এ অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন নয়। যখনই কোনও একটা কনসার্ন তুলে দিই তখনই ঋক বেঁধে আমাদের সেই কনসানের সম্মানিত ক্লায়েন্টরা কিঞ্চিৎ খিস্তি-খাস্তা করে যায়। এ খিস্তিটুকু আমাদের তেমন গায়ে লাগে না। কেননা সেই প্রবাদটা আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়, আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। যাই হোক হীরাচন্দরা চলে গেলে আমি নিজের চেম্বারে চলে এলাম। ঢুকেই দেখি লতিকা খুব হাসছে। হাসির কারণটা হীরাচন্দদের হতাশ এবং বেকুব হয়ে ওই একটানা খিস্তিখেউড়ে। দেখাদেখি আমিও হেসে ফেললাম।
হাসতে হাসতে বললাম, আরেকবার আমাদের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হল।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ফোন বেজে উঠল। সেটা তুলে নিয়ে কানে লাগাতেই মহিলা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, মিস্টার সরকার?
বললাম, হ্যাঁ।
আমি মনোবীণা সান্যাল। বিশেষ একটা দরকারে আপনাকে ফোন করছি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, বলুন–আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছি সেটা কী রকম চলছে?
ভালোই। আমি সিনসিয়ারলি চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ডোরাকে নরম্যাল করা যাবে বলে আপনার মনে হয়?
সেই রকমই আমার ধারণা।
ভেরি গুড। বলে একটু থামলেন মনোবীণা। পরক্ষণে আবার শুরু করলেন, কুড়ি-বাইশ দিন হল আপনি আমার কাজটা নিয়েছেন।
বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ–
আপনাকে আর পঁচিশ দিন সময় দিচ্ছি। তার মানে নেক্সট মাস্থের দশ তারিখ পর্যন্ত। এর মধ্যে আপনার কাজ কমপ্লিট করতে হবে।
বললাম, বাইশ দিনের মধ্যে কী হবে? আপনি তো আপনার মেয়েকে জানেন; তার মধ্যে কতরকমের অ্যাডিকসান রয়েছে। সে সব থেকে তাকে বার করে আনতে অনেক সময়ের দরকার।
মনোবীণা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, জানি জানি। কিন্তু বাইশ দিনের বেশি একটা দিনও আপনাকে দিতে পারব না। আর শুনুন, আরেকটা কাজ আপনাকে করতে হবে।
কী?
নেক্সট মান্থের ইলেভেন্থ সন্ধের ট্রেনে ভোরাকে নিয়ে আপনাকে বম্বে যেতে হবে। বম্বের একটা ঠিকানা দিয়ে দেব; ওকে ওখানে পৌঁছে দেবেন। আর এই বম্বে যাবার ব্যাপারটা এখন ভোরাকে বলবেন না।
কিন্তু এত অল্প সময়ে
বললামই তো, এর বেশি একটা সেকেন্ডও বাড়ানো যাবে না। দশ তারিখটা মনে রাখবেন। আচ্ছা ছাড়ছি–
টেলিফোনটা নামিয়ে বাঁদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল লতিকা একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আবার ফোন বেজে উঠল। টেলিফোনটা তুলে কানে ঠেকাতেই মণিমোহনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মনোবীণার পরেই এই লোকটা আমার জন্যে যে ওঁত পেতে বসে ছিল, কে ভাবতে পেরেছে। গলার স্বরটা মধুতে চুবিয়ে বললাম, বলুন স্যার
মণিমোহন বললেন, আমার কাজের কথাটা মনে আছে তো?
নিশ্চয়ই! শমিতা বোসের নুড ছবি আর বেডরুমের কিছু উত্তেজক পিকচার তুবে দেব-এই তো?
মণিমোহন বললেন, কারেক্ট। এবার বলুন, কখানা ফোটো ভোলা হল?
আপনি তো আমাকে দুমাস সময় দিয়েছেন; তার মধ্যেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু সময়টা যে একটু কমাতে হচ্ছে। আমি আপনাকে আর পঁচিশটা দিন দিচ্ছি; তার মানে নেক্সট মাছের দশ তারিখের মধ্যে ফোটোগুলো আমার চাই।
দারুণ চমকে উঠলাম। মনোবীণাও ঠিক ওই তারিখটাই আমাকে দিয়েছেন। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে ওর মধ্যে যে একটা সাংঘাতিক ঝামেলা রয়েছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। বললাম, ঠিক আছে স্যার, দশ তারিখের মধ্যেই ফোটোগুলো দিতে চেষ্টা করব। চেষ্টা না, দিতেই হবে। আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত থাক। পরে আবার যোগাযোগ করব।
লাইন কেটে যাবার পর নিজের অজান্তেই বাঁদিকে আমার ঘাড়টা ঘুরে গেল। দেখি আগের মতোই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লতিকা। চোখাচোখি হতেই সে বলল, ডিসটার্বড় মনে হচ্ছে?
নিজের মুখ তো দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো সেখানে দুর্ভাবনার কিছু ছাপ পড়ে থাকবে। তবু হেসে বললাম, স্লাইট
কে ফোন করেছিল? মণিমোহন মল্লিক?
হ্যাঁ।
তার আগে মনোবীণা সান্যাল?
আমি আস্তে মাথা নাড়লাম। লতিকা আর কিছু জানতে চাইল না। তার সামনে হিসেবের খাতাপত্র খোলা হয়েছে, সে-সব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি রিভলভিং চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম, পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা এবার বন্ধ করে দিতে হবে। মণিমোহন মল্লিক যেভাবে আমার পিছনে লেগে আছে ওটা তুলে না দিলেই নয়। অবশ্য মনোবীণাও লেগে আছেন। তবে এ ব্যাপারটায় আমার নিজেরই যথেষ্ট ইন্টারেস্ট।
চেয়ারে শরীর ছড়িয়ে রেখেই একসময় জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা লতিকাকাচের দেয়ালের ওধার থেকে লতিকার গলা শোনা গেল, বলো–
আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে আমরা কী রকম অ্যাডভান্স পেয়েছি?
হিসেব-টিসেব সব সময় মুখস্থই থাকে লতিকার। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, মোট সাঁইত্রিশ হাজার চারশো টাকা
একটু চুপ করে থেকে বললাম, নট ব্যাড। অনেকদিন হয়ে গেল; এবার ভাবছি ওটার গণেশ উল্টে দেব। ওই ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিয়ে নতুন কী খোলা যায় বলো তো?
হে মহান জনগণ, আগেই বলেছি কীভাবে আমাদের প্রাফেসানটা নতুন নতুন ডাইভার্সিফিকেসন করা যায়, এ নিয়ে কিছুদিন ধরে নানারকম রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছে লতিকা। সে বলল, ভেবেছি ওখানে প্ল্যানস বলে একটা ডিপার্টমেন্ট খুলব।
ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলো।
আমরা প্ল্যানস থেকে নানারকম পরিকল্পনা সাপ্লাই করব। এই ওয়ার্ল্ডে কেউ রাতারাতি মিলিওনেয়ার হতে চায়, কেউ ফেম চায়, কেউ প্রতিষ্ঠা চায়, কেউ চায় পাওয়ার। আমরা তাদের কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকা নিয়ে দুমাস কি তিন মাস সময় নেব। বলব, পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হচ্ছে, পরে পাঠানো হবে। তিন মাসের মধ্যেই আশা করা যায় এই ডিপার্টমেন্টে লাল বাতি জ্বালানো যাবে।