হীরাচন্দ আগরওয়াল এক মুহূর্ত কী চিন্তা করল। তারপর বলল, স্পেশ্যালটাই আমার বেশি পছন্দ। তাতে ঝামেলা নেই। একটু থেমে আবার বলল, আমি বিজনেসম্যান। বুঝতেই পারছেন ধান্দার পেছনে ছুটে ছুটে একেবারে সময় পাই না। কিন্তু ইলেকসানটা আমাকে জিততেই হবে। ওটা একটা প্রেস্টিজের ব্যাপারকী বলেন?
সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, তা তো বটেই।
দু-চারটে পয়সা রামজির কৃপায় আমার হয়েছে। এখন কিছু প্রেস্টিজ চাই আর পাওয়ার।
তা তো বটেই।
তা হলে আমার দায়িত্বটা আপনারাই নিন।
এ তো আমাদের সৌভাগ্য। এখন বলুন আপনি কী হতে চান–এম-পি, এম-এল-এ, কর্পোরেশনের কাউন্সিলার না মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার?
আমি এম-এল-এ হতে চাই।
ভেরি গুড। প্লিজ এক মিনিট–আমার গা ঘেঁসেই সমরেশ বসে আছে। তাকে বললাম, রেজিস্ট্রি খাতাটা দাও তো
সমরেশ বাঁধানো মোটা একটা খাতা আমার সামনে রাখল। সেটা খুলে পকেট থেকে পেন বার করতে করতে বললাম, আপনার বায়োডেটা বলে যান; আমাদের কাজের জন্যে দরকার হবে। আপনার নামটা তো জেনেছি। বাবার নাম? বলতে বলতে হীরাচন্দর নাম লিখে ফেললাম।
সোনাচাঁদ আগরওয়াল
সোনাচাঁদের ছেলে হীরাচাঁদ! আপনার বয়েস?
বাহান্ন।
বিজনেসম্যান তত বললেন। কীসের বিজনেস?
ছোটখাটো দুটো লোহার কারখানা আর একটা সোপ ফ্যাক্টরি আছে। বড়বাজারে কাপড়ের গদিও আছে। আর শেয়ার মার্কেটে কিছু ধান্দা করি। টুকতে ঢুকতে বললাম, আপনাদের বংশে কেউ জেল-টেল খেটেছে?
হীরাচন্দ নড়েচড়ে বসল। সন্দিগ্ধভাবে বলল, মানে?
খেটেছে কিনা বলুন না
খানিক্ষণ চিন্তা করে হীরাচন্দ বলল, আমার ঠাকুরমার ভাই চোরাই সোনা রাখার জন্যে দুমাস জেল খেটেছিল।
ফাইন। ওই জেল খাটাটা আপনার ঠাকুরদার ওপর চাপিয়ে মেয়াদটা বাড়িয়ে দুবছর করে দেব। কেন বলুন তো?
বুঝতে পারছি না।
বুঝিয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলুন আপনার ঠাকুরদার নাম কী?
মোতিচন্দ।
আমি বলতে লাগলাম, আপনার একটা জীবনচরিত লিখতে হবে তো। তাতে লিখব বৃটিশ আমলে নির্যাতিত দেশকর্মী মোতিচন্দ আগরওয়ালের পৌত্র হীরাচ আগরওয়ালকে ভোট দিন।
হীরাচন্দ প্রায় লাফিয়ে উঠল, চোরাই সোনার জন্যে জেল-খাটাটাকে এভাবে কাজে লাগাবেন! আপনার জবাব নেই। মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায় এসেছি, আমার এম-এল-এ হওয়া কেউ রুখতে পারবে না। বলুন–আপনাদের কাজ চালু করার জন্যে কী রকম অ্যাডভান্স দিতে হবে?
আমাদের বাঁধা রেট-টোয়েন্টি পারসেন্ট অ্যাডভান্স নিয়ে থাকি
তার মানে পাঁচ হাজার টাকা–এ পকেট ও পকেট হাতড়ে পঞ্চাশখানা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দিল হীরাচন্দ। তারপর হাতের ভর দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। আচ্ছা চলি-নমস্কার। আমায় আবার শেয়ার মার্কেটে ছুটতে হবে।
আপনার রিসিটটা নিয়ে যান।
কিছু দরকার নেই। আমি লোক চিনি–বিশাল চেহারা নিয়ে হেলেদুলে চলে গেল হীরাচন্দ আগরওয়াল।
সমরেশ বলল, এ হে, একটা কথা জিগ্যেস করতে এক্কেবারে ভুলে গেছেন রাজীবদা।
কী কথা? খাতাটা বন্ধ করতে করতে মুখ তুলে তাকালাম।
কোন কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে লোকটা দাঁড়াবে তা কিন্তু জেনে নেননি।
নিশ্চিন্তে থাকো। ক্যাশ যখন দিয়ে গেছে তখন গরজা ওর। দু-একদিনের মধ্যে আবার ও আসবে। তখন কনস্টিটিউয়েন্সির খবরটা জেনে নিলেই চলবে। কিন্তু তার দরকার হবে কি? বলে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে চোখ টিপলাম। সমরেশ হেসে হেসে মাথা নাড়তে লাগল অর্থাৎ দরকার হবে না।
একটু পর নিজের চেম্বারে ফিরে এসে হীরাচরে সেই পাঁচ হাজার টাকা লতিকাকে দিতে দিতে বললাম, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের প্রথম ইনকাম, জয় মা ভোটেশ্বরী। একবার যখন ফাঁদে ইঁদুর পড়তে শুরু করেছে তখন আঁকা বেঁধে আরো অনেকেই এসে যাবে, না কী বলে?
হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে নিতে লতিকা বলল, দেখা যাক।
এ রকম গোটা পনেরো-কুড়ি হীরাচন্দ ক্যাঁচাকলে গলা ঢোকালেই এইড-ইলেকক্সন কর্পোরেশনকে লিকুইডেশনে দেওয়া যেতে পারে।
পরের কথা পরে ভাবলেও চলবে। এখন বলল, এই টাকাটা কী করব?
চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে আমাদের এখানে চাকরির জন্যে ঘোরাঘুরি করছে না?
হ্যাঁ প্রায়ই আসছে। কিন্তু কোনও কাজকর্ম নেই–কী দেব?
ঠিক আছে, এই টাকাটা থেকে আপাতত ওদের বেকারভাতা দিয়ে যাও।
তারপর যদি কিছু বাঁচে রিজার্ভ ফান্ডে রেখে দেবে।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে উঠল। ইন্টারনাল কানেকানে পার্সোনাল থেকে রীতেশের গলা ভেসে এল, বাইরের একটা লাইন আছে রাজীবদা–
বললাম, দাও
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, এটা কি পার্সোন্যালের অফিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এর আগেও আমি তিনবার ফোন করেছি।
রিসিভারটা কানে রেখেই লতিকার দিকে ফিরে চোখ টিপলাম। লতিকা তাকিয়ে ছিল, আমার ইঙ্গিতটা বুঝে ফিসফিসিয়ে উঠল, সেই মহিলা নাকি? টেলিফোনের মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে বললাম, মনে হচ্ছে; দেখা যাক–বলেই দ্রুত হাতটা সরিয়ে মহিলার সঙ্গে কথা শুরু করলাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, শুনেছি আপনি ফোন করেছিলাম। বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি।
আপনাকে একটা ব্যক্তিগত কাজের দায়িত্ব দেব। সে বিষয়ে কথাবার্তা বলার জন্যে অনুগ্রহ করে একবার আমাদের বাড়ি আসতে হবে।
মহিলার কণ্ঠস্বর ঈষৎ ভারী, তবে তাতে এক ধরনের সুরেলা মাদকতা আছে। এই মাদকতার ভাবটা ভেতরে ভেতরে আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। লতিকাকে যা বলেছিলাম মহিলাকেও ঠিক তাই বললাম, আপনার দরকারের কথাটা ফোনে বলা যায় না?