তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না মণিমোহন। মনে হল, আমার শেষ কথাটায় কাজ হয়েছে। আফটার অল, বাবা মণিমোহন তুমি যদি ডালে ডালে ঘোরো তবে আমি চলি পাতায় পাতায়। তোমার মতো বহু মালকে আমি চড়িয়ে বেড়াই। কয়েক সেকেন্ড বাদে মণিমোহন বললেন, ব্ল্যাকমেল শব্দটা শুনেছেন?
আমি চমকে উঠলাম, নিশ্চয়ই
ওটা মাথায় রেখে ফোটো তুলে যান। ও-কে?
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই লাইনটা কেটে দিলেন মণিমোহন। ফোনটা কাচের দেয়ালের ফেঁকর গলিয়ে লতিকাকে ফেরত দিতে দিতে বললাম, জানো লতিকা, কাল রাত্তিরে শমিতা একটা দারুণ।
আমার কথা শেষ হবার আগেই লতিকা বাকিটুকু বলে উঠল, কাণ্ড করেছে-এই তো? তোমার এক্সপিরিয়েন্সের কথা পরে শুনব। আগে তুমি আমার কথাটা শুনে নাও
বলো–
কাল তুমি বেরিয়ে যাবার পর থেকে আজ বেলা বারোটা পর্যন্ত বাইশ জন লোক এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে গেছে। এদের কেউ এমপি হতে চায়, কেউ এম-এল-এ, কেউ কাউন্সিলার কেউ মিনিসিপ্যাল কমিশনার।
যা খুশি হতে চাক। কিন্তু কেউ কিছু হবে না।
লতিকা আমার কথা হয়তো শুনতে পেল না। নিজের মনেই বলে যেতে লাগল, কয়েকটা মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকসান আসছে মাসেই হচ্ছে। এখন থেকেই তাহলে ক্যাম্পেনের কাজ
শুরু করতে হবে। তাই ভাবছিলাম–
বললাম, এইড-ইলেকসানের এবার গণেশ উল্টে দেওয়া দরকার–কেমন?
হ্যাঁ! বেশিদিন ওটা রাখলে অ্যাডভান্সওলারা এসে ট্রাবল ক্রিয়েট করবে।
বেশ তো; দাও উল্টে—
আমার ইচ্ছা কাল-পরশুর মধ্যেই ওখানে অন্য অফিস বসিয়ে দেব।
কী অফিস বসাতে চাও?
সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। ওখানে একটা জ্যোতিষের অফিস বসাব।
একটু চিন্তা করে বললাম, নট-এ ব্যাড আইডিয়া
লতিকা বলল, নামটাও আমি ঠিক করে রেখেছি-ভূত-ভবিষ্যৎ।
বললাম, নামটা কোয়াইট গুড। তবে ওটা চলবে না। ইংরেজি নাম দিতে হবে। কারণ নন-বেঙ্গলি ক্লায়েন্টও তো আছে। তাদেরও ফাঁদে ফেলা দরকার। তা ছাড়া বাংলা নাম-ধাম অচল; যতই যা-ই হই, ভেতরে ভেতরে আমরা আজও ইংরেজিয়ানার চাকর হয়ে আছি।
মিনিটখানেক চিন্তা করে লতিকা বলল, তাহলে নাম দেওয়া যাক পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার।
আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম, ইটস এ বিউটি। এই নামই দেওয়া হবে।
তাহলে মাইন-বোর্ডওলা আর ইন্টেরিয়র ডেকরেটরদের খবর দিই? কারণ বসার অ্যারেঞ্জমেন্ট-ট্যারেঞ্জমেন্টগুলো তো বদলে দিতে হবে।
নিশ্চয়ই। আর নেক্সট উইকে সব কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দাও। ইংরেজি-বাংলা। দুই ল্যাঙ্গুয়েজেই ভালো করে দুটো রাইট-আপ তৈরি করে ফেলল।
আচ্ছা
আর আমাদের এইড-ইলেকসানে এখন সমরেশ বসছে তো? ওর জায়গায় পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারে অন্য কাউকে বসাতে হবে। কারণ অ্যাডভান্স যারা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই এসে হানা দেবে। তখন সমরেশকে দেখলে ছিঁড়ে ফেলবে। ওর বদলে কাকে বসাতে চাও?
বর্ধমানের দুটো ছেলে কিছুদিন ধরে চাকরির জন্যে আসছে। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। ভাবছি ওদের একজনকে অফিসার, আরেকজনকে বেয়ারা করে ওখানে বসাব।
ঠিক আছে।
কথা শেষ করেই সাইনবোর্ড এবং ইন্টেরিয়ার ডেকরেটরকে ফোন করে কালই চলে আসতে বলল লতিকা। প্রতিবারই অফিস তুলে দিয়ে নতুন অফিস বসবার আগে ভেতরের সাজসজ্জা, চেয়ার-টেবল, দেয়ালের রঙ সব বদলে দিই। এই কাজটা আমরা এক রাতের মধ্যেই সেরে ফেলি। পরের দিন পুরনো কনসার্নের খদ্দেররা এসে নতুন অফিস নতুন লোকজন দেখে একেবারে হাঁ হয়ে যায়। তারা বুঝতেই পারে না পুরোনো ম্যানেজমেন্টই এই নতুন অফিস খুলেছে। লতিকার ফোন হয়ে গেলে আমি আবার সেই আগের কথায় ফিরে গেলাম। বললাম, এবার শমিতার ব্যাপারটা শোনো
লতিকা হেসে হেসে বলল, শমিতার ব্যাপারে তোমার আরো অনেক এক্সপিরিয়েন্স হবে। একটু একটু করে শুনে সাসপেন্সের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে না। এক্সপিরিয়েন্সটা কমপ্লিট হোক; একসঙ্গে পুরোটা শুনব। বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে।
জিগ্যেস করলাম, উঠলে যে?
আমাকে বাড়ি যেতে হবে। মায়ের শরীরটা খুব খারাপ।
কী হয়েছে? আমি যাব?
না-না, তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। তোমার যাবার দরকার নেই।
লতিকা চলে গেল। সত্যিই কি ওর মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে? কেনই বা শমিতার কথা ও শুনতে চাইল না? মায়ের অসুস্থতার নাম করে আমাকে কি এখন এড়াতে চাইল? সব কিছু কেমন যেন অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে মনে হতে লাগল আমার।
ছটা পর্যন্ত চুপচাপ অফিসে বসে রইলাম। বাইরে যখন অন্ধকার নামল, রাস্তায় কর্পোরেশনের মার্কারি ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠল সেই সময় আমার মনে পড়ে গেল সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে শমিতার সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। হিপনোটিজমের বাংলা যেন কী-ও হ্যাঁ, সম্মোহন–মেয়েটা সম্মোহনের মতো দুরন্ত আকর্ষণে আমাকে তার দিকে টানতে লাগল।
.
১৩.
হে মহান জনগণ, দেখতে দেখতে আরো সাত-আট দিন কেটে গেল। এর মধ্যে কর্পোরেশনের জায়গায় পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। রাতারাতি ইন্টেরিয়র ডেকরেসন আর দেয়ালের রঙ বদলে ঝকঝকে এবং দারুণ মডার্ন একটা জ্যোতিষ গণনার অফিস বসিয়ে দিয়েছে লতিকা। সমরেশের বদলে যে ছেলেটি ওখানে এখন বসছে তার নাম বিমল। আর বেয়ারার কাজ দেওয়া হয়েছে অজয়কে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ছেলেকেও আমাদের এই ডিপার্টমেন্টে নিয়েছি।