে ভেতরের একটা ঘরে এসে দেখলাম গোল টেবল ঘিরে তিনটে যুবক রানিং ফ্ল্যান্স খেলছে। চারপাশে এই রকম আরো কটা টেবল সাজানো হয়েছে। তবে সেখানে কেউ নেই। দেখেশুনে মনে হল এটা একটা পার্মানেন্ট জুয়ার আড্ডা। শমিতা কি জুয়াড়িদের সঙ্গে ভিড়ল, ভাবতে পারছিলাম না।

যাই হোক, ওই যুবক তিনটি শমিতাকে দেখে তাস-ফাস ফেলে হরিশের মতোই চেঁচিয়ে উঠল। এবং শমিতা কেন বোজ আসে না, এই নিয়ে খানিকক্ষণ হইচই করল। পরে তাদের উচ্ছ্বাস কমলে যথারীতি আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। আলাপের হর হরিশ শমিতাকে বলল, কী, খেলবে নাকি?

শমিতা বল, সিওর—

হরিশ এবার আমার দিকে ফিরল, আপনি?

হে মহান জনগণ, আমি মানুষের উইকনেসের যাবতীয় সুযোগ নিয়ে থাকি।

সেটাই আমার প্রফেসান কিন্তু জুয়া-ফুয়ার ব্যাপারে আমার মাথায় ঢোকে না। বললাম, আজ আমি দেখব।

ও-কে। ওরা খেলতে শুরু করল। আর আমি, মানে আপনাদের এই রাজীব সরকার সাক্ষীগোপাল হয়ে দেখতে লাগলাম।

খেলার মধ্যে একসময় হরিশ বলল, ড্রিংক দিতে বলব?

শমিতা ঘাড় কাত করল, নো। গ্যাম্বলিং-এর সময় গ্যাম্বলিং, ড্রিংকের সময় ড্রিংক। দুটোকে একসঙ্গে আমি ব্লেন্ড করি না।

ভেরি নাইস ফিলজফি।

ঘণ্টা দেড়েক খেলার পর শখানেক টাকা হেরে দুম করে উঠে দাঁড়াল শমিতা!

আমাকে বলল, চলুন—

হরিশ বলল, কী হল!

বোরিং লাগছে। আচ্ছা চলি। বাই-শমিতা হাত নাড়ল।

লিফটে করে নীচে এসে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এতক্ষণে সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তার দুধারে কর্পোরেশনের টিউবলাইটগুলো জ্বলে উঠেছে।

মসৃণ গতিতে গাড়িটা ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছিল শমিতা। দুধার থেকে বাড়ি-ঘর দোকানপাটের, নানা দৃশ্যপট মুহূর্তে মুহূর্তে সরে যাচ্ছিল। আমি কিন্তু সে-সব, দেখছিলাম না। অন্যমনস্কর মতো শমিতার কথাই ভাবছিলাম। সেই বিকেলে থেকে ঘণ্টা দুয়েক তার সঙ্গে সঙ্গে আছি। এর মধ্যে দুজায়গায় গেছে সে। কিন্তু কোথাও বেশিক্ষণ থাকেনি। আসলে কোথায় যেন তার মধ্যে দারুণ একটা অস্থিরতা রয়েছে।

গাড়িটা সুর্কালার রোডে এলে শমিতা হঠাৎ বলল, কী ভাবছেন?

চমকে উঠলাম। চমকটা থিতিয়ে গেলে বললাম, কিছু না তো।

শমিতা হাসল, নিশ্চয়ই ভাবছিলেন। ভাবছিলেন আচ্ছা পাল্লায় পড়া গেছে।

আমি হাসলাম, কোনও উত্তর দিলাম না।

শমিতা এবার বলল, যাক গে, এখন কোথায় যাবেন বলুন—

কোথায় বলতে?

দুটো হোটেলে আমি ধারে ড্রিংক করতে পারি। আপনি যেখানে বলবেন নিয়ে যাব। বলেই হোটেল দুটোর নাম করল। দুটোই ফাইভ স্টার হোটেল। বললাম, আমার কোনও চয়েস নাই। যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব।

একটু ভেবে শমিতা বলল, কালকের হোটেলটাতেই চলুন

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চৌরঙ্গীর সেই বিশাল মাল্টি-স্টোরিড হোটেলটায় চলে এলাম। তারপর সেভেন্থ ফ্লোরের বল রুম-কাম-বার-এ।

চারদিকে লোক গিজ গিজ করছিল। ওধারে ফ্লোর ডান্স চলছে। শমিতাকে দেখে সব টেবল থেকেই একজন দুজন করে জড়ানা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হোয়-য়–অন ডার্লিং

শমিতা হাত নাড়ল। অর্থাৎ কারো টেবলেই যাবে না। আমাকে নিয়ে এক কোণে একটা ফাঁকা টেবলে গিয়ে বসল। আমরা বসতে না বসতেই একটা ওয়েটার দৌড়ে এল। শমিতা বলল, দো হুইস্কি

ওয়েটার চলে গেল। আমি আন্দাজ করে নিলাম, শমিতা এখন সমানে হুইস্কি টেনে যাবে। যতক্ষণ না সে আউট হয়ে মদ্যপানটা চলবেই।

কাল এবং আজ এই দুদিন শমিতাকে দেখছি। লক্ষ্য করেছি দুটো ব্যাপারে তার দারুণ অ্যাডিকশান। এক নম্বর হল ড্রিংক, দুনম্বর জুয়া। আরো কত ব্যাপারে সে জড়িয়ে আছে, কে জানে। মনোবীণা সান্যল আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন সেটা পালন করতে হলে গ্যাম্বলিং এবং ড্রিংক থেকে শমিতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, কিন্তু সেটা দু-একদিনের কাজ নয়। হে মহান জনগণ, এই সব অ্যাডিকশন শমিতার রক্তের ভিতর ঢুকে গেছে। একটা কথা মনে হতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালাম। শমিতা অবাক হয়ে বলল, কী হল? বললাম, একটু বসুন, আমি আসছি।

আমি সোজা বার-এর কাউন্টারে চলে এলাম। বার-বয়রা এখন থেকেই খদ্দেরদের জন্যে ড্রিংক-ট্রিংক নিয়ে যাচ্ছে। এক ধারে গাবদা-গোবদা চেহারার বার-ম্যানেজার দাঁড়িয়ে ছিল; সে কাছে এগিয়ে এল, ইয়েস স্যার

আমার আসার উদ্দেশ্যটা তাকে জানিয়ে দিলাম। বললাম, এখন থেকে শমিতাকে যে ড্রিংক সার্ভ করা হবে তাতে যেন অর্ধেক জল মেশানো থাকে।

বার-ম্যানেজার বলল, কিন্তু স্যার, এটা তো ডিজ-অনেস্টি জানাজানি হলে আমাদের রেপুটেশন নষ্ট হবে।

জানাজানি হবে না। আসলে কথাটা কী জানেন, শমিতার লিভারটাকে বাঁচানো দরকার। এ ব্যাপারে প্লিজ আমার সঙ্গে একটু কো-অপারেট করুন। আমিও আপনার সঙ্গে কো-অপারেট করব। ম্যানেজারকে শমিতার লিভারের কথা বললাম। কিন্তু আদতে আমি যে ধীরে ধীরে তাকে অ্যাডিকশান থেকে সরিয়ে নেবার প্ল্যান করেছি তা বলা গেল না। কারণ সেটা বলার রিস্ক আছে। শমিতার মতো ক্লায়েন্ট চলে গেলে বিজনেসের ক্ষতি। কে আর জেনেশুনে ক্ষতিটা চায়।

ম্যানেজার বলল, আপনার কে-অপারেশনের ব্যাপারটা তো বুঝলাম না।

হাফ জল মেশালেও বিলটা আপনি ফুলই পাবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু আপনাকে আগে আর কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। মিস শমিতা বসু আপনার কেউ হন নাকি?

দুসেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, তা বলতে পারেন। আচ্ছা চলি। ড্রিংকে জল দেবার কথা মনে রাখবেন।

শমিতার কাছে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরেই হুইস্কি এসে গেল। এলোমেলো কথা বলতে বলতে খেতে লাগলাম। এর মধ্যে যে সব নতুন নতুন কাস্টমার আসছে তারা সবাই শমিতার দিকে হাত তুলে বলে যাচ্ছে, হ্যালো–

শমিতাও হাত তুলছে, হ্যালো

দশ পেগ হয়ে যাবার পর হঠাৎ যেন খেয়াল হল শমিতার। বলল, এটা কী হল বলুন তো?

কোনটা? আমি সোজা শমিতার চোখের দিকে তাকালাম।

দশ পেগ খাওয়া হয়ে গেল কিন্তু একটুও টিপসি লাগছে না! কী হুইস্কি সার্ভ করছে! একটুও কিক নেই! আপনি কোনও কিক পাচ্ছেন?

হে মহান জনগণ, দশ পেগ মদ্যপান করলেও আসলে শমিতা খেয়েছে পাঁচ পেগ; বাকিটা টালা ট্যাঙ্কের বিশুদ্ধ ফিলটারড় ওয়াটার। সে যা মাতাল তাতে পাঁচ পেগে কী করে কিক পাবে?

শালা ম্যানেজার মওকা বুঝে আমার হুইস্কিতেও জল মিশিয়ে দিয়েছে। আমিও মাছের জল খাওয়ার মতো ড্রিংক করতে পারি। পাঁচ পেগ হুইস্কি আমার পেটে কিঞ্চিৎ নিম্নচাপ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু সে কথা তো শমিতাকে বলা যাবে না। বললাম, হ্যাঁ, দারুণ কিক পাচ্ছি

এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল শমিতা, ওয়েটার–

ওয়েটার দৌড়ে এল। আমার ভয় হল, হুইস্কির ব্যাপার নিয়ে শমিতা চেঁচামেচি করবে। কিন্তু কিছুই করল না সে। শুধু বলল, জলদি বিল লাও–বিলে সই করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে নিয়ে হোটেলের পার্কিং জোনে চলে এল শমিতা। তাই সেই ফিয়েট গাড়িটায় আমাকে তুলে নিজে উঠল। তারপর বাইরে বেরিয়ে বলল, হোটেলে বোরিং লাগছিল। চলুন, আপনাকে একটু ওপের এয়ারে ড্রিংক করাব।

হে মহান জনগণ, ওপেন-এয়ারের বাংলা যেন কী? ও হা—মুক্তাঙ্গন। খোলা আকাশের নীচে মুক্তাঙ্গনে শমিতা আমাকে ড্রিংক করাতে চাইছে। দেখাই যাক আমার নাকে বঁড়শি লাগিয়ে শমিতা কোথায় কতদুরে টেনে নিয়ে যায়। ভবানীপুর এসে একটা গলির ভিতর গাড়ি ঢোকাল শমিতা। তারপর সোজা যেখানে গিয়ে থামল সেটা একটা বাংলা মদের দোকান। আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে একটু হেসে বলল, স্কচে কিছুই হল না; একটু কান্ট্রি লিকার খেয়ে দেখা যাক। বলেই জোরে হর্ন বাজাল।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, এ শহরের যাবতীয় খুঁড়িখানা-দিশি বা বিলিতি–সবই চেনে শমিতা–হর্নের শব্দে দোকান থেকে একটা ছোকরা ছুটে এল। তার হাতে দাম দিয়ে এক বোতল কালীমার্কা বাংলা মদ আনতে বলল শমিতা।

কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বোতলটি নিয়ে আমরা গঙ্গার পাড়ে চলে এলাম। ওপেন এয়ারে। মুক্ত অসীম আকাশের তলায় দুজনে মুখোমুখি বসে বোতলটি যখন শেষ করলাম শমিতা পুরোপুরি আউট হয়ে গেছে। আমার মাথার ভেতরেও একটানা জোরালো কনসার্ট বেজে যাচ্ছে। তবে শমিতার মতো বেহুশ হয়ে যাইনি; চেতনার একটু আধটু তলানি তখনও পড়ে আছে।

শমিতা আউট হয়ে গেলেও শুয়ে পড়েনি; বসেই ছিল। তার ঘাড় ভেঙে মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। হাতদুটো আলগা হয়ে শরীর থেকে যেন ঝুলছে।

এই ফাঁকা নির্জন জায়গায় আর বসে থাকার মানে হয় না। শমিতাকে টেনে তুলে কোনওরকমে গাড়িতে নিয়ে এলাম। ড্রাইভ করার মতো ওর অবস্থা নয়। আমিই গাড়িটা চালিয়ে ইডেন গার্ডেন, আকাশবাণী ভবন, নেতাজী স্ট্যাচু ইত্যাদির পাশ দিয়ে যখন রেড রোডে এসে পড়েছি শমিতা অতি কষ্টে মাথাটা তুলে জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

নেশায় শমিতার চোখ বুজে গিয়েছিল। সেটা আধাআধি খুলে আরক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। তারপর বলল, আমি বাড়ি যাব না।

দারুণ নেশার মধ্যেও চমকে উঠলাম, তা হলে কোথায় যাবেন?

এনি হোয়ার। হেভেন অর হেল–যেখানে ইচ্ছা নিয়ে চলুন।

রেড রোড় বাঁয়ে ফেলে আমরা পার্ক স্ট্রিটের কাছে চলে এসেছিলাম। আমার ইচ্ছা ক্যামাক স্ট্রিট, সাকুলার রোড হয়ে গুরুসদয় রোডে পড়ব; সেখানে থেকে ডাইনে ঘুরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। শমিতা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ইউ সোয়াইন, বললাম না বাড়ি যাব না। গাড়ি ঘেরাও

কলকাতার রাস্তাঘাটের ম্যাপ ভুলে যায়নি শমিতা। যাই হোক স্কচ এবং বাংলা পাকস্থলীতে চালান করবার পরও এই রকম সেটুকু এখনও আমার আছে যে এত রাত্তিরে খামখেয়ালি মাতাল যুবতী মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাকে তার নিজের ঠিকানাতেই জমা করে দেওয়া দরকার। হে মহান জনগণ, চৌরঙ্গী পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকিয়ে দিলাম।

এবার শমিতা আমার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টিয়ারিংটা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। আর সমান চিৎকার করতে লাগ, ইউ বাস্টার্ড, সান অফ এ বিচ–আমার কথা তোমার কানে ঢুকছে না!

এত রাত্রে রাস্তা প্রায় ফাঁকাই; গাড়ি-টাড়ি তেমন নেই। কিন্তু যেভাবে শমিতা স্টিয়ারিংটার ওপর হামলা করছে তাতে গাড়িটা ফুটপাতে উঠে ল্যাম্পপোস্ট-টোস্টে ধাক্কা মেরে অ্যাকসিডেন্ট বাধিয়ে দিতে পারে।

অগত্যা কী আর করা, গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলাম এবং এত রাত্তিরে কোথায় আর যাব; সোজা এন্টালিতে নিজের সেই আস্তানায় ফিরে এলাম।

হে মহান জনগণ, মেয়ে ফুসলে কিডন্যাপ করার চার্জে না পড়ে যাই। আপনারা কিন্তু সাক্ষী হয়ে রইলেন।

যাই হোক গাড়িটা লক করে শমিতাকে ধরে ধরে তেতলার ছাদে উঠতে উঠতে হাতঘড়িটা একবার দেখে নিলাম, এখন সাড়ে বারোটা বাজে। এই মধ্যরাতে গোট বাড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে।

ছাদে আসতে চোখে পড়ল, দু-ঘরেই লাইট জ্বলছে; আর মেঝেতে বসে দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে ঢুলেছে চার্লি। চার্লির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। তার মাথায় এবং হাতে দুটো বড় ব্যান্ডেজ।

পায়ের শব্দে চার্লি চোখ মেলে তাকাল। আমার সঙ্গে শমিতাকে দেখে মেঝেতে হাতের চাপ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়াল। তার ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজগুলো দেখিয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার এ অবস্থা হল কী করে?

চার্লি বলল, আমার কথা পরে শুনো। লর্ড, তুমি সত্যিই লর্ড। চোখের কোণ দিয়ে শমিতাকে দেখাতে দেখাতে গলার স্বরটা ঝপ করে অনেকখানি খাদে নামিয়ে দিল, কালকে ফাস্ট দেখলে আর আজই বাড়িতে এনে তুললে! ইউ আর রিয়ালি গ্রেট। কী করে ম্যানেজ করলে বলো তো?

শমিতাকে আমার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললাম, সব বলব। তার আগে চট করে আমি একটা ফোন করে আসছি। তুমি একে একটু দেখো।

আমি বেরিয়ে গেলাম। মনোবীণা সান্যালকে একটা ফোন করতে হবে। আমাদের বাড়ির প্রায় উল্টোদিকে একটা পেট্রোল পাম্প রয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেটা খোলা থাকে। সেখান থেকে পয়সা দিলে ফোন করা যায়।

সোজা পেট্রোল পাম্পে এসে ডায়াল করতেই মনোবীণাকে পাওয়া গেল। আমার অবশ্য ভয় ছিল এত রাত্রে তাকে পাব কিনা। সে যাক, ওধার থেকে তার জড়ানো বিরক্ত কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হু দা ডেভিল ইউ আর?

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মহিলা যথেষ্ট পরিমাণে মদ্যপান করেছেন। তার কণ্ঠস্বর রীতিমতো জড়ানো। বললাম, আমি রাজীব-রাজীব সরকার।

এ রকম নাম আমি কখনও শুনিনি।

প্রায় দশ মিনিট নিজের সম্বন্ধে এবং তিনি যে শমিতার দায়দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছেন সে সম্বন্ধে বলবার পর মনোবীণা একটু একটু চিনতে পারলেন যেন। বেশ রুক্ষ স্বরেই বললেন, তা এত রাতে কী?

তাকে জানালাম, শমিতাকে আমার এখানে আনতে হয়েছে। কেননা সে বাড়ি যেতে চাইছে না।

মনোবীণা বললেন, সো হোয়াট? আপনাকে রেসপনসিবিলিটি দেওয়া হয়েছে। যা ভালো বুঝবেন করবেন—

না, ব্যাপারটা আপনাকে জানানো দরকার। তাই

কিছু দরকার নেই। মাঝরাত্রে এভাবে আর যেন বিরক্ত করবেন না। লাইনটা ঝড়াৎ করে কেটে দিলেন মনোবীণা।

আমি ফিরে এসে দেখলাম, শমিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই বিকেল থেকে হুইস্কি আর বাংলা মদ ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি তার। খাবার জন্যে তাকে অনেক ডাকাডাকি করলাম কিন্তু শমিতার ঘুম ভাঙানো গেল না।

সুতরাং চার্লিকে আর আমি পাশের ঘরে খেয়ে সেখানেই পাশাপাশি বিছানা পেতে নিলাম। আর তখনই চাাকে জিগ্যেস করলাম, তোমার মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ কেন? অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিলে নাকি?

চার্লি খাড়া উঠে বসল, দারুণ উত্তেজিতভাবে বলল, ইট ইজ ফর ইউ লর্ড।

কেন, আমি কী করলাম?

চৌরঙ্গীর রেস্তোরাঁর কাছে প্রক্সি দিতে পাঠিয়েছিলে! যদি জানতাম ওখানে ডরোথি বসে আছে, ও গড, আমি কিছুতেই যেতাম না; জানো তোমার বদলে আমি গেছি শুনেই প্লেট কাপ ছুঁড়তে আরম্ভ করল। তারপর ফর্ক-টক দিয়ে অ্যাটাক করল। সেই জন্যেই আমার এই হাল।

শুনে দারুণ হাসতে লাগলাম। হাসির তোড়ে আমার শরীর বেঁকে যেতে লাগল। চার্লির ব্যাপারটা খুবই দুঃখের, সেই সঙ্গে ভীষণ মজারও।

চার্লি এক পলক আমাকে দেখল। তারপর ভয়ানক রেগে গিয়ে আমার দিকে পিছন ফিরে আবার শুয়ে পড়ল। বলল, ডোন্ট লাফ লর্ড ইটস নট ফান; লাইফ অ্যান্ড ডেথের কোশ্চেন। শি ইজ এ টাইগ্রেস-ইয়েস, এ টাইগ্রেস।

আমি হাসতেই লাগলাম।

.

১১.

পরের দিন বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ ফেলতেই লক্ষ্য করলাম যে ঘরে আমি শুই, সেখানে নেই। আরো দেখলাম আমার দেড় ফুট দূরে ময়লা চিটচিটে বিছানায় কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে চার্লি।

একটু ভাবতেই কাল রাতের সব ঘটনা মনে পড়ে গেল। ধড়মড় করে উঠে প্রথমে গেলাম পাশের ঘরে। নিজের বিছানার দিকে তাকাতেই আচমকা ফোর ফর্টি ভোল্টের বিদ্যুৎ আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে গেল যেন। শমিতা ডানদিকে ঈষৎ হেলে শুয়ে আছে। তার হট প্যান্টের কটি বোতাম খোলা, নাভির অনেকটা জায়গা উন্মুক্ত। শার্ট এবং ব্রার হুক আলগা করে দেবার জন্যে সোনার দ্বীপের মতো তার দুটি বুক বেরিয়ে এসেছে। ঘুমের ঘোরেই হয়তো ব্রা-টা খুলে ফেলেছে শমিতা।

মণিমোহন মল্লিকের কথা আমার মনে পড়ে গেল। শমিতার ন্যুড ছবি তুলে দেবার দায়িত্ব সে আমাকে দিয়েছে। হে মহান জনগণ, আমার পেক্ষ সেটা কি সম্ভব? আফটার অল আমার শরীরে ভদ্দরলোকের কিঞ্চিৎ রক্ত তো রয়েছে। তাড়াতাড়ি একটা পাতলা চাদরে শমিতার শরীর ঢেকে দিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

আধ ঘণ্টা বাদে ফিরে এসে দেখি চার্লি কখন যেন উঠে পড়েছে। বিছানা-টিছানা গুটিয়ে এখন সে চা বানাচ্ছে। ও ঘরে শমিতাও উঠে বিছানায় বসে অবাক হয়ে চারদিক দেখছিল। আমি সোজা তার কাছে চলে এলাম। বললাম, গুড মর্নিং। কাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছে?

আমার কথায় উত্তর না দিয়ে শমিতা জিগ্যেস করল, কাল রাত্তিরে কি আমি এই ঘরে ঘুমিয়েছি?

হ্যাঁ।

এখানে আমি এলাম কী করে?

হে মহান জনগণ, আমার শিরদাঁড়ার ভোর দিয়ে ঠান্ডা বরফ নেমে গেল। বলে কী মেয়েটা? শেষটায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে না তো? বললাম, আপনার মনে পড়ছে না?

ভুরু কুঁচকে কী ভাবল শমিতা। একটু একটু করে কাল রাত্রের ব্যাপারটা যেন মনে পড়ল তার। বলল, আমি বাড়ি যেতে চাইনি; তাই আপনি এখানে নিয়ে এসেছেন–তাই না?

আমি নিজেকে খুবই স্টেড়ি রাখতে চাইছি। বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ

আচ্ছা এটা কি আপনার বাড়ি?

হ্যাঁ।

কে কে থাকে এখানে?

আমি আর আমার এক বন্ধু চার্লি।

একটু চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিল শমিতা। তারপর বলল, কাল রাত্তিরে আমি কি একাই এ-ঘরে শুয়েছিলাম?

অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ—

আপনি কোথায় শুয়েছিলেন?

চার্লি আর আমি ওই পাশের ঘরটায় শুয়েছিলাম।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে শমিতা বলল, স্ট্রেঞ্জ! বাড়িতে নিয়ে এলেও কোনওরকম চান্স নিলেন না?

শমিতা আমাকে রেপ কেসে-টেসে ফাঁসিয়ে দিতে চায় নাকি? আমার কানের ডগা গরম হয়ে উঠল। টের পেতে লাগলাম, ব্লাড প্রেসারটা একটা বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছে গেছে। বললাম, ইউ মে টেক মি ফর এ জেন্টলম্যান–আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দ্রুত একবার দেখে নিয়ে বলল, হয়তো তাই। তবু জেন্টলম্যান বা ব্রুট–আমাকে এ অবস্থায় পেলে কেউ ছাড়ত না। সবাই তো বলে আমার মধ্যে দারুণ সেক্স আছে; আমি দুর্দান্ত অ্যাট্রাক্টিভ; আমার ফিগার দেখলে নাকি স্ট্রোক হয়ে যায়। আপনি কী বলেন?

উত্তর দিলাম না।

শমিতা আমার দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, আপনি তো আমার প্রায়-নুড শরীর দেখেছেন; তবু ভদ্রলোক হয়ে ছিলেন?

চমকে বললাম, কে বললে আমি দেখেছি?

সকালে উঠে আমি নিজের দিকে একবার তাকিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমার গা একটা চাদর দিয়ে টাকা ছিল। মনে আছে কাল চাদর গায়ে দিয়ে শুইনি। এটা কে দিয়েছে? আপনি?

হ্যাঁ। মানে

চাদরটা দেবার সময় আমার ফিগার আপনি দ্যাখেননি?

সাঁতার-না-জানা মানুষের মতো গভীর জলে ডুবতে ডুবতে কী বলতে যাচ্ছিলাম, চার্লি এসে বাঁচিয়ে দিল। সে আমাদের জন্যে চা নিয়ে এসেছে।

শমিতাও আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না। চা খেয়ে বাথরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বলল, এবার বাড়ি যাব।

বললাম, এখনই যাবেন!

হ্যাঁ। সকালেই আমি স্নান করি। বাড়ি গিয়ে স্নানটা করতে হবে

দুম করে নিজের অজান্তেই বলে বসলাম, এখানেও তো জল আছে

শমিতা বলল, কিন্তু শাওয়ার নেই। শাওয়ার ছাড়া আমার আবার স্নান করে আরাম হয় না।

হে জনগণ, পৈতৃক প্রপার্টি হিসেবে পাওয়া এই চল্লিশ টাকার ভাড়া বাড়িতে শাওয়ার কোথায় পাব? আমি চুপ করে রইলাম।

শমিতা এবার উঠে পড়ল। বলল, আমার গাড়িটা কোথায়?

বললাম, নীচে রয়েছে।

চলুন, একটু দেখিয়ে দেবেন।

শমিতাকে সঙ্গে করে নীচের রাস্তায় এলাম। গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শমিতা বলল, আপনার এই বাড়িটার অ্যাড্রেস যেন কী?

বাড়ির নম্বর এবং রাস্তার নাম বললাম।

শমিতা বলল, ঠিকানাটা মনে করে রাখলাম। ড্রিংক-ট্রিংক করে রাত্রে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে না করলে কিন্তু এখানে চলে আসব।

উইদাউট হেজিটেসন।

একটু চুপ করে থেকে এক পলক আমাকে দেখল শমিতা। তারপর বলল, আই হ্যাভ স্টার্টেড লাইকিং ইউ। তারপর আমি কিছু বলার আগেই শমিতা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আবার বলে উঠল, আবার কখন দেখা হচ্ছে?

বললাম, আপনিই বলুন।

সন্ধের সময় পার্ক স্ট্রিটে চলে আসুন। বলে একটা হোটেলের নাম করল শমিতা। আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, যাব।

শমিতা চলে গেল। আমি বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আবার ছাদের দিকে উঠতে লাগলাম। তেতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে আসতেই ডরোথির চিৎকার কানে এল, ইউ স্কাউনড্রেল ব্রুট–

চমকে তাকিয়ে দেখি ডরোথি তাদের ফ্ল্যাটের সামনের প্যাসেজটায় দাঁড়িয়ে আছে। ডরোথিকে দেখে দাঁত বার করে হাসলাম। কেননা পালাবার আর উপায় নেই; আমি একটা ফঁদে পড়ে গেছি যেন।

হাসিতে গলল না ডরোথি। বরং আরো ক্ষেপে উঠল, কাল রেস্তোরাঁয় কাকে পাঠিয়েছিলে? সান অফ এ বিচ একটা থার্ড ক্লাস চোরকে পাঠাতে তোমার লজ্জা করল না?

বারকতক ঢোক গিলে বললাম, মানে আমি একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তুমি একা-একা বসে থাকবে। তাই চার্লিই–

কাজ চালিয়ে নিক–ডরোথি রক্ষাকালীর মতো হিংস্র হয়ে উঠল, রাসকে বিস্ট, প্ল্যান করে তুমি আমাকে ইনসাল্ট করেছ। বলেই হাতের খবর কাগজটা ছুঁড়ে মারল।

টক করে কাগজটা লুফে নিতে নিতে বললাম, বিশ্বাস করো, মা দুর্গার দিব্যি, তোমাদের যীশুর দিব্যি-ইনসাল্ট করার কোনও ইচ্ছে ছিল না।

নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে দিতে ডরোথি, বলল, তোমার সঙ্গে আজ থেকে অল রিলেসান কাট অফ। সোয়াইনি, ব্রুট

হে মহান জনগণ, চার্লির জন্যে ডরোথির হাত থেকে বোধহয় চিরকালের জন্যে রক্ষা পাওয়া গেল। মনে মনে তার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বললাম–চার্লি হেন্ডারসন, যুগ যুগ জিয়ো–বলেই সিঁড়ি টপকে টপকে ছাদে চলে এলাম।

.

১২.

অনেকদিন পর চার্লি আর আমি আজ একসঙ্গে দিনের বেলায় বাড়িতে আছি। চার্লি বলল, লর্ড টাকা দাও; চিকেন আর সবজি-টবজি নিয়ে আসি। ফলে খাওয়া-দাওয়া সেরে অফিসে আসতে বেশ দেরি হয়ে গেল আমার।

কাচের  দেয়ালের ওপারে লতিকা তার জায়গায় বসে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছিল। আমাকে দেখেই লাইনের ওধারের অদৃশ্য ব্যক্তিটিকে ব্যস্তভাবে বলে উঠল, একটু ধরুন, উনি এসে গেছেন। তারপর টেলিফোনটা কাচের  দেয়ালের ফুটোর ভেতর দিয়ে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, মণিমোহন মল্লিক।

মণিমোহনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, দু-চার সেকেন্ড ভেবে নিলাম। তারপর ফোনটা কানে লাগিয়ে বললাম, নমস্কার মিস্টার মল্লিক। বলুন–

লাইনের ওধার থেকে মণিমোহনের কণ্ঠ ভেসে এল। প্রতি-নমস্কার জানিয়ে তিনি বললেন, খবর তো আপনার কাছে। কাজটা শুরু করে দিয়েছেন?

নিশ্চয়ই। আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি; কাজটা তো করে দিতেই হবে। মনে মনে বলাম, শালা শুয়োরের বাচ্চা ইহজন্মে তুমি আমাকে দিয়ে ওই কর্ম করাতে পারবে না।

মণিমোহন বললেন, কাজের নেচারটা মনে আছে?

নিশ্চয়ই।

বলুন তো? কী রকম মনে আছে দেখি

শমিতা বোসের ন্যুড ফোটো আর বেডরুমের ছবি–এই তো?

ভেরি গুড। বেশ তারিফের সুর মণিমোহন বললেন, মনে হচ্ছে আমার কাজের জন্য রাইট লোককেই ধরেছি। ফোটোগুলো কবে পাচ্ছি?

আপনি তো আমাকে দুমাস সময় দিয়েছেন

তা দিয়েছি। তবে আগে দিতে পারলে এই কাজটা নিয়ে অতদিন আমাকে থাকতে হয় না; আমিও নিজের কাজ শুরু করে দতে পারি।

ফোটোগুলো নিয়ে কী করবেন বলুন তো স্যার?

আপনাকে সেদিনই বলে দিয়েছি এ নিয়ে কোনওরকম প্রশ্ন করা চলবে না।

নিষেধাজ্ঞাটা আমার মনে ছিল। তবু ইচ্ছা করেই কথাটা আবার জিগ্যেস করেছি। হে মহান জনগণ, আমি স্রেফ একটা চান্স নিয়েছিলাম। অসাবধানে দুম করে মণিমোহন হয়তো নিজের উদ্দেশ্যটা বলেও ফেলতে পারেন। কিন্তু লোকটার স্নায়ু-টায়ু দারুণ সজাগ।

কিন্তু আমার নামও রাজীব সরকার। তাই একটু ভেবে বললাম, স্যার, ফোটোগুলো আপনার কী কাজে লাগবে-তা নিয়ে আমার হেড-এক নেই। তবে জানতে পারলে আমার কাজের একটু সুবিধা হত। মানে আপনার পারপাস বুঝে সেই অ্যাঙ্গেল থেকে শমিতার ফোটো তুলতাম।

তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না মণিমোহন। মনে হল, আমার শেষ কথাটায় কাজ হয়েছে। আফটার অল, বাবা মণিমোহন তুমি যদি ডালে ডালে ঘোরো তবে আমি চলি পাতায় পাতায়। তোমার মতো বহু মালকে আমি চড়িয়ে বেড়াই। কয়েক সেকেন্ড বাদে মণিমোহন বললেন, ব্ল্যাকমেল শব্দটা শুনেছেন?

আমি চমকে উঠলাম, নিশ্চয়ই

ওটা মাথায় রেখে ফোটো তুলে যান। ও-কে?

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই লাইনটা কেটে দিলেন মণিমোহন। ফোনটা কাচের  দেয়ালের ফেঁকর গলিয়ে লতিকাকে ফেরত দিতে দিতে বললাম, জানো লতিকা, কাল রাত্তিরে শমিতা একটা দারুণ।

আমার কথা শেষ হবার আগেই লতিকা বাকিটুকু বলে উঠল, কাণ্ড করেছে-এই তো? তোমার এক্সপিরিয়েন্সের কথা পরে শুনব। আগে তুমি আমার কথাটা শুনে নাও

বলো–

কাল তুমি বেরিয়ে যাবার পর থেকে আজ বেলা বারোটা পর্যন্ত বাইশ জন লোক এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে গেছে। এদের কেউ এমপি হতে চায়, কেউ এম-এল-এ, কেউ কাউন্সিলার কেউ মিনিসিপ্যাল কমিশনার।

যা খুশি হতে চাক। কিন্তু কেউ কিছু হবে না।

লতিকা আমার কথা হয়তো শুনতে পেল না। নিজের মনেই বলে যেতে লাগল, কয়েকটা মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকসান আসছে মাসেই হচ্ছে। এখন থেকেই তাহলে ক্যাম্পেনের কাজ

শুরু করতে হবে। তাই ভাবছিলাম–

বললাম, এইড-ইলেকসানের এবার গণেশ উল্টে দেওয়া দরকার–কেমন?

হ্যাঁ! বেশিদিন ওটা রাখলে অ্যাডভান্সওলারা এসে ট্রাবল ক্রিয়েট করবে।

বেশ তো; দাও উল্টে—

আমার ইচ্ছা কাল-পরশুর মধ্যেই ওখানে অন্য অফিস বসিয়ে দেব।

কী অফিস বসাতে চাও?

সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। ওখানে একটা জ্যোতিষের অফিস বসাব।

একটু চিন্তা করে বললাম, নট-এ ব্যাড আইডিয়া

লতিকা বলল, নামটাও আমি ঠিক করে রেখেছি-ভূত-ভবিষ্যৎ।

বললাম, নামটা কোয়াইট গুড। তবে ওটা চলবে না। ইংরেজি নাম দিতে হবে। কারণ নন-বেঙ্গলি ক্লায়েন্টও তো আছে। তাদেরও ফাঁদে ফেলা দরকার। তা ছাড়া বাংলা নাম-ধাম অচল; যতই যা-ই হই, ভেতরে ভেতরে আমরা আজও ইংরেজিয়ানার চাকর হয়ে আছি।

মিনিটখানেক চিন্তা করে লতিকা বলল, তাহলে নাম দেওয়া যাক পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার।

আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম, ইটস এ বিউটি। এই নামই দেওয়া হবে।

তাহলে মাইন-বোর্ডওলা আর ইন্টেরিয়র ডেকরেটরদের খবর দিই? কারণ বসার অ্যারেঞ্জমেন্ট-ট্যারেঞ্জমেন্টগুলো তো বদলে দিতে হবে।

নিশ্চয়ই। আর নেক্সট উইকে সব কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দাও। ইংরেজি-বাংলা। দুই ল্যাঙ্গুয়েজেই ভালো করে দুটো রাইট-আপ তৈরি করে ফেলল।

আচ্ছা

আর আমাদের এইড-ইলেকসানে এখন সমরেশ বসছে তো? ওর জায়গায় পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারে অন্য কাউকে বসাতে হবে। কারণ অ্যাডভান্স যারা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই এসে হানা দেবে। তখন সমরেশকে দেখলে ছিঁড়ে ফেলবে। ওর বদলে কাকে বসাতে চাও?

বর্ধমানের দুটো ছেলে কিছুদিন ধরে চাকরির জন্যে আসছে। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। ভাবছি ওদের একজনকে অফিসার, আরেকজনকে বেয়ারা করে ওখানে বসাব।

ঠিক আছে।

কথা শেষ করেই সাইনবোর্ড এবং ইন্টেরিয়ার ডেকরেটরকে ফোন করে কালই চলে আসতে বলল লতিকা। প্রতিবারই অফিস তুলে দিয়ে নতুন অফিস বসবার আগে ভেতরের সাজসজ্জা, চেয়ার-টেবল, দেয়ালের রঙ সব বদলে দিই। এই কাজটা আমরা এক রাতের মধ্যেই সেরে ফেলি। পরের দিন পুরনো কনসার্নের খদ্দেররা এসে নতুন অফিস নতুন লোকজন দেখে একেবারে হাঁ হয়ে যায়। তারা বুঝতেই পারে না পুরোনো ম্যানেজমেন্টই এই নতুন অফিস খুলেছে। লতিকার ফোন হয়ে গেলে আমি আবার সেই আগের কথায় ফিরে গেলাম। বললাম, এবার শমিতার ব্যাপারটা শোনো

লতিকা হেসে হেসে বলল, শমিতার ব্যাপারে তোমার আরো অনেক এক্সপিরিয়েন্স হবে। একটু একটু করে শুনে সাসপেন্সের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে না। এক্সপিরিয়েন্সটা কমপ্লিট হোক; একসঙ্গে পুরোটা শুনব। বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে।

জিগ্যেস করলাম, উঠলে যে?

আমাকে বাড়ি যেতে হবে। মায়ের শরীরটা খুব খারাপ।

কী হয়েছে? আমি যাব?

না-না, তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। তোমার যাবার দরকার নেই।

লতিকা চলে গেল। সত্যিই কি ওর মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে? কেনই বা শমিতার কথা ও শুনতে চাইল না? মায়ের অসুস্থতার নাম করে আমাকে কি এখন এড়াতে চাইল? সব কিছু কেমন যেন অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে মনে হতে লাগল আমার।

ছটা পর্যন্ত চুপচাপ অফিসে বসে রইলাম। বাইরে যখন অন্ধকার নামল, রাস্তায় কর্পোরেশনের মার্কারি ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠল সেই সময় আমার মনে পড়ে গেল সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে শমিতার সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। হিপনোটিজমের বাংলা যেন কী-ও হ্যাঁ, সম্মোহন–মেয়েটা সম্মোহনের মতো দুরন্ত আকর্ষণে আমাকে তার দিকে টানতে লাগল।

.

১৩.

হে মহান জনগণ, দেখতে দেখতে আরো সাত-আট দিন কেটে গেল। এর মধ্যে কর্পোরেশনের জায়গায় পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। রাতারাতি ইন্টেরিয়র ডেকরেসন আর দেয়ালের রঙ বদলে ঝকঝকে এবং দারুণ মডার্ন একটা জ্যোতিষ গণনার অফিস বসিয়ে দিয়েছে লতিকা। সমরেশের বদলে যে ছেলেটি ওখানে এখন বসছে তার নাম বিমল। আর বেয়ারার কাজ দেওয়া হয়েছে অজয়কে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ছেলেকেও আমাদের এই ডিপার্টমেন্টে নিয়েছি।

বিশেষ করে আরো যাদের নেওয়া হয়েছে তারা হল অ্যাস্ট্রোলজার, তান্ত্রিক, অবধূত, পিশাচসিদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া কপাল দেখে, নাক দেখে, কুঁচকি দেখে, কণ্ঠা দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে–এমন মহাপুরুষও আছে ডজন ডজন। কিন্তু আমরা শোম্যানশিপ আর পাবলিশিটির ব্যাপারটা ভালো করেই জানি। ওটা ছাড়া এ-যুগে কোনও বিজনেস বা প্রফেসান চালানো প্রায় অসম্ভব।

তাই খবরের কাগজে পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছি, হাজার হাজার হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করছি, পোস্টারে পোস্টারে কলকাতার দেয়াল ঢেকে দিচ্ছি। বিজ্ঞাপনে, হ্যান্ডবিলে, পোস্টারে, সর্বত্র লেখা আছে–আমরা হিমালয়ের ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষকে দিয়ে সব রকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকি। বিশেষ করে রেসে কোন ঘোড়া জিতবে, আপনি বম্বের ফিল্মস্টার হতে পারবেন কিনা, সেলস্-ট্যাক্স ইনকাম-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েও আপনি রেহাই পাবেন কিনা, ব্ল্যাক টাকার পাহাড় জমিয়েও পার পাবেন কিনা এবং ইলেকসানে জিততে পারবেন কিনা–এই চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমাদের বিশেষত্ব। প্রতি প্রশ্নের উত্তরের জন্য দক্ষিণা মাত্র পঞ্চাশ টাকা। প্রশ্ন এবং দক্ষিণা জমা দেবার পর দু-মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ হিমালয়ের ঐশী শক্তিসম্পন্ন ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষের কাছে লোক পাঠিয়ে প্রশ্নের উত্তর আনতে এই সময়টা তো লাগবেই। সুতরাং আপনারা দু-মাস পরের যে বিষয় জানতে চান সে সম্বন্ধে এখনই প্রশ্ন করুন এবং ফি পাঠান।

হে মহান জনগণ, দু-মাস সময় কেন নিয়েছি বুঝতেই পারছেন। এর মধ্যে প্রশ্ন গণনার জন্যে কিছু টাকা অ্যাডভান্স পেয়ে গেলেই দুম করে পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের গণেশ উল্টে দেওয়া যেতে পারে।

এছাড়া আমাদের এই অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টটাতে রাতারাতি গ্ল্যামার আনার জন্যে আরো কিছু প্ল্যান-ট্যান নিয়েছি। অজয় আর বিমল বাদে অন্য যে ছেলেগুলোকে এই ডিপার্টমেন্টে জুড়ে দিয়েছি তারা অফিসে বসে না। তাদের দেওয়া হয়েছে নানারকমের ফিল্ডওয়ার্ক। তারা নামকরা ফিল্মস্টার, লিডার, বিজনেসম্যান, ডাক্তার, ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইত্যাদির পারিবারিক এবং গোপন খবর অর্থাৎ তারা স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় কার সঙ্গে ঘোরে, কোন মেয়ের সঙ্গে মেশে–এসব খবর নিয়ে আসে। আর আমি করি কী প্রত্যেকের ঠিকানায় সেই সব তথ্য ভরে চিঠি পাঠাই। সেই চিঠিতে আরো লিখিখবরের কাগজে আপনার যে ছবি বেরিয়েছে সেই ছবিতে আপনার কপাল দেখে আমার এসব মনে হয়েছে।

আমি কপাল দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারি। যদি আপনার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক এই সব তথ্য সত্যি হয়, তাহলে সামনে আপনার ভয়ানক বিপদ। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আজই আড়াইশো টাকা পাঠান। হিমালয়ের ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষের কাছ থেকে মন্ত্রসিদ্ধ মাদুলি আনিয়ে আপনাকে পাঠাব।

হে মহান জনগণ, প্রফেসান বা বিজনেস যা-ই বলুন না–এই নতুন ডাইভার্সিফিকেসনের ফল দারুণ হয়েছে। রেস, ইলেকসানের রেজাল্ট, ব্ল্যাকমানি ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রতিদিন ডাকে গাদা গাদা প্রশ্ন এবং সেই সঙ্গে ফি-এর টাকা আসছে। আর ফিল্মস্টার, ডাক্তার, প্রফেসর ইত্যাদিদের কাছ থেকে মাদুলি বাবদ অজস্র টাকা। এভাবে চললে দু-মাসের মধ্যেই কয়েক লাখ টাকা আমাদের হাতে এসে যাবে।

.

১৪.

একদিকে আমাদের প্রফেসানটা দুর্দান্ত চলছে। আরেক দিকে-হে মহান জনগণ, আমি সেই ক্যাঁচাকলটায় আরো ভালো করে আটকে যাচ্ছি। অর্থাৎ শমিতার ব্যাপারটা বলছি আর কী।

এই সাত-আট দিন তার সঙ্গে রোজ দেখা হয়েছে। যদিও আমিই শমিতাকে শোধরাবার দায়-দায়িত্ব নিয়েছি, আমারই তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা; তবু বলব শমিতাই আমার সে ঝামেলা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তার মুভমেন্টের ওপর নজর রেখে আমাকে ফোন করার জন্যে এখন আর চার্লিকে পাঠাবার দরকার হয় না। পরের দিন কোথায় তার সঙ্গে দেখা হবে সেটা আগের দিনই শমিতা আমাকে জানিয়ে দেয়।

একদিন ওর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আন্দাজ করতে পেরেছি, আলাপটা অল্প দিনের হলেও সে আমাকে মোটামুটি পছন্দ করে। বিশেষ করে সেদিন তাকে বেহেড মাতাল অবস্থায় আমার ছাদের ঘরে নিয়ে যাবার পরও যখন কোনওরকম সুযোগ নিইনি তখন থেকেই সে আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আমাকে স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছে, রাত্রে নেশার ঘোরে যখন পুরোপুরি আউট হয়ে যাবে তখন আমি যেন তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড়ে পৌঁছে দিই। কিংবা ইচ্ছা হলে এন্টালিতে আমার সেই ছাদের ঘরেও নিয়ে যেতে পারি। এ কদিনের মেলামেশায় আমরা পরস্পরকে তুমি বলতে শুরু করেছি।

হে মহান জনগণ, সাত-আটদিন যদিও খুবই অল্প সময় তবু এরই মধ্যে শমিতা সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত কীভাবে কাটায় সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। লক্ষ্য করেছি বারোটার আগে শমিতা বাড়ি থেকে বেরোয় না। আগের দিন যে পরিমাণ হুইস্কি বা বাংলা মাল সে টেনে যায় তার হ্যাংওভার কাটাতে কাটাতেই তার অনেক বেলা হয়ে যায়। তারপর স্নান-টান করে কোনওদিন লাঞ্চ সেরে, কোনওদিন বা না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলে যায় ক্লাবে। হোল ক্যালকাটার সাত-আটটা ক্লাবের সে মেম্বার। এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাব, তারপর আরেক ক্লাব কিংবা জুয়ার আড্ডা অথবা ফিগার স্কুল-এইভাবে শাটুল-ককের মতো ঘুরতে ঘুরতে সে চলে আসে হোটেলে। সেখানে ড্রিংকের ফাঁকে ফাঁকে চলে ফ্লোর ডান্স। বাঙালি-পাঞ্জাবি-সিন্ধি-পার্শি, ইন্ডিয়ান, নন-ইন্ডিয়ান–নানা জাতের লোকের সঙ্গে তার জানাশোনা। এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারি সবার চোখ শমিতার দারুণ সুন্দর আর সেক্সি শরীরটার দিকে। প্রায় সবাই চায় সে আউট হয়ে গেলে তাকে পৌঁছে দেবার নাম করে কোনও প্রাইভেট অ্যাপার্টমেন্টের বেডরুমে ঢোকাতে। কিন্তু আমি তা হতে দিই না।

আজ সন্ধেবেলা নানা ক্লাব ঘুরে শমিতা পার্ক স্ট্রিটের সেই বড় হোটেলটায় আমাকে নিয়ে এল। এসেই হুইস্কির অর্ডার দিল।

যে সব জায়গায় শমিতা বিলে সই করে মদ খায় সেই জায়গায় বার-এ জল-মেশানো হুইস্কি সার্ভ করতে বলে দিয়েছি।

যাই হোক ড্রিংক এসে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বললাম, তোমার সঙ্গে কদিন ধরে মিশছি। নাউ উই আর গুড ফ্রেন্ডস-এটা বলা যেতে পারে তো?

শমিতা হাসল, অফ কোর্স

তাহলে একটা কথা বলব?

শিওর।

তুমি বড় বেশি ড্রিংক করো

তাই নাকি। তবে তো তুমি আমার মাকে দেখোনি। শি ড্রিংকস লাইক ফিশ। এনিওয়ে তুমি যা বলছিলে বলে ফেলো। তবেফর গডস্ সেক, সারমন-টারমন দিও না।

আমি একটু হাসলাম, সারমন দেব আমি! হাসালে। কিন্তু একটা কথা আমার মনে হয়–তুমি তোমার লাইফটা টোটালি ওয়েস্ট করছ।

আই হ্যাভ গট এভরি রাইট টু ওয়েস্ট ইট।

চমকে উঠলাম, মানে!

শমিতা উত্তর দিল না। কোনও কথাও বলল না। পনেরো মিনিটের মধ্যে সটাসট আরো তিন পেগ খেয়ে ফেলল। অর্ধেক জল মেশানো থাকলেও বাকি অর্ধেকটা তো হুইস্কি। পাঁচ পেগে আড়াই পেগ হুইস্কি তার পেটে চলে গেছে। শমিতার মুখ লালচে হয়ে উঠতে লাগল।

আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, তোমার আপত্তি থাকলে শুনতে চাই না। আই মিন কোনও ভাবে তোমাকে হার্ট করলাম নাকি?

একটুও না–শমিতা হাসল। বলল, আমার লাইফের কথা বলতে হলে নিজেকে একটু প্রিপেয়ার করে নিতে হবে। তাই পাঁচ পেগ হুইস্কি টেনে মুডটাকে ঠিক করে নিলাম। নাউ আই মে স্টার্ট

আমি চুপ করে রইলাম। শমিতা বলতে লাগল, আমার মাকে দেখেছ?

বললাম, দেখেছি

শমিতা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল, কী করে দেখলে?

বা রে, রোজই তো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি। তখন দেখেছি–আরে তাই তো। শমিতা বললে, মাকে তো দেখেছ; সেই লোকটাকে দেখোনি? অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, কার কথা বলছ?

দ্যাট ম্যান-মানে অরিন্দম সান্যাল?

অরিন্দম সান্যালকে নিশ্চয়ই দেখেছি। একটু চুপ করে থেকে বললাম, তোমাকে পৌঁছে দিতে গিয়ে তাকেও দেখেছি। তোমার বাবা তো?

আমার কথা শেষ হল কি হল না, তার আগেই হে মহান জনগণ, একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। এই পাঁচ-তারা-মার্কা হোটেলের বারকে চমকে দিয়ে শমিতা চেঁচিয়ে উঠল, ওই স্কাউড্রেল সান-অফ-এ বিচটাকে আমার বাবা বলছ! আমি বোস আর ও সান্যাল। হাউ দ্যাট স্ট্রিট ডগ ক্যান বি মাই ফাদার?

হে মহান জনগণ, এই কথাটা আমিও অনেকবার ভেবেছি। মনোবীণা সান্যালের মেয়ে শমিতা বোস হয় কী করে? যাই হোক, শমিতার দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু তোমার মা তো বললে মিস্টার সান্যাল তার হাসব্যান্ড

তার হাসব্যান্ড হতে পারি কিন্তু আমার বাবা নয়

আমার মাথায় চরকি খেলে যেতে লাগল। বললাম, তবে?

আমার কথা এবার খুব সম্ভব শমিতার কানে ঢুকল না! সে দারুণ উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল, আমার মা আর দ্যাট বাগার অরিন্দম সান্যাল-এই দুজনে মিলে আমার লাইফটাকে হেল করে দিয়েছে। বিলিভ মি, আই ওয়াজ নট লাইক দিস–বলেই শমিতা একসঙ্গে ডাবল পেগের অর্ডার দিল।

বুঝতে পারছিলাম শমিতা তার লাইফের সব কথা আজ আমাকে বলবে। আমি চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

হুইস্কি এসে গিয়েছিল। এক চুমুকে ডবল পেগ শেষ করে আরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি শুরু করে দিল শমিতা। থেমে থেমে ভেঙে ভেঙে কখনো হিস্টিরিয়ার রোগীর মতো হাত-পা ছুঁড়ে, কখনো ভয়ানক উত্তেজিত ভাবে, আবার কখনও বিষাদের গলায় সে যা বলে গেল তা এইরকম।

শমিতার বাবার নাম দেবতোষ বোস। তিনি একটা ইউনিভার্সিটিতে লিটারেচারের অধ্যাপক ছিলেন। দারুণ ডেডিকেটেড মানুষ। ইউনিভর্সিটি, ছাত্র-ছাত্রী, পড়াশোনা, নানা রকম সেমিনার–এইসব নিয়েই প্রায় সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন। স্ত্রী মনোবীণা আর মেয়ে শমিতাকে নিয়ে তাঁর ছিল খুবই ছোট্ট ফ্যামিলি। নিজের পড়াশোনা এবং কাজকর্মের মধ্যেও স্ত্রী এবং মেয়েকে যতটা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া যায়, দিতেন। কিন্তু মনোবীণা তাতে খুশি নন। অধ্যাপকের স্ত্রীর ম্যাড়মেড়ে প্যানপেনে লাইফ তার পছন্দ নয়। তিনি প্রতি মুহূর্তে, এক্সাইটমেন্ট চান, কিক চান, হাউইয়ের মতো উড়তে চান। প্রফেসরের স্ত্রীর জীবনে এসব সুযোগ কোত্থেকে জুটবে?

কিন্তু জুটে গেল। দেবতোষ একদিন তার এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে বাড়ি নিয়ে এলেন। নাম অরিবন্দ সান্যাল। জানতেন না নিজের হাতে সুড়ঙ্গ কেটে কাকে এনে ঢোকালেন। এই অরিন্দম সান্যাল একটা পারফেক্ট সোয়াইন, পায়ের তলা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত নাম্বার ওয়ান স্কাউন্ট্রেল–এমনিতে দেখতে সুপুরুষ। অনেক দিন ওয়েস্ট জার্মানিতে কাটিয়ে তখন কলকাতায় ছোটখাটো একটা কনসালট্যান্ট ফার্ম খুলেছে। চমৎকার কথা বলতে পারত, দুর্দন্ত স্মার্ট। মোট কথা, লোককে বিশেষ করে মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো সবকিছুই ছিল তার মধ্যে। এই লোকটা ফাস্ট লাইফের নেশাটাকে তাতিয়ে তাতিয়ে একেবারে এক্সপ্লোসান ঘটিয়ে ছড়ল। তারপর একদিন সে যখন মনোবীণা আর শমিতাকে নিয়ে পালাল সেইদিন অধ্যাপক দেবতোষ বোস বুঝতে পারলেন তার বন্ধু, তার গ্রেট ফ্রেন্ড অরিন্দম সান্যাল হোল ওয়ার্ল্ডের সামনে তাকে একেবারে ন্যাংটো করে ফেলে দিয়ে গেছে। তার চারপাশ থেকে সবাই যেন ফিসিফিসিয়ে সমানে বলে গেছে, এই লোকটা নিজের স্ত্রীকে মেয়েকে সামলে রাখতে পারে না। হেঁ-হেঁ–এই লোকটা–

এই সব চোদ্দো-পনেরো বছর আগের ঘটনা। যাই হোক, মনোবীণা চলে যাবার পর ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন দেবতোষ। সেখান থেকে অরিন্দমকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তুমি পারফেক্ট বন্ধুর কাজ করেছ। যাই হোক দু-চারদিন ফুর্তি করে মনোবীণাকে রাস্তায় ছুঁড়ে দিও না কিংবা তাকে রক্ষিতা করেও রেখ না। তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিও। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার নামে অ্যাডালটারি বা অন্য যে কোনও চার্জ, মানে যা আনলে ডিভোর্স হতে সুবিধা হয় নিয়ে এসো। আমি কেস কনটেস্ট করব না, খুব সহজেই মনোবীণা ডিভোর্স পেয়ে যাবে। তারপর তুমি ওকে বিয়েটা করে নিও।

বিয়ে অবশ্য শেষ পর্যন্ত করেছিলেন অরিন্দম সান্যাল। কিন্তু এই নাম্বার টু বিয়েটা হয়ে যাবার পর কোন ফাঁদে পা দিয়েছেন, বুঝতে পেরেছিলেন মনোবীণা। ছোট কনসাল্টিং ফার্মটাকে বড় করবার জন্যে তাকে, মানে তার দারুণ সুন্দর আকর্ষণীয় শরীরটাকে কাজে লাগিয়েছেন অরিন্দম। বড় বড় অর্ডার পাবার জন্যে মনোবীণাকে অনেকের বেডরুমে যেতে হত।

প্রথম প্রথম আপত্তি করেছেন মনোবীণা। তারপর আস্তে আস্তে যা হয়, সব ব্যাপারটা হ্যাঁবিন্টের মধ্যে এসে গেছে। হ্যাবিট ইজ দি সেকেন্ড নেচার না কী যেন বলে, এ হল তাই। এর নিট ফল হয়েছে এই, ব্যাঙ্কে টাকার পাহাড় জমেছে অরিন্দম সান্যালের, ছোট্ট কনসালট্যান্ট ফার্মটা এখন ফরেন কোলাবরেসনে বিরাট হয়ে উঠেছে। বালিগঞ্জ সার্কুলারে প্রকাও বাড়ি করেছেন অরিন্দম। এ ছাড়া বম্বেতে ফ্ল্যাট আছে, দার্জিলিঙে বাংলো, দিল্লিতে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। এখন প্রতিদিন পার্টি, প্রতিদিন ড্রিংক, ডান্স ইত্যাতি ইত্যাদি। হাউইয়ের মতো আকাশের দিকে উড়তে উড়তে না মনোবীণা সান্যাল, না অরিন্দম সান্যাল-কারোরই লক্ষ্য ছিল না শমিতার দিকে। অবশ্য তার আরাম বা সুখের সব রকম ব্যবস্থাই ওঁরা করে দিয়েছেন। শমিতার জন্যে আলাদা একটা গাড়ি, একজন গভর্নের্স, একটা চাকর, একটা সব সময়ের মেড়-সারভেন্ট কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু যা না হলে হিউম্যান গ্রোথ অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার নাম মা-বাবার স্নেহ, তাদের পার্সোনাল কেয়ার–সেটি পায়নি শমিতা।

হে মহান জনগণ, তেরো-চোদ্দো বছর আগে মনোবীণা যখন অরিন্দমের সঙ্গে পালিয়ে আসেন তখন শমিতার বয়স দশ। তারপর থেকে শমিতা একটা জঘন্য অ্যাবনরম্যাল পরিবেশের মধ্যে আছে। এতগুলো বছর এই নোংরা অ্যাটমসফিয়ার আর মা এবং তার দ্বিতীয় স্বামীটির নানারকম কীর্তিকলাপ শমিতার নার্ভের ওপর দারুণ প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে দিয়েছে। তার ক্রমাগত মনে হয়েছে একটা অদ্ভুত ভ্যাকুয়ামের অর্থাৎ শূন্যতার মধ্যে সে ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার চামটা তার কাছে একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আত্মহত্যার কথা দু-একবার ভেবে দেখেছে সে। এমনকী, একবার ব্লেড দিয়ে কর্জির শিরাও কেটে ফেলেছিল। বাড়ির একটা চাকর দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করে দেয়; ফলে বেঁচে গিয়েছিল শমিতা।

অ্যাটেস্পট অফ মার্ডার সেই একবারই। তারপর কিছুদিন শমিতাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের ট্রিটমেন্টে থাকতে হয়েছে; কারণ সবই ধারণা তার এই আত্মহত্যার অ্যাটেম্পট সম্পূর্ণ মানসিক কারণে। ইট ইজ এ মেন্টাল কেস। শমিতার পরিষ্কার মনে আছে এই সময়টা দিনরাত সে চুপচাপ আর বিষণ্ণ থাকত। যাই হোক, সাইকিয়াট্রিস্টের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার নেচারটা একেবারে পাল্টে গেল। সে ভাবলস, এভাবে ভূতের মতো ঘরের কোণে ওয়ার্ল্ডের সব বিস্বাদ আর দুঃখের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয়। লাইফটাকে দু-হাতে উড়িয়ে দাও।

বাড়িতেই ছোটখাটো একটা ফ্যামিলি-বার রয়েছে। একদিন সেখান থেকে হুইস্কির বোতল বার করল সে। ওপেনিং সেরিমনিটা সেদিনই হয়ে গেল। তারপর আর তাকে বাড়িতে আটকে রাখা গেল না। অনেকগুলো পশ ক্লাবের মেম্বার হল সে; হোটেলে অ্যাকাউন্টে ড্রিংকের ব্যবস্থা করল। সেই সঙ্গে জুয়া, রেস ইত্যাদির মধ্যে ক্রমশ ডুবে যেতে লাগল।

এই নিয়ে অরিন্দম আর মনোবীণার মধ্যে অনেক গোলমাল হয়েছে। এখনও হয়। কেননা মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকা নিয়ে দিচ্ছে শমিতা। স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে এভাবে টাকা ওড়াক, অরিন্দম সান্যাল তা চান না। কিন্তু এ ব্যাপারে মনোবীণা মেয়ের পক্ষে। তিনি বলেন ও তোমার বাবা কিংবা চোদ্দ পুরুষের টাকা নষ্ট করছে না। নিজের শরীর দিয়ে আমি তোমার যে ফরচুন তৈরি করে দিয়েছি তার থেকে নষ্ট করছে। দ্বিতীয় স্বামীটিকে মহিলা প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। অবশ্য গোপনে মেয়েকে ফেরাতে চেষ্টা করেছেন মনোবীণা। বলেছেন, বি নর্মাল ভোরা; বি ডিসেন্ট—

শমিতা বিদ্রুপের সুরে বলেছে, নরম্যালসি আর ডিসেন্সির কথা তোমার মুখে অন্তত মানায় না। রোজ যা ম্যাজিক দেখাচ্ছ! বলেই মায়ের গালে আদরের ভঙ্গিতে আলতো টোকা দিয়েছে, মামণি, তুমি তোমার অরবিটে ঘুরতে থাকো; আমি আমার অরবিটে ঘুরি। এসো, আমরা একটা ভদ্রলোকের চুক্তি করে ফেলি। কেউ কারোকে ডিসটার্ব করব না।

যাই হোক দিনরাত শমিতা এই যে ড্রিংক-ডান্স-জুয়া-রেসের মধ্যে তলিয়ে থাকে এটা শুধু সময় কাটাবার জন্যে। কিন্তু বেশিক্ষণ কোনওটাই ভালো লাগে না। খানিকটা পর এ সব তার খুবই বোরিং মনে হয়। তবে ক্লান্তি আর একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে আবার এই ড্রিংক, এই রেস, এই সব হুল্লোড়বাজি।

হে মহান জনগণ, কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার চোখের সামনে শমিতা তার চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জীবনের একটা পেন্সিল স্কেচ এঁকে দিয়ে বলল, এবার বলো, নিজের লাইফটা ওয়েস্ট করার রাইট আমার আছে কিনা

কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। আমি চুপ করে রইলাম।

আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না শমিতা। ওয়েটারকে ডেকে আবার হুইস্কির অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ফরগেট অল দ্যাট ব্লাডি বোগাস থিং। লেটস এনজয় ড্রিংক। এই পেগটা খেয়ে একটু নাচবে নাকি?

বললাম, আমার আপত্তি নেই।

ড্রিংক এসে গিয়েছিল। খেয়েই শমিতা আমাকে বলরুমে নিয়ে গেল।

নাচতে নাচতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। তা ছাড়া ফ্লোরডান্সে আমি একেবারেই আনাড়ি। কাজেই স্টেপিংটা এলোমেলো পড়তে লাগল।

সেদিন বেহুঁশ অবস্থায় নেচেছিল শমিতা। আজ সাত পেগ খেলেও তার অর্ধেকটাই জল। কাজেই তার চোখকে আজ ফাঁকি দেওয়া গেল না। সে বলল, কী হল, স্টেপিংটা মেলাও–

আমি কেন, আমার ফোরটিন জেনারেসনও ফ্লোরডান্সে স্টেপ মেলাতে পারবে না। বললাম, এই যে মেলাচ্ছি–

কিন্তু কিছুতেই পা মেলানো যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ লক্ষ্য করে শমিতা বলল, তোমাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে।

এ কথাটা সত্যি। আমার অন্যমনস্কতার কারণ যে শমিতাই, সে কথাটা আর বলা গেল না। ঝোঁকের মাথায় যেদিন তাকে ফেরাবার এবং শোধরাবার দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেদিন জানতাম না এই মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডে এইসব ঝামেলার ব্যাপার রয়েছে। মেয়েটার জন্যে আমি কি দুঃখ বোধ করছি।

হে মহান জনগণ, আমার কাজ হল মানুষের দুর্বলতা থেকে কিছু প্রফিট উঠিয়ে সরে পড়া। কারো ব্যাপারেই আমার কোনও সেন্টিমেন্ট নেই। কিন্তু এই মেয়েটা আমাকে ফ্যাসাদে ফেলে দিল দেখা যাচ্ছে। এর কথা না ভেবে পারা যাচ্ছে না। হে মহান জনগণ, জালে আঠা লাগিয়ে পাখি ধরতে গিয়ে আমিই যেন আঠায় জড়িয়ে গেছি।

শমিতা আবার বলল, তুমি আজ অফ মুডে আছ। চলো, আর নাচতে হবে না। ড্রিংকই করা যাক

আবার আমরা বার-এ ফিরে এলাম। কিন্তু বারো পেগের কোটা কমপ্লিট করার পরও শমিতা আউট হল না। চোখ অবশ্য ছ-সাত পেগের পরই লাল হয়ে উঠেছিল। বিরক্তভাবে সে বলল, কদিন ধরেই দেখছি বারো পেগে আমার কিছু হচ্ছে না। মনে হয় হুইস্কি কোম্পানিগুলো বাজে থার্ড ক্লাস জিনিস বাজারে ছাড়ছে। আমি ওদের এগেনস্টে ল-ইয়ারের চিঠি দেব।

আমি চুপ করে রইলাম।

শমিতা বলল, চলো, স্কচে যখন কিছু হচ্ছে না, কান্ট্রি লিকারই খাব–

হে মহান জনগণ, বার ম্যানেজারদের সঙ্গে অ্যারেঞ্জমেন্ট করে হুইস্কিতে না হয় জল মেশাবার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু দিশি বাংলা মদ খাওয়াটা ওর আটকাব কী করে? রেস-টেস এবং অন্য অ্যাডিকশান থেকেই বা ওকে ফেরাব কোন উপায়ে? আমার মাথার ভেতরটা চরকির মতো ঘুরতে লাগল।

 » ৫. আরেক সমস্যা

১৫.

এদিকে আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। শমিতার ব্যাপারে আমি যতই জড়িয়ে যাচ্ছি, ততই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে লতিকা। কদিন ধরেই লক্ষ্য করছি অফিসের ব্যাপার নিয়ে দারুণ মেতে উঠেছে সে। কীভাবে নতুন নতুন রাস্তায় আমাদের প্রফেসানটার ডাইভার্সিফিকেশন করা যায় তার প্ল্যান করছে, ব্লু প্রিন্ট করছে, চার্ট করছে এবং কী রকম প্রফিট-ট্রফিট হতে পারে তার হিসেব-টিসেবও করছে।

তাকে যখনই শমিতার কথা বলতে যাই তখনই সে একই কথা বলে যায়, আরে বাবা তোমার এক্সপিরিয়েন্সটা কমপ্লিট হোক না, তখনই সব শুনব।

পরিষ্কার বুঝতে পারি শমিতার অ্যাফেয়ারটা এড়িয়ে যাচ্ছে লতিকা। কিন্তু যে অনিচ্ছুক তাকে তো আর জোর করে শোনানো যায় না।

যাই হোক একদিন দুপুরে অফিসে এসে নিজের চেম্বার পর্যন্ত যাওয়া গেল না। লিফট বক্সের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, পাস্ট-প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের সামনে তুলকালাম চলছে। একগাদা লোক সমানে চেঁচাচ্ছে আর বাপ-বাপান্ত করছে। তাদের মধ্যে জিরাফের মতো লম্বা গলা-ওলা সিঁড়িঙ্গে ভগবতী পোদ্দার আর গোলাকার ঘাড়ে-গর্দানে ঠাসা হীরাচাঁদ আগরওয়ালাও রয়েছে। হে মহান জনগণ, এদের নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন। এরা আমাদের এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের মাননীয় সব ক্লায়েন্ট।

হীরাচাঁদ এবং ভগবতী একই কনস্টিটিউয়েন্সির দুই রাইভ্যাল ক্যান্ডিডেট। কিন্তু এখন কে বলবে তারা পরস্পরের রাইভ্যাল? দুজনেই গলার শির ছিঁড়ে খিস্তি দিয়ে যাচ্ছিল। দম নেবার জন্যে একজন যখন থামে, আরেকজন শুরু করে দেয়। জানোয়ার, শুয়ারকে বাচ্চা-কুত্তা, হারামিকে বাচ্চা–গিধধর–উল্লু-কা-পাঠঠে।

ব্যাপারটা এই। এতগুলো লোক কেউ এম-পি, কেউ এম-এল-এ হবার জন্যে, কেউ বা অন্য ইলেকসান জেতার জন্যে আমাদের টাকা দিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ খবর-টবর পেয়ে অকুস্থলে এসে দ্যাখে এইড-ইলেকসানের অফিস উঠে গেছে। ফলে যা রি-অ্যাকশান হবার তাই হচ্ছে।

কদিন আগেও ইলেকসান নিয়ে ওরা একজন আরেকজনের পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতে পারত। কিন্তু যেই দেখল এইড-ইলেকসানের জায়গা অন্য অফিস বসে গেছে অমনি তারা এককাট্টা হয়ে হয়ে গেছে। একসঙ্গে কোরাসে আমাদের খিস্তি করে এখন গলাগালি করে দুজনে চলে যাচ্ছে। আর আর যাদের কাছে ইলেকসান করাবার নাম করে টাকা নিয়েছি তারাও ওদের পিছু পিছু প্রায় শোভাযাত্রার করেই চলে গেল।

এ অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন নয়। যখনই কোনও একটা কনসার্ন তুলে দিই তখনই ঋক বেঁধে আমাদের সেই কনসানের সম্মানিত ক্লায়েন্টরা কিঞ্চিৎ খিস্তি-খাস্তা করে যায়। এ খিস্তিটুকু আমাদের তেমন গায়ে লাগে না। কেননা সেই প্রবাদটা আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়, আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। যাই হোক হীরাচন্দরা চলে গেলে আমি নিজের চেম্বারে চলে এলাম। ঢুকেই দেখি লতিকা খুব হাসছে। হাসির কারণটা হীরাচন্দদের হতাশ এবং বেকুব হয়ে ওই একটানা খিস্তিখেউড়ে। দেখাদেখি আমিও হেসে ফেললাম।

হাসতে হাসতে বললাম, আরেকবার আমাদের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হল।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই ফোন বেজে উঠল। সেটা তুলে নিয়ে কানে লাগাতেই মহিলা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, মিস্টার সরকার?

বললাম, হ্যাঁ।

আমি মনোবীণা সান্যাল। বিশেষ একটা দরকারে আপনাকে ফোন করছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, বলুন–আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছি সেটা কী রকম চলছে?

ভালোই। আমি সিনসিয়ারলি চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ডোরাকে নরম্যাল করা যাবে বলে আপনার মনে হয়?

সেই রকমই আমার ধারণা।

ভেরি গুড। বলে একটু থামলেন মনোবীণা। পরক্ষণে আবার শুরু করলেন, কুড়ি-বাইশ দিন হল আপনি আমার কাজটা নিয়েছেন।

বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ–

আপনাকে আর পঁচিশ দিন সময় দিচ্ছি। তার মানে নেক্সট মাস্থের দশ তারিখ পর্যন্ত। এর মধ্যে আপনার কাজ কমপ্লিট করতে হবে।

বললাম, বাইশ দিনের মধ্যে কী হবে? আপনি তো আপনার মেয়েকে জানেন; তার মধ্যে কতরকমের অ্যাডিকসান রয়েছে। সে সব থেকে তাকে বার করে আনতে অনেক সময়ের দরকার।

মনোবীণা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, জানি জানি। কিন্তু বাইশ দিনের বেশি একটা দিনও আপনাকে দিতে পারব না। আর শুনুন, আরেকটা কাজ আপনাকে করতে হবে।

কী?

নেক্সট মান্থের ইলেভেন্থ সন্ধের ট্রেনে ভোরাকে নিয়ে আপনাকে বম্বে যেতে হবে। বম্বের একটা ঠিকানা দিয়ে দেব; ওকে ওখানে পৌঁছে দেবেন। আর এই বম্বে যাবার ব্যাপারটা এখন ভোরাকে বলবেন না।

কিন্তু এত অল্প সময়ে

বললামই তো, এর বেশি একটা সেকেন্ডও বাড়ানো যাবে না। দশ তারিখটা মনে রাখবেন। আচ্ছা ছাড়ছি–

টেলিফোনটা নামিয়ে বাঁদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল লতিকা একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আবার ফোন বেজে উঠল। টেলিফোনটা তুলে কানে ঠেকাতেই মণিমোহনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মনোবীণার পরেই এই লোকটা আমার জন্যে যে ওঁত পেতে বসে ছিল, কে ভাবতে পেরেছে। গলার স্বরটা মধুতে চুবিয়ে বললাম, বলুন স্যার

মণিমোহন বললেন, আমার কাজের কথাটা মনে আছে তো?

নিশ্চয়ই! শমিতা বোসের নুড ছবি আর বেডরুমের কিছু উত্তেজক পিকচার তুবে দেব-এই তো?

মণিমোহন বললেন, কারেক্ট। এবার বলুন, কখানা ফোটো ভোলা হল?

আপনি তো আমাকে দুমাস সময় দিয়েছেন; তার মধ্যেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু সময়টা যে একটু কমাতে হচ্ছে। আমি আপনাকে আর পঁচিশটা দিন দিচ্ছি; তার মানে নেক্সট মাছের দশ তারিখের মধ্যে ফোটোগুলো আমার চাই।

দারুণ চমকে উঠলাম। মনোবীণাও ঠিক ওই তারিখটাই আমাকে দিয়েছেন। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে ওর মধ্যে যে একটা সাংঘাতিক ঝামেলা রয়েছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। বললাম, ঠিক আছে স্যার, দশ তারিখের মধ্যেই ফোটোগুলো দিতে চেষ্টা করব। চেষ্টা না, দিতেই হবে। আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত থাক। পরে আবার যোগাযোগ করব।

লাইন কেটে যাবার পর নিজের অজান্তেই বাঁদিকে আমার ঘাড়টা ঘুরে গেল। দেখি আগের মতোই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লতিকা। চোখাচোখি হতেই সে বলল, ডিসটার্বড় মনে হচ্ছে?

নিজের মুখ তো দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো সেখানে দুর্ভাবনার কিছু ছাপ পড়ে থাকবে। তবু হেসে বললাম, স্লাইট

কে ফোন করেছিল? মণিমোহন মল্লিক?

হ্যাঁ।

তার আগে মনোবীণা সান্যাল?

আমি আস্তে মাথা নাড়লাম। লতিকা আর কিছু জানতে চাইল না। তার সামনে হিসেবের খাতাপত্র খোলা হয়েছে, সে-সব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি রিভলভিং চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম, পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা এবার বন্ধ করে দিতে হবে। মণিমোহন মল্লিক যেভাবে আমার পিছনে লেগে আছে ওটা তুলে না দিলেই নয়। অবশ্য মনোবীণাও লেগে আছেন। তবে এ ব্যাপারটায় আমার নিজেরই যথেষ্ট ইন্টারেস্ট।

চেয়ারে শরীর ছড়িয়ে রেখেই একসময় জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা লতিকাকাচের  দেয়ালের ওধার থেকে লতিকার গলা শোনা গেল, বলো–

আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে আমরা কী রকম অ্যাডভান্স পেয়েছি?

হিসেব-টিসেব সব সময় মুখস্থই থাকে লতিকার। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, মোট সাঁইত্রিশ হাজার চারশো টাকা

একটু চুপ করে থেকে বললাম, নট ব্যাড। অনেকদিন হয়ে গেল; এবার ভাবছি ওটার গণেশ উল্টে দেব। ওই ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিয়ে নতুন কী খোলা যায় বলো তো?

হে মহান জনগণ, আগেই বলেছি কীভাবে আমাদের প্রাফেসানটা নতুন নতুন ডাইভার্সিফিকেসন করা যায়, এ নিয়ে কিছুদিন ধরে নানারকম রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছে লতিকা। সে বলল, ভেবেছি ওখানে প্ল্যানস বলে একটা ডিপার্টমেন্ট খুলব।

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলো।

আমরা প্ল্যানস থেকে নানারকম পরিকল্পনা সাপ্লাই করব। এই ওয়ার্ল্ডে কেউ রাতারাতি মিলিওনেয়ার হতে চায়, কেউ ফেম চায়, কেউ প্রতিষ্ঠা চায়, কেউ চায় পাওয়ার। আমরা তাদের কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকা নিয়ে দুমাস কি তিন মাস সময় নেব। বলব, পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হচ্ছে, পরে পাঠানো হবে। তিন মাসের মধ্যেই আশা করা যায় এই ডিপার্টমেন্টে লাল বাতি জ্বালানো যাবে।

আমি প্রায় লাফিয়েই উঠলাম, গ্র্যান্ড! তোমার ব্রেনটা আজকাল দারুণ ওয়ার্ক করছে।

লতিকা হাসল, সেটা বোধহয় সঙ্গগুণে।

আমিও হেসে ফেললাম, যা বলেছ। তাহলে আসছে সপ্তাহে একটা শুভ দিন দেখে পার্সোনালের সাইন বোর্ডটা পাল্টে দাও

আচ্ছা

.

১৬.

আজ একটা দুর্দান্ত ঘটনা ঘটে গেল।

হে মহান জনগণ, আগেই জানিয়েছি আলাপ হবার পর থেকে আজকাল রোজই শমিতার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে। সে-ই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমাকে ক্লাবে, হোটেলে, সুইমিং পুলে কিংবা জুয়ার আড্ডায় চরকির মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। আজ সে নিয়ে গিয়েছিল রেস কোর্সে।

আগেও আর একদিন রয়াল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের মাঠে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিন্তু রেসের র আমি জানি না। নেহাত ওর গায়ে জোঁকের মতো আমার লেগে থাকতে হবে তাই সঙ্গে সঙ্গে যেতে হয়।

আগের দিনও লক্ষ্য করেছি, আজও দেখলাম, হাজার খানেক টাকা সে হেরেছে। টাকা গচ্চা যাওয়া ছাড়া এর মধ্যে কী ফান বা চার্ম আছে বুঝতে পারি না। আজ বললাম, রেস খেলতে তোমার ভালো লাগে?

শমিতা বলল, দারুণ।

এর মধ্যে কী আছে?

এক্সাইটমেন্ট অ্যান্ড কিক। লাইফটা আমার খুবই বোরিং। তার মধ্যে একটু এক্সাইটমেন্ট না থাকলে স্রেফ মরে যাব। বলে একটু থামল শমিতা। তারপর আবার বলল, রেসের ঘোড়াগুলো যখন ছোটে সেই সময়টা আমার দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটে। এই উত্তেজনার জন্যেই আমি এখানে আসি।

কথা বলতে বলতে আমরা মেম্বারদের জন্যে সংরক্ষিত স্ট্যান্ড থেকে নেমে আসছিলাম। হঠাৎ সামনে কার দিকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে গেল শমিতা। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকাতেই দেখতে পেলাম স্ট্যান্ডটার নীচে ঘাসের লনে সাতাশ-আটাশ বছরের একটা ছোকরা-সাড়ে ছফুটের মতো হাইট, রোদে পোড়া টাফ চেহারা, চওড়া মাসকুলার বুক, ষাঁড়ের মতো ছড়ানো কাধ, পরনে বুকখোলা স্পোর্টস গেঞ্জি আর ট্রাউজার, চোখে সানগ্লাস

জিগ্যেস করলাম, কে ও?

একটা সেক্সি বিস্ট। অনেকদিন কলকাতায় ছিল না। আবার দেখছি এসে হাজির হয়েছে। বলেই আমার হাত ধরে টানল শমিতা, চলো, অন্যদিক দিয়ে যাই—

শমিতার মতো মেয়ে যাকে ভয় পায় সে নিশ্চই বিস্টই হবে।

অসংখ্য মানুষ আর গ্যালারির ফাঁক দিয়ে আমরা কোণাকুণি নামতে লাগলাম। কিন্তু এত করেও তাকে এড়ানো গেল না। নীচে নামতেই দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আমাদের দিকে চোখ রেখে রেখে সে এখানে চলে এসেছিল। সে বলল, কী ব্যাপার–ডাকলাম, শুনতে পাওনি?

কই না তো–শমিতা ঠান্ডা গলায় বলল।

আমি ভাবলাম অ্যাভয়েড করলে বুঝি—

অ্যাভয়েড করব কেন? তারপর, কবে আমেরিকা থেকে ফিরলে?

পরশু। এসেই তোমার খোঁজ করেছি। শুনলাম তুমি নাকি নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছ, তাকে নিয়ে দারুণ মাতামাতি করছ! বলেই আঙুল দিয়ে আমাকে দেখাল সে, হি মাস্ট বি দ্যাট লাকি গ্যায়–

রাইট-শমিতা বলল, আমার একটা খুব আরজেন্ট কাজ আছে এখানে চললাম; পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। বাই

আমি তোমাকে চিনি। তোমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। এতদিন পর দেখা হল—চলো আমার সঙ্গে। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়তে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে, জানো-দারুণ একটা খবর আছে। ইওরোপ যাবার আগে রাসেল স্ট্রিটে যে নতুন অ্যাপার্টমেন্টটা বুক করে গিয়েছিলাম কাল সেটা পেয়ে গেছি। তোমার আরেকটা সময় কাটাবার জায়গা

তার কথা শেষ হবার আগেই শমিতা বলে উঠল, প্লিজ প্রবীর, আমি আর ওয়েট করতে পারছি না। বলেই সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিল শমিতা।

সে অর্থাৎ প্রবীর দারুণ নাছোড়বান্দা হাত বাড়িয়ে শমিতার একটা হাত ধরে বলল। বলল, আজ তোমাকে ছাড়ছি না। এতদিন পর দেখা—

প্লিজ

নো, নেভার- দু’কাঁধ ধরে শমিতাকে নিজের দিকে ফেরাল প্রবীর, বলল, শমিতা, ইউ নো মি এভরি ওয়েল। সো

দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র চাপা গলায় শমিতা বলল, সো হোয়াট?

আমার ইচ্ছা আমার সঙ্গে তুমি আমার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে যাবে।

তোমার এতটা সাহস কোত্থেকে হল?

সে সাহস তো তুমিই আমাকে দিয়েছ ডার্লিং।

শমিতা তার কাঁধ থেকে প্রবীরের হাত দুটো ছুঁড়ে ফেলে আমাকে বলল, চলে এসো-

কিন্তু আরেকবার পা বাড়াতে গিয়ে শমিতাকে থামতে হল। প্রবীর আবার তার দুই কাঁধ চেপে ধরেছে। শমিতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ডোন্ট ক্রিয়েট সিন–

প্রবীর বলল, সিন ক্রিয়েট করার কোনও দরকারই হবে না যদি তুমি আমার সঙ্গে যাও

হে মহান জনগণ, আপনাদের রাজীব সরকার–অর্থাৎ আমি এতক্ষণ একটি কথাও বলিনি এবার আর চুপচাপ থাকা গেল না, প্রবীরকে বললাম, শমিতা যখন যেতে চাইছে না, ইনসিস্ট করছেন কেন?

প্রবীর কিন্তু স্প্যানিশ মাতাদোরের মতো আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ইউ সাট আপ সোয়াইন

আমার মাথায় চিড়িক করে ইলেকট্রিক শকের মতো কিছু খেলে গেল তবু যতটা সম্ভব মেজাজ শান্ত রেখে বললাম, আপনি যা বললেন তার উত্তর আমার জানা আছে। সেটি দিতে বাধ্য করবেন না।

আর একটা কথা বললে, তোমার মুখে একটা দাঁতও আস্ত থাকবে না রাসকেল–বলে উঠল প্রবীর।

হে মহান জনগণ, আমি একটা ভদ্রলোকের ছেলে; পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স হলেও রক্তের উত্তাপ এখনও যথেষ্ট আছে। সুতরাং নিজের অজান্তে এবং প্রবীর কিছু বুঝবার আগেই তার চোয়ালে আমার একটা ঘুষি নেমে গেল। পরক্ষণেই দেখা গেল ছোকরা প্রায় পনেরো ফুট দূরে মাটির ওপর শুয়ে আছে।

একটু বাদেই স্প্রিংয়ের মতো প্রবীর লাফিয়ে উঠল এবং হে মহান জনগণ, ইংরেজি ভাষার সব চাইতে নোংরা গোটাকয়েক খিস্তি আউড়ে আবার আমার দিকে দৌড়ে এল–তার মাথায় এখন খুন চেপে গেছে।

সুতরাং হে মহান জনগণ, আমাকে দ্বিতীয়বার তার চোয়ালে আরেকটা ঘুষি জমিয়ে দিতে হল। এবারও পনেরো ফুট দুরে ছিটকে গিয়ে শুয়ে পড়ল সে; আর উঠল না।

এদিকে চারপাশ থেকে লোকজন হই-চই করে ছুটে আসতে লাগল। আমি হাত দুটো ঝেড়ে দারুণ নির্বিকার মুখে শমিতাকে বললাম; চলো

শমিতা থ হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, ভয় আর সেই সঙ্গে খানিকটা রিলিফ মানে স্বস্তির ভাবও যেন মেশামেশি করে রয়েছে। আমাকে এই চেহারায় দেখবে, সে হয়তো ভাবতে পারেনি।

যাই হোক, শমিতা আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল।

পার্কিং জোনে এসে আমরা গাড়িতে উঠলাম। শমিতা স্টার্ট দিয়ে তার ফিয়েটটা রেস কোর্সের বাইরে নিয়ে এল। উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে সে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ

জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ ধন্যবাদ কেন?

ওই বিস্টটার হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, তাই বলে একটু থামল শমিতা। তারপর আবার শুরু করল, তুমি না থাকলে ও আমাকে নিশ্চয়ই ওর অ্যাপার্টমেন্টে টেনে নিয়ে যেত। আর আজকের রাতটা আটকে রাখত। এতক্ষণে শমিতার স্বস্তির কারণটা বোঝ গেল। তবে আমি আর কিছু বললাম না।

রেস কোর্সের পিছন দিয়ে গাড়িটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে নিয়ে এসেছিল শমিতা। ডাইনে ঘুরে চৌরঙ্গীর দিকে যেতে যেতে সে বলল, তবে আমার খুব ভয় করছে।

ফিরে বললাম, কীসের ভয়?

শমিতা বলল, ওই প্রবীর–হি ইজ এ ডার্টি রোগ; দারুণ ভিন্ডিকটিক। তুমি একটু সাবধানে থেকো।

আমার ওপর দুশ্চিন্তার ছায়া পড়তে পড়তেই মিলিয়ে গেল। কিছু বললাম না। আচমকা শমিতা জিগ্যেস করল, আচ্ছা, তুমি ওকে মারলে কেন?

বললাম, তোমরা ওপর ওইরকম জোর করছিল। তা ছাড়া আমাকে শুধু শুধু যা তা খিস্তি করল। তাই

নাকি কারণটা অন্য? গাড়ির স্পিড কমিয়ে আমার দিকে তাকাল শমিতা। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে নীচু গলায় বলল, মানে আমাকে ভালোবেসে-টেসে ফেলেছ নাকি?

আমার হার্ট লাংস ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চমকে খেলে গেল। হে মহান জনগণ, অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি, মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার বিজনেস পার্টনার মানে লতিকার সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে। আমার প্রতি তার দুর্বলতা সব সময়ই টের পাই। কিন্তু তার সম্পর্কে আমার যে সহানুভূতি বা ফিলিং সেটা ভালোবাসার কতটা কাছাকাছি তা আমার নিজের কাছেই খুব স্পষ্ট নয়।

কিন্তু এই মেয়েটা, অর্থাৎ শমিতার পিছনে কদিন ধরে বঁড়শিতে আটকানো মাছের মতো যে ছুটে বেড়াচ্ছি সেটা কি শুধুমাত্র তাকে মদ জুয়া রেস ইত্যাদির অ্যাডিকসান থেকে ফেরাবার জন্যে? আগেও দু-একবার ভেবেছি, এখনও মনে হল, হে মহান জনগণ-আমি ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছি। হেসে হেসে বললাম, কী জানি–

আমরা চৌরঙ্গীতে চলে এসেছিলাম। কিছু বুঝবার আগেই আচমকা শমিতা গাড়িটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বলল, আজ আর হোটেলে খাব না।

তবে?

কিছুদিন ধরে দেখছি হোটেলে বারো পেগ ড্রিংক করার পরও আউট হইনি। আজ ক্লাবে বসে হুইস্কি খাব।

হে মহান জনগণ, মেয়েটা আমাকে দারুণ ঝামেলায় ফেলে দিল তো। হোটেল ষড়যন্ত্র করে হুইস্কিতে জল মেশাবার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সব জায়গায় কি তা সম্ভব?

ল্যান্সডাউন রোডের এক পশ ক্লাবে এসে সুইমিং পুলে ঘণ্টাখানেক সাঁতার কাটল শমিতা। সাঁতার-টাতার কাটার পর কিছু খাবার আর ড্রিংক নিয়ে আমার মুখোমুখি বসল শমিতা। আজ এগারোটার মধ্যেই বারো পেগের কোটা কমপ্লিট করে পুরোপুরি আউট হয়ে গেল সে। অবশ্য আউট হবার আগেই কালকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করে নিয়েছিল। কাল দুটোর সময় বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে।

শমিতাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন এন্টালি এলাম একটা বেজে গেছে।

.

১৭.

পরের দিন ঠিক দুটোর সময় বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে থেকে আমাকে গাড়িতে তুলে নিল শমিতা, তারপর পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে যেতে বলল, কোথায় যাওয়া যায় বলো তো? ক্লাব হোটেল এসব বোরিং লাগছে।

আজ সকালেই মাথায় একটা দারুণ প্ল্যান এসে গেছে। বললাম, তুমি এ কদিন আমাকে যেখানে নিয়ে গেছ সেখানেই গেছি। চলো, আজ তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই। যাবে?

কোথায়?

গেলেই বুঝতে পারবে।

আচ্ছা যাব।

তাহলে গাড়ি থামিয়েই আমার জায়গায় এসো। আমাকে ড্রাইভ করতে দাও। ঘণ্টা দুয়েক পর শমিতাকে নিয়ে সোজা ডায়মণ্ড হারবার চলে এলাম। ট্যুরিস্ট লজে কফি-টফি খেয়ে আমরা যখন নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম তখন বিকেল। ঝকঝকে সোনালি রোদ জলের ওপর স্থির হয়ে আছে।

বিশাল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে শমিতা বলল, বিউটিফুল।

আমি আস্তে মাথা নাড়লাম।

শমিতা এবার বলল, অনেক দিন পর ডায়মণ্ড হারবার এলাম। একটু থেমে অন্যমনস্ক মতো আবার বলল, জানো, ছেলেবেলায় একেকদিন বাবা আমাদের ডায়মণ্ড হারবার নিয়ে আসতেন। কী ভালো যে লাগত।

মুখ ফসকে বলে বললাম, কার কথা বলছ–মিস্টার সান্যালের?

আরে না, ও তো মার সেকেন্ড হাজব্যান্ড। হি ইজ এ সোয়াইন।

আমি আমার নিজের বাবার কথা বলছি।

যদি কিছু মনে না করে একটা কথা জিগ্যেস করব?

নিশ্চয়ই করবে। মনে করার কী আছে?

বাবাকে তোমার দেখতে ইচ্ছা করে না?

করে তো। কিন্তু দেখব কী করে? হি ইজ নাউ ইন কানাডা

বললাম, তোমাদের তো পয়সার অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই তো তুমি বাবার কাছে চলে যেতে পারো।

তা হয়তো পারি। কিন্তু এতদিন মা যেতে দেয়নি; তারপর কত রকম অ্যাডিকসানের মধ্যে জড়িয়ে গেছি। বাবা এমনিতে খুব লিবারেল কিন্তু এসব নেশা-টেশা নোংরামি একেবারেই পছন্দ করেন না। অথচ জানো

কী?

আমার বিশ্বাস, বাবার কাছে যেতে পারলে আমি বেঁচে যেতাম।

একটু চুপ করে থেকে বললাম, বাবার কাছেই তোমার যাওয়া উচিত।

দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আবছা গলায় শমিতা বলল, সাহস হয় না। যদি কোনওদিন নোংরা হ্যাবিটগুলো ছাড়তে পারি তবেই যাবার কথা ভাবব।

হ্যাবিটগুলো ইজিলি ছাড়তে পারো। মানুষ ইচ্ছা করলে না পারে কী?

আমার পক্ষে এগুলো ছাড়া ইমপসিবল। তোমাকে আমার লাইফের সব কথা বলেছি না। আমি একটা দারুণ ভ্যাকুয়ামের মধ্যে আছি। সেটা ভুলবার জন্যেই ওই হ্যাবিটগুলোর আমার দরকার।

আমি চুপ করে রইলাম। একটু পর টুপ করে সূর্যটা নদীর জলে ডুবে গেল। আর সন্ধ্যা নামতে না নামতেই চনমনে হয়ে উঠল শমিতা। বলল, আই–

তার চোখ-মুখের লক্ষণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবু জিগ্যেস করলাম, কী বলছ?

এখানে হুইস্কি-টুইস্কি পাওয়া যাবে?

কলকাতা থেকে মাত্র তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে মদ্য পাওয়া যাবে না, এ কখনও হয়! কিন্তু সে কথা কি আর বলি। যা বললাম তা এই রকম–হুঁইস্কি কেন, এক ফোঁটা কান্ট্রি লিকারও পাওয়া যাবে না।

শমিতা বলল, ভীষণ ড্রিংক করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার জন্যে তো কলকাতায় ফিরতে হয়।

আমি ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে গেলাম। ফেরার জন্যে না শমিতা ক্ষেপে ওঠে। কিন্তু না, সে আবার বলল, নদীর পাড়টা খুব ভালো লাগছে। এখন আর কলকাতায় ফিরব না।

রাত্রে ফেরার সময় শমিতা বলল, একটা কথা ভেবে ভীষণ মজা লাগছে।

বললাম, কী কথা?

অনেক দিন পর আজকের দিনটা আমার উইদাউট ড্রিংক কাটল।

খুব খারাপ লাগল কি?

শমিতা হাসল, না না। তবে গলাটা খুব খুসখুস করছে। অনেক দিনের হ্যাবিট তো।

আমিও হাসলাম।

আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর আজই প্রথম সজ্ঞানে স্বাভাবিক ভাবে বাড়ি ফিরল শমিতা। তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলর রোডে রেখে ট্যাক্সি ধরলাম।

হে মহান জনগণ, আগেই বলেছি আমার আস্তানায় যেতে হলে ট্রাম রাস্তা থেকে গলির ভেতর ঢুকতে হয়।

ট্যাক্সিটা বড় রাস্তায় ছেড়ে গলি দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি দুটো লোক কোত্থেকে মাটি খুঁড়ে আমার পিছু নিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তারাও দাঁড়িয়ে গেল। তাদের চালচলন কেমন যেন সন্দেহজনক। চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে তোমরা?

হঠাৎ লোক দুটো পিছন ফিরে দৌড় লাগাল এবং সাপের মতো এঁকে বেঁকে মাঝরাতের অন্ধকার নির্জন রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারেই ঝাপসা থেকে গেল।

.

১৮.

পরের দিন আবার শমিতাকে নিয়ে কলকাতা থেকে উধাও হলাম। আজ গেলাম ব্যারাকপুরে। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম।

এর পর থেকে শমিতাকে নিয়ে রোজই অনেক দূরের কোনও খোলা মাঠে, শালবনে, কিংবা নদীর পাড়ের ছোটখাটো গঞ্জে অথবা নাম-না-জানা কোনো অজ পাড়াগাঁয়ে চলে যাই। রাতের অনেকটা সময় পর্যন্ত কাটিয়ে তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে রেখে আসি। বাইরে কাটাবার জন্যে ড্রিংকটা সে আর করতে পারছে না। প্রথম প্রথম এ জন্যে তার অসুবিধা হত। কিন্তু দু-চার দিন যেতে না যেতে ড্রিংকের কথা সে আর বলে না।

আসলে কলকাতার কটা ক্লাব, হোটেল, রেস কোর্স আর জুয়ার আড্ডার মধ্যে থেকে থেকে তার লাইফ বোরিং হয়ে উঠেছিল। হাজার গন্ডা অ্যাডিকশানের ঘোর কাটিয়ে যখন তাকে বাইরে বার করে আনলাম সে যেন বেঁচে গেল। বিশাল খোলা মাঠ, সবুজ গাছপালায় ঘেরা স্নিগ্ধ গ্রাম কিংবা নদী তীর–এ পর্বের মধ্যে যে এত আনন্দ ছিল সে জানত না।

আগে আগে শমিতা মজা করে বলত, তুমি একটা আস্ত ডেভিল–যাতে ড্রিংক না করতে পারি, রেস কি গ্যাম্বলিং নিয়ে না মাতি সেইজন্যে আমাকে রোজ কলকাতার বাইরে নিয়ে যাও। তোমার মতলব আমি বুঝি?

আমি হাসতে থাকি; উত্তর দিই না।

কোনও দিন বা শমিতা বলে, আই অ্যাম ভেরি মাচ থ্যাঙ্কফুল টু ইউ-মনে হচ্ছে তোমার জন্যে অ্যাডিকশান আর ব্যাড হ্যাবিটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব। এক এক সময় আমার কী মনে হত জানো?

কী?

হোল লাইফ আমি অ্যাবনরম্যাল থেকে যাব। কিন্তু এখন আমি বিশ্বাস করি–তুমি যদি আরেকটু হেল্প করো আমি পুরোপুরি নর্মাল হয়ে যাব।

গম্ভীর গলায় বলি, আমি সব সময় তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছি শমিতা।

এনি হেল্প-আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি।

.

রোজ নিয়ম করে বাইরে ঘুরতে ঘুরতে একদিন একটা দারুণ ব্যাপার ঘটে গেল। সেদিন আমরা একটা গ্রামে গেছি। দেড়-দুশো মাইল দূরে বে অফ বেঙ্গলে কোথায় যেন আচমকা নিম্নচাপ হয়েছিল; তার ফলে অসময়ে বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টিটা এমনই একটানা আর নাছোড়বান্দা যে থামবার লক্ষণ নেই। সুতরাং এক চাষীর বাড়িতে থেকে যেতে হল।

ওরা খাইয়ে-দাইয়ে আমাদের একটা ঘরের ভেতর পুরে দিল। ঢুকে দেখি তক্তপোষে পাশাপাশি বালিশ পেতে আমাদের জন্যে বিছানা করা রয়েছে।

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ বিছানাটা দেখল শমিতা। তারপর শব্দ করে হেসে উঠল, ওরা আমাদের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ভেবেছে।

বললাম, তাই মনে হয়।

আজ রাতটার জন্যে টেম্পোরারি হাজব্যান্ড-ওয়াইফ হতে আমার আপত্তি নেই। হে মহান জনগণ, আমি যে ভেতরে ভেতরে মেয়েদের ব্যাপারে দারুণ পিউরিটান আর নীতিবাগীশ এই প্রথম টের পেলাম। আমি করলাম কী, তক্তাপোষ থেকে একটা বালিশ আর চাদর তুলে নিয়ে মেঝেতে বিছানা পাতলাম। বললাম, তুমি ওপরে শোও। আমি নীচে শুচ্ছি।

কেন?

আমি, অন্য ঘরে শুতে পারতাম। কিন্তু সে কথা বলতে গেলেই এ বাড়ির লোকেরা জেরা করে করে লাইফ হেল করে দেবে। সুতরাং আমাদের সম্বন্ধে ওরা যা ভেবেছে তা আর ভাঙানোর দরকার নেই। রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে কাল ভালো ভালোয় কেটে পড়তে পারলেই আমি খুশি।

শমিত তক্তপোষে উঠে শুয়ে পড়ল। আমি মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।

শমিতার শিয়রের দিকে একটা উঁচু টুলের ওপর হ্যারিকেন জ্বলছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটা নেভাতে নেভাতে চাপা গলায় বলল, কাওয়ার্ড।

কথাটা কাকে লক্ষ্য করে বলা, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। হে মহান জনগণ, আমি জবাব দিলাম না; ঘাড় মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম।

পরের দিন সকালে কলকাতায় ফেরার সময় শমিতা বলল, একদিন তোমার বাড়িতে আর কাল ওই চাষীদের ঘরে-দু-দুবার চান্স পেয়েও তুমি আমায় ছেড়ে দিলে। ইউ আর অলমোস্ট লাইক গড়।

উত্তর দিলাম না; জানালার বাইরে ধু-ধু ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শমিতা আবার বলল, যদি ফ্ল্যাটারি না ভাবো, একটা কথা বলব?

জানালাম ফ্ল্যাটারি ভাবব না। শমিতার যা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে বলতে পারে।

শমিতা খুব গাঢ় গলায় এবার বলল, বাবাকে বাদ দিলে ছেলেবেলা থেকে এমন কারোকে পাইনি যাকে শ্রদ্ধা করতে পারি, যার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। বহুদিন পর একমাত্র তোমাকেই পেলাম যাকে এখন থেকে বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা দুটোই করতে পারব।

হে মহান জনগণ, মেয়েটা বলে কী! প্রায় চমকেই উঠলাম। আমি কী বস্তু শমিতা তো জানে না। জানলে কোথায় থাকত তার বিশ্বাস আর কোথায়ই বা শ্রদ্ধা! যাই হোক এমন কথা আগে আর কখনও কেউ আমাকে বলেনি। আমার স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো কিছু বয়ে যেতে লাগল।

.

১৯.

যেদিন শমিতা আর আমি চাষীদের বাড়ি রাত কাটিয়ে এলাম তার দুদিন পরের কথা।

আজ আমরা বর্ধমানের একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। অন্য দিনের মতো আজও কলকাতায় ফিরে শমিতাকে ওদের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। তারপর ট্যাক্সি ধরে সোজা এন্টালিতে।

বড় রাস্তায় ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির সামনে যখন এসে গেছি দেখতে পেলাম গেটের কাঠে কটা ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িরই ছেলে ওরা, খুব সম্ভব নাইট শোতে সিনেমা দেখে এসেছে; এখন তাই নিয়ে গল্প করছে।

আচমকা পিছন থেকে আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে একটা হাতবোমা উড়ে গিয়ে সামনের দেয়ালে ফাটল। দারুণ জোরে একটা শব্দ হল; সেই সঙ্গে আগুনের ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দিল। চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম বিশ গজ দুরে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনে হল, সেদিন এরাই আমার পিছু নিয়ে এই গলিতে এসেছিল।

আমাকে ঘুরতে দেখেই ওরা আবার দুটো বোমা ছুড়ল। টার্গেটটা যে আমিই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু এবারের দুটো বোমাও আমার গায়ে লাগল না; উড়ে গিয়ে ওধারের বাড়ির একটা দেয়ালে গিয়ে ফাটল।

হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝবার বা করবার আগেই দেখলাম হল্লা করতে করতে আমাদের বাড়ির সেই ছোকরারা সেই লোক দুটোর দিকে দৌড়ে গেল এবং চোখের পলকে একটাকে ধরেও ফেলল। অন্য লোকটাকে অবশ্য ধরা গেল না; সে অন্ধকারে সাপের মতো পিছনে বেরিয়ে গেছে।

বেদম পিটতে পিটতে টেনে হিঁচড়ে ছোকরাগুলো লোকটাকে যখন আমার কাছে নিয়ে এল তার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

ছেলেদের থামিয়ে বললাম, কে তুমি?

হাতের পিঠ দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে লোকটা গোঙানির মতো শব্দ করল, আমাকে ছেড়ে দিন বাবু

ছেড়ে দেব কিন্তু তার আগে বলতে হবে কেন তুমি আমাকে পেটো মারলে? কে তোমাকে পাঠিয়েছে?

প্রথমে কিছুতেই বলবে না। শেষে যখন তার গলার নলি টিপে ধরে বললাম, জানে খতম করে দেব, তখন সব স্বীকার করল লোকটা। প্রবীর সিনহা তাদের আমার পিছনে লাগিয়েছে। কদিন ধরে আমাকে ফলো করে শেষ পর্যন্ত আজ তারা সুযোগ বুঝে বোমা ছুঁড়েছিল।

প্রবীর সিন্হা মানে রেস কোর্সের সেই ছোকরা। শমিতা বলেছিল সে খুব ডার্টি টাইপের লোক; ভয়ানক ভিনডিক্টিভ। ডার্টি টাইপ তাতে কোনওরকম সন্দেহ নেই। তবে তার সাহস যে নেই, সেটা সে প্রমাণ করে দিয়েছে। সাহস থাকলে সোজা আমার সামনে এসে চোয়াল ভেঙে দিত। তার বদলে দুটো থার্ড ক্লাস গুন্ডাকে আমার পিছনে লাগিয়েছে। হে মহান জনগণ, প্রবীরটা একেবারেই ছ্যাচড়া।

আমি লোকটাকে বললাম, ঘুরে দাঁড়া–

ভয়ে ভয়ে সে পিছন ফিরে দাঁড়াল। আমি তখন তার পাছায় টেনে একটা লাথি কষিয়ে বললাম, ফরোয়ার্ড।

লোকটা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার ওপর পড়ল। তারপর ধাঁ করে উঠেই চো-চা ছুট। আমি আর দাঁড়ালাম না; ছেলেদের নিয়ে সদলবলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম প্রবীর সম্বন্ধে আমার আর দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। ওর দৌড় আমার জানা হয়ে গেছে।

.

২০.

দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিয়ে প্ল্যানস নামে নতুন বিভাগটা খোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছে লতিকা। রেসপন্স ভালোই পাওয়া যাচ্ছে। লতিকা এবং আমার আশা এই ডিপার্টমেন্টটা দুমাস যদি টিকিয়ে রাখা হয় নিট লাখখানেক টাকা আমাদের হাতে এসে যাবে।

আজ আবার লতিকা অফিসে আসেনি। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে বাড়ির একটা ব্যাপারে ভীষণভাবে আটকে গেছে। কাজেই কাচের  দেয়ালের ওধারে আধখানা চেম্বার এখন ফাঁকা। লতিকা থাকলে খানিকক্ষণ গল্প-টল্প করা যায়। একলা বসে বসে ভীষণ বোরিং লাগছে; হাই উঠছে ঘন ঘন।

আরামদায়ক রিভলভিং চেয়ারে গা এলিয়ে যখন খানিকটা ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করছি সেইসময় দরজার কাছে খুট খুট আওয়াজে তাকালাম। আর তাকিয়েই মনে হল আমার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। মণিমোহন মল্লিক সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

চোখাচোখি হতেই মণিমোহন বললেন, মে আই কাম ইন

বিশেষ করে যার জন্যে পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিতে হয়েছে তিনি যে এখানে সরাসরি চলে আসতে পারেন, ভাবতেই পারিনি। ভেবেছিলাম ডিপার্টমেন্ট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ও ব্যাপারটার ওপর যবনিকা পতন হয়ে গেছে।

হে মহান জনগণ, আমার বেশ ভয়ই করতে লাগল কিন্তু কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপরেই মণিমোহনকে দেখে খুশিতে ফেটে পড়ার মতো ভাব করে বললাম, আসুন স্যার, আসুন

মণিমোহন ভেতরে ঢুকে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন। তার হাতে একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। সেটা আমার টেবলি রাখতে রাখতে বললেন, কদিন ধরেই আপনাকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছি কিন্তু যতবারই কানেকসান হচ্ছে ততবারই শুনছি পার্সোনাল বলে কোনও অফিস নেই। ব্যাপারটা কী বুঝবার জন্য সরেজমিন তদন্তে আসতে হল। অকুস্থলে এসে দেখি সত্যি সত্যি অফিসটা নেই। তার জায়গায় প্ল্যানস বলে একটা অফিস বসেছে। ওটা তো আপনারই?

স্বীকার করতে হল। ঢোঁক গিলে বললাম, হ্যাঁ। মানে ওই কারবারটা ভালো চলছিল না। তাই তুলে দিতে হল।

আমাকে এ ব্যাপারটা জানানো উচিত ছিল। কারণ আমি আপনার পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টের ক্লায়েন্ট।

ভেবেছিলাম দু-একদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেব।

কী একটু ভেবে মণিমোহন বললেন, ভালো কথা, আসবার সময় প্ল্যানসের পাশে পাস্ট-প্রেজেন্ট-ফিউচার আর ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন বলে দুটো অফিসও দেখলাম। মনে হচ্ছে ওগুলোও আপনারই।

হে মহান জনগণ, এ রকম ঝামেলায় আগে আর কখনও পড়িনি। বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মতো উল্টোপাল্টা জেরা করে লোকটা কী জানতে চায়? খুব সাবধানে তাকে লক্ষ্য করতে করতে বললাম, না-না, ওগুলোর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ওগুলো সেপারেট কনসার্ন।

স্থির চোখে আমার দিকে পুরো একটা মিনিট তাকিয়ে থাকলেন মণিমোহন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।

বাইরে স্মার্ট থাকলেও ভেতরে ভেতরে দারুণ উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মণিমোহন বললেন, ফোটোগ্রাফগুলোর কী হল?

ঢোক গিলে বললাম, এখনও তো অনেক সময় আছে।

অনেক নেই। আর মাত্র পাঁচটা দিন রয়েছে।

আচমকা আমার মনে পড়ে গেল, এ মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়ে রেখেছিলেন মণিমোহন। আর কী আশ্চর্য, মনোবীণা সান্যালও তো ওই একই তারিখ দিয়েছেন। আর আজ হল এ মাসের ফিফথ।

মণিমোহন আবার বললেন, আপনার মতলবটা কী?

তার গল্প স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে চমকে উঠলাম। বললাম, মতলব?

আমার মনে হচ্ছে ফোটোগুলো আপনি দেবেন না। খুব সম্ভব এটাই আপনার মতলব।

হঠাৎ আমার রক্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রায় চিৎকার করেই বললাম, ঠিকই ধরেছেন, ফোটো আমি দেব না।

দারুণ ঠান্ডা গলায় মণিমোহন বললেন, আস্তে মহাশয়, আস্তে। ডোন্ট বি সো একসাইটেড। ওতে ব্লাড প্রেসার চড়ে যায়। একটু থেমে বললেন, কিন্তু আপনার সঙ্গে সেই রকম চুক্তিই ছিল। সেইজন্যে পাঁচ হাজার টাকা আর একটা দামি ক্যামেরা দিয়েছিলাম।

আপনার কথামতো কাজ করতে আমি রাজি না। তবে টাকাটা আর ক্যামেরা ফেরত দিতে রাজি আছি।

সেই সঙ্গে ফোটোগুলোও তুলে দেবেন।

নো, নেভার–দাঁতে দাঁত চাপলাম, আপনার মতো ব্ল্যাকমেলারের হাতে ওই নুড ছবি কিছুতেই তুলে দেব না।

পকেট থেকে পাইপ আর টোব্যাকো বার করলেন মণিমোহন। ধীরে সুস্থে পাইপে তামাক পুরতে পুরতে বললেন, দেবেন, নিশ্চয়ই দেবেন

তার মানে?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে মণিমোহন জিগ্যেস করলেন, আপনাদের এখানে প্লাগ পয়েন্ট আছে।

অবাক হলেও বললাম, আছে।

কোথায়?

দেখিয়ে দিলাম। মণিমোহন উঠে গিয়ে প্লাগ পয়েন্ট কানেকসান করে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এতদিন মণিমোহনের সঙ্গে ফোনে যে সব কথা বলেছি সেগুলোই রেকর্ডার থেকে উঠে আসতে লাগল। যেমন আমি শমিতার ন্যড ছবি আর বেডরুম সিনের পিকচার তুলব।-এই কথাটাই বার বার শোনা যেতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য, মণিমোহন আমাকে যা-যা বলেছেন সেগুলো শুনতে পাচ্ছি না। তার মানে নিজের কথাগুলো মণিমোহন ইরেজ করে ফেলেছেন।

নিজের গলা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিল। গলগল করে ঘামতে লাগলাম। এদিকে টেপ রেকর্ডার থামিয়ে মণিমোহন বললেন, পাঁচ হাজার টাকা, ক্যামেরা আর শমিতার ফোটোগুলো দিতে এবার আর আপত্তি হবে না আশা করি। যদি হয় আমাকে এই টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে কোর্টে যেতে হবে।

আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই মণিমোহন আবার বলে উঠলেন, আমি আপনার কাছে এসেছি; ইচ্ছা করলে জোর করে এই টেপ রেকর্ডারটা কেড়ে নিতে পারেন। কিন্তু আপনার জেনে রাখা ভালো, এ রকম আরো পাঁচটা টেপে আপনার কথাগুলো ধরা আছে। কাজেই লাভ হবে না।

হে মহান জনগণ, আমার রি-অ্যাকশানটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। এই লোকটা কী আশ্চর্য ঠান্ডা মাথায় একই সঙ্গে শমিতা আর আমাকে একই ফাঁদে ফেলতে চাইছে; একই সঙ্গে দুজনকে ব্ল্যাকমেলের জালে পোরার প্ল্যান নিয়েছে। মাথাটা দারুণ পরিষ্কার তার, কিন্তু আমার কোমরের বেল্ট আলগা হয়ে যাচ্ছিল। আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না।

এদিকে মণিমোহন মল্লিক উঠে পড়েছিলেন। টেপ রেকর্ডারটা হাতে ঝুলিয়ে বললেন, আর পাঁচ দিন দেখব। এর মধ্যে ফোটো, টাকা, ক্যামেরা না পেলে শমিতা বোসের ছবির জন্যে আমাকে অন্য লোক অ্যাপয়েন্ট করতে হবে। আর আপনার সম্বন্ধে আমি কিছু খোঁজ খবর নিয়েছি। সেই সব

আমি প্রায় আঁতকেই উঠলাম, আমার সম্বন্ধে কী খোঁজখবর?

এক্ষুনি বলছি না। পাঁচ দিন দেখব, তারপর যা হয় করব। আচ্ছা নমস্কার।

মণিমোহন মল্লিক চলে গেলেন। বেশ বুঝতে পারছি আমি লোকটার হাতের ভেতর চলে গেছি। বাঘ যেমন তার শিকার নিয়ে খেলে সেও আমাকে নিয়ে তেমনি খেলবে মনে হচ্ছে।

ইচ্ছা করলেই শমিতার নুড ছবি আমি তুলে দিতে পারি। কিন্তু না, কিছুতেই দেব না। হাজার রকম অ্যাডিকশান দিয়ে ঘেরা একটা নোংরা কদর্য ওয়ার্ল্ড থেকে যাকে বার করে এনেছি কিছুতেই তার ক্ষতি হতে দেব না। কিন্তু শমিতার সম্বন্ধে এত দুর্ভাবনা কেন আমার? হে মহান জনগণ, সেই কথাটা আরেকবার মনে পড়ে গেল–আমি কি তবে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি?

.

২১.

তিনটে দিন শমিতাকে একরকম পাহারা দিয়েই কাটিয়ে দিলাম। তারপর চতুর্থ দিন অফিসে আসতেই মনোবীণা সান্যালের ফোন এল। মনোবীণা বললেন, কাল ভোর পাঁচটার ভেতর একবার আসতে হবে; বিশেষ দরকার।

আমি বললাম, কিন্তু শমিতা যদি আমাকে আপনার সঙ্গে দেখে ফেলে—

অত ভোরে ও ওঠে না।

—আচ্ছা আসব।

পরের দিন ভোরে মনোবীণা সান্যাল তাদের বাড়ির বাইরের লনে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি যেতেই বললেন, আমি আপনার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। ভোরাকে সত্যিই আপনি ফেরাতে পেরেছেন। তার ব্যাড হ্যাবিটগুলো কেটে যাচ্ছে। এখন ও আর ড্রিংক করে না; নেচারও অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। রিয়ালি আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ

শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যেই কি মহিলা এত ভোরে আমাকে আসতে বলেছেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

মনোবীণা আবার বললেন, এতটা করেছেন; এবার বাকি কাজটুকু কাইন্ডলি করে দিন।

কী কাজ?

হাত ব্যাগ খুলে দুটো ট্রেনের টিকেট আর একটা ঠিকানা বার করে আমাকে দিলেন মনোবীণা। দেখলাম টিকেট দুটো বম্বের। ঠিকানাটাও বম্বেরই–ডক্টর দেবতোষ বোস, আরব সাগর, ভিলে পার্লে স্কীম, সেভেন্থ ফ্লোর, সুইট নাম্বার ২৭, বম্বে।

মনোবীণা বলতে লাগলেন, আজই সন্ধের ট্রেনে ভোরাকে নিয়ে বম্বে চলে যান; ওকে ওই ঠিকানায় পৌঁছে দেবেন।

শমিতার মুখে তার বাবার কথা আগেই শুনেলািম। তবু ইচ্ছা করেই বললাম, এক্সকিউজ মি, একটা কথা জিগ্যেস করব?

কী?

ডক্তর দেবতোষ বোস কে?

মনোবীণা সেদিনের মতো রেগে উঠলেন না। আস্তে করে বললেন, শমিতার বাবা; আমার আগেকার স্বামী। একটু থেমে অন্যমনস্কর মতো আপন মনেই আবার বললেন, আমার লাইফটা তো নষ্টই হয়ে গেল। ডেরা ওর বাবার কাছে গিয়ে বাঁচুক।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু বাদেই মনোবীণার অন্যমনস্কতা কাটল। বললেন, তাহলে আজই যাচ্ছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ও ভালো কথা বলতে বলতেই মনোবীণা সান্যাল। ব্যাগ থেকে একটা সাদা এনভেলাপ আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।

কী এটা! আমি কিছুটা অবাকই হলাম।

আট হাজার টাকা আছে এতে। আপনার রেমুনারেশন দশ হাজারের মধ্যে দুহাজার অ্যাডভান্স করা ছিল। বাকিটা

এনভেলাপটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, এটা নিতে পারব না।

মনোবীণা বিমূঢ়ের মতো তাকালেন, কেন?

আপনার কাজটা নেবার আগে শমিতার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তারপর ওর সঙ্গে আলাপ হল, ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম। নাউ উই আর গুড ফ্রেন্ডস। যদি কিছু আমি করে থাকি তা করেছি বন্ধুর জন্যে, কিছু করে মজুরি নিতে পারব না। অ্যাডভান্সের টাকাটা বম্বে থেকে ফিরেই সেটা দিয়ে যাব।

আমি চলে এলাম। মনোবীণা সান্যাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

.

২২.

হঠাৎ বম্বে যাবার কথা বলতে অবাক হয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিন্তু আমার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তাই একটা প্রশ্নও না করে আমার সঙ্গে পরশু দিন ট্রেনে উঠে পড়েছিল সে।

আজ সকালে আমরা বম্বের শহরতলীতে দাদার স্টেশনে পৌঁছেছি। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে ভিলে পার্লে স্কিমে গিয়ে দেবতোষ বোসের স্যুইটটা যখন বার করলাম তখন নটাও বাজেনি।

কলিং বেল টিপতেই যিনি দরজা খুলে দিলেন তার বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন। ইস্পাতের ঝকঝকে ফলার মতো চেহারা, টকটকে রঙ, কাটা-কাটা ধারালো মুখ, শরীরের এক মিলিগ্রাম অনাবশ্যক মেদ নেই। তবে চোখ দুটি দূরমনস্ক। ইরেজিতে যাকে বলে ড্রিমি ঠিক তাই।

ভদ্রলোক কিছু বলবার আগেই হে মহান জনগণ, একটা দারুণ নাটকীয় ব্যাপার ঘটে গেল। হঠাৎ তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ডোরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বাবা, আমি–আমি ভোরা–

বুঝতেই পারলাম ইনি ডক্টর দেবতোষ বোস। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোর মা চিঠি দিয়েছিল; তুই আসবি। চল্ মা, ভেতরে চল্‌-আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার নাম তো রাজীব।

বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ।

এসো–

কিছুক্ষণ পর আবেগের ঢেউটা থিতিয়ে এলে একটা ঘরে শমিতা আর আমি মুখোমুখি বসলাম। সে বলল, এই জন্যেই তুমি আমাকে বম্বে এনেছিলে?

হ্যাঁ–আস্তে মাথা নাড়লাম, শুধু তাই না, তুমি যাতে তোমার বাবার কাছে আসতে পারো সেইজন্যেই তোমার সঙ্গে এতদিন মিশেছি, বন্ধুত্ব করেছি।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

মনোবীণা সান্যাল আমার ওপর শমিতার কী দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং কীভাবে আমি তা পালন করেছি খুব সংক্ষেপে সে-সব জানিয়ে বললাম, পিতা এবং কন্যার পুনর্মিলন হয়ে গেছে। এবার আমার একজিটের পালা। আজই আমি চলে যাব শমিতা।

শমিতা হতবাক, আজই!

হ্যাঁ।

কেন, কদিন থেকে যাও না।

না, তার উপায় নেই। কলকাতায় আমার অনেক কাজ রয়েছে।

তবে আবার কবে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে?

আর দেখা না হওয়াই ভালো।

কেন?

তুমি আমাকে জানো না শমিতা–আমি একজন

একজন কী?

প্রতারক। তোমার জীবনে আমার ছায়া না পড়াই ভালো।

শমিতা বিষণ্ণ চোখে তাকাল, তুমি যাই হও, আমার তাতে দরকার নেই। তুমি আমার ফ্রেন্ড; আমি–আমি তোমাকে ভালোবাসি-

এই কথাটা চিরদিন মনে রাখব। আমি করুণ ভাবে হাসলাম।

.

২৩.

দুদিন পর কলকাতায় ফিরে সোজা অফিসে চলে এলাম। কে জানত, পুলিশ ফাঁদ পেতে রেখেছে। অফিসে পা দিতে না দিতেই সেই ফাঁদে পড়ে গেলাম। চোখে পড়ল আমাদের তিনটে ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ পাস্ট-প্রেজেন্ট-ফিউচার, ন্যাশনাল ডিকেটটিভ কনসার্ন এবং প্ল্যানসের দরজায় তালা ঝুলছে। তার মানে পুলিশই ওগুলো সিল করে দিয়েছে। এটা কার কাজ বুঝতে পারছিলাম। মণিমোহন মল্লিক তার কথা রেখেছেন।

আমাকে ধরে পুলিশ সোজা হাজতে পুরে দিল। আমার বিরুদ্ধে হাজার গন্ডা চিটিংবাজির অভিযোগ রয়েছে। হে মহান জনগণ, এ সব অভিযোগের একটাও মিথ্যে নয়।

সকালে ধরা পড়েছিলাম। কোত্থেকে কীভাবে খবর পেয়ে বিকেলে লতিকা আমাকে দেখতে এল।

লোহার গরাদের ওধারে দাঁড়িয়ে একটা কথাও বলতে পারছিল না লতিকা। তার ঠোঁট থরথর করে কাঁপছিল আর চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। হে মহান জনগণ, মেয়েটা সত্যিই মরেছে। আমার মতো মানুষকে ভালোবাসার কোনও মানে হয়! হাত বাড়িয়ে লতিকার একটা হাত ধরে বললাম, কেঁদো না লতিকা, কেঁদো না। এখান থেকে নিশ্চয়ই একদিন বেরুতে পারব। তখন নতুন করে আবার জীবন শুরু করা যাবে।

লতিকার চোখের জল গালের ওপর দিয়ে ঢলের মতো নামতে লাগল।

হে মহান জনগণ, একবার মাত্র একবারই আমি প্রতারণা করতে চাইনি, চিটিংবাজি কতে চাইনি। আর ওই কারণে আজ আমাকে এখানে—এই হাজতে চলে আসতে হয়েছে।

আমার কথা তো শুনলেন। আপাতত এখানেই শেষ করা যাক। নমস্কার।

 

Exit mobile version