কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?
আপনার যা ইচ্ছে—
মনোবীণা খানিকক্ষণ ভেবে বলেন, এক হাজার দিই?
বললাম, তাই দিন
হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা বার করতে করতে মনোবীণা বললেন, না, দুহাজার দিচ্ছি। আমার মেয়েকে তো চিনি। ওর পেছনে আপনাকে অনেক পয়সায় দৌড়ুতে হবে। দুহাজারই রাখুন।
কুড়িখানা একশো টাকার নোট গুণে গুণে আমাকে দিলেন মনোবীণা। টাকাটা অবহেলার ভঙ্গিতে ব্রিফকেসে রেখে বললাম, ধন্যবাদ।
আমার কাজ আপাতত শেষ। মনোবীণা সান্যালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠতে যাব সেই সময় একটা দামি ইম্পোর্টেড গাড়ি সামনের বড় গেট দিয়ে ঢুকে টেনিস লনটার কাছে এস থামল। আর সেই গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সাড়ে ছফুটের ওপর হাইট, প্রকাণ্ড বুক, পালিশ করা ব্রোঞ্জের মতো রঙ। এত বয়সেও গায়ের চামড়া টান টান, মসৃণ। ছড়ানো কাধ তার, পাতলা ভুরুর তলায় মাঝারি ধরনের বাদামি চোখ, বিস্তৃত কপালের ওপর থেকে ব্যাক ব্রাস করা লালচে চুল। চৌকো মুখ, দৃঢ় চোয়াল, পরনে স্টিল গ্রে কালারের ট্রাউজার আর শার্ট। কোটটা গায়ে নেই, হাতে ঝুলছে। সব মিলিয়ে তাকে কেমন যেন অভারতীয় মনে হয়।
গাড়ি থেকে নেমে নুড়ির রাস্তার ওপর দিয়ে ভদ্রলোক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলেন। মনোবীণা সান্যাল তার দিকে চোখ রেখে চাপা নীচু গলায় বললেন, আপনি কী জন্যে এসেছেন, ওঁর কাছে বলবেন না।
আচ্ছা–আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম।
আর আমি যা বলে যাব তাতে সায় দিয়ে যাবেন।
ঠিক আছে।
আর কিছু বলার সময় পেলেন না মনোবীণা; ভদ্রলোক আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। দ্রুত এক পলকে আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, ইনি? মনোবীণা বললেন, ইনি একজন ইনটেরিয়র ডেকরেটর। আমাদের বাইরের ঘরটা ডেকরেসনের জন্য ওঁকে ডাকিয়েছি।
ভদ্রলোক বললেন, ও—
মনোবীণা এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, উনি আমার স্বামী–অরিন্দম সান্যাল।
আমি বিনীত ভাবে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতজোড় করলাম। অরন্দিম সান্যাল আমার দিকে আর ফিরেও তাকালেন না; একজন ইনটেরিয়র ডেকরেটর সম্বন্ধে তার কোনও কৌতূহল নেই। এমনকী সামান্য সৌজন্যও না। বড় বড় পা ফেলে ধবধবে সাদা নুড়ির রাস্তা দিয়ে তিনি বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
আর আচমকা বিদ্যুৎ চমকে যাবার মতো একটা কথা মনে পড়ে যেতে দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে মনোবীণার দিকে তাকালাম, কিন্তু
আমার গলায় হয়তো কিছু উত্তেজনা ছিল, হয়তো কিন্তু শব্দটা খানিকটা জোর দিয়েই বলে ফেলেছিলাম। মনোবীণা কী বুঝলেন তিনিই জানেন, তর্জনী তুলে বসলেন, আস্তে। কী জানতে চাইছেন?
আপনি তখন বললেন শমিতাদেবীর বাবা কানাডা থেকে আসছেন। কিন্তু আপনার স্বামী তো এখানেই আছেন–
মনোবীণা আরেকবার তর্জনী তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না। আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার বাইরে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ করেন–এটা আমি চাই না। আচ্ছা নমস্কার-সাদা সাদা ঝালরের মতো লোমলা সেই কুকুরটাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মনোবীণা। বললেন, আপনার কাজ কী রকম এগুচ্ছে মাঝে মাঝে খবর দেবেন। আই থিঙ্ক ইট উইল টেক সাম টাইম।
নমস্কার জানিয়ে যখন আমি গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম, তখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে। পাতলা অন্ধকার উলঙ্গবাহার শাড়ির মতো কলকাতাকে জড়িয়ে আছে।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর নিরিবিলি। দেশভাগ, পপুলেশন এক্সপ্লোসান–এসব কোনও কিছুই কলকাতার এই অংশটাকে ছুঁতে পারেনি। তবে এ রাস্তায় পার্টিসনের পর ট্রাফিক বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বালিগঞ্জ, সাদার্ন অ্যাভেনিউ, যোধপুর পার্কের দিকে যারা থাকে এই রাস্তাটা শর্ট কাট করে তারা চলে যায়।
তখন সাতটার মতো বাজে। হুড় হুড় করে অগুনতি প্রাইভেট কার স্রোতের মতো নেমে আসছে। আমি রাস্তার ধার ঘেঁষে অন্যমনস্কর মতো লোয়ার সার্কুলার রোডের দিকে হাঁটছিলাম।
আমার ব্রিফকেসে নগদ দুটি হাজার টাকা রয়েছে। সাধারণত সব ব্যাপারেই অ্যাডভান্সের টাকাটা হাতিয়ে নিয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক চুকিয়ে দিই। অনেকগুলো ক্লায়েন্টের কাছ থেকে দু-এক হাজার টাকা করে অ্যাডভান্স নিতে পারলে মোটামুটি একটা ভালো অঙ্কই দাঁড়ায়। তখন আমরা করি কী, রাতারাতি কোম্পানির গণেশ উল্টে দিই। এবং সেই জায়গায় কলকাতার রাস্তায় নতুন নতুন শিবলিঙ্গর মতো আনকোরা নতুন একটা প্রতিষ্ঠানে গজিয়ে তুলি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আমাদের প্রফেসানের এই হল ট্রেড সিক্রেট।
মনোবীণা সান্যালের কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকাটা যখন পাওয়া হয়ে গেছে তখন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে আমি আর আসছি না। যেখান থেকে একবার কিছু আদায় হয়ে যায়, সেদিকে আমি আর তাকাই না।
নো লুকিং ব্যাক। কিন্তু আমার এই ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের লাইফে ওয়ার্ল্ডের অনেকটাই তো দেখা হল, বহু ঘাটের জলও খাওয়া হল, আমাদের প্রফেসানে সেই সূত্রে অদ্ভুত অদ্ভুত সব মানুষের কাছে এসেছি। যাদের অনায়াসেই রেয়ার হিউম্যান স্পেসিমেন বলা যেতে পারে। এতকাল যা-ই দেখে থাকি না কেন, মনোবীণা সান্যালকে আগে আর কখনও দেখিনি। যতই তাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করছি, তার ভাবনাটা টোকা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছি ততই তিনি, এক মিনিটের জন্যে দেখা তার স্বামী অরিন্দম সান্যাল, যাকে নর্মাল লাইফে পুনর্বাসন দেবার দায়িত্ব কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছি সেই শমিতা এবং এবং তার কানাডা প্রবাসী বাবা—সবাই তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে লাগল।
২. আমি থাকি এন্টালিতে
০৩.