এই সব চোদ্দো-পনেরো বছর আগের ঘটনা। যাই হোক, মনোবীণা চলে যাবার পর ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন দেবতোষ। সেখান থেকে অরিন্দমকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তুমি পারফেক্ট বন্ধুর কাজ করেছ। যাই হোক দু-চারদিন ফুর্তি করে মনোবীণাকে রাস্তায় ছুঁড়ে দিও না কিংবা তাকে রক্ষিতা করেও রেখ না। তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিও। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার নামে অ্যাডালটারি বা অন্য যে কোনও চার্জ, মানে যা আনলে ডিভোর্স হতে সুবিধা হয় নিয়ে এসো। আমি কেস কনটেস্ট করব না, খুব সহজেই মনোবীণা ডিভোর্স পেয়ে যাবে। তারপর তুমি ওকে বিয়েটা করে নিও।
বিয়ে অবশ্য শেষ পর্যন্ত করেছিলেন অরিন্দম সান্যাল। কিন্তু এই নাম্বার টু বিয়েটা হয়ে যাবার পর কোন ফাঁদে পা দিয়েছেন, বুঝতে পেরেছিলেন মনোবীণা। ছোট কনসাল্টিং ফার্মটাকে বড় করবার জন্যে তাকে, মানে তার দারুণ সুন্দর আকর্ষণীয় শরীরটাকে কাজে লাগিয়েছেন অরিন্দম। বড় বড় অর্ডার পাবার জন্যে মনোবীণাকে অনেকের বেডরুমে যেতে হত।
প্রথম প্রথম আপত্তি করেছেন মনোবীণা। তারপর আস্তে আস্তে যা হয়, সব ব্যাপারটা হ্যাঁবিন্টের মধ্যে এসে গেছে। হ্যাবিট ইজ দি সেকেন্ড নেচার না কী যেন বলে, এ হল তাই। এর নিট ফল হয়েছে এই, ব্যাঙ্কে টাকার পাহাড় জমেছে অরিন্দম সান্যালের, ছোট্ট কনসালট্যান্ট ফার্মটা এখন ফরেন কোলাবরেসনে বিরাট হয়ে উঠেছে। বালিগঞ্জ সার্কুলারে প্রকাও বাড়ি করেছেন অরিন্দম। এ ছাড়া বম্বেতে ফ্ল্যাট আছে, দার্জিলিঙে বাংলো, দিল্লিতে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। এখন প্রতিদিন পার্টি, প্রতিদিন ড্রিংক, ডান্স ইত্যাতি ইত্যাদি। হাউইয়ের মতো আকাশের দিকে উড়তে উড়তে না মনোবীণা সান্যাল, না অরিন্দম সান্যাল-কারোরই লক্ষ্য ছিল না শমিতার দিকে। অবশ্য তার আরাম বা সুখের সব রকম ব্যবস্থাই ওঁরা করে দিয়েছেন। শমিতার জন্যে আলাদা একটা গাড়ি, একজন গভর্নের্স, একটা চাকর, একটা সব সময়ের মেড়-সারভেন্ট কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু যা না হলে হিউম্যান গ্রোথ অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার নাম মা-বাবার স্নেহ, তাদের পার্সোনাল কেয়ার–সেটি পায়নি শমিতা।
হে মহান জনগণ, তেরো-চোদ্দো বছর আগে মনোবীণা যখন অরিন্দমের সঙ্গে পালিয়ে আসেন তখন শমিতার বয়স দশ। তারপর থেকে শমিতা একটা জঘন্য অ্যাবনরম্যাল পরিবেশের মধ্যে আছে। এতগুলো বছর এই নোংরা অ্যাটমসফিয়ার আর মা এবং তার দ্বিতীয় স্বামীটির নানারকম কীর্তিকলাপ শমিতার নার্ভের ওপর দারুণ প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে দিয়েছে। তার ক্রমাগত মনে হয়েছে একটা অদ্ভুত ভ্যাকুয়ামের অর্থাৎ শূন্যতার মধ্যে সে ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার চামটা তার কাছে একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আত্মহত্যার কথা দু-একবার ভেবে দেখেছে সে। এমনকী, একবার ব্লেড দিয়ে কর্জির শিরাও কেটে ফেলেছিল। বাড়ির একটা চাকর দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করে দেয়; ফলে বেঁচে গিয়েছিল শমিতা।
অ্যাটেস্পট অফ মার্ডার সেই একবারই। তারপর কিছুদিন শমিতাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের ট্রিটমেন্টে থাকতে হয়েছে; কারণ সবই ধারণা তার এই আত্মহত্যার অ্যাটেম্পট সম্পূর্ণ মানসিক কারণে। ইট ইজ এ মেন্টাল কেস। শমিতার পরিষ্কার মনে আছে এই সময়টা দিনরাত সে চুপচাপ আর বিষণ্ণ থাকত। যাই হোক, সাইকিয়াট্রিস্টের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার নেচারটা একেবারে পাল্টে গেল। সে ভাবলস, এভাবে ভূতের মতো ঘরের কোণে ওয়ার্ল্ডের সব বিস্বাদ আর দুঃখের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয়। লাইফটাকে দু-হাতে উড়িয়ে দাও।
বাড়িতেই ছোটখাটো একটা ফ্যামিলি-বার রয়েছে। একদিন সেখান থেকে হুইস্কির বোতল বার করল সে। ওপেনিং সেরিমনিটা সেদিনই হয়ে গেল। তারপর আর তাকে বাড়িতে আটকে রাখা গেল না। অনেকগুলো পশ ক্লাবের মেম্বার হল সে; হোটেলে অ্যাকাউন্টে ড্রিংকের ব্যবস্থা করল। সেই সঙ্গে জুয়া, রেস ইত্যাদির মধ্যে ক্রমশ ডুবে যেতে লাগল।
এই নিয়ে অরিন্দম আর মনোবীণার মধ্যে অনেক গোলমাল হয়েছে। এখনও হয়। কেননা মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকা নিয়ে দিচ্ছে শমিতা। স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে এভাবে টাকা ওড়াক, অরিন্দম সান্যাল তা চান না। কিন্তু এ ব্যাপারে মনোবীণা মেয়ের পক্ষে। তিনি বলেন ও তোমার বাবা কিংবা চোদ্দ পুরুষের টাকা নষ্ট করছে না। নিজের শরীর দিয়ে আমি তোমার যে ফরচুন তৈরি করে দিয়েছি তার থেকে নষ্ট করছে। দ্বিতীয় স্বামীটিকে মহিলা প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। অবশ্য গোপনে মেয়েকে ফেরাতে চেষ্টা করেছেন মনোবীণা। বলেছেন, বি নর্মাল ভোরা; বি ডিসেন্ট—
শমিতা বিদ্রুপের সুরে বলেছে, নরম্যালসি আর ডিসেন্সির কথা তোমার মুখে অন্তত মানায় না। রোজ যা ম্যাজিক দেখাচ্ছ! বলেই মায়ের গালে আদরের ভঙ্গিতে আলতো টোকা দিয়েছে, মামণি, তুমি তোমার অরবিটে ঘুরতে থাকো; আমি আমার অরবিটে ঘুরি। এসো, আমরা একটা ভদ্রলোকের চুক্তি করে ফেলি। কেউ কারোকে ডিসটার্ব করব না।
যাই হোক দিনরাত শমিতা এই যে ড্রিংক-ডান্স-জুয়া-রেসের মধ্যে তলিয়ে থাকে এটা শুধু সময় কাটাবার জন্যে। কিন্তু বেশিক্ষণ কোনওটাই ভালো লাগে না। খানিকটা পর এ সব তার খুবই বোরিং মনে হয়। তবে ক্লান্তি আর একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে আবার এই ড্রিংক, এই রেস, এই সব হুল্লোড়বাজি।