আমি সামনে যেতেই দারোয়ান বলল, সাড়ে ছে বাজে আপকো আনেকা বাত থা?
মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ—
অন্দর যাইয়ে। বড়া মেমসাব আপকে লিয়ে ইন্তেজার করতী হ্যায়–
ভেতরে ঢুকলাম। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে কম্পাউন্ড; সেটা ঘিরে উঁচু দেয়াল। মাঝখানে অত্যন্ত মডার্ন আর্কিটেকচারের দোতলা বাড়ি। বাড়িটার সামনের দিকে একধারে টেনিস কোর্ট, আরেকধারে সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসের লন। লনে বড় বড় অনেকগুলো রঙিন গার্ডেন আমব্রেলা রয়েছে। সেগুলোর তলায় ফ্যাশনেবল বেতের চেয়ার। লনটাকে ঘিরে নানারকম অর্কিডের কেয়ারি। আরেকধারে ফুলের বাগান, বেঁটে পামগাছের জটলা। আমার বাঁদিকে খানিকটা দুরে কম্পাউন্ড ওয়াল ঘেঁষে তারের জালের ভেতর অগুণতি হরিণ আর খরগোস চোখে পড়ল। তার পাশে আরেকটা প্রকাণ্ড জালে ট্রপিক্যাল কান্ট্রির নানা ধরনের পাখি।
লন আর টেনিস কোর্টের মাঝখান দিয়ে সাদা নুড়ির পথ বাড়িটার দিকে চলে গেছে। আমি কী করব যখন ভাবছি, নুড়ির রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির দিকে যাব না এখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব–সেই সময় কোত্থেকে একটা সাদা উর্দি-পরা বেয়ারা প্রায় মাটি খুঁড়েই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। গেটের দারোয়ানটা যা জিগ্যেস করেছিল বেয়ারাটাও তাই জিগ্যেস করল। অর্থাৎ সাড়ে ছটায় আমার আসার কথা ছিল কিনা?
আমি মাথা হেলিয়ে দিলাম।
বেয়ারাটা বলল, আসুন আমার সঙ্গে
সে আমাকে লনের শেষ মাথায় নিয়ে গেল। কী আশ্চর্য, আগে লক্ষ্য করিনি, এখন দেখলাম, একটা রঙিন ছাতার তলায় সাদা বেতের চেয়ারে একটি মহিলা বলে আছেন।
কত বয়স হবে তার? দূর থেকে তিরিশ-বত্রিশের বেশি মনে হবে না। তবে কাছে এসে বোঝা যায় বয়সটা চল্লিশ পেরিয়েছে।
তার গায়ের রঙ ঝকঝকে রৌদ্র ঝলকের মতো। কপাল থেকে নাকটা নেমে এসেছে; তার দুধারে আঁকা আই-ব্রোর তলায় দীর্ঘ চোখ; মুখটা ডিম্বাকৃতি, সরু থুতনি, ভরাট মসৃণ গলার তলায় অনেকখানি অংশ অনাবৃত। তারপর ব্রা-টাইপের ছোট্ট ব্লাউজ; তার তলা থেকে সুভীর নাভির নীচে এক ইঞ্চি জায়গা পর্যন্ত শরীরের মধ্যভাগটা আবার উন্মুক্ত। মহিলার কোমরের তলায় বিশাল অববাহিকা। তার ঠোঁটে গাঢ় রঙ; নখ ম্যানিকিওর-করা; মুখে এনামেল। বাদামি চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এবং সযত্নে কার্ল-করা। তবে দু-চোখেরই নীচের দিকটা তার ফোলা ফোলা। পেটে এবং গালে কিঞ্চিৎ মেদও জমেছে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, চোখের এই ফোলা ফোলা ভাব, পেটের এই চবি–এগুলো কীসের লক্ষণ আমি জানি; এবং আপনারাও জানেন। শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখলেই আমি টের পেয়ে যাই। মহিলা অ্যালকোহলটি বেশ ভালোই চালান।
যাই হোক, তার পরনে এই মুহূর্তে দামি সিফন, গলায় বীভের হাড়, ডান হাতের কব্জিতে সোনার ব্যান্ডে ছোট্ট ওভাল সেপের এটা ঘড়ি। কোলে প্রচুর লোমওলা ধবধবে কুকুর। তাঁর লম্বা লম্বা সুন্দর আঙুল অলস ভঙ্গিতে কুকুরের লোমগুলোতে বিলি কেটে দিচ্ছিল।
বেয়ারা ডাকল, মেমসাব
মহিলা আমাদের দিকে ফিরলেন। বেয়ারা বলল, ইনি এসেছেন—
মহিলা আমাকে বললেন, পার্সোন্যালের অফিস থেকে আসছেন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, নমস্কার
নমস্কার। বসুন—
একটা বেতের চেয়ারে মহিলার মুখোমুখি বসলাম।
আপনার নামটা তখন টেলিফোনে জেনে নেওয়া হয়নি। নাম জানলে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হয়।
নিজের আসল নামটা বলব কি বলব না, এক মুহূর্ত ভেবে নিলাম। তারপর নিজের অজান্তেই সেটা বলে ফেললাম।
মহিলা বললেন, আমার নাম মনোবীণা সান্যাল। আপনি আমাকে মিসেস সান্যাল বলতে পারেন।
এক পলক দ্রুত মনোবীণা সান্যালের সিঁথি এবং কপালটা দেখে নিলাম। মহিলা জানিয়েছেন তিনি মিসেস অর্থাৎ বিবাহিতা। কিন্তু সিঁদুর-টিদুর চোখে পড়ছে না। বাঙালি সুলভ রীতিনীতি সম্বন্ধে খুব সম্ভব এঁদের তেমন শ্রদ্ধা নেই। না থাক, আমার তাতে কী। আমি এসেছি আমার প্রফেসানের ব্যাপারে। বিবাহিত হয়েও কে সিঁদুর পরছে না, তা নিয়ে ভেবে ভেবে ব্লাড-প্রেসার চড়াবার কোনও মানে হয় না। বললাম, ধন্যবাদ। এখন বলুন, আমার ওপর কী দায়িত্ব দিতে চান
তার আগে আপনাদের সম্বন্ধে আমার কিছু জানবার আছে।
অত্যন্ত সতর্কভাবে মহিলাকে লক্ষ্য করতে করতে বললাম, কী জানতে চান?
আপনাকে ফোনে পাবার আগে আপনাদের অফিসের এক মহিলার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।
শুনেছি। ওই মহিলা আমার বিজনেস পার্টনার।
ও, আচ্ছা। আমি ওঁকে বলেছিলাম আমার কাজটা অত্যন্ত গোপনীয়। আপনাদের দায়িত্ব দিলে জানাজানি হয়ে যাবে না?
নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাডাম। আপনি যখন চাইছেন তখন কেউ জানতে পারবে না। গোপনীয়তা রক্ষা করা আমাদের প্রফেসানের একমাত্র ক্যাপিটাল। নইলে এই কনসার্ন কবে উঠে যেত।
আরেকটা কথা। আপনাদের বিশ্বাস করতে পারি তো?
সেটা আপনার ওপর নির্ভর করছে। এ ব্যাপারে নিজেদের সম্বন্ধে কোনও ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিতে পারব না। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমাদের কনসার্নটা পঁচিশ বছরের। কমাস আগে সিলভার জুবিলি হয়ে গেছে। মাননীয় ক্লায়েন্টদের খুশি করতে না পারলে এই কনসার্ন নিশ্চয়ই টিকত না। বলতে বলতে মনোবীণা সান্যালের দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলাম। মুখ-চোখ দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে ফাঁদটি আমি পেতেছি মহিলা তাতে পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ আমার কথা তিনি অবিশ্বাস করছেন না।