ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ বিছানাটা দেখল শমিতা। তারপর শব্দ করে হেসে উঠল, ওরা আমাদের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ভেবেছে।
বললাম, তাই মনে হয়।
আজ রাতটার জন্যে টেম্পোরারি হাজব্যান্ড-ওয়াইফ হতে আমার আপত্তি নেই। হে মহান জনগণ, আমি যে ভেতরে ভেতরে মেয়েদের ব্যাপারে দারুণ পিউরিটান আর নীতিবাগীশ এই প্রথম টের পেলাম। আমি করলাম কী, তক্তাপোষ থেকে একটা বালিশ আর চাদর তুলে নিয়ে মেঝেতে বিছানা পাতলাম। বললাম, তুমি ওপরে শোও। আমি নীচে শুচ্ছি।
কেন?
আমি, অন্য ঘরে শুতে পারতাম। কিন্তু সে কথা বলতে গেলেই এ বাড়ির লোকেরা জেরা করে করে লাইফ হেল করে দেবে। সুতরাং আমাদের সম্বন্ধে ওরা যা ভেবেছে তা আর ভাঙানোর দরকার নেই। রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে কাল ভালো ভালোয় কেটে পড়তে পারলেই আমি খুশি।
শমিত তক্তপোষে উঠে শুয়ে পড়ল। আমি মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।
শমিতার শিয়রের দিকে একটা উঁচু টুলের ওপর হ্যারিকেন জ্বলছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটা নেভাতে নেভাতে চাপা গলায় বলল, কাওয়ার্ড।
কথাটা কাকে লক্ষ্য করে বলা, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। হে মহান জনগণ, আমি জবাব দিলাম না; ঘাড় মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম।
পরের দিন সকালে কলকাতায় ফেরার সময় শমিতা বলল, একদিন তোমার বাড়িতে আর কাল ওই চাষীদের ঘরে-দু-দুবার চান্স পেয়েও তুমি আমায় ছেড়ে দিলে। ইউ আর অলমোস্ট লাইক গড়।
উত্তর দিলাম না; জানালার বাইরে ধু-ধু ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শমিতা আবার বলল, যদি ফ্ল্যাটারি না ভাবো, একটা কথা বলব?
জানালাম ফ্ল্যাটারি ভাবব না। শমিতার যা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে বলতে পারে।
শমিতা খুব গাঢ় গলায় এবার বলল, বাবাকে বাদ দিলে ছেলেবেলা থেকে এমন কারোকে পাইনি যাকে শ্রদ্ধা করতে পারি, যার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। বহুদিন পর একমাত্র তোমাকেই পেলাম যাকে এখন থেকে বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা দুটোই করতে পারব।
হে মহান জনগণ, মেয়েটা বলে কী! প্রায় চমকেই উঠলাম। আমি কী বস্তু শমিতা তো জানে না। জানলে কোথায় থাকত তার বিশ্বাস আর কোথায়ই বা শ্রদ্ধা! যাই হোক এমন কথা আগে আর কখনও কেউ আমাকে বলেনি। আমার স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো কিছু বয়ে যেতে লাগল।
.
১৯.
যেদিন শমিতা আর আমি চাষীদের বাড়ি রাত কাটিয়ে এলাম তার দুদিন পরের কথা।
আজ আমরা বর্ধমানের একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। অন্য দিনের মতো আজও কলকাতায় ফিরে শমিতাকে ওদের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। তারপর ট্যাক্সি ধরে সোজা এন্টালিতে।
বড় রাস্তায় ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির সামনে যখন এসে গেছি দেখতে পেলাম গেটের কাঠে কটা ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িরই ছেলে ওরা, খুব সম্ভব নাইট শোতে সিনেমা দেখে এসেছে; এখন তাই নিয়ে গল্প করছে।
আচমকা পিছন থেকে আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে একটা হাতবোমা উড়ে গিয়ে সামনের দেয়ালে ফাটল। দারুণ জোরে একটা শব্দ হল; সেই সঙ্গে আগুনের ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দিল। চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম বিশ গজ দুরে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনে হল, সেদিন এরাই আমার পিছু নিয়ে এই গলিতে এসেছিল।
আমাকে ঘুরতে দেখেই ওরা আবার দুটো বোমা ছুড়ল। টার্গেটটা যে আমিই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু এবারের দুটো বোমাও আমার গায়ে লাগল না; উড়ে গিয়ে ওধারের বাড়ির একটা দেয়ালে গিয়ে ফাটল।
হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝবার বা করবার আগেই দেখলাম হল্লা করতে করতে আমাদের বাড়ির সেই ছোকরারা সেই লোক দুটোর দিকে দৌড়ে গেল এবং চোখের পলকে একটাকে ধরেও ফেলল। অন্য লোকটাকে অবশ্য ধরা গেল না; সে অন্ধকারে সাপের মতো পিছনে বেরিয়ে গেছে।
বেদম পিটতে পিটতে টেনে হিঁচড়ে ছোকরাগুলো লোকটাকে যখন আমার কাছে নিয়ে এল তার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
ছেলেদের থামিয়ে বললাম, কে তুমি?
হাতের পিঠ দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে লোকটা গোঙানির মতো শব্দ করল, আমাকে ছেড়ে দিন বাবু
ছেড়ে দেব কিন্তু তার আগে বলতে হবে কেন তুমি আমাকে পেটো মারলে? কে তোমাকে পাঠিয়েছে?
প্রথমে কিছুতেই বলবে না। শেষে যখন তার গলার নলি টিপে ধরে বললাম, জানে খতম করে দেব, তখন সব স্বীকার করল লোকটা। প্রবীর সিনহা তাদের আমার পিছনে লাগিয়েছে। কদিন ধরে আমাকে ফলো করে শেষ পর্যন্ত আজ তারা সুযোগ বুঝে বোমা ছুঁড়েছিল।
প্রবীর সিন্হা মানে রেস কোর্সের সেই ছোকরা। শমিতা বলেছিল সে খুব ডার্টি টাইপের লোক; ভয়ানক ভিনডিক্টিভ। ডার্টি টাইপ তাতে কোনওরকম সন্দেহ নেই। তবে তার সাহস যে নেই, সেটা সে প্রমাণ করে দিয়েছে। সাহস থাকলে সোজা আমার সামনে এসে চোয়াল ভেঙে দিত। তার বদলে দুটো থার্ড ক্লাস গুন্ডাকে আমার পিছনে লাগিয়েছে। হে মহান জনগণ, প্রবীরটা একেবারেই ছ্যাচড়া।
আমি লোকটাকে বললাম, ঘুরে দাঁড়া–
ভয়ে ভয়ে সে পিছন ফিরে দাঁড়াল। আমি তখন তার পাছায় টেনে একটা লাথি কষিয়ে বললাম, ফরোয়ার্ড।
লোকটা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার ওপর পড়ল। তারপর ধাঁ করে উঠেই চো-চা ছুট। আমি আর দাঁড়ালাম না; ছেলেদের নিয়ে সদলবলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম প্রবীর সম্বন্ধে আমার আর দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। ওর দৌড় আমার জানা হয়ে গেছে।