অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স আর কাকে বলে! কোথায় একটি অচেনা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনব, তা নয়। সমরেশ কথা বলছে! ছোকরা এমনিতে খুবই সুপুরুষ, চেহারাটা দেখবার মতো, কিন্তু গলার স্বর যাচ্ছেতাই। ছেলেবেলায় অনবরত ফ্যারেনজাইটিসে ভোগার ফলে গলাটা ওই রমক হয়ে গেছে।
লতিকা তাকিয়েই আছে। টেলিফোনের মুখটা এক হাতে চেপে তাড়াতাড়ি লতিকাকে সেই কথাটা বলে নিলাম, অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। মহিলা নয়–আমাদের সমরেশ। বলেই হাত সরিয়ে সমরেশকে বললাম, কী ব্যাপার সমরেশ, যেতে হবে কেন?
গলার স্বর যতটা সম্ভব নামিয়ে খুব সতর্কভাবে সমরেশ বলল, এক ভদ্রলোক এসেছেন, ম্যানেজ করতে পারছি না।
খানিকটা ঝুঁকে এইড-ইলেকসন কর্পোরেশনের পিছন দিকের দেয়ালের কাঁচ দিয়ে দেখে নিলাম সমরেশের মুখোমুখি প্রকাণ্ড চেহারার মধ্যবয়সি একটি লোক বসে রয়েছে। বললাম, ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। বলেই টেলিফোনটা ক্রেডলে নামিয়ে রেখে লতিকার দিকে তাকালাম।
লতিকা জিগ্যেস করল, সমরেশ কী বলছে?
আঙুল দিয়ে সমরেশের সামনাসামনি সেই বিশাল লোকটাকে দেখাতে দেখাতে বললাম, এইড-ইলেকসানের নেটে বোধহয় একটা মালদার শিকার ঢুকেছে; সমরেশ ঠিক খেলিয়ে তুলতে পারছে না। যাই, গিয়ে দেখি ক্যাচ-কট-কট করা যায় কিনা
আমাদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সামনের সরু প্যাসেজটা দিয়ে ডানদিকের সেই করিডরে চলে এলাম। এখানে একটা ছোট দরজা আছে; যাকে সাইড-ডোর বলা হয় অনেকটা সেই রকম। দরজাটা ঠেলে এইড-কর্পোরেশনের ভেতরে চলে এলাম।
আমাকে দেখে সমরেশ তার চেয়ার ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। আর আমি তার ফাঁকা চেয়ারটায় সেই লোকটির মুখোমুখি বসলাম। আমাকে দেখিয়ে সমরেশ সেই লোকটিকে বলল, আপনি এঁর সঙ্গে কথা বলুন
এবার ভালো করে লোকটিকে লক্ষ্য করলাম। আমার চেম্বার থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম–লোকটা মধ্যবয়সি। সারা গায়ে বোপ চর্বির স্তূপ। গোলাকার শরীর, গোল মুখে ছোট ছোট চোখ, চওড়া কপাল, চুলে কলপ-লাগানো। থুতনির তলায় তিনটে থাক পড়েছে লোকটার; অনেকটা গলকম্বলের মতো দেখায়। তার পরণে সিল্কের পাঞ্জাবি, আর মিলের ফিনফিনে ধুতি, পায়ে চকচকে পাম্প-সু। দু-হাতের মোটা মোটা আঙুলগুলোতে কম করে সাতটা আংটি, গলায় সোনার চেন, হাতে গোল্ডেন ব্যাণ্ডে বাঁধা দামি চৌকো ফরেন রিস্টওয়াচ। চেহারা-টেহারা দেখে বেশ শাঁসালো ক্লায়েন্টই মনে হচ্ছে।
আমার সেই ট্রেড মার্ক নেওয়া পেটেন্ট হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বললাম, বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি–
লোকটি বলল, আমার নাম হীরাচন্দ আগরওয়াল।
নমস্কার।
নমস্কার, দিন কয়েক আগে নিউজ পেপারে আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখেছি। ইলেকসানের ব্যাপারে আপনারা তো সাহায্য করে থাকেন।
টেবলের ওপর ঝুঁকে বললাম, নিশ্চয়ই; ওটাই আমাদের বিজনেস।
বিজ্ঞাপনটা দেখে কদিন ধরে ভাবছিলাম আপনাদের অফিসে আসব। শেষ পর্যন্ত চলেই এলাম।
সো কাইন্ড অফ ইউ।
হীরাচন্দ আগরওয়াল একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমি এবার ইলেকসানে নামতে চাই। আপনারা আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন, বলুন
দু-ভাবে সাহায্য করে থাকি। অর্ডিনারি আর স্পেশ্যাল–দু-রকম ব্যবস্থা আছে। আমাদের কাস্টমাররা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সাহায্য করব।
ব্যাপারটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন
অবশ্যই
আমি যা বললাম সংক্ষেপে এই রকম–স্পেশ্যাল ব্যবস্থায় আমরা নির্বাচন-প্রার্থীর জন্যে মিটিং-এর অ্যারেঞ্জমেন্ট করি, লোকজন জুটিয়ে প্রসেসান বার করি, ক্যান্ডিডেটের ছবি দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাই, সিনেমা হলে স্লাইড দিই, মাইকে অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের মতো দিনরাত ভোট ফর অমুক বলে ইলেকসানের আগে পর্যন্ত চেঁচিয়ে যাই। প্রার্থী চোর ভেজালদার-স্মাগলার-ফেরেব্বাজ যাই হোক না, দেশসেবক, দানবীর ইত্যাদি ইত্যাদি অ্যাডজেকটিভ জুড়ে তার একখানা জীবনী ছেপে বাড়ি বাড়ি বিলি করি। ক্যান্ডিডেট যা বক্তৃতা দেবে তার কপি লিখে রেগুলার রিহার্সাল দিইয়ে নিই। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটিয়ে ক্যারেক্টার অ্যাস্যাসিনেশন মানে চরিত্র হননের ক্যাম্পেন চালিয়ে যাই। আমাদের আরেকটা স্পেশ্যালিটি হল প্রতিটি মিটিং-এ একজন করে চিত্রতারকা কিংবা পপ-সিঙ্গার নিয়ে আসি। এতে সভার গুরুত্ব বাড়ে, লোকজনও বেশি হয়। মোদ্দা কথা, মাঝে মাঝে মিটিং আর প্রসেসানের সময় ক্যান্ডিডেটকে হাজির হলেই চলবে। নইলে বাকি সময়টা নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে সে ঘুমোতে পারে। তবে এই স্পেশ্যাল ব্যবস্থার জন্য রেটটাও স্পেশ্যাল।
হীরাচন্দ বলল, রেটটা যদি বলেন
এম-পি-দের জন্যে পঞ্চাশ হাজার, এম-এল-এ-দের জন্যে পঁচিশ, কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের জন্যে দশ, আর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের জন্যে পাঁচ। ধন্যবাদ। অর্ডিনারি ব্যবস্থাটা কী রকম?
এতে আমরা শুধু ডেস্ক-ওয়ার্ক করে থাকি; ফিল্ডে নামি না। যেমন ধরুন পোস্টার ডিজাইন থেকে বক্তৃতার কপি পর্যন্ত তৈরি করে দিই। কীভাবে মিটিং করতে হবে, প্রসেসান বার করতে হবে তার প্ল্যান ছকে দিই। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজটা ক্যান্ডিডেটকে তার লোকজন দিয়ে করিয়ে নিতে হয়। অর্ডিনারি ব্যবস্থার রেট কেমন?
হাফ।