ওধার থেকে মহিলার গলা ভেসে এল, না
এক পলক চুপ করে থেকে বললাম, কবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে হবে?
আজই, সন্ধের দিকে চলে আসুন–সে অ্যাট সিক্স থার্টি।
আসব। আপনার ঠিকানাটা
মহিলা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটা নম্বর দিলেন। ডায়েরিতে টুকে নিতে নিতে বললাম, আচ্ছা নমস্কার।
মহিলাও প্রতি-নমস্কার জানিয়ে বললেন, সন্ধেবেলা আপনার জন্যে কিন্তু আমি অপেক্ষা করছি।
ঠিক আছে-আমি টেলিফোন রেখে দিলাম। তারপর ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল লতিকা একদৃষ্টে আমাকে লক্ষ্য করছে। তার চোখে-ঠোঁটে-চিবুকে এক ধরনের চাপা কৌতুকের হাসি চকচকিয়ে উঠেছে। চোখাচোখি হতেই সে মজা করে বলল, তা হলে যাচ্ছ।
বললাম, যেতেই হবে। আফটার অল এটা আমাদের প্রফেশন। তারপর সোজাসুজি লতিকার চোখের দিকে তাকিয়ে কাচের পার্টিসান-ওয়ালটার দিকে অনেকখানি ঝুঁকলাম। নীচু গলায় বললাম, তোমার আপত্তি নেই তো?
বিন্দুমাত্র না। প্রফেসান যখন, তখন যেতেই হবে।
থ্যাঙ্ক ইউ-চোখ টিপে হেসে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকো, আমি ফাঁসব না—
স্মার্ট ঝকঝকে মেয়ে লতিকা বিশ্বাস গ্রাম্য বালিকার মতো বলল, আচ্ছা–
.
০২.
সাড়ে পাঁচটায় আমাদের অফিস ছুটি হয়ে যায়। এখন পাঁচটা চল্লিশ।
সমরেশ, রীতেশ এবং মীনাক্ষী এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন আর পার্সোনালের ঘরে তালা লাগিয়ে চলে গেছে। ওদের তিন বেয়ারা রবীন, ভবতোষ আর শরদিন্দু নেই; ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও উধাও।
অবশ্য আমাদের এখানে কেউ আলাদা ভাবে অফিসার বা বেয়ারা নয়। এখানে সবার স্ট্যাটাস সমান। রবীন-শরদিন্দু-ভবতোষও ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট। আপাতত ওরা বেয়ারা হয়ে আছে; কদিন বাদেই অফিসার হবে। তখন সমরেশদের গায়ে বেয়ারার উর্দি চড়বে। আমাদের অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মোটামুটি এভাবেই চলছে। অর্থাৎ পালা করে এখানে সবাই অফিসার আর বেয়ারা সাজে।
যাই হোক, দুটো-আড়াইটার সময় এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনে সেই যে হীরাচন্দ আগরওয়াল এসেছিল তারপর আমাদের তিনটে কনসার্নের কোনওটাতেই একটা মাছি পর্যন্ত ঢোকেনি। বিজনেসের অবস্থা খুবই খারাপ।
ছুটির পর সবাই চলে গেলেও আমি কিন্তু এখনও আছি। সাড়ে ছটায় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সেই মহিলাটির কাছে যাবার কথা। ঠিক করে রেখেছি সোয়া ছটা নাগাদ এখান থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে চলে যাব। আগে বেরুলে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে সময়টা কাটাতে হবে। তাই অফিসেই আছি। আমি বেরুইনি বলে লতিকাও যায়নি; আমরা দুজন কাচের দেয়ালের দুধারে যে যার চেম্বারে বসে আছি।
আমরা এলোমেলো গল্প করছিলাম। মাঝে মাঝে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। কথাবার্তার ফাঁকে একবার বললাম, এখনও আধ ঘণ্টার মতো আমাকে থাকতে হবে। তুমি শুধু শুধু আটকে আছ কেন? বাড়ি চলে যাও
লতিকা বলল, এখন বাড়ি যাব না।
কেন?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না লতিকা। আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তার টেবলের ওপর যে রঙিন পেপারওয়েটটা ছিল সেটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর বিস্বাদ গলায় বলল, বাবা ফিরে এসেছে।
খুবই চাপা ধরনের মেয়ে লতিকা। চার ঘন্টা আগে অফিসে এসেছি। এর মধ্যে একবারও বাবার কথাটা বলেনি। নেহাত বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলাম; তাই বলল। আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম, আবার!
হ্যাঁ।
কবে এল?
আজই সকালে।
লতিকার বাবার নাম যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস। এই লোকটা লতিকার জীবনে এক চিরস্থায়ী সমস্যা। মজা করে বললাম, খুবই আনন্দের খবর।
লতিকা বলতে লাগল, হা, আনন্দ আর ধরছে না। জানো, এবার একা আসেনি সে; সেই মেয়েছেলেটাকেও নিয়ে এসেছে। সঙ্গে দুটো বাচ্চা
ফার্স্ট ক্লাস। তোমাদের জনবল বেশ বেড়ে গেল।
লতিকা উত্তর দিল না; তার চোখে-মুখে ঘৃণা, রাগ, বিতৃষ্ণা–সব একাকার হয়ে যেতে লাগল।
একটা কথা মনে পড়তে বললাম, মাস তিনেক আগে তোমার বাবা তোমার কাছ থেকে না দুহাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিল? বলেছিল আর আসবে না?
বলেছিল তো। অনেকবার টাকা নিয়ে গেছে, অনেকবার ওই এক কথা বলে গেছে। বলতে বলতে লতিকা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, বাড়ির অবস্থাটা ভাবতে পারছ? আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, লতিকার বাবার কথা আমি পরে বলব। কেননা সামনের সুদৃশ্য ওয়াল-ক্লকটায় দেখতে পাচ্ছি এখন ছটা বেজে তেরো মিনিট। আর বসে থাকার উপায় নেই। এখনই উঠতে হবে।
লতিকা আবার বলল, আমি কী করব, বলতে পারো?
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, পরে ভেবে যা হয় করা যাবে। এখন চলো, বেরুনো যাক। আর দেরি করলে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সাড়ে ছটায় পৌঁছতে পারব না।
লতিকা আর কিছু বলল না।
তিন মিনিটের মধ্যে আমাদের চেম্বারে তালা লাগিয়ে দুজনে নীচে নেমে এলাম। নেমেই আমি একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। লতিকা আমার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠল না। ওরা থাকে বেলেঘাটায়। হাঁটতে হাঁটতে সে চৌরঙ্গীর দিকে চলে গেল; ওখান থেকে বাস-টাস ধরে বাড়ি চলে যাবে।
.
সেই মহিলাট টেলিফোনে যে ঠিকানা দিয়েছিলেন কাটায় কাটায় সাড়ে ছটায় সেখানে পৌঁছে গেলাম।
বিরাট কম্পাউন্ড-ওলা বাড়ি। আমি অবশ্য ট্যাক্সি নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম না। ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে রাস্তা থেকেই ট্যাক্সিওলাকে ছেড়ে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে প্রকাণ্ড গেটটার কাছে চলে এলাম। ঝকঝকে উর্দি-পরা নেপালি দারোয়ান সেখানে অ্যাটেনসানের ভঙ্গিতে মেরুদণ্ড টান করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে বন্দুক; গলা থেকে চামড়ার চওড়া বেল্টে টোটার মালা বুকের দিকে নেমে এসেছে।