আমি আমার নিজের বাবার কথা বলছি।
যদি কিছু মনে না করে একটা কথা জিগ্যেস করব?
নিশ্চয়ই করবে। মনে করার কী আছে?
বাবাকে তোমার দেখতে ইচ্ছা করে না?
করে তো। কিন্তু দেখব কী করে? হি ইজ নাউ ইন কানাডা
বললাম, তোমাদের তো পয়সার অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই তো তুমি বাবার কাছে চলে যেতে পারো।
তা হয়তো পারি। কিন্তু এতদিন মা যেতে দেয়নি; তারপর কত রকম অ্যাডিকসানের মধ্যে জড়িয়ে গেছি। বাবা এমনিতে খুব লিবারেল কিন্তু এসব নেশা-টেশা নোংরামি একেবারেই পছন্দ করেন না। অথচ জানো
কী?
আমার বিশ্বাস, বাবার কাছে যেতে পারলে আমি বেঁচে যেতাম।
একটু চুপ করে থেকে বললাম, বাবার কাছেই তোমার যাওয়া উচিত।
দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আবছা গলায় শমিতা বলল, সাহস হয় না। যদি কোনওদিন নোংরা হ্যাবিটগুলো ছাড়তে পারি তবেই যাবার কথা ভাবব।
হ্যাবিটগুলো ইজিলি ছাড়তে পারো। মানুষ ইচ্ছা করলে না পারে কী?
আমার পক্ষে এগুলো ছাড়া ইমপসিবল। তোমাকে আমার লাইফের সব কথা বলেছি না। আমি একটা দারুণ ভ্যাকুয়ামের মধ্যে আছি। সেটা ভুলবার জন্যেই ওই হ্যাবিটগুলোর আমার দরকার।
আমি চুপ করে রইলাম। একটু পর টুপ করে সূর্যটা নদীর জলে ডুবে গেল। আর সন্ধ্যা নামতে না নামতেই চনমনে হয়ে উঠল শমিতা। বলল, আই–
তার চোখ-মুখের লক্ষণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবু জিগ্যেস করলাম, কী বলছ?
এখানে হুইস্কি-টুইস্কি পাওয়া যাবে?
কলকাতা থেকে মাত্র তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে মদ্য পাওয়া যাবে না, এ কখনও হয়! কিন্তু সে কথা কি আর বলি। যা বললাম তা এই রকম–হুঁইস্কি কেন, এক ফোঁটা কান্ট্রি লিকারও পাওয়া যাবে না।
শমিতা বলল, ভীষণ ড্রিংক করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার জন্যে তো কলকাতায় ফিরতে হয়।
আমি ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে গেলাম। ফেরার জন্যে না শমিতা ক্ষেপে ওঠে। কিন্তু না, সে আবার বলল, নদীর পাড়টা খুব ভালো লাগছে। এখন আর কলকাতায় ফিরব না।
রাত্রে ফেরার সময় শমিতা বলল, একটা কথা ভেবে ভীষণ মজা লাগছে।
বললাম, কী কথা?
অনেক দিন পর আজকের দিনটা আমার উইদাউট ড্রিংক কাটল।
খুব খারাপ লাগল কি?
শমিতা হাসল, না না। তবে গলাটা খুব খুসখুস করছে। অনেক দিনের হ্যাবিট তো।
আমিও হাসলাম।
আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর আজই প্রথম সজ্ঞানে স্বাভাবিক ভাবে বাড়ি ফিরল শমিতা। তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলর রোডে রেখে ট্যাক্সি ধরলাম।
হে মহান জনগণ, আগেই বলেছি আমার আস্তানায় যেতে হলে ট্রাম রাস্তা থেকে গলির ভেতর ঢুকতে হয়।
ট্যাক্সিটা বড় রাস্তায় ছেড়ে গলি দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি দুটো লোক কোত্থেকে মাটি খুঁড়ে আমার পিছু নিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তারাও দাঁড়িয়ে গেল। তাদের চালচলন কেমন যেন সন্দেহজনক। চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে তোমরা?
হঠাৎ লোক দুটো পিছন ফিরে দৌড় লাগাল এবং সাপের মতো এঁকে বেঁকে মাঝরাতের অন্ধকার নির্জন রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারেই ঝাপসা থেকে গেল।
.
১৮.
পরের দিন আবার শমিতাকে নিয়ে কলকাতা থেকে উধাও হলাম। আজ গেলাম ব্যারাকপুরে। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম।
এর পর থেকে শমিতাকে নিয়ে রোজই অনেক দূরের কোনও খোলা মাঠে, শালবনে, কিংবা নদীর পাড়ের ছোটখাটো গঞ্জে অথবা নাম-না-জানা কোনো অজ পাড়াগাঁয়ে চলে যাই। রাতের অনেকটা সময় পর্যন্ত কাটিয়ে তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে রেখে আসি। বাইরে কাটাবার জন্যে ড্রিংকটা সে আর করতে পারছে না। প্রথম প্রথম এ জন্যে তার অসুবিধা হত। কিন্তু দু-চার দিন যেতে না যেতে ড্রিংকের কথা সে আর বলে না।
আসলে কলকাতার কটা ক্লাব, হোটেল, রেস কোর্স আর জুয়ার আড্ডার মধ্যে থেকে থেকে তার লাইফ বোরিং হয়ে উঠেছিল। হাজার গন্ডা অ্যাডিকশানের ঘোর কাটিয়ে যখন তাকে বাইরে বার করে আনলাম সে যেন বেঁচে গেল। বিশাল খোলা মাঠ, সবুজ গাছপালায় ঘেরা স্নিগ্ধ গ্রাম কিংবা নদী তীর–এ পর্বের মধ্যে যে এত আনন্দ ছিল সে জানত না।
আগে আগে শমিতা মজা করে বলত, তুমি একটা আস্ত ডেভিল–যাতে ড্রিংক না করতে পারি, রেস কি গ্যাম্বলিং নিয়ে না মাতি সেইজন্যে আমাকে রোজ কলকাতার বাইরে নিয়ে যাও। তোমার মতলব আমি বুঝি?
আমি হাসতে থাকি; উত্তর দিই না।
কোনও দিন বা শমিতা বলে, আই অ্যাম ভেরি মাচ থ্যাঙ্কফুল টু ইউ-মনে হচ্ছে তোমার জন্যে অ্যাডিকশান আর ব্যাড হ্যাবিটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব। এক এক সময় আমার কী মনে হত জানো?
কী?
হোল লাইফ আমি অ্যাবনরম্যাল থেকে যাব। কিন্তু এখন আমি বিশ্বাস করি–তুমি যদি আরেকটু হেল্প করো আমি পুরোপুরি নর্মাল হয়ে যাব।
গম্ভীর গলায় বলি, আমি সব সময় তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছি শমিতা।
এনি হেল্প-আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি।
.
রোজ নিয়ম করে বাইরে ঘুরতে ঘুরতে একদিন একটা দারুণ ব্যাপার ঘটে গেল। সেদিন আমরা একটা গ্রামে গেছি। দেড়-দুশো মাইল দূরে বে অফ বেঙ্গলে কোথায় যেন আচমকা নিম্নচাপ হয়েছিল; তার ফলে অসময়ে বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টিটা এমনই একটানা আর নাছোড়বান্দা যে থামবার লক্ষণ নেই। সুতরাং এক চাষীর বাড়িতে থেকে যেতে হল।
ওরা খাইয়ে-দাইয়ে আমাদের একটা ঘরের ভেতর পুরে দিল। ঢুকে দেখি তক্তপোষে পাশাপাশি বালিশ পেতে আমাদের জন্যে বিছানা করা রয়েছে।