হে মহান জনগণ, কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার চোখের সামনে শমিতা তার চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জীবনের একটা পেন্সিল স্কেচ এঁকে দিয়ে বলল, এবার বলো, নিজের লাইফটা ওয়েস্ট করার রাইট আমার আছে কিনা
কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। আমি চুপ করে রইলাম।
আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না শমিতা। ওয়েটারকে ডেকে আবার হুইস্কির অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ফরগেট অল দ্যাট ব্লাডি বোগাস থিং। লেটস এনজয় ড্রিংক। এই পেগটা খেয়ে একটু নাচবে নাকি?
বললাম, আমার আপত্তি নেই।
ড্রিংক এসে গিয়েছিল। খেয়েই শমিতা আমাকে বলরুমে নিয়ে গেল।
নাচতে নাচতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। তা ছাড়া ফ্লোরডান্সে আমি একেবারেই আনাড়ি। কাজেই স্টেপিংটা এলোমেলো পড়তে লাগল।
সেদিন বেহুঁশ অবস্থায় নেচেছিল শমিতা। আজ সাত পেগ খেলেও তার অর্ধেকটাই জল। কাজেই তার চোখকে আজ ফাঁকি দেওয়া গেল না। সে বলল, কী হল, স্টেপিংটা মেলাও–
আমি কেন, আমার ফোরটিন জেনারেসনও ফ্লোরডান্সে স্টেপ মেলাতে পারবে না। বললাম, এই যে মেলাচ্ছি–
কিন্তু কিছুতেই পা মেলানো যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ লক্ষ্য করে শমিতা বলল, তোমাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে।
এ কথাটা সত্যি। আমার অন্যমনস্কতার কারণ যে শমিতাই, সে কথাটা আর বলা গেল না। ঝোঁকের মাথায় যেদিন তাকে ফেরাবার এবং শোধরাবার দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেদিন জানতাম না এই মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডে এইসব ঝামেলার ব্যাপার রয়েছে। মেয়েটার জন্যে আমি কি দুঃখ বোধ করছি।
হে মহান জনগণ, আমার কাজ হল মানুষের দুর্বলতা থেকে কিছু প্রফিট উঠিয়ে সরে পড়া। কারো ব্যাপারেই আমার কোনও সেন্টিমেন্ট নেই। কিন্তু এই মেয়েটা আমাকে ফ্যাসাদে ফেলে দিল দেখা যাচ্ছে। এর কথা না ভেবে পারা যাচ্ছে না। হে মহান জনগণ, জালে আঠা লাগিয়ে পাখি ধরতে গিয়ে আমিই যেন আঠায় জড়িয়ে গেছি।
শমিতা আবার বলল, তুমি আজ অফ মুডে আছ। চলো, আর নাচতে হবে না। ড্রিংকই করা যাক
আবার আমরা বার-এ ফিরে এলাম। কিন্তু বারো পেগের কোটা কমপ্লিট করার পরও শমিতা আউট হল না। চোখ অবশ্য ছ-সাত পেগের পরই লাল হয়ে উঠেছিল। বিরক্তভাবে সে বলল, কদিন ধরেই দেখছি বারো পেগে আমার কিছু হচ্ছে না। মনে হয় হুইস্কি কোম্পানিগুলো বাজে থার্ড ক্লাস জিনিস বাজারে ছাড়ছে। আমি ওদের এগেনস্টে ল-ইয়ারের চিঠি দেব।
আমি চুপ করে রইলাম।
শমিতা বলল, চলো, স্কচে যখন কিছু হচ্ছে না, কান্ট্রি লিকারই খাব–
হে মহান জনগণ, বার ম্যানেজারদের সঙ্গে অ্যারেঞ্জমেন্ট করে হুইস্কিতে না হয় জল মেশাবার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু দিশি বাংলা মদ খাওয়াটা ওর আটকাব কী করে? রেস-টেস এবং অন্য অ্যাডিকশান থেকেই বা ওকে ফেরাব কোন উপায়ে? আমার মাথার ভেতরটা চরকির মতো ঘুরতে লাগল।
» ৫. আরেক সমস্যা
১৫.
এদিকে আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। শমিতার ব্যাপারে আমি যতই জড়িয়ে যাচ্ছি, ততই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে লতিকা। কদিন ধরেই লক্ষ্য করছি অফিসের ব্যাপার নিয়ে দারুণ মেতে উঠেছে সে। কীভাবে নতুন নতুন রাস্তায় আমাদের প্রফেসানটার ডাইভার্সিফিকেশন করা যায় তার প্ল্যান করছে, ব্লু প্রিন্ট করছে, চার্ট করছে এবং কী রকম প্রফিট-ট্রফিট হতে পারে তার হিসেব-টিসেবও করছে।
তাকে যখনই শমিতার কথা বলতে যাই তখনই সে একই কথা বলে যায়, আরে বাবা তোমার এক্সপিরিয়েন্সটা কমপ্লিট হোক না, তখনই সব শুনব।
পরিষ্কার বুঝতে পারি শমিতার অ্যাফেয়ারটা এড়িয়ে যাচ্ছে লতিকা। কিন্তু যে অনিচ্ছুক তাকে তো আর জোর করে শোনানো যায় না।
যাই হোক একদিন দুপুরে অফিসে এসে নিজের চেম্বার পর্যন্ত যাওয়া গেল না। লিফট বক্সের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, পাস্ট-প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের সামনে তুলকালাম চলছে। একগাদা লোক সমানে চেঁচাচ্ছে আর বাপ-বাপান্ত করছে। তাদের মধ্যে জিরাফের মতো লম্বা গলা-ওলা সিঁড়িঙ্গে ভগবতী পোদ্দার আর গোলাকার ঘাড়ে-গর্দানে ঠাসা হীরাচাঁদ আগরওয়ালাও রয়েছে। হে মহান জনগণ, এদের নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন। এরা আমাদের এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের মাননীয় সব ক্লায়েন্ট।
হীরাচাঁদ এবং ভগবতী একই কনস্টিটিউয়েন্সির দুই রাইভ্যাল ক্যান্ডিডেট। কিন্তু এখন কে বলবে তারা পরস্পরের রাইভ্যাল? দুজনেই গলার শির ছিঁড়ে খিস্তি দিয়ে যাচ্ছিল। দম নেবার জন্যে একজন যখন থামে, আরেকজন শুরু করে দেয়। জানোয়ার, শুয়ারকে বাচ্চা-কুত্তা, হারামিকে বাচ্চা–গিধধর–উল্লু-কা-পাঠঠে।
ব্যাপারটা এই। এতগুলো লোক কেউ এম-পি, কেউ এম-এল-এ হবার জন্যে, কেউ বা অন্য ইলেকসান জেতার জন্যে আমাদের টাকা দিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ খবর-টবর পেয়ে অকুস্থলে এসে দ্যাখে এইড-ইলেকসানের অফিস উঠে গেছে। ফলে যা রি-অ্যাকশান হবার তাই হচ্ছে।
কদিন আগেও ইলেকসান নিয়ে ওরা একজন আরেকজনের পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতে পারত। কিন্তু যেই দেখল এইড-ইলেকসানের জায়গা অন্য অফিস বসে গেছে অমনি তারা এককাট্টা হয়ে হয়ে গেছে। একসঙ্গে কোরাসে আমাদের খিস্তি করে এখন গলাগালি করে দুজনে চলে যাচ্ছে। আর আর যাদের কাছে ইলেকসান করাবার নাম করে টাকা নিয়েছি তারাও ওদের পিছু পিছু প্রায় শোভাযাত্রার করেই চলে গেল।