লতিকার বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ; আমার চাইতে দু-তিন বছরের ছোট। তবে তিরিশের বেশি তাকে দেখায় না। দুর্দান্ত সুন্দরী নয় সে। মাঝারি চোখ, গায়ের রঙটা অবশ্য পাকা গমের মতো, নাকে-মুখে তেমন ধার নেই। তবে স্বাস্থ্য খুব ভালো; কোমল মসৃণ মাংসে তার কণ্ঠার হাড় ঢাকা। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা বাদামি চুল, পাতলা রক্তাক্ত ঠোঁট। থুতনির তলায় মুসুর ডালের মতো লালচে একটা তিলও রয়েছে। এই তিলটা লতিকার চেহারায় এক ধরনের তীব্র আকর্ষণ এনে দিয়েছে। মোট কথা, সব মিলিয়ে সে দারুণ স্মার্ট আর ঝকঝকে মেয়ে। লতিকারা বাঙালি ক্রিশ্চান।
বললাম, মার পাগলামিটা আবার বেড়েছে। সকালে হসপিটাল থেকে খবর পাঠিয়েছিল। তাই দেখে এলাম।
সিরিয়াস কিছু?
সিরিয়াস তো নিশ্চয়ই।
লতিকার মুখে উৎকণ্ঠার ছায়াটা গাঢ় হল। সে জিগ্যেস করল, ডাক্তাররা কী করতে বলছে?
আমাদের এইসব কেসে কিছুই করণীয় নেই। যা করবার হসপিটালই করবে। এনি ওয়ে, ডোন্ট ওরি। যা হবার তা হবেই; ভেবে কিছু লাভ নেই। বলে আমি হাসলাম। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আমি এমন একটি ক্যারেক্টার যে, যে-কোনও অবস্থায় হাসতে পারে। কাপড়-টাপড়ে যেমন মিলের ছাপ মারা থাকে তেমনি আমার মুখে সব সময় একটি পেটেন্ট হাসির স্ট্যাম্প মারা আছে। এই হাসিটা আমার ট্রেডমার্ক।
লতিকা মায়ের বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না। আমি এবার জিগ্যেস করলাম, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের কোনও খবর আছে?
লতিকা মাথা নাড়ল, না।
বলো কী! হোল কান্ট্রি জুড়ে ইলেকসানের সিজন আসছে; তবু কোনও ব্রাদার-ইন-ল মুখ দেখাচ্ছে না–স্ট্রেঞ্জ! এক কাজ করো-কাল ডেলি কাগজগুলোতে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দেবে। ভালো করে রাইট-আপ লিখে দিও–
আচ্ছা।
ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টও কেউ আসেনি?
না।
হোয়াট অ্যাবাউট পার্সোনাল?
একই অবস্থা।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, কোনও কারণেই আমার মুখ থেকে হাসি মুছে যায় না; দুশ্চিন্তা-টুশ্চিন্তা আমার হাজার কিলোমিটারের মধ্যেও নেই। হেসে হেসেই লতিকাকে বললাম, এ সব বিজনেসে যে রকম রিসেশন চলছে তাতে রেড লাইট জ্বেলে দিতে হবে দেখছি। বাবা গণেশকে উল্টে আবার নতুন বিজনেস ফঁদতে হবে।
আর কিছুদিন দেখো না-বলতে বলতেই হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল লতিকার। খানিকটা ব্যস্তভাবেই সে বলে উঠল, আরে একটা কথা বলতেই তোমাকে ভুলে গেছি।
কী?
একটি মহিলা পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে তিনবার ফোন করেছিলেন। মহিলা!
রিভলভিং চেয়ারটা লতিকার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম, কত বয়েস?
গলা শুনে বয়স বোঝা যায় নাকি? লতিকার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল। যায় না বুঝি?
হয়তো যায়; তবে আমি খেয়াল করিনি।
না করারই কথা। মেয়েদের গলা সম্বন্ধে তোমার আর কী ইন্টারেস্ট!
দ্যাটস ট্রু; ইন্টারেস্টটা তোমারই হওয়ার কথা। এবার থেকে মেয়েরা ফোন করলে বয়েস জিগ্যেস করে রাখব।
দারুণ বলেছ। ব্যাপারটা কী জানো, কম বয়সের মেয়েরা ফোন করলে আনন্দ হয়। আমি হেসে ফেললাম, যাক গে, এখন বলো মহিলাটি কী চান?
লতিকা বলল, উনি বলছিলেন ওঁর একটা ব্যক্তিগত কাজে আমাদের দেবেন; কাজটা যেমন পার্সোনাল তেমনি কনফিডেন্সিয়াল। এতে খুব স্ট্রিক্টলি গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
বেশ। কাজটা কী?
সেটা উনি টেলিফোনে বলতে চান না।
ওঁকে আমাদের অফিসে আসতে বললে না কেন?
বলেছিলাম। কিন্তু উনি এখানে আসতে চান না। উনি চাইছেন আমরাই ওঁর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলি। আমদের সঙ্গে আলোচনা করে মহিলা যদি কনভিন্সড হন, কাজটা আমরা পাব।
আচ্ছা
লতিকা বলতে লাগল, আমি ওঁকে কোনও কথা দিইনি। যতবার ফোন করেছেন ততবারই ওঁকে বলেছি পরে ফোন করতে। তারপর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।
তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তোমার কী মনে হয়, ডেকে নিয়ে গিয়ে কাঁদে ফেলবে?
বুঝতে পারছি না। লতিকাকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাল।
দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আবার যদি মহিলা ফোন করেন দেখা যাবে।
আমার কথা শেষ হবার আগেই ঘুঘুর ডাকের মতো শব্দ করে টেলিফোন বেজে উঠল। নিশ্চয়ই সেই মহিলার ফোন হবে।
হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জনগণ, পৃথিবীর কোনও ব্যাপারেই আমার কৌতূহল নেই। যা ঘটবার–ঘটবেই, যা হবার হবেই। আগে থেকে ব্যস্ত হয়ে বা হুড়োহুড়ি করে ব্লাড প্রেসারকে একটা বিপজ্জনক সীমানায় টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। লাইফকে আমি মোটামুটি এভাবেই নিয়েছি। ফলে আমার রক্তচাপ সব সময় নর্মাল। এদিক থেকে আপনারা আমাকে একজন নিরাসক্ত দার্শনিক ভাবতে পারেন। দার্শনিক! ফিলজফার। কথাটা শুনে নিশ্চয়ই আপনারা শার্টের হাতার নীচে নাক ঢেকে হাসছেন। হাসুন, আর যা-ই করুন আমি একজন ফিলজফারই।
কোনও ব্যাপারেই আগে থেকে আমি মাথা ঘামাই না। তবু ওই মহিলার টেলিফোনটা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আগ্রহ বোধ করলাম। ফোনটা তুলতে গিয়ে কী মনে হতে তাড়াতাড়ি ঘাড় ফেরাতে গিয়ে লতিকার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। লতিকা চোখ সামান্য কুঁচকে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছে আর গালের ভেতর জিভটা খুব আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসছে।
আমিও চোখ টিপে হাসলাম। তারপর ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই সমরেশের মোটা খ্যাসখেসে গলা শোনা গেল, রাজীবদা, আপনাকে একটু আসতে হবে। ইন্টারনাল কানেকনে সামনের অফিস তিনটের সঙ্গে আমাদের চেম্বারের টেলিফোনে যোগাযোগ রয়েছে। কোনও ব্যাপারে আটকে গেলে বা জরুরি পরামর্শের দরকার হলে ওখানে যারা থাকে আমার সঙ্গে কথা বলে নেয়। আমি না থাকলে লতিকার সঙ্গে কথা বলে। এই মুহূর্তে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন থেকে সমরেশ আমার লাইনটা ধরেছে।