এই বিশাল একুশতলা বাড়ির সবগুলো ফ্লোর জুড়েই নানারকম সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, ফরেন এয়ার লাইন্স আর ট্রাভেল এজেন্সির সাজানো কাউন্টার।
পিপল অর্থাৎ জনগণের কেউ কি আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন? এসে থাকলে বাঁদিকের পর পর তিনটে ঘর লক্ষ্য করুন।
আপাতত তিনটে ঘরের মাথায় তিনখানা ঝকমকে সাইনবোর্ড রয়েছে। প্রথম ঘরটার সাইনবোর্ডে লেখা আছে : এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন। দ্বিতীয় ঘরের সাইনবোর্ডটা এই রকম : ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ণ। তৃতীয়টি লেখা আছে? পার্সোনাল।
আপাতদৃষ্টিতে এ তিনটে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আসলে তা নয়। কেন নয় সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।
যাই হোক প্রতিটি সাইনবোর্ড থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্ম কী হতে পারে তার মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। তবু মাঝে মাঝে খবরের কাগজে এদের যে বিজ্ঞাপন বেলোয় তাতে বিশদভাবে অনেক কিছু লেখা থাকে। যেমন ধরুন, এইড ইলেকসান কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন থাকে; সিওর সাকসেস। সাকসেস গ্যারান্টেড নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে আমাদের সাহায্য নিন। ভাবী এম-এল-এ, এমপি, কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের সুবর্ণ সুযোগ। ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্নের বিজ্ঞাপনে থাকে যে কোনও অনুসন্ধানের কাজে আমরা সহায়তা করে থাকি। যোগাযোগ করুন। পার্সোনালের বিজ্ঞাপনে থাকে ও ব্যক্তিগত যে কোনও বিষয়ে আপনাদের সেবার জন্য সর্বদাই আমরা প্রস্তুত। প্রয়োজনে সবরকম গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে।
হে জনগণ, আপনাদের আগে-ভাগেই জানিয়ে রাখছি ওই সাইনবোর্ডগুলো কিন্তু চিরকাল এক রকম থাকে না। দু-মাস, চার মাস, এমনকী কোনও কোনও সময় পনেরো দিন বাদেও ওগুলো বদলে যায়। যেমন ধরুন, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন হয়ে যায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ব্যুরো, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন হয়ে যায় এইড ক্লাব ফর ফ্লাড-অ্যাফেক্টেড পিপল ইত্যাদি ইত্যাদি। চারদিরে হাওয়া-টাওয়া বুঝে সাইনবোর্ড পাল্টে দেওয়া হয়; এই আর কি। কিন্তু এসব কথা পরে।
প্রথম ঘরটা অর্থাৎ এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের গা ঘেঁষে সরু একটা প্যাসেজ ভেতর দিকে চলে গেছে। সেখানে আছে মাঝারি মাপের একটা চেম্বার। আমি রাজীব সরকার প্যাসেজটা দিয়ে সোজা সেই চেম্বার চলে এলাম।
চেম্বারটা সমান দু-অংশে ভাগ করা। মাঝখানে কাচের পার্টিসান ওয়াল। ওয়ালের এধারে এবং ওধারে দুটো দিকই চমৎকার করে সাজানো। লাল কার্পেটে মোড়া মেঝে, গ্লাস-টপ সেক্রেটারিয়েট টেবল, ফোম-বসানো রিভলভিং চেয়ার, ঝকঝকে রঙিন টেলিফোন, ফাইল-টাইল রাখার জন্যে প্লাইউডের কাজ করা র্যাক, ছোট অথচ সুদৃশ্য বুক কেস। চেম্বারের পিছন দিকে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা এয়ার কুলারও রয়েছে; সেটা গোটা কামরার শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
কাচের দেয়ালের একদিকে বসি আমি; অন্যদিকটা আমার বিজনেস পার্টনার মেরী লতিকা বিশ্বাসের।
চেম্বারে আমার দিকটায় ঢুকতে ঢুকতে চোখে পড়ল লতিকা পার্টিসান ওয়ালের ওপাশে বসে আছে। আমাকে দেখে সে একটু হাসল; আমিও হাসলাম। তারপর হাতের ব্রিফকেসটা টেবলে রেখে কুপ করে শরীরটা রিভলভিং চেয়ারে ছেড়ে দিলাম।
আমাদের এই চেম্বারের সামনের দিকে সমান্তরাল রেখার মতো আরেকটা সরু প্যাসেজ রয়েছে। তারপর সেই তিনটে অফিস অর্থাৎ এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন আর পার্সোনাল। ওই অফিসগুলোর পিছন দিকের দেয়ালের খানিকটা করে অংশ কাচের। লতিকা আর আমি আমাদের ঘরে বসে ওই তিনটে আফিসের ওপরই নজর রাখতে পারি।
ওই অফিসগুলোও চমৎকার করে সাজানো। আমাদের এই চেম্বারের মতোই কার্পেট, টেলিফোন, রিভলভিং চেয়ার, এয়ার কুলার সবই সেখানে রয়েছে। তবে বসবার ব্যবস্থা এমনভাবে করা আছে যাতে ওই অফিস তিনটের কোনওটা থেকেই আমাদের চেম্বার দেখা যায় না। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, রামায়ণে কে যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে তীর ছুড়ত-কী যেন ক্যারেক্টারটার নাম-ও, হ্যাঁ মেঘনাদ, আমরাও ঠিক তেমনি সবার চোখে ধুলো দিয়ে এই চেম্বারে বসে থাকি। আমরা সবাইকে দেখি কিন্তু আমাদের কেউ দেখতে পায় না।
এই মুহূর্তে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের অফিসে বসে আছে সমরেশ, পার্সোনালে আছে রীতেশ আর ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসানে মীনাক্ষী। ওদের বয়স পঁচিশ থেকে আটাশের মধ্যে। রীতেশ ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির কমার্স গ্র্যাজুয়েট, মীনাক্ষী যাদবপুর থেকে কম্পারেটিভ লিটারেচারে সেকেন্ড ক্লাস এম-এ, আর সমরেশ শিবপুরের বি-ই। পাশ-টাশ করে চাকরি-বাকরির জন্যে ছসাত বছর ওরা গোটা কলকাতা চষে ফেলেছে। কোথাও কিছু জোটাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে ঠেকেছে।
এয়ার কুলারটা পুরোদমে চালানোই ছিল। এক মিনিটের মধ্যে আমার ঘাম শুকিয়ে গায়ের চামড়া জুড়িয়ে গেল।
লতিকা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, আজ এত দেরি হল?
যাতে পরস্পরের কথা শুনতে অসুবিধা না হয় সেজন্য কাচের দেয়ালের এক জায়গায় একটা গোল ফুটো রয়েছে। সেই ফোকর দিয়ে বললাম, মেন্টাল হসপিটালে গিয়েছিলাম
লতিকা চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিল। বলল, কী ব্যাপার? তাকে বেশ চিন্তিও আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।