.
২০.
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিয়ে প্ল্যানস নামে নতুন বিভাগটা খোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছে লতিকা। রেসপন্স ভালোই পাওয়া যাচ্ছে। লতিকা এবং আমার আশা এই ডিপার্টমেন্টটা দুমাস যদি টিকিয়ে রাখা হয় নিট লাখখানেক টাকা আমাদের হাতে এসে যাবে।
আজ আবার লতিকা অফিসে আসেনি। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে বাড়ির একটা ব্যাপারে ভীষণভাবে আটকে গেছে। কাজেই কাচের দেয়ালের ওধারে আধখানা চেম্বার এখন ফাঁকা। লতিকা থাকলে খানিকক্ষণ গল্প-টল্প করা যায়। একলা বসে বসে ভীষণ বোরিং লাগছে; হাই উঠছে ঘন ঘন।
আরামদায়ক রিভলভিং চেয়ারে গা এলিয়ে যখন খানিকটা ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করছি সেইসময় দরজার কাছে খুট খুট আওয়াজে তাকালাম। আর তাকিয়েই মনে হল আমার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। মণিমোহন মল্লিক সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
চোখাচোখি হতেই মণিমোহন বললেন, মে আই কাম ইন
বিশেষ করে যার জন্যে পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিতে হয়েছে তিনি যে এখানে সরাসরি চলে আসতে পারেন, ভাবতেই পারিনি। ভেবেছিলাম ডিপার্টমেন্ট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ও ব্যাপারটার ওপর যবনিকা পতন হয়ে গেছে।
হে মহান জনগণ, আমার বেশ ভয়ই করতে লাগল কিন্তু কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপরেই মণিমোহনকে দেখে খুশিতে ফেটে পড়ার মতো ভাব করে বললাম, আসুন স্যার, আসুন
মণিমোহন ভেতরে ঢুকে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন। তার হাতে একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। সেটা আমার টেবলি রাখতে রাখতে বললেন, কদিন ধরেই আপনাকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছি কিন্তু যতবারই কানেকসান হচ্ছে ততবারই শুনছি পার্সোনাল বলে কোনও অফিস নেই। ব্যাপারটা কী বুঝবার জন্য সরেজমিন তদন্তে আসতে হল। অকুস্থলে এসে দেখি সত্যি সত্যি অফিসটা নেই। তার জায়গায় প্ল্যানস বলে একটা অফিস বসেছে। ওটা তো আপনারই?
স্বীকার করতে হল। ঢোঁক গিলে বললাম, হ্যাঁ। মানে ওই কারবারটা ভালো চলছিল না। তাই তুলে দিতে হল।
আমাকে এ ব্যাপারটা জানানো উচিত ছিল। কারণ আমি আপনার পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টের ক্লায়েন্ট।
ভেবেছিলাম দু-একদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেব।
কী একটু ভেবে মণিমোহন বললেন, ভালো কথা, আসবার সময় প্ল্যানসের পাশে পাস্ট-প্রেজেন্ট-ফিউচার আর ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন বলে দুটো অফিসও দেখলাম। মনে হচ্ছে ওগুলোও আপনারই।
হে মহান জনগণ, এ রকম ঝামেলায় আগে আর কখনও পড়িনি। বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মতো উল্টোপাল্টা জেরা করে লোকটা কী জানতে চায়? খুব সাবধানে তাকে লক্ষ্য করতে করতে বললাম, না-না, ওগুলোর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ওগুলো সেপারেট কনসার্ন।
স্থির চোখে আমার দিকে পুরো একটা মিনিট তাকিয়ে থাকলেন মণিমোহন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।
বাইরে স্মার্ট থাকলেও ভেতরে ভেতরে দারুণ উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মণিমোহন বললেন, ফোটোগ্রাফগুলোর কী হল?
ঢোক গিলে বললাম, এখনও তো অনেক সময় আছে।
অনেক নেই। আর মাত্র পাঁচটা দিন রয়েছে।
আচমকা আমার মনে পড়ে গেল, এ মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়ে রেখেছিলেন মণিমোহন। আর কী আশ্চর্য, মনোবীণা সান্যালও তো ওই একই তারিখ দিয়েছেন। আর আজ হল এ মাসের ফিফথ।
মণিমোহন আবার বললেন, আপনার মতলবটা কী?
তার গল্প স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে চমকে উঠলাম। বললাম, মতলব?
আমার মনে হচ্ছে ফোটোগুলো আপনি দেবেন না। খুব সম্ভব এটাই আপনার মতলব।
হঠাৎ আমার রক্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রায় চিৎকার করেই বললাম, ঠিকই ধরেছেন, ফোটো আমি দেব না।
দারুণ ঠান্ডা গলায় মণিমোহন বললেন, আস্তে মহাশয়, আস্তে। ডোন্ট বি সো একসাইটেড। ওতে ব্লাড প্রেসার চড়ে যায়। একটু থেমে বললেন, কিন্তু আপনার সঙ্গে সেই রকম চুক্তিই ছিল। সেইজন্যে পাঁচ হাজার টাকা আর একটা দামি ক্যামেরা দিয়েছিলাম।
আপনার কথামতো কাজ করতে আমি রাজি না। তবে টাকাটা আর ক্যামেরা ফেরত দিতে রাজি আছি।
সেই সঙ্গে ফোটোগুলোও তুলে দেবেন।
নো, নেভার–দাঁতে দাঁত চাপলাম, আপনার মতো ব্ল্যাকমেলারের হাতে ওই নুড ছবি কিছুতেই তুলে দেব না।
পকেট থেকে পাইপ আর টোব্যাকো বার করলেন মণিমোহন। ধীরে সুস্থে পাইপে তামাক পুরতে পুরতে বললেন, দেবেন, নিশ্চয়ই দেবেন
তার মানে?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে মণিমোহন জিগ্যেস করলেন, আপনাদের এখানে প্লাগ পয়েন্ট আছে।
অবাক হলেও বললাম, আছে।
কোথায়?
দেখিয়ে দিলাম। মণিমোহন উঠে গিয়ে প্লাগ পয়েন্ট কানেকসান করে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এতদিন মণিমোহনের সঙ্গে ফোনে যে সব কথা বলেছি সেগুলোই রেকর্ডার থেকে উঠে আসতে লাগল। যেমন আমি শমিতার ন্যড ছবি আর বেডরুম সিনের পিকচার তুলব।-এই কথাটাই বার বার শোনা যেতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য, মণিমোহন আমাকে যা-যা বলেছেন সেগুলো শুনতে পাচ্ছি না। তার মানে নিজের কথাগুলো মণিমোহন ইরেজ করে ফেলেছেন।
নিজের গলা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিল। গলগল করে ঘামতে লাগলাম। এদিকে টেপ রেকর্ডার থামিয়ে মণিমোহন বললেন, পাঁচ হাজার টাকা, ক্যামেরা আর শমিতার ফোটোগুলো দিতে এবার আর আপত্তি হবে না আশা করি। যদি হয় আমাকে এই টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে কোর্টে যেতে হবে।