একটু বাদেই স্প্রিংয়ের মতো প্রবীর লাফিয়ে উঠল এবং হে মহান জনগণ, ইংরেজি ভাষার সব চাইতে নোংরা গোটাকয়েক খিস্তি আউড়ে আবার আমার দিকে দৌড়ে এল–তার মাথায় এখন খুন চেপে গেছে।
সুতরাং হে মহান জনগণ, আমাকে দ্বিতীয়বার তার চোয়ালে আরেকটা ঘুষি জমিয়ে দিতে হল। এবারও পনেরো ফুট দুরে ছিটকে গিয়ে শুয়ে পড়ল সে; আর উঠল না।
এদিকে চারপাশ থেকে লোকজন হই-চই করে ছুটে আসতে লাগল। আমি হাত দুটো ঝেড়ে দারুণ নির্বিকার মুখে শমিতাকে বললাম; চলো
শমিতা থ হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, ভয় আর সেই সঙ্গে খানিকটা রিলিফ মানে স্বস্তির ভাবও যেন মেশামেশি করে রয়েছে। আমাকে এই চেহারায় দেখবে, সে হয়তো ভাবতে পারেনি।
যাই হোক, শমিতা আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল।
পার্কিং জোনে এসে আমরা গাড়িতে উঠলাম। শমিতা স্টার্ট দিয়ে তার ফিয়েটটা রেস কোর্সের বাইরে নিয়ে এল। উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে সে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ
জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ ধন্যবাদ কেন?
ওই বিস্টটার হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, তাই বলে একটু থামল শমিতা। তারপর আবার শুরু করল, তুমি না থাকলে ও আমাকে নিশ্চয়ই ওর অ্যাপার্টমেন্টে টেনে নিয়ে যেত। আর আজকের রাতটা আটকে রাখত। এতক্ষণে শমিতার স্বস্তির কারণটা বোঝ গেল। তবে আমি আর কিছু বললাম না।
রেস কোর্সের পিছন দিয়ে গাড়িটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে নিয়ে এসেছিল শমিতা। ডাইনে ঘুরে চৌরঙ্গীর দিকে যেতে যেতে সে বলল, তবে আমার খুব ভয় করছে।
ফিরে বললাম, কীসের ভয়?
শমিতা বলল, ওই প্রবীর–হি ইজ এ ডার্টি রোগ; দারুণ ভিন্ডিকটিক। তুমি একটু সাবধানে থেকো।
আমার ওপর দুশ্চিন্তার ছায়া পড়তে পড়তেই মিলিয়ে গেল। কিছু বললাম না। আচমকা শমিতা জিগ্যেস করল, আচ্ছা, তুমি ওকে মারলে কেন?
বললাম, তোমরা ওপর ওইরকম জোর করছিল। তা ছাড়া আমাকে শুধু শুধু যা তা খিস্তি করল। তাই
নাকি কারণটা অন্য? গাড়ির স্পিড কমিয়ে আমার দিকে তাকাল শমিতা। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে নীচু গলায় বলল, মানে আমাকে ভালোবেসে-টেসে ফেলেছ নাকি?
আমার হার্ট লাংস ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চমকে খেলে গেল। হে মহান জনগণ, অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি, মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার বিজনেস পার্টনার মানে লতিকার সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে। আমার প্রতি তার দুর্বলতা সব সময়ই টের পাই। কিন্তু তার সম্পর্কে আমার যে সহানুভূতি বা ফিলিং সেটা ভালোবাসার কতটা কাছাকাছি তা আমার নিজের কাছেই খুব স্পষ্ট নয়।
কিন্তু এই মেয়েটা, অর্থাৎ শমিতার পিছনে কদিন ধরে বঁড়শিতে আটকানো মাছের মতো যে ছুটে বেড়াচ্ছি সেটা কি শুধুমাত্র তাকে মদ জুয়া রেস ইত্যাদির অ্যাডিকসান থেকে ফেরাবার জন্যে? আগেও দু-একবার ভেবেছি, এখনও মনে হল, হে মহান জনগণ-আমি ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছি। হেসে হেসে বললাম, কী জানি–
আমরা চৌরঙ্গীতে চলে এসেছিলাম। কিছু বুঝবার আগেই আচমকা শমিতা গাড়িটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বলল, আজ আর হোটেলে খাব না।
তবে?
কিছুদিন ধরে দেখছি হোটেলে বারো পেগ ড্রিংক করার পরও আউট হইনি। আজ ক্লাবে বসে হুইস্কি খাব।
হে মহান জনগণ, মেয়েটা আমাকে দারুণ ঝামেলায় ফেলে দিল তো। হোটেল ষড়যন্ত্র করে হুইস্কিতে জল মেশাবার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সব জায়গায় কি তা সম্ভব?
ল্যান্সডাউন রোডের এক পশ ক্লাবে এসে সুইমিং পুলে ঘণ্টাখানেক সাঁতার কাটল শমিতা। সাঁতার-টাতার কাটার পর কিছু খাবার আর ড্রিংক নিয়ে আমার মুখোমুখি বসল শমিতা। আজ এগারোটার মধ্যেই বারো পেগের কোটা কমপ্লিট করে পুরোপুরি আউট হয়ে গেল সে। অবশ্য আউট হবার আগেই কালকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করে নিয়েছিল। কাল দুটোর সময় বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে।
শমিতাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন এন্টালি এলাম একটা বেজে গেছে।
.
১৭.
পরের দিন ঠিক দুটোর সময় বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে থেকে আমাকে গাড়িতে তুলে নিল শমিতা, তারপর পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে যেতে বলল, কোথায় যাওয়া যায় বলো তো? ক্লাব হোটেল এসব বোরিং লাগছে।
আজ সকালেই মাথায় একটা দারুণ প্ল্যান এসে গেছে। বললাম, তুমি এ কদিন আমাকে যেখানে নিয়ে গেছ সেখানেই গেছি। চলো, আজ তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই। যাবে?
কোথায়?
গেলেই বুঝতে পারবে।
আচ্ছা যাব।
তাহলে গাড়ি থামিয়েই আমার জায়গায় এসো। আমাকে ড্রাইভ করতে দাও। ঘণ্টা দুয়েক পর শমিতাকে নিয়ে সোজা ডায়মণ্ড হারবার চলে এলাম। ট্যুরিস্ট লজে কফি-টফি খেয়ে আমরা যখন নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম তখন বিকেল। ঝকঝকে সোনালি রোদ জলের ওপর স্থির হয়ে আছে।
বিশাল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে শমিতা বলল, বিউটিফুল।
আমি আস্তে মাথা নাড়লাম।
শমিতা এবার বলল, অনেক দিন পর ডায়মণ্ড হারবার এলাম। একটু থেমে অন্যমনস্ক মতো আবার বলল, জানো, ছেলেবেলায় একেকদিন বাবা আমাদের ডায়মণ্ড হারবার নিয়ে আসতেন। কী ভালো যে লাগত।
মুখ ফসকে বলে বললাম, কার কথা বলছ–মিস্টার সান্যালের?
আরে না, ও তো মার সেকেন্ড হাজব্যান্ড। হি ইজ এ সোয়াইন।