হে মহান জনগণ, ভদ্রমহিলাকে বললাম বটে আমাদের প্রতিষ্ঠানটা পঁচিশ বছরের, আসলে তিন মাস আগেও ওটার অস্তিত্ব ছিল না। আফটার অল এ একটা প্রফেসান; প্রফেসানের খাতিরে কত কিছুই তো বলতে হয়, যে প্রতিষ্ঠানের আয়ু মোট তিন মাস তার সিলভার জুবিলিও ঘটাতে হয়।
মনোবীণা সান্যাল বললেন, এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।
আমি নড়ে-চড়ে মেরুদণ্ড টান করে বললাম। মনোবীণা শুরু করলেন, আজে বাজে কথা না বলে আমি শুধু কাজের কথাটুকুই বলব।
উত্তর না দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম।
মনোবীণা বলতে লাগলেন, আমার একটি মেয়ে আছে; তার নাম শমিতা; ডাকনাম ডোরা। বয়েস চব্বিশ। প্রথমেই বলে রাখি শি ইজ এ প্রবলেম চাইল্ড। আমার ধারণা সে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড হুইস্কি খায়, শি ড্রিংকস লাইক ফিশ। যার তার সঙ্গে সে মেশে; একবার বেরুলে কখন কবে বাড়ি ফিরবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এভাবে চলতে পারে না। আপনি বলুন, পারে কি?
কেউ নিজের মেয়ের সম্বন্ধে এ রকম বলতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম। কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না।
মনোবীণা সান্যাল আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। একটু আগের প্রশ্নটা যদিও আমারই উদ্দেশ্যে, আসলে ওটা তিনি করেছিলেন নিজেকেই। মনোবীণা বলে যেতে লাগলেন, আমি চাই, ভোরা নর্মাল হোক। অন্য দশটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হোক ওর লাইফ।
গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, সব মা-ই তা চান!
আপনি তাহলে আমার সঙ্গে একমত?
নিশ্চয়ই।
মনোবীণা সান্যাল চিন্তিতভাবে এবার বললেন, বুঝতেই পারছেন, আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ানক সমস্যায় পড়ে গেছি। কিছুতেই ওকে কনট্রোল করতে পারছি না। এদিকে ওর বাবা চোদ্দো বছর পর কানাডা থেকে ফিরে আসছেন। হি ইজ এ ডিফারেন্ট টাইপ; তিনি ফিরে আসার আগে মেয়েকে আমি নর্মাল করে তুলতে চাই। আমার এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্যেই আমি আপনাকে ডেকেছি।
খুব শান্তভাবে বললাম, কী সাহায্য চান বলুন
ডোরা যেভাবে যেদিকে চলেছে সেটা খুবই বিপজ্জনক। যে কোনওদিন একটা ডিজাস্টার ঘটে যাবে। আমি চাই আপনি ওকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুন। যদি মেয়েটাকে নর্মাল করে দিতে পারেন, আই শ্যাল রিমেন এভার গ্রেটফুল। বলতে বলতে একটা থামলেন মনোবীণা। কী যেন চিন্তা করে একটু পর আবার বললেন, একটা কথা জিগ্যেস করতে ভুলে গেছি–এ জাতীয় কাজের অভিজ্ঞতা আপনাদের আছে কি?
নানা ধরনের মানুষ অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। কিন্তু এ রকম প্রবলেমের কথা আগে আর শুনিনি। পাছে এত বড় একটা ক্লায়েন্ট আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় তাই ব্যস্তভাবে বলে উঠলাম, এর চাইতে অনেক বড় সমস্যা ট্যাল করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন মিসেস সান্যাল।
মনোবীণা বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর অ্যাসুয়োরেন্স। এখন বলুন, এজন্য আপনাদের কী রেমুনারেসন দিতে হবে?
রেমুনারেসনের কথাটা পরে বলছি। আগে আপনার মেয়ে শমিতাদেবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন।
আলাপ করানো যাবে না।
বিমূঢ়ের মতো বললাম, কেন?
মনোবীণা বললেন, অসুবিধা আছে। ডোরা অদ্ভুত টাইপের মেয়ে। ও যদি টের পেয়ে যায়, আমি ওর পেছনের আপনাকে লাগিয়েছি, রেজাল্ট খুব খারাপ হবে।
তা হলে?
আমার মনোভাবটা বোধহয় বুঝতে পারলেন মনোবীণা। বললেন, ওকে যাতে চিনতে পারেন সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। এই দেখুন–পাশে একটা ফ্যাসনেবল লেডিজ হ্যান্ডব্যাগ পড়ে ছিল। সেটা খুলে দুটো পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোগ্রাফ সামনের টেবলটার ওপর রাখলেন মহিলা।
ফোটোদুটোর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। সে দুটো একই তরুণীর দুটি আলাদা আলাদা ভঙ্গির ছবি। ফোটোর চেহারার সঙ্গে মনোবীণা সান্যালের আশ্চর্য মিল। কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় মনোবীণার বয়সটা আচমকা কুড়ি-বাইশ বছর কমিয়ে ফেলতে পারলে এই রকমই দাঁড়াবে।
মনোবীণা আবার বললেন, দেখা হয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম।
কেউ দেখে-টেখে ফেলতে পারে। ফোটো দুটো আপনি ব্রিফকেসে নিয়ে নিন। কথামতো ফোটো দুটো আমার ব্রিফকেসে পুরে ফেললাম।
মনোবাণী এবার বললেন, এর বেশি আমি আর কিছু দিতে পারব না। এখন কীভাবে ডোরার সঙ্গে আলাপ করবেন, কীভাবে ওকে নর্মাল লাইফে ফিরিয়ে আনবেন সেটা কমপ্লিটলি আপনার ব্যাপার।
ঘাড় কাত করে বললাম, তা তো বটেই।
এবার রেমুনারেসনটা ঠিক করে ফেলা যাক। কী পেলে আপনি হ্যাপি?
আমি জানি এই সব অদ্ভুত টাইপের মহিলাদের কাছে টাকা পয়সার কথা বলতে যাওয়া বোকামি। হয়তো আমি যা চাইব, মনে মনে উনি তার তিন গুণ দেবার কথা ভেবে রেখেছেন। ব্যাপারটা পুরোপুরি ওঁর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বললাম, আমি কী বলব; সব কিছু কনসিডার করে আপনি যা দেবেন আমি তাতেই খুশি।
মনোবীণা বললেন, এই তো বিপদে ফেললেন–বলে একটু থামলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইফ আই পে টেন থাউজেন্ড-খুব কম হবে কি?
দশ হাজার! ফিগারটা আমার পক্ষে প্রায় অভাবনীয়। খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠাই উচিত। কিন্তু কোথায় চেঁচাতে হয় আর কোথায় স্বরগ্রামকে নীচু ভাবে বেঁধে রাখা দরকার, আমি জানি। দশ হাজারের অঙ্কটা যেন কিছুই নয়, নেহাত দু-পাঁচ টাকার ব্যাপার, এই রকম মুখের চেহারা করে বললাম, ঠিক আছে, ওতেই হবে।