আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই মণিমোহন আবার বলে উঠলেন, আমি আপনার কাছে এসেছি; ইচ্ছা করলে জোর করে এই টেপ রেকর্ডারটা কেড়ে নিতে পারেন। কিন্তু আপনার জেনে রাখা ভালো, এ রকম আরো পাঁচটা টেপে আপনার কথাগুলো ধরা আছে। কাজেই লাভ হবে না।
হে মহান জনগণ, আমার রি-অ্যাকশানটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। এই লোকটা কী আশ্চর্য ঠান্ডা মাথায় একই সঙ্গে শমিতা আর আমাকে একই ফাঁদে ফেলতে চাইছে; একই সঙ্গে দুজনকে ব্ল্যাকমেলের জালে পোরার প্ল্যান নিয়েছে। মাথাটা দারুণ পরিষ্কার তার, কিন্তু আমার কোমরের বেল্ট আলগা হয়ে যাচ্ছিল। আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না।
এদিকে মণিমোহন মল্লিক উঠে পড়েছিলেন। টেপ রেকর্ডারটা হাতে ঝুলিয়ে বললেন, আর পাঁচ দিন দেখব। এর মধ্যে ফোটো, টাকা, ক্যামেরা না পেলে শমিতা বোসের ছবির জন্যে আমাকে অন্য লোক অ্যাপয়েন্ট করতে হবে। আর আপনার সম্বন্ধে আমি কিছু খোঁজ খবর নিয়েছি। সেই সব
আমি প্রায় আঁতকেই উঠলাম, আমার সম্বন্ধে কী খোঁজখবর?
এক্ষুনি বলছি না। পাঁচ দিন দেখব, তারপর যা হয় করব। আচ্ছা নমস্কার।
মণিমোহন মল্লিক চলে গেলেন। বেশ বুঝতে পারছি আমি লোকটার হাতের ভেতর চলে গেছি। বাঘ যেমন তার শিকার নিয়ে খেলে সেও আমাকে নিয়ে তেমনি খেলবে মনে হচ্ছে।
ইচ্ছা করলেই শমিতার নুড ছবি আমি তুলে দিতে পারি। কিন্তু না, কিছুতেই দেব না। হাজার রকম অ্যাডিকশান দিয়ে ঘেরা একটা নোংরা কদর্য ওয়ার্ল্ড থেকে যাকে বার করে এনেছি কিছুতেই তার ক্ষতি হতে দেব না। কিন্তু শমিতার সম্বন্ধে এত দুর্ভাবনা কেন আমার? হে মহান জনগণ, সেই কথাটা আরেকবার মনে পড়ে গেল–আমি কি তবে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি?
.
২১.
তিনটে দিন শমিতাকে একরকম পাহারা দিয়েই কাটিয়ে দিলাম। তারপর চতুর্থ দিন অফিসে আসতেই মনোবীণা সান্যালের ফোন এল। মনোবীণা বললেন, কাল ভোর পাঁচটার ভেতর একবার আসতে হবে; বিশেষ দরকার।
আমি বললাম, কিন্তু শমিতা যদি আমাকে আপনার সঙ্গে দেখে ফেলে—
অত ভোরে ও ওঠে না।
—আচ্ছা আসব।
পরের দিন ভোরে মনোবীণা সান্যাল তাদের বাড়ির বাইরের লনে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি যেতেই বললেন, আমি আপনার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। ভোরাকে সত্যিই আপনি ফেরাতে পেরেছেন। তার ব্যাড হ্যাবিটগুলো কেটে যাচ্ছে। এখন ও আর ড্রিংক করে না; নেচারও অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। রিয়ালি আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ
শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যেই কি মহিলা এত ভোরে আমাকে আসতে বলেছেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
মনোবীণা আবার বললেন, এতটা করেছেন; এবার বাকি কাজটুকু কাইন্ডলি করে দিন।
কী কাজ?
হাত ব্যাগ খুলে দুটো ট্রেনের টিকেট আর একটা ঠিকানা বার করে আমাকে দিলেন মনোবীণা। দেখলাম টিকেট দুটো বম্বের। ঠিকানাটাও বম্বেরই–ডক্টর দেবতোষ বোস, আরব সাগর, ভিলে পার্লে স্কীম, সেভেন্থ ফ্লোর, সুইট নাম্বার ২৭, বম্বে।
মনোবীণা বলতে লাগলেন, আজই সন্ধের ট্রেনে ভোরাকে নিয়ে বম্বে চলে যান; ওকে ওই ঠিকানায় পৌঁছে দেবেন।
শমিতার মুখে তার বাবার কথা আগেই শুনেলািম। তবু ইচ্ছা করেই বললাম, এক্সকিউজ মি, একটা কথা জিগ্যেস করব?
কী?
ডক্তর দেবতোষ বোস কে?
মনোবীণা সেদিনের মতো রেগে উঠলেন না। আস্তে করে বললেন, শমিতার বাবা; আমার আগেকার স্বামী। একটু থেমে অন্যমনস্কর মতো আপন মনেই আবার বললেন, আমার লাইফটা তো নষ্টই হয়ে গেল। ডেরা ওর বাবার কাছে গিয়ে বাঁচুক।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু বাদেই মনোবীণার অন্যমনস্কতা কাটল। বললেন, তাহলে আজই যাচ্ছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ও ভালো কথা বলতে বলতেই মনোবীণা সান্যাল। ব্যাগ থেকে একটা সাদা এনভেলাপ আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।
কী এটা! আমি কিছুটা অবাকই হলাম।
আট হাজার টাকা আছে এতে। আপনার রেমুনারেশন দশ হাজারের মধ্যে দুহাজার অ্যাডভান্স করা ছিল। বাকিটা
এনভেলাপটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, এটা নিতে পারব না।
মনোবীণা বিমূঢ়ের মতো তাকালেন, কেন?
আপনার কাজটা নেবার আগে শমিতার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তারপর ওর সঙ্গে আলাপ হল, ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম। নাউ উই আর গুড ফ্রেন্ডস। যদি কিছু আমি করে থাকি তা করেছি বন্ধুর জন্যে, কিছু করে মজুরি নিতে পারব না। অ্যাডভান্সের টাকাটা বম্বে থেকে ফিরেই সেটা দিয়ে যাব।
আমি চলে এলাম। মনোবীণা সান্যাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
২২.
হঠাৎ বম্বে যাবার কথা বলতে অবাক হয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিন্তু আমার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তাই একটা প্রশ্নও না করে আমার সঙ্গে পরশু দিন ট্রেনে উঠে পড়েছিল সে।
আজ সকালে আমরা বম্বের শহরতলীতে দাদার স্টেশনে পৌঁছেছি। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে ভিলে পার্লে স্কিমে গিয়ে দেবতোষ বোসের স্যুইটটা যখন বার করলাম তখন নটাও বাজেনি।
কলিং বেল টিপতেই যিনি দরজা খুলে দিলেন তার বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন। ইস্পাতের ঝকঝকে ফলার মতো চেহারা, টকটকে রঙ, কাটা-কাটা ধারালো মুখ, শরীরের এক মিলিগ্রাম অনাবশ্যক মেদ নেই। তবে চোখ দুটি দূরমনস্ক। ইরেজিতে যাকে বলে ড্রিমি ঠিক তাই।
ভদ্রলোক কিছু বলবার আগেই হে মহান জনগণ, একটা দারুণ নাটকীয় ব্যাপার ঘটে গেল। হঠাৎ তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ডোরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বাবা, আমি–আমি ভোরা–