মনে আছে থিয়েটার রোডে আমার বিজনেস স্টার্ট করার তিন-চার বছর পর একদিন সন্ধেবেলা এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে লেকের দক্ষিণের নতুন স্যাটেলিট টাউনশিপ লেক গার্ডেনসে গিয়েছিলাম। কথাবার্তা সেরে অনেক রাত্রে রেললাইন পেরিয়ে লেকের দিকে আসতে আসতে হঠাৎ চোখে পড়েছিল অনেক দুরে-সেই গড়িয়াহাটা ওভারব্রিজের তলা থেকে বজবজ লাইনের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দুর্দান্ত স্পিডে ছুটে আসছে। গাড়িটার সামনের দিকে যে হেডলাইট জুলছিল তার আলোয় দেখতে পেয়েছিলাম, একটি মেয়ে রেললাইন ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো ট্রেনটার দিকে ছুটছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটার উদ্দেশ্য কী। সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে আগুনের হলকা বইতে শুরু করেছিল। কী করব, ভাবতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন পেরেক ঠুকে আমার পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে।
ওদিকে ট্রেনটা ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে; মেয়েটাও উল্টোদিক থেকে ছুটে যাচ্ছে। দু-চার মিনিটের মধ্যে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যাবে।
আচমকা আমার শরীরে কোত্থেকে যেন দশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনের মতো শক্তি নেমে এসেছিল। মাটি থেকে পা দুটো টেনে তুলে শ্বাসরুদ্ধের মতো সামনের দিকে ছুটেছিলাম। তারপর ট্রেনটা যখন মাত্র পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে সেই সময় মেয়েটাকে পিছন দিক থেকে জাপ্টে ধরে টানতে টানতে রেললাইনের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা আমাদে গা ঘেঁষে ক্ষ্যাপা জানোনায়ারের মতো গাঁক গাঁক করে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ট্রেনটা চলে যাবার পর মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চাবুকের মতো তীব্র গলায় সে বলেছিল, কেন, কেন আপনি আমাকে বাঁচালেন?
আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই মেয়েটার মুখ চোখে পড়ে গিয়েছিল। কেননা রেললাইনের ধারে ধারে যে রিফিউজি কলোনি গজিয়ে উঠেছে সেখান থেকে আলো এসে পড়েছিল তার ওপর। যাই হোক দেখা মাত্র চমকে উঠেছিলাম। বলেছিলাম, এ কী লতিকা-তুমি!
লতিকাও ততক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছে। সেও খানিকটা অবাক। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুহাতে মুখ ঢেকেছিল লতিকা। এবার খুব ক্লান্ত স্বরে বলেছিল, আমাকে না বাঁচালেই পারতে।
একটু মজা করে বলেছিলাম, তোমার শরীরটা হল ন্যাশনাল প্রপার্টি; এটাকে ধ্বংস করার কোনও রাইট নেই তোমার। একজন অনেস্ট নাগরিক হিসেবে তোমাকে বাঁচাতে আমি বাধ্য হয়েছি।
লতিকা কী বলতে যাচ্ছিল; তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, এখানে দাঁড়িয়ে কোনও কথা নয়। চলো, কোথাও গিয়ে একটু বসি।
তাকে নিয়ে রেললাইন পেরিয়ে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে চলে এসেছিলাম। তারপর বিশাল রাস্তার মাঝখানে যে সারি সারি সবুজ ঘাসের আইল্যান্ড রয়েছে তার একটাতে দুজনে পাশাপাশি বসেছিলাম। লতিকার বসবার ভঙ্গিটা অত্যন্ত ক্লান্ত, ভেঙেপড়া। রেললাইন ধরে ট্রেনের দিকে ছুটবার সময় তার মধ্যে যে ক্ষ্যাপা উদ্ভ্রান্ত মরিয়া ভাবটা কাজ করছিল, তখন আর তা নেই। হাত-পায়ের জোড় তখন আলগা হয়ে গিয়েছিল; দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে ভাঙাচোরা কোনও মূর্তির মতো সে বসে ছিল।
অত রাতে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে তেমন লোকজন ছিল না। যা দু-চারজন ছিল, চোখ কুঁচকে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছিল। কেউ কেউ যাবার সময় দু-একটা রগরগে টিপ্পনিও ছুঁড়ে দিচ্ছিল। ওদের আর দোষ কী, মাঝরাতে লেকের কাছে এক জোড়া যুবক-যুবতাঁকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখলে গলা খুসখুস তো করবেই, গ্ল্যান্ডগুলোও অশ্লীল হয়ে উঠবে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বলেছিলাম, এবার বলো, আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে কেন?
লতিকা নিজবি গলায় বলেছিল, আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তুমি তো দারুণ ঝকঝকে মেয়ে ছিলে। হঠাৎ এত পেসিমিস্ট হয়ে উঠলে কেন?
তুমি আমার ফ্যামিলির কথা কিছুই জানে না রাজীব। জানলে বুঝতে কেন পেসিমিস্ট হয়েছি, কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।
আমি শব্দ করে বেশ জোরেই হেসে উঠেছিলাম।
চমকে হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলছেল লতিকা, কী হল, হাসছ যে!
বলেছিলাম, তোমার ফ্যামিলির কথা না জেনেও বুঝতে পারছি তোমার দুঃখ। কিন্তু আমার ফ্যামিলির কথা যদি জানতে তাহলে বলতে, আমার একবার না, বারদশেক আত্মহত্যা করা উচিত। কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারটা ভাবতেই পারি না। তোকা হেসে হেসেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। একটু থেমে আবার বলেছিলাম, আচ্ছা বলো, তোমার ফ্যামিলির কথা শুনি–
লতিকা যা বলেছিল, সংক্ষেপে এই রকম–টালিগঞ্জের এক ভাড়া বাড়ির একতলার দুটো ঘর নিয়ে ওরা থাকত (এখনও থাকে)। মা-বাবা আর চার ভাইবোন নিয়ে ওদের মাঝারি মাপের সংসার। বাবা যোশেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস একসময় ভালোই চাকরি-বাকরি করত। কিন্তু লোকটার ক্যারেক্টার বলতে কোনও ব্যাপারই নেই। জুয়াড়ি, মাতাল এবং প্রথম শ্রেণির ফেরেব্বাজ সে। ওয়ার্ল্ডে যত রকম জুয়ো আছে–রেস, রামি, সাট্টা, মাটিকা–কোনও কিছুতেই তার অরুচি নেই। এছাড়া মেয়েমানুষের দোষও ছিল। এত বিভিন্ন দিকে নিজের প্রতিভাকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ঠিক সময় অফিসে হাজিরা দিতে পারত না লোকটা, ফলে তার চাকরি যায়। একটা চাকরি যাবার পর অবশ্য আবার নতুন চাকরি সে জুটিয়ে নেয়। কিন্তু দু-চার মাসের মধ্যে সেটাও থাকে না। এইভাবে যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস প্রায় ডজন দেড়েক অফিসের অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে অটোগ্রাফ রেখে গেছে। দশ-পনেরো দিন কামাই করার পরও অফিস থেকে সে যা মাইনে পেত সেটা আর বাড়িতে আসত না। রেসের মাঠে, মদের দোকানে কিংবা জুয়োর আড্ডায় সেটা জমা দিয়ে আসতে হত। যাই হোক, এই করে করে, অর্থাৎ অফিসে না গিয়ে গিয়ে শেষ চাকরিটাও সে খুইয়েছিল।